অকেজো মানুষের অকেজো গল্প

আর লিখেই বা কী হবে? তবু কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। যাদের কথা শোনার কেউ নেই, তাদেরও তো অনেক কিছু বলার থাকে! জীবনের কাছে আমি বারবারই হেরে গেছি। অনেক কষ্ট করে একদিন মানুষের সভায় নিজের জায়গাটা করে নিয়েছিলাম। হায়, ভাগ্যের কাছে হার মেনে সে জায়গাটা হারালাম—এটাই হয়ত আমার নিয়তি! জীবনে যাদের অনেক বেশি বিশ্বাস করেছি, তারাই আমার অনেক বড় ক্ষতি করে চলে গেছে। তাদের কোনও ক্ষতি আমি কখনো চাইনি, এখনও চাই না। সবসময়ই ভেবেছি, কোনও কাজের শেষ না দেখে সেটা কিছুতেই ছাড়ব না। এমন মনোবল আমার ছিল। তবু আর পারলাম না।

জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, যখন আমার বেঁচেথাকার অর্থটাই শেষ হয়ে গিয়েছিল! সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। তিন বছর পর আবারও মানুষের খেলার শিকার হলাম আমি। বন্ধু ভেবে যাকে জীবনের সব কথা বললাম, সে-ই আমাকে সবার কাছে একজন নিম্ন পর্যায়ের মানুষ হিসেবে প্রচার করলো। সেবারের এই ধাক্কাটা আর সামলে উঠতে পারলাম না। থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট খুবই খারাপ হল। কোনওমতে পাস করে গেলাম—২.৭৪। বাবা-মা’র আশাগুলো যেন একএক করে শেষ করে দিচ্ছিলাম। প্রায়ই আমাকে শুনতে হয়েছে সেইসব কথা, যার জন্য আমি দায়ী ছিলাম না। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে-করতে আজ আমি হেরে গেছি। খুব ইচ্ছে ছিল, ভাল একটা চাকরি করে বাবা-মা’কে দেখবো। কেবল ছেলেই না, একটা মেয়েও তার বাবা-মা’র দায়িত্ব নিতে পারে। এই কথাটি আমি সবাইকে বলতাম, বোঝাতাম। আমি বোধহয় আর পারলাম না, বাবা-মা’র মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না………উল্টো আজীবনের জন্য ওদের বোঝা হয়ে গেলাম! ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ’র এমবিএ’তে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আবার কেউকেউ বলছিল বিসিএস পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে। আমার রেজাল্ট যা, তা দিয়ে এ দুটোর চাইতে ভাল কিছু করার বুদ্ধিও মাথায় ছিল না। ভেবে পাচ্ছিলাম না, কীভাবে কী করব! ব্যাংকে পরীক্ষা দিতে হলে ফার্স্টক্লাস থাকা লাগবে। আমি কী করব!……আমি আর কিছুই পারব না। স্রেফ বেঁচেথাকার চাইতে বড় কোনও সাফল্যের স্বপ্ন এখন আর দেখি না।

আমার জীবনটা থেমে গেছে। আমার সামনে কেবলই অন্ধকার। কত মানুষের জীবনে তবুও ভোর হয়, আর আমার জীবনপথে কেবলই সন্ধে নামে। উঠে দাঁড়ানোর কোনও শক্তিই পাচ্ছি না। এখন আর আমার মনে কোনও জোর নেই! এক বিশাল সমুদ্রযাত্রায় আমি তরীবিহীন হয়ে পড়ে রইলাম। আমায় নিতে কোনও নৌকো তীরে ভিড়বে না, আমি এমনি করেই তীরে একাকি, নিঃস্ব, অথর্ব, অবাঞ্ছিত, অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকব। অন্য সবার জীবন মানে ভালভাবে বাঁচার স্বপ্নদেখা, আর আমার জীবন মানে কেবলই দুঃসহ অস্তিত্বকে বয়ে বেড়ানো।

ছোটো থাকতে মোটামুটি ভাল স্টুডেন্টই ছিলাম। তাই আমাকে নিয়ে বাবা-মা’র আশাটাও অনেক বেশি ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলাম। সেখানেও একটি অপূর্ণতা রয়ে গেল। অনেক আশা করেছিলাম যে গোল্ডেন এপ্লাস পাব। আসেনি। অনেক কষ্ট করেছিলাম, তবু কাজ হল না। আমার সাথে আমার সব ফ্রেন্ড গোল্ডেন পেয়েছিল। তারপরও মেনে নিয়েছিলাম। সামনে ভাল কিছু হবে, এই আশাটা মনের মধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণে কাজ করছিল। যে কলেজে পড়ার স্বপ্ন ছিল, তা অধরাই রয়ে গেল। তবু অন্য এক কলেজে ভর্তি হলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে।

নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম……..

