অভিধানে ভ্রষ্ট নেই

  এক।
তোমার সাথে যা কথা হয়,
তার আমারটুকু রাখি না আমি,
মুছে দিই তা বরাবরই।
তোমারটুকু থেকেই যায় শুধু।
তোমার কাছে মিথ্যা আমি ঠিক যতটুক,
আমার কাছে সত্য তুমি ঠিক ততটুক!
 
অথচ, কী আশ্চর্য,দেখো!
আমার কাছে যে ‘তুমিটা,
সত্য হয়ে আছে অবিচল হয়ে,
সে আসলেই মিথ্যে ভীষণ!
তোমার কাছে যে মিথ্যে ‘আমি’,
সে-ই বরং সত্য কেবল!
 
জীবন--
সত্যিমিথ্যের অগোছালো এক
গোলকধাঁধার মেলা,
অদ্ভুত পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে চলছে দেখি
রঙহীন সব খেলা।
 
জানি না, তুমি কী আদৌ বোঝো আমায়!
বিশ্বাস? সে তো বড়ো গোলমেলে!
সে আসলে কোথায় থাকে? থাকে কি আদৌ?
তার হিসেব নাহয় বাদই দিলাম!
ভালোবাসা?
তোমার কাছে তা তো জানি ছেলেখেলা শুধুই!
 
যদি কখনো দেখ,
আমায় আর যাচ্ছে না চেনা,
বদলে গেছি অনেকখানিই,
তবে জেনো, যা প্রার্থনা আমার,
তা হয়েছে পূরণ পুরোপুরিই!
 
জানো, খুব করে চাই,
এই যে ভেতরে যত্নেরাখা
তোমার জন্য অনুভূতিটুক,
সে আমায় জানাক বিদেয়,
ঠাঁই করে নিক সেই হৃদয়ে,
যে হৃদয়ের ভালোবাসার প্রতীক্ষায়
তোমার যত প্রহর কাটে।
 
দুই।
নিজেই আমি নিজের সাথে লুকোচুরির খেলায়
আজ ক্লান্ত ভীষণ।
যে মন ভালোবাসার যত গভীরে যায়,
সে মন জানে ভালোবাসার মূল্য কত,
ভালোবাসার অযতন, সে যে পাপ বড়ো!
 
এই যে এখন
ভালোবাসি বলেই,
রোজ কাঁদি, আমার আমি’কে রোজই ভেজাই,
জানি, একদিন অ-ভালোবাসায়ও
কেঁদেই যাবো,
আমার আমি’টা
আর চিনবে না তোমায় আগের মতো,
ভালোও হয়তো বাসবে না আর,
আমার সে আমি’কে
চিনতে সেদিন
ভাসবো চোখের কষ্টজলে!
আমি কি তবে এমনই রবো সারাটা জীবন!
 
তবুও ভাল থাকবো সেদিন
এইটুক ভেবে--
ভালোবাসা আমার যত্নেই আছে
আরেক হৃদয়ে!
যে হৃদয়ের ভালবাসা আর অনুভূতিটুক
তোমার চাওয়া,
সে হৃদয়ে।
 
তিন।
বৃষ্টি...আহা!
প্রকৃতিটা ভিজছে যখন,
ওকে বড়ো আপন লাগে,
বৃষ্টিজলের যে ঘ্রাণটা আছে--খুব আলাদা,
লোনাজলের নেই তা, বল?
ঘ্রাণ তো তার আছেই আছে, বরং একটু বেশিই,
সে ঘ্রাণটা নাক দিয়ে নয়, মন দিয়ে নাও!
 
আমার যে জল,
তা ছোঁবে না, জানি।
বৃষ্টিজলের কয়েক ফোঁটা
দাও না ছুঁয়ে,
যে জলের এপাশটা ছুঁয়েছি আমি!
 
সময়ে যা কথা
অসময়ে বলা......
এমনই ভোগায়!
 
চার।
ওপারে--
অনিচ্ছেয় বর্ণরা আসে
দেরি করেই!
প্রত্যুত্তর নিঃসন্দেহে তাই
অবান্তরই!
 
এপারে--
অবুঝ অবোধ কারণগুলি
তবু সুখে ভাসে,
সে সুখের আনন্দটুক
দ্বিধায় সরে
আরো একটু দূরে
নিরন্তরই!
 
প্রকৃতি ধুয়ে দিতে জানে
মিথ্যে যত!
মিথ্যে যে অস্তিত্বে আমিই বাঁচি
প্রকৃতির কাছে তা নিরর্থকই!
 
পাঁচ।
কোনো এক সীমানার বাইরে
যে ঘ্রাণের আর দাম নেই কোনো,
অসীমের ভয় সে ঘ্রাণেরই আছে!
যার ঘ্রাণটাই নেই,
তাকেও কেন ভয় দেখানো?
 
মস্তিষ্ক, মন, শরীর।
মাঝেমাঝে কেমন যেন হয়ে পড়ে।
কোথায় যেন হারিয়েই যায়।
মন খারাপ হয়, স্তব্ধ হয়ে থাকে।
শরীর খারাপ করে, অনুভূতি হারিয়ে ফেলে।
দুঃখ কিবা সুখ, কেউ পায় না ওদের খোঁজ,
পেলেও যেন ঠিক চিনতে পারে না।
 
হঠাৎ করেই মনটা ভাবে,
এ-ই তো ভাল! দিব্যি আছি!
আসলে কি তা?
 
দুঃখ কষ্ট দেবেই!
সুখ দেবে আনন্দ।
এই দুই ক্ষমতা মিলেই তো এই পৃথিবীর জীবনীশক্তি!
ওরা হারালে পৃথিবী বাঁচে কী করে?
 
ছয়।
স্মৃতি মুছে