অটাম সোনাটা (১৯৭৮)

একজন সফল আর্টিস্টের কাছে তাঁর পরিবার কতটুকু গুরুত্ব পায়? নিজের ক্যারিয়ার আর পরিবার, এই দুইকে সমান সময় দেয়া আদৌ কি সম্ভব? একের পর এক সাফল্য আসতে শুরু করলে তা থেকে নিজেকে কতটা সরিয়ে রাখা যায়? আপোষ করলে ক্যারিয়ারের ঘোড়া ছুটতে ভুলে যায়। ওকে ছোটাতে হলে নিজের মনকে বেঁধে ফেলতে হয়, পরিবারকে সেকেন্ডারি করে রাখতে হয়।

স্বামী আর সন্তান, এই দুই পারিবারিক বলয়ের মধ্যে থেকে নামযশের পেছনে ঠিকমতো ছোটা যায় কি? তাঁর ভালোবাসা কীসের জন্য নিবেদিত? পরিবারের জন্য? নাকি ক্যারিয়ারের জন্য? একই সাথে দুইয়ের জন্যই তো নয়ই, যদি সে ভালোবাসা অকৃত্রিম হয়।

পরিবার যদি বেঁকে বসে, তবে ক্যারিয়ারকে ঠিকভাবে গোছানো কঠিন। তাই তিনি পরিবারের সব সদস্যকে খুশি রাখার চেষ্টা করে যান। এর জন্য যদি ভালোবাসার অভিনয় করতে হয়, তাও করেন। সবার সাথে মেকি আন্তরিকতা আর মিডিয়া হাসির বদৌলতে ভাল সম্পর্ক রেখে যান। তবে তাঁর মনের মধ্যে এক ধরনের ভয়ও কাজ করে। সে ভয় থেকে তিনি কখনোই স্বামী-সন্তানের খুব কাছে যান না। কীসের ভয়? ভালোবাসা আর সময় দিতে হওয়ার ভয়। কাছে গেলে যদি স্বামী কিংবা সন্তান ভালোবাসা আশা করে বসে, চেয়ে বসে কিছু মনোযোগ, তখন কী হবে? অথচ, পরিবার তাঁর কাছ থেকে একটু সময়ই চায়, আর কিছুই না।

উনি খুব ভাল করেই বুঝতে পারেন, এই যে লোকদেখানো প্রসন্ন ব্যবহার আর হাসি, যা তিনি দিনের পর দিন দেখিয়ে যাচ্ছেন বাড়তি ঝামেলা এড়াতে, তাঁর পরিবার মুখে কিছু না বললেও সবই বোঝে, অথচ মুখে কিছুই বলে না, কারণ কাছের কাউকে কিছু বললে যদি তিনি তা না রাখেন, তবে কষ্টই কেবল বাড়বে, এই ভয়ে।

বুঝলে বুঝুক! পরিবারের সবকিছু চুলোয় যাক! তাঁকে শিখরে উঠতে হবে। যেকোনো মূল্যে। সেখানে পরিবারের কারুর মানসিক চাহিদা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না! এমন-কী পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ল কি না, তার চিকিৎসা আদৌ হচ্ছে কি না, তার কিছু লাগবে কি না, তার পাশে একটু থাকা কিংবা তার জন্য সময়দেয়া, এই সবকিছুর চাইতে বড়ো হয়ে ওঠে তাঁর ক্যারিয়ার আর শিল্পীসত্তা। পাখিদের যেমনি নীড়ে ফিরতে হয়, তেমনি, যতো বড়ো আর্টিস্টই হন না, সবাইকেই একসময় ঘরে ফিরতে হয়, ঘরের মানুষের স্নেহে বাঁচতে হয়। জীবনে কিছু সময় আসে, যখন খ্যাতির চাইতে সাহচর্য মুখ্য হয়ে ওঠে, বাইরের চাইতে ঘরের আশ্রয় বেশি স্বস্তি যোগায়, নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী যিনি, তাঁর কি আর অতো কিছু মাথায় রাখলে চলে?

ওপরের থিমকে উপজীব্য করে ঋতুপর্ণ ঘোষ বানিয়েছিলেন ‘উনিশে এপ্রিল’। অপূর্ব একটা সিনেমা। আর যেখান থেকে ঋতুপর্ণ কাহিনি ধার করেছেন, সেখানে গেলে অসীম ঘোরলাগা কাজ করে; সে মুগ্ধতার নাম ‘অটাম সোনাটা’। স্রষ্টা হচ্ছেন ইংমার বার্গম্যান, ঋতুপর্ণ যাঁকে গুরু মানতেন। উনিশে এপ্রিল-এর চাইতে ‘অটাম সোনাটা’ হজম করা অনেক বেশিই শক্ত!