স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়ার সময় একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। জীবনে প্রথম কোনও ছেলের সাথে সামনাসামনি কথা বললাম। ও খুবই আন্তরিক ছিল, কথাবার্তায় ভদ্র ছিল। ফেসবুকে ভাল কবিতা লিখত, কলেজের প্রোগ্রামে দারুণ আবৃত্তি করতো। আমাদের বন্ধুত্ব খুব সুন্দরভাবে চলছিল। বন্ধু হিসেবে তাকে বিশ্বাস করলাম। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার চরম মূল্যটা তখনই দিতে হল। সে ছেলে আমার পুরো পৃথিবীটাকে একমুহূর্তেই এলোমেলো করে দিল। একটা মেয়ের ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন কীভাবে একটা মানুষ পায়ে মাড়িয়ে এইভাবে শেষ করে দিতে পারে!

আমরা এক ভাইয়ার কাছে ফিজিক্স আর ম্যাথস্‌ প্রাইভেট পড়তাম। উনি আমাদের শহরে সবচাইতে ভাল পড়াতেন। আমার সে বন্ধু উনার কাজিন ছিল। উনার কোচিং-এর টুকটাকও কাজও সে করে দিত। আমার বন্ধুটি ম্যাথসে একটু দুর্বল ছিল। আমি ম্যাথস্‌ খুব ভাল পারতাম। একদিন পরীক্ষার আগে ও আমাকে একটু ম্যাথস্‌ দেখিয়ে দিতে বলল। যার কাছে প্রাইভেট পড়তাম, উনিও বললেন, আমি যেন ওকে ইন্ট্রিগেশনটা একটু বুঝিয়ে দিই। গ্রুপস্টাডিতে আমার নিজেরও লাভ হবে। আমি ভাবলাম, ভালই হবে, আমারও প্র্যাকটিস হয়ে যাবে। গেলাম। ওই সময় ভাইয়ার ব্যাচ পড়ানোর কথা, কিন্তু গিয়ে দেখি, কোচিং-এ ভাইয়া আর আমার বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই। কেমন জানি, ভয়ভয় করতে লাগল। তবু কিছু না বলে বন্ধুর সাথে অংক করতে বসে গেলাম। ভাইয়া পাশের রুমেই ছিলেন। আধাঘণ্টা পর উনি আমাদের তিনজনের জন্য কোক নিয়ে এলেন। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমার সব শেষ। ওরা আমাকে ধর্ষণ করেছিল। ওই ভাইয়া আমার গলার নিচে একটা ধারালো ছুরি ধরে বললেন, সবকিছুই মোবাইলে ভিডিও করা আছে। কাউকে কিছু বললেই সব ফাঁস করে দেবেন। এরপর ওরা দুজন মিলে আমাকে আরেক দফায় ধর্ষণ করে। আমার শরীরে একফোঁটাও শক্তি ছিল না। ক্লান্তিতে আর অবসাদে আমি ওদের কোনও বাধাই দিতে পারিনি। ভিডিও ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে কখনওই কাউকে কিছু বলিনি। ওই ঘটনার পর ওই কোচিং-এ আর কখনও যাইনি। তবে আমার বন্ধুর সাথে কলেজে গেলেই দেখা হত। ও খুবই স্বাভাবিক আচরণ করতো, যেন কিছুই হয়নি!

আজ বুঝি, এ পৃথিবীতে ভালথাকার সবচাইতে ভাল বুদ্ধি হল, কাউকেই বিশ্বাস না করা। বিশ্বাস করলেই ঠকতে হবে, কষ্ট পেতে হবে। ভারমুক্ত থাকতে চাইলে কারও কিবা প্রশংসা কিবা নিন্দা, এমনকি মন্তব্যও, কোনওটাতেই নিজেকে প্রভাবিত হতে দেয়া যাবে না। তখন তো এতকিছু মাথায় ছিল না। সে ঘটনার পর বুঝতে পারছিলাম না, কী করব, কোথায় যাব! আমার সাথে এ কী হল! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! ধীরেধীরে অনুভব করলাম, ক্রমেই আমি কী যেন হারিয়ে ফেলছি! আমি যা হারাচ্ছিলাম, তা হচ্ছে মানুষের প্রতি বিশ্বাস।

সেই সময়টা ছিল আমার জীবনের প্রথমভাগের সবচেয়ে দুর্বিষহ সময়। আজও জানি না কীভাবে সেই সময়টা আমি পার করেছি।

আজ ভাবলে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়, কারণ সেই সময়টাতে আমার পাশে যদি বাবা-মা না থাকতো, তাহলে আমি জীবনে আর এগোতেই পারতাম না। সেই সময়ের দিনগুলো আমি আজও ভুলতে পারি না। তখন আমি জীবনে প্রথম আমার বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমার জন্য। সেইদিন আমার বাবা বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদেছিল। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে এমন কেউ ছিল না যে ব্যাপারটা জানত না। তবে কার বা কাদের জন্য আমার ওই অবস্থা, তা কেউ কখনও জানতে পারেনি। সেই মুহূর্তটা আমার কাছে কেমন ছিল, তা আমি বলে বুঝাতে পারব না।

