অফিসে আসার পথে

২৭ অগ্রহায়ণ। মানে পৌষ এখনো আসেনি। অথচ শীত এসে গেছে। মেয়ের আগে মা এসে যায়। শীতের সকাল ৬:৩০টা মানে সকাল না, ভোর। ওইসময়ে কলের জল হল ফ্রিজের জল। হাওয়া হল কুয়াশা। জেগে-থাকা হল ঘুমঘুম চোখে জেগে-থাকা। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলে চোখের পাতা অবশ হয়ে যায়, প্রিয়ার উষ্ণ চুম্বনে জমে-যাওয়া চোখে প্রাণ ফেরাতে ইচ্ছে করে। হায়! প্রিয়া নেই, এয়ারপোর্টের ফ্লাইট আছে; ৮:৩০টায়। প্রিয়া আসে না, প্লেন আসে। প্লেনগুলো এই শীতের ভোরেও আমাকে স্নান করিয়ে নেয়। ৭:০০টায় বাসার সামনে গাড়ি এল।

পথে আসতে-আসতে মনে হল, আজকের ভোরটা একটু অন্যরকম বোধ হয়। নাকি, আজকের আমিই একটু অন্যরকম? এই অন্যরকম আমি মাঝেমাঝে কোথায় হারাই তবে?

অভিমানী প্লেনগুলো প্রতিদিন দেরিতে রানওয়েতে নামে। পিচঢালা রানওয়ে প্লেনের চাকাগুলোর স্পর্শসুখের আশায় উবে-না-যাওয়া কুয়াশা বুকে নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। তবুও ঘন কুয়াশা ওদের নামতে দেয় না। গাড়িতে ভাবতে লাগলাম, হয়তো বা আজকেও এমন।

পথের পাশে ৫-৬টা কুকুর বেশ ভাবটাব নিয়ে লেজ উঁচিয়ে ওদের এলাকা টহল দিতে দিতে খোশগল্প করছে। দেখলাম, একটা কুকুরের লেজ নামানো। ওটা বোধ হয় অন্য এলাকার কুকুর। আচ্ছা, এই কুকুরদের শীত লাগে না?

এক জায়গায় কিছু শ্রমিক এই কুয়াশায়ও জড়ো হয়েছে। ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ টাইপ সমাবেশ। ওদের ব্যানারে লেখা আছে, “শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নাও, মানতে হবে।” আমিও ওদের দাবিগুলো সমর্থন করে ওদের আন্দোলনের সাথে মনেমনে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। কারণ ওরা ‘ন্যায্য’ বানানে ভুল করেনি। যে দেশে বড়বড় মানুষও ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ দিয়ে সকল শ্রদ্ধাঞ্জলি জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়, সেই দেশে এই ছোটছোট মানুষের এতো বড়ো বানানসাফল্য মুগ্ধ করার মতোই। প্রার্থনা করি, ওরা ভাল থাকুক, শুদ্ধ বানানে প্রতিবাদ করে যাক।

কিছু-কিছু মোরগকে দেখলাম, মুরগিগুলোর সাথে ওপেনলি ফ্লার্ট করছে। এদের মধ্যে দুএকটা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে চোখের ইশারা করছে। হায়! মুরগিদের ইভটিজিং দেখার কেউ নেই। ওরাও অ্যাডামচেজিং শুরু করবে, ভাবছে। আমি চাই, মোরগগুলো কিংবা ওরা নিজেরা চিকেনফ্রাই হওয়ার আগেই ওদের কার্যক্রম শুরু হোক।

খেটেখাওয়া মানুষ অনেকসময়ই কোনও কারণ ছাড়াই গালিগালাজ করে। রাস্তায় এক লোক ২-৩জন ড্রাইভারকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে। এসব শুনেটুনে আমি অতিবিব্রত। আমি চাই, কেউ প্রকাশ্যে গালাগালি করলে ওদেরকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাক। কিংবা সবার সামনে ২০ টাকা জরিমানা করুক। এইসব লোক পিটালে মাইন্ড করবে না, কানেধরে উঠবস করালেও দাঁত বের করে হাসতে থাকবে, কিন্তু পকেটের পয়সা খসালে পরেরবার অন্তত দশবার ভেবে কাজ করবে। আমার কথা হচ্ছে, ওরা রাস্তায় গালাগালি করবে কেন? রাস্তাটাকে পার্লামেন্ট পেয়েছে নাকি? আজব!