এইচএসসি’র রেজাল্ট অতো ভাল হল না। ভাগ্য আমার সাথে এক নিষ্ঠুর খেলা খেলে যাচ্ছিল।

সামনে আমার ভর্তি পরীক্ষা। আর তখন আমার দিনগুলি কাটছিল নানান মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে। প্রায়ই ট্রমার মধ্যে কাটতো, ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়তাম। ঠিক ওইসময় আমার নানি মারা গেলেন। আমার মা তার মৃত মাকে দেখতে যেতে পারলো না। তার কাছে যে তখন সবকিছুর উপরে ছিল তার মেয়ের জীবন! ভাবতে অবাক লাগে, ভালোবাসার পালাবদলে মেয়েরা তাদের প্রায়োরিটি কেমন করে যে বদলে ফেলে! প্রকৃতি মেয়েদের মধ্যে এমন অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব তৈরি করে দেয়। মেয়েরা সব মেনে নিতে পারে। বাঁচতে হলে মেয়েদের বড় কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়! একটা ছেলে এতটা চাপ নিতে পারে কি না, আমার জানা নেই। আমার ধারণা ছিল, আমার মা পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে আমার নানিকে। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল, আমি এতদিন যা জেনেছি, তা ভুল।

আমার মা আমারই জন্য তার মাকে শেষদেখাটা দেখতে পারলো না!

তখন মনে হচ্ছিল, আমি কেন বেঁচে আছি? আমি তো এমন জীবন চাইনি! তাহলে আমার সাথে কেন এমন হল! আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি, তাহলে আমার সাথেই কেন এমন হল? কেন আর দশজনের থেকে আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে গেল! কখনও এসবের কোনও উত্তরই খুঁজে পাইনি। হয়ত ভুলটা আমারই ছিল—মানুষকে বিশ্বাস করাটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। প্রথমবার পরীক্ষাটা দিতে গেলাম অনেকটা দেয়ার জন্যই। ঢাবি’তে হলো না, জাবি আর জবি’তে চান্স পেলাম। কিন্তু স্বপ্নটা যে ছিল অন্যরকম!

চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় ২য় বারের জন্য অপেক্ষা শুরু করলাম। একেকটা দিন কাটছিল একেকটা বছরের মতো। পড়ার মত কোনও শক্তিই গায়ে ছিল না। জীবনটাকেই যে মেনে নিতে পারছিলাম না! ওই সময় কারো সাথে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই তাদের স্বপ্নের দিকে এগোচ্ছিল, আর আমার স্বপ্নটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তারপরও মনের মধ্যে কী জানি এক বিশ্বাস রেখে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম।

সেসময় জীবন আমায় কিছু ব্যাপার শিখিয়েছিল। কোনও কিছু করার জন্য যতটা দরকার অনুপ্রেরণার, তার চাইতে অনেক অনেক অনেক বেশি দরকার—ধৈর্য ধরে কাজটির পেছনে লেগেথাকা। প্রতিদিনই রুটিন করে কাজ করে যেতে হবে। কাজটি করতে ভাল লাগুক, আর না-ই লাগুক, কাজটি করে যেতে হবে, কাজটির পেছনেই সময় দিতে হবে। মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেকে কাজটার পেছনে নিয়োজিত করে রাখতে হবে। পড়াশোনা করাটা প্রয়োজন হলে আনন্দে হোক আর বিনা আনন্দেই হোক, পড়াশোনা করে যেতেই হবে। অংক করতে ভাল লাগে না বলে যদি আমি কখনওই খাতাকলম নিয়ে না বসি, তবে আমি জীবনেও অংক শিখতে পারব না। এটাই বাস্তবতা। যদি আমি অনুপ্রেরণার জন্য অপেক্ষা করে থাকি, তাহলে হয়ত আমি কখনওই আমার কাজটা করতে পারব না। অনুপ্রেরণার জন্য অপেক্ষা করে থাকে যারা, ওরা কেবলই অজুহাত দেখানোর রাস্তা বানায়। আর কে না বোঝে, লোকে কেবল অর্জনকেই স্যালুট করে আর অজুহাতকে স্রেফ করুণা করে! কোনও লেখক যদি অপেক্ষা করে বসে থাকেন, কখন উনি অনুপ্রাণিত হবেন আর লিখবেন, তাহলে হয়ত উনি সারাজীবনে একটি বইও লিখতে পারবেন না। কাজ করে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা বেশিরভাগ সময়ই খুবই একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার। তবু কাজ করে যেতেই হবে—ভাল লাগুক, আর না-ই লাগুক। কাজ করতে-করতেই অনুপ্রেরণা চলে আসে। অনুপ্রেরণা থেকে কাজ নয়, কাজ থেকে অনুপ্রেরণা—এ সহজ সূত্রটি একবার মাথায় গেঁথে গেলে আর পিছিয়ে পড়ে থাকার কথা নয়। আমার মনে আছে, আমি সেসময় ফেসবুক/ ভাইবার/ হোয়াটস্‌অ্যাপ/ ইমো কোথাও ভুলেও ঢুকতাম না, কোনও ফোন ধরতাম না। সবকিছুতেই আর সবাইকেই সময় দিলে সব স্বপ্ন আজীবন স্বপ্নই থেকে যাবে—এটা নিশ্চিত। আমি সবসময়ই মিলিয়ে নিতাম, আমি যা করছি, তার কি সত্যিই কোনও দরকার আছে—অন্তত এই সময়টাতে? যদি উত্তর পেতাম—না, তবে সেটি করা তৎক্ষণাৎই বন্ধ করে দিতাম। জীবনে কোন কারণে কিছু করতে পারলাম না, সেটা কোনও বিষয় না, করতে যে পারলাম না, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। এ পৃথিবী কখনওই অজুহাত শুনতে প্রস্তুত নয়।

নিজের উপর রাগ করে আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটাই ডিলিট করে দিয়েছিলাম। আমি ফেসবুকে ছোটছোট গল্প লিখতাম, ওই মুহূর্তে আমার ফলোয়ার ছিল ৩৭,৮৪১ জন—আমি ফেসবুকে কতটা অ্যাক্টিভ ছিলাম, এ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। ডিলিট করার সময় বারবারই মনে হচ্ছিল, আহা, জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে! এতএত ফ্যান-ফলোয়ার, পোস্ট, সব চলে গেল! এখন বুঝি, ওটাই ছিল আমার জীবনের শুরু! ওইসব ফেসবুক ফ্রেন্ড, ফলোয়ার খুবই অপ্রয়োজনীয় আর অতিমূল্যায়িত জিনিস। আগের অ্যাকাউন্ট তো আর নেই, নতুন অ্যাকাউন্টে এখন আমাকে লক্ষাধিক লোক ফলো করে। লোকে আসলে ব্যক্তিকে ফলো করে না, অর্জনকে ফলো করে। তখন প্রায় আটত্রিশ হাজার ফলোয়ারকে আমার গোটা জীবনের সমান মনে হত, আর এখন লক্ষাধিক ফলোয়ারকেও আমার একটা অলস দুপুরের নির্বিঘ্ন ঘুমের সমানও মনে হয় না। সেসময় আমি নিজেকে পুরোপুরিই নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিলাম। নিজেকে নিঃসঙ্গ করে না ফেললে কোনওভাবেই অন্যদের চাইতে বেশি কাজ করা সম্ভব নয়। আমাকে হয়ত অনেকেই রোবট ডেকেছে। কিন্তু আজ আমি বুঝি, আমি ঢাকা ভার্সিটিতে দ্বিতীয়বারেও চান্স না পেলে লোকে আমাকে তার চাইতেও আরও বেশি আজেবাজে কথা বলতে ছাড়ত না। আমি দেখেছি, কোনও কাজের সবচাইতে কঠিন ধাপটা হচ্ছে, শুরু করাটা। শুরু করে দিলে আর নিজেকে ফাঁকি না দিয়ে প্রতিদিনই করে গেলে, কাজটা শেষ হবেই হবে।

আমি সেসময় এক ধরনের দ্বৈত সত্তা নিয়ে বাঁচতাম। আমি অন্য যে কাজই করি না কেন, তার পুরোটাই আমার কাছে সময়ের অপচয় মনে হত। আমার মাথায় সারাক্ষণই ঘুরতে থাকত, কখন আমি পড়তে বসব! পড়তে যে খুব শখ করে বসতাম, তা কিন্তু নয়, আমি বুঝে গিয়েছিলাম, বাঁচতে চাইলে আমাকে পড়তে বসতেই হবে! কারণ, আমি জানতাম, আমি আমার স্বপ্ন ছুঁতে না পারলে আমার অন্য সব কাজই অর্থহীন হয়ে যাবে। হাজার বছর লুকিয়ে বাঁচার চাইতে হাজার মিনিট চুটিয়ে বাঁচা অনেক বেশি আনন্দের। তখন পড়তে ইচ্ছে না করলেও টেবিল ছেড়ে উঠে যেতাম না—অন্য যা পড়তে ভাল লাগে, তা-ই পড়তাম। গান শুনতে ইচ্ছে করলে একটু গান শুনে নিতাম। তবে তা ততক্ষণ পর্যন্তই, যতক্ষণ না আমার সাময়িক অনিচ্ছাটা কাটছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, আধাঘণ্টা ইন্সট্রুমেন্টাল শুনলে ক্লান্তি কেটে যাওয়ারই তো কথা! টেবিল ছেড়ে একবার উঠে গেলে নিজেকে আবারও টেবিলে টেনে আনাটা খুব কঠিন কাজ। যতক্ষণ জেগে আছি আর বাথরুমে না যাচ্ছি, ততক্ষণই টেবিলে থাকব—এই টার্গেটেই প্রতিদিন বাঁচতাম। প্রতিদিনই পড়ার টেবিল ছাড়তাম এক ধরনের অতৃপ্তি আর আত্মঅভিযোগ নিয়ে, যাতে করে পরেরদিন আরও বেশি করে নিজেকে খাটিয়ে নিতে পারি। প্রতিভা হয়ত সকলের থাকে না, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষমতা তো সবারই থাকে! আমি বিশ্বাস করি, যে কেউই ক্রমাগত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিভার ঘাটতিকে অতিক্রম করতে পারে। কাজ করে যাওয়াটাই জরুরি, বেঁচে থাকাটা নেহায়েত অপ্রয়োজনীয়। আমি ওই সময় কঠোর পরিশ্রম করতে পারতাম, এবং এর ফলে আমার ভেতর থেকে যতটা বের করে আনা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করতাম, তার চাইতে অনেক বেশি বের করে আনতে পেরেছি। সময়ের প্রয়োজনে হঠাৎ করেই আমার বিবেকবোধ খুবই তীব্র হয়ে উঠেছিল। ওই সময় আমি এতটাই বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি জানতাম, কেউ যদি আমাকে এটা সম্পর্কে নিশ্চিত করেও দিত—যতই পড়ি না কেন, আমি কোথাও চান্স পাব না………তবু আমি নিরলসভাবে চেষ্টা করে যেতাম। আমি নিজেকে বারবার বলতে থাকতাম—আমি যা করছি, তার শেষ দেখে তবেই ছাড়ব!

যা-ই হোক, অবশেষে ক-ইউনিটে ১২শ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলাম। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলাটি তখনো শেষ হয়নি। আমার সেই বন্ধুটি এবার শুরু করল আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা। ওর কথা, ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক রাখতে হবে, নইলে সব ফাঁস করে দেবে। আমার ভার্সিটির বন্ধুদের কাছে আজেবাজে কথা ছড়ানো শুরু করল। যখন দেখলো, কোনওভাবেই আমাকে দুর্বল করতে পারছে না, তখন কিছুটা থামল। আমি প্রতিনিয়ত এইসব কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনটা বছর পার করলাম এমন সব কষ্টের বোঝা নিয়ে।

হঠাৎ জীবনের কষ্টগুলো দূর হয়ে গিয়েছিল একজনের জন্য। আমার মনে হল, সবাই তো আর খারাপ হতে পারে না। কাউকেই বিশ্বাস না করে জীবন কাটানো কি আদৌ সম্ভব? যে কেবলই সুখের ভাগ নেয়, হয়ত তাকে বিশ্বাস করা চলে না, কিন্তু যে কষ্টেরও ভাগ নেয়, তাকে তো বিশ্বাস করা যায়ই! ওকে নিয়ে সিরিয়াসলিই ভাবছিলাম। তবে কোনও কমিটমেন্টে যাওয়ার আগে তাকে আমার সব কথা বলতে চাইলাম। আমি কাউকে ঠকাতে চাইনি। তাই সব তাকে বললাম। সে আমার সব সত্য জেনেও আমার পাশে থাকতে চাইল। তখন জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হতে লাগল। মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস ফিরে এলো। সে খুবই কেয়ারিং ছিল। আমাকে অনেক সময় দিত। আমি কখনও কোনও ব্যাপারে মনখারাপ করলে যেকোনওভাবেই হোক, আমার মনভাল করে দিত। আমি কী করছি, কেমন আছি, আমার কোনও কিছু লাগবে কি না, আমি কী পছন্দ করি, সব সে জানত, জানার চেষ্টা করতো। আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেললাম। আমার মনে যেন জীবনের রঙ আবারও ফিরে এলো!

খুন হয়ে যাওয়াই যদি নিয়তি হয়, তবে খুন হয়ে যাওয়ার রাস্তায় পা বাড়ানোর পক্ষে অনেক কারণ আর যুক্তি মানুষের অবচেতন মন দাঁড় করিয়ে ফেলে। ওই সুখটুকুই যে আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে, তা আমি বুঝতে পারিনি। কিছুদিন পর তার আসল রূপটা বুঝতে পারলাম। আমি যখন পুরো পৃথিবী বলতে ওকেই বুঝি, তখনই ও আমাকে মারাত্মকভাবে মানসিক নির্যাতন শুরু করল। কথায়-কথায় অপ্রয়োজনেই প্রচুর মিথ্যে বলতো, নিজের অবস্থানকে বড় করে দেখাত, বিভিন্ন মেয়েকে ফেসবুকে আর ফোনে ক্রমাগত বিরক্ত করে যেত, কোনও ভুল করলেও কখনওই বিন্দুমাত্রও অপরাধবোধে ভুগত না, আমার আবেগ নিয়ে প্রায়ই খেলত, একটুতেই রেগেমেগে মুখে যা আসতো তা-ই বলতো, আমি ওর ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার বাবা-মা’র নাম ধরে পর্যন্ত গালাগালি করতো, ওর ধারণা ছিল ওর ফ্যামিলির সবকিছুই ভাল আর আমার ফ্যামিলির সবকিছুই খারাপ, আমি কোনও ব্যাপারে ভুল করলে যতই সরি বলি না কেন, ওটা নিয়েই আমাকে ননস্টপ কথা শোনাতেই থাকত………এরকম আরও অনেক অনেককিছু। আমি বুঝি না একজন মানুষ কাউকে কীকরে এত অপমান করতে পারে! একময় সে আমাকে সবার চোখে রাস্তার মেয়ে বানিয়ে দিল। সবার কাছে আমার পুরনো কষ্টের কাহিনি অতিরঞ্জিত করে ছড়াতে লাগল। আমি সত্যিই জানি না কেন সে এমন করতে শুরু করেছিল! আমি তো তাকে আমার জীবনে আসতে বলিনি………সে-ই অনেকটা জোর করে, কিছুটা পলিটিকাল প্রভাব খাটিয়ে আমার জীবনে এসেছে। প্রথমদিকে ওকে খুব বেশিই এড়িয়ে চলতাম। তখন ও আমাকে ‘দেখে নেবে’ বলে চ্যালেঞ্জ করেছিল। পরবর্তীতে ওর ব্যবহার, আচরণ আর আমার প্রতি টান দেখে আমি সব কিছু ভুলে ওকেই আমার জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছিলাম। আমি তো তার কাছে আমার অতীতের কিছুই গোপন করিনি, তবে কেন………?