কিছু ন্যাংটা ছেলে খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে নাচছে। ওরা মহাআনন্দিত। জগতের সকল আনন্দযজ্ঞের আয়োজন এখানেই। ওদের কাস্টমসের সহকারী কমিশনারকে গোনার টাইম নাই। ওরা গোনে শুধু প্রতি মুহূর্তের আনন্দকে। আমি ভাবছি অন্যকথা। ন্যাংটাদের শীত লাগে না নাকি? জগতের সব ন্যাংটারই দেখি হাসিহাসি মুখ। ঘটনা কী? লজ্জা নাই, না কি শীত নাই?

কিছু কবুতর রাস্তায় পড়ে-থাকা শস্যদানা খুঁটিয়ে খাচ্ছে। এক কিশোর ওইসময়ে ওই রাস্তায় দুই হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালাতে-চালাতে সাইকেল নিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। একটু আগের সেয়ানা নায়ক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। নায়কদেরকে মাটিতে লুটাতে দেখলে কষ্ট লাগে। তার উপরে ওই বেচারা বিশেষ জায়গায় ব্যথা পেয়েছে। ওইখানে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে, মুখ ব্যথায় বিকৃত। বিশেষ জায়গায় ব্যথা পেলে সবারই ব্যথা লাগে। নায়কেরও কোনও ছাড় নেই। পাশে বেরসিক নিষ্ঠুর কবুতরগুলো বাকবাকুম করেই চলেছে, বন্ধ করেনি। কারওর অগ্রহায়ণমাস, কারওর সর্বনাশ। ভূপাতিত নায়ক ভাবছে, বাসায় গিয়ে কম মসলায় রান্নাকরা কবুতরের স্যুপ খাবে। শরীরের ব্যথা কমবে, মনের জ্বালাও কমবে। হতচ্ছাড়া কবুতর!

রাস্তায় মাইকিং হচ্ছে, “একটি শোকসঅঅঅঅংবাদ একটি শোকসঅঅঅঅংবাদ…।” কেউ একজন মারা গেছেন। এর পাশেই একটা সিএনজি’তে এক ছোকরা মাইকে ধেড়েগলায় চিলাচ্ছে, “প্রেমের নাম বেদনা, সেকথা বুঝিনি আগে…।” একটা মসজিদ বানানো হবে, তাই এর জন্যে রাস্তার পাশে টেবিলচেয়ারে বসে মাইক দিয়ে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন সৌম্য চেহারার এক প্রবীণ। অদ্ভুত দৃশ্য! মৃত্যু আনন্দ আর ধর্মের অভূতপূর্ব সহাবস্থান।

“আমি আর আরএফএল কোয়ালিটির ব্যাপারে আপোষ করি না।” একটা কাভার্ড ভ্যানের গায়ে লেখা দেখলাম। দেখলাম, ওটার গায়ে মৌসুমী লেপ্টে আছে। কেয়ামত থেকে কেয়ামত-এর কিউট মৌসুমীকে খুব মিস করলাম। আমরা কি এই কোয়ালিটির ঐরাবত-মৌসুমীকে চেয়েছিলাম?

দূরে দেখা যাচ্ছে, একটা টয়লেটের পেছনের দিকের অংশটা নেই। টয়লেটের পেছনটা জঙ্গলটাইপের বলে কাছ থেকে এই ব্যাপারটা দেখা কিংবা বোঝা যাবে না হয়তো। কিন্তু দেখতে চাইলে দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখা সম্ভব। তাহলে কি ধরে নেবো, সামনাসামনি দেখা যায়, শুধু এমন লজ্জাই মানুষ ঢাকে?

রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ভিড় করে ঘিরে আছে। এই লোককে এই মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো দরকার। সেদিকে কারওরই খেয়াল নেই। সবাই গাড়ির ড্রাইভারকে ধোলাই দিতে ব্যস্ত। ড্রাইভারকে গালি দিতে দিতে ওর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলছে, আর ওদিকে লোকটার প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে অনেক চেষ্টা করেও আমি উনার কাছে যেতে পারলাম না। একটু পর উনাকে ভ্যানে তোলা হল। লোকের ভিড় ঠেলে ভ্যান যেতে পারছে না। ওরা রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে। সমানে গালাগালি করছে। অতি উৎসাহী ব্যস্ত জনতা। বাঙালিরা অতিকিউট বেকুব বেআক্কেল জাতি।