তখন আমার সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিটি দিন তার অপমান হজম করতে হত। ও সবার সামনে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। আমি নিরুপায় ছিলাম। ওর কথা আমি বাসায় জানিয়েছিলাম। বাসা থেকেও ওকে পছন্দ করেছিল। ও রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও পড়াশোনায় অনেক ভাল ছিল। তাছাড়া মানুষ হিসেবে ওর খুব ভাল রূপটা দেখে আমি ওকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু এমন কেন হল? আমি ওর ফোন না ধরলে ও আমার বাসায় ফোন করার হুমকি দিত। বলতো, আমার বাসায় ফোন করে আমার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা বলবে। আমি যে কী করব, কাকে কী বলব, কিছুই মাথায় আসছিল না। পুরো ডিপার্টমেন্টে আমি আলোচনায় চলে এসেছিলাম। প্রতিটি পরীক্ষার আগে আমাকে তার সাথে দেখা করতে হত। তখন আমি হলে থাকতাম। সে আমার সিনিয়র ছিল, কিন্তু রিঅ্যাডমিশন নেয়ায় আমরা একই ক্লাসে ছিলাম। তার কথা হচ্ছে, সে পরীক্ষা দেবে না, তাই আমিও পরীক্ষা দিতে পারব না। প্রতিবাদ করে অনেকদিনই তার হাতে চড় পর্যন্ত খেয়েছি! প্রত্যেকটি পরীক্ষাই আমি আগেরদিন রাতে পড়ে দিয়েছি। কী পড়েছি, কী লিখেছি, কীভাবে লিখেছি, তার কোনও বোধশক্তি আমার ছিল না। কম্পিউটার সায়ন্সের সাবজেক্টগুলির পরীক্ষা একরাতের প্রস্তুতি নিয়ে দেয়াটা নেহায়েতই বোকামি। কিন্তু আমি কী করব! আমার যেদিন প্রোগ্রামিং পরীক্ষা থাকত, তার আগের দিন সন্ধ্যায় জোর করে আমার ল্যাপটপটা নিয়ে যেত—ওর নাকি কী কাজে লাগবে, ওর ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে গেছে, এসব কথাবার্তা বলে। ওর জন্য সবকিছুই মেনে নিয়েছিলাম। আমি ওকে কোনওভাবেই হারাতে চাইছিলাম না। কী করব, ভালোবাসতাম যে!

এরপর একসময় সে আমার মাকে নিয়ে নোংরা কথা বলা শুরু করল। তখন আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। কখনোই তার জঘন্য বাজে কথার পিঠে আমি কিছু বলিনি। তবে এবার আমি ওকে বলে দিলাম, এইভাবে আর সম্ভব না। কিন্তু তার কথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। আমাকে সে কখনো ছাড়বে না। কারণ আমাকে নাকি সে, যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে ব্যবহার করতে পারবে। আমি নাকি প্রতিবাদ করতে জানি না। আমি আরেকটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ওকে আমি বিশ্বাস করে আমাদের কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি রাখতে দিয়েছিলাম। ও আমাকে হুমকি দিল, আমি ওকে ছেড়ে চলে গেলে ও আমাদের এই ছবিগুলি ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে পাবলিশ করে দেবে।

আমার কোনও কিছুই ভাল লাগছিল না। জীবনের কাছ থেকে আমি আবারও ধোঁকা খেলাম। পড়াশোনা করা একেবারেই বন্ধ করে দিলাম। সারাদিনই হলে আমার রুমে বসে থাকতাম। ক্লাসে যেতাম না, ঠিকমতো খেতাম না, কারও সাথে মিশতাম না, এমনকি ফোনও রিসিভ করতাম না। শুধু একটাই প্রার্থনা করছিলাম, আমার যা হয় হোক, যেন কোনওভাবেই আমার বাবা-মা’র মুখটা আবারও ছোট না হয়। থার্ড ইয়ার ফাইনালে পাস করলাম কোনওমতে, বলতে গেলে, অলৌকিকভাবেই। ফাইনাল ইয়ারে অনেক কষ্ট করলাম। কিন্তু আর পারলাম না………

ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব। জীবনটাকে খুব ছোট আর নিরর্থক লাগছিল। জেদের বশে সুইসাইড করার অ্যাটেম্পটও নিলাম। কিন্তু কিছু প্রকৃত বন্ধুর কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। চারদিন ক্লিনিকে থাকতে হয়েছিল। মৃত্যুযন্ত্রণা কী, তা টের পেয়েছিলাম।

খুবই অবাক হয়েছিলাম, যখন জানতে পারলাম আমার এই খবর জেনে তার প্রতিক্রিয়া ছিল—খেয়া নাটক করছে! ওর মতো মেয়েরা সব পারে!

বাবা-মা এটা জানত না। ওরা জানত, ওদের মেয়েটা খুব ভাল আছে।

এর ছয়দিন পর খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে টিএসসি’র মাঠের ওখানে ভুল বোঝাবুঝির এক পর্যায়ে ও আমাকে আমাদের আরও কয়েকজন ফ্রেন্ডের সামনে খুব জোরে চড় মারে। লজ্জায়, অপমানে, রাগে ওকে কিছুই না বলে ওখান থেকে বাড্ডায় আমার বড়মামার বাসায় চলে আসি। সেদিন রাতেই ওর মেজো ভাইয়ের নাম্বার যোগাড় করে ব্যাপারটা উনাকে জানাই। ওর মেজো ভাই ভীষণ রাগী মানুষ, ও যদি পৃথিবীতে কাউকে ভয় পায়, সেটা একমাত্র ওর মেজো ভাইকেই। ভাইয়া ওকে ফোন করে খুব বকাঝকা করেন। সেদিন রাতেই ও ‘রিভেঞ্জ’ নামে একটা ফেইক আইডি খুলে ফটোশপে ওর নিজেকে আড়াল করে আমাদের ঘনিষ্ঠ সব ছবি আপলোড করে আমাকে ট্যাগ করে দেয়। এটা দেখে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল, ওকে টানা ফোন করে গেলাম, ও ধরল না। আমার পাগলপাগল লাগছিল, মাথা একটুও কাজ করছিল না। সবকিছুকেই এলোমেলো মনে হচ্ছিল। কিছু না ভেবেই মামার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন রাত পৌনে একটা। রাস্তায় কোনও কিছুই পেলাম না। আগপিছ না ভেবেই আলগোছে দৌড়াতে শুরু করলাম। যে করেই হোক, ওর হলে পৌঁছাতে হবে, ওর সাথে দেখা করতে হবে। আমার মাথায় এর বাইরে আর কিছুই ছিল না। হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা মাইক্রো এসে আমাকে ধাক্কা দেয়। আমি জ্ঞান হারাই।

আমি এখন আর আট-দশটা মেয়ের মত করে ভাবতে পারি না। আমার জীবন ওদের জীবনের মত না। আমাকে হাসিমুখে সবার সাথে ভালথাকার অভিনয় করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। যারা পঙ্গু, তাদের অনেক হাসতে হয়, নইলে ওদের পক্ষে বেঁচেথাকাটা অসম্ভব। লোকে দুইহাত দুইপা নিয়েও জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হিমশিম খেয়ে যায়, আর আমার তো কেবল দুইহাত আছে। আমার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবা পথে বসে গেছেন। এখন আমার চিকিৎসা চলছে আমার মতই—খুঁড়িয়ে। আমি আর পারছি না। আমি হেরে গেছি। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি আমার জন্য কিছু চাই না। আমি শুধু চাই আমার বাবা-মা’র মুখে হাসি দেখতে। বাবাকে শেষ কবে হাসতে দেখেছি, মনে পড়ে না। মার চোখে শেষ কবে জল দেখিনি, তাও মনে পড়ে না। অবশ্য, এমন হওয়ারই কথা! আমি যে তাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি! আমাকে এ পৃথিবীতে আনার প্রায়শ্চিত্ত ওদের এখনও শেষ হয়নি। তবে আমি কক্ষনো কাঁদি না, বাবা-মা’র সামনে কাঁদলে আমি আর ওদের বাঁচাতে পারব না, আমি জানি! এ জীবনে আমি আর কারও জন্যই কিছু করতে পারব না। আমার এ পৃথিবীতে আসার কোনও মানে ছিল না। প্রায়ই ভাবি, আমার সাথেই কেন এমন হল? এ জীবনে কারও উপকার করতে পারি আর না পারি, কখনওই তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি! আমার অপরাধটা কী ছিল তবে?