আচ্ছা, সাগর নামের সব ড্রাইভারই কি অ্যাক্সিডেন্টবিহীনভাবে অতিদ্রুত গাড়ি চালাতে পারে? আমার আগের এক ড্রাইভারের নাম ছিল সাগর। ওর মাথার দুএকটা স্ক্রু ছিল না, কিন্তু ড্রাইভার হিসেবে ও ছিল অসাধারণ! বাংলা সিনেমার গান গাইতে-গাইতে খুব দ্রুত গাড়ি চালাতো। আমার শুধু একটাই ভয় কাজ করতো, কোনসময় হঠাৎ রাস্তার পাশের পুকুরটুকুরে নামিয়ে দিয়ে বলে, “স্যার, কী করবো বলেন, গরমে তো আর টেকা যাচ্ছিল না!” এখনকার ড্রাইভারও সাগর, তবে মাথাখারাপ সাগর না, মাথাঠিক সাগর। মিল শুধু এক জায়গাতেই, দুজনেই চমৎকার ‘নেভার লেট’ ড্রাইভার। এয়ারপোর্টের রাস্তা বন্ধ দেখে সাগর অন্যরাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে ৮:০৫টায় এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এলো। আমাদের এয়ারপোর্টের কাছেই সাগরতীর। নেভাল বিচ। ওটার পাশ দিয়ে ক্রস করার সময় ড্রাইভারকে থামতে বললাম। গাড়ির জানালা নামালাম। ভোরের শান্ত সাগরতীর দেখতে ইচ্ছে হলো। আমি ‘লাইফ ফর জব’ থিওরিতে বিশ্বাসী নই, আমি ‘জব ফর লাইফ’ মেনে চাকরি করি। এই হিমশীতল নেভাল বিচ দেখার সুযোগ যদি আর কখনোই না হয়, তাহলে? ছোটোবেলার অংকের মতো করে ভাবলাম, “মনে করি, আজকেও ফ্লাইটডিলে।” গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সাগরকে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে সাগরের কাছে গেলাম। বুকভরে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া নিলাম। আহা! ভোরের সাগর আর নদীকে শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষে পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টে এলাম। পথে শিশিরভেজা ঘাস দেখে জুতামোজা খুলে ঘাসের উপরে কয়েক মিনিট হেঁটেছি। অপূর্ব স্নিগ্ধ এক শিহরণ! মনে হচ্ছিল, ওই নরোম ভেজা ঘাস প্রেমিকার নরোম ভেজা ঠোঁটের মতোই নরোম। পৌনে ৯টার দিকে এয়ারপোর্টে ফিরলাম। এসে জানলাম, আজকেও ফ্লাইট ডিলে। একঘণ্টা; ৮:৩০টার ফ্লাইট নামবে ৯:৩০টায়। কী শান্তি! মাঝেমাঝে চাকরিও একেবারে খালিহাতে ফেরায় না।

পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টে আসার পথে যখন গাছের পাতায় রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা দেখছিলাম, জীবনটাকে তখন বারবারই মনে হচ্ছিল, শীতের রোদের ঘ্রাণের মতন মাখামাখা মিষ্টি।

এজরা পাউন্ডের মাত্র দুই লাইনের লাইনের একটা পূর্ণ কবিতা আছে, ‘In a Station of the Metro’:

The apparition of these faces in the crowd;

Petals on a wet, black bough.

এই লেখাটা লেখার কোনও মানে ছিল না। তাই এই লেখাটা পড়ারও কোনও মানে ছিল না। যদি পড়েই ফেলেন, তবে বলবো, পাউন্ডের ওই কবিতায় গাছের কালো ডালে জমে থাকা পাপড়িগুলোর মতো আপনার অনুভূতিকে একটু স্থির করে ভাবুন তো, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কিন্তু জীবনটা নেহায়ৎ মন্দ নয়! কী আছে আর জীবনে! আমি বলছি, জীবন আপনাকে কিছুই দেবে না! উই অল আর ওয়েটিং ফর গডো। এখানে সব ছোটোছোটো সুখগুলি ছড়ানোছিটানো। আপনাকে তা কুড়িয়েকুড়িয়ে নিতে হবে। জীবনটা দামী। কতোটা? ততোটাই, যতোটা আমরা ভাবি।

এই লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার রুম থেকে দেখছি, প্লেন থেকে নেমে দেশে-ফেরা সারিসারি লোক রানওয়েতে হেঁটেহেঁটে এয়ারপোর্টের দিকে আসছে। আমার ল্যাপটপের স্পিকারে বাজছে ডেনভার…

Life is old there, older than the trees,

Younger than the mountains, growing like a breeze

Country roads, take me home

To the place I belong…

কাকতালীয় না? হ্যাঁ, জীবনটা আসলে এরকমই!