আমার শরীর এখন কেবল হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত, আমার মুখ বেঁকে গেছে, সামনের পাটির কয়েকটা দাঁত ভেঙে গেছে, বাঁহাতটা নাড়াতে খুব কষ্ট হয়। আমার মাথায় কোনও চুল নেই, ডাক্তার ন্যাড়া করে দিয়েছেন। একসময় আমার পাশে পুরো পৃথিবী ছিল, এখন আমার পাশে আমার বাবা-মা ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকে এখন আমার মা ছাড়া আর কেউ চুমু খায় না। বাবা আমাকে এখনও আগের মতো প্রিন্সেস বলেই ডাকে। কেন যে বেঁচে গেলাম! এটা মাথায় এলেই খুব কান্না পায়! এই দুইটি মানুষের ভালোবাসা দেখলে সবকিছুর পরও খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমি ডানচোখে কিছু দেখি না, বাঁচোখে আবছা দেখি, ডাক্তার বলেছেন, এখুনিই চিকিৎসা না করালে সে চোখের দৃষ্টিও বেশিদিন থাকবে না। আমার যে চোখটা এখনও পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়নি, সে চোখ মেলে তাকাতেও যেন ভয় লাগে—চোখের সামনে কেবলই সবকিছু ভেসে আসে! আগে আমার দুইচোখ ছিল, এখন একটা নেই, আরেকটাও প্রায় নেই—তবু………তবু আমি পৃথিবীর অন্য যে কারও চাইতে মানুষের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাই। কানে কম শুনি, হিয়ারিং-এইড লাগিয়ে শুনতে হয়। কেউ আমার সাথে কথা বলতে চায় না, আমি কখনো কারও সাথে কিছুই শেয়ার করতে পারি না। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে—কোনও কষ্ট কিংবা অভিযোগের কথা নয়, জীবনের কথাই বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমার জন্য কারও কোনও সময় নেই।

এই দুর্ঘটনার পর রুদ্র দয়া করে সেই ফেইক আইডিটা বন্ধ করে দেয়। আমাকে ইনবক্সে লিখে পাঠায়: “যাও, মাফ করে দিলাম।” আর কখনওই আমার সাথে কোনও যোগাযোগ করেনি। আমিও করিনি, আমৃত্যু করবও না। কারও প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমার পুরোটা সময় তো বেঁচেথাকার জন্য লড়াই করতে-করতেই চলে যায়, অভিযোগ করার সময় কোথায়? আমি জানি, আমি যা পাচ্ছি, তা আমার কর্মফল। মানুষকে বারবার বিশ্বাস করা—এটাই আমার এ ক্ষুদ্র জীবনের একমাত্র পাপকর্ম। আমাকে দেখে অনেকেই সহানুভূতি দেখায়, তবু একমাত্র আমিই জানি, আমাকে কীসের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে! পৃথিবীর সবচাইতে জ্ঞানী এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিটির পক্ষেও অন্য কারও যন্ত্রণা অনুভব করা দূরে থাক, তা সম্পর্কে ধারণা করাও সম্ভব নয়!

মাঝেমাঝে ভাবি, একসময় কত জীবনবোধে পূর্ণ ছিলাম আমি। এখন আমার শরীরে কেবল প্রাণটাই কোনওমতে আটকে আছে। পঙ্গুদের কোনও জীবনবোধ থাকে না, কেবলই জীবন থাকে। জীবন আমাকে অনেক গল্প উপহার দিয়েছিল, আমি সেসব গল্প নিয়ে ভালই ছিলাম; এখন আমার কাছে যা আছে, তা কেবলই একজন অকেজো মানুষের কিছু অকেজো গল্প।

সেদিন আমার বাবার এক বন্ধু আমাকে বললেন, খেয়া, তুমি অনার্সটা কমপ্লিট করে ফেলো। তাহলে তো প্রতিবন্ধী কোটায় বিসিএস দিতে পারবে। মা, তুমি তো স্টুডেন্ট খারাপ ছিলে না। তুমি চেষ্টা করলে তোমার হয়ে যাবে।

আমি জানি, আঙ্কেল যা বলেছেন, আমার ভালর জন্যই বলেছেন। তবু উনার কথা শুনে বুকের ভেতর কোথায় যেন খুব কষ্ট পেয়েছি, ঢোঁকের সাথে কান্না গিলে ফেলেছি………রাগও হয়েছে। সে রাগটা যে কার উপর, আমি জানি না।

আমি একসময় আমার ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে সুন্দর পাঁচটা মেয়ের একজন ছিলাম। অন্তত সবাই তা-ই বলতো। কখনওবা ভুলে এটা মনে এলে আমার এখনও ভাল লাগে।

এখন আমি পুরো পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত মেয়ে। আমি বুঝতে পারি, একটা কুৎসিত মেয়ের হাসিও সবার চোখে কুৎসিত। তবু আমি হাসি, অনেক হাসি………আমাকে হাসতে হয়।

ওরা আমার সতীত্ব কেড়ে নিল, মানুষের প্রতি বিশ্বাস কেড়ে নিল, তবু আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।

ভালোবাসা আমার সব কেড়ে নিল, আমি আর দাঁড়াতেই পারলাম না, চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম—ভেতরে, বাইরে।

যতই চেষ্টা করুক না কেন, মানুষ বোধহয় কিছুতেই তার নিয়তিকে এড়াতে পারে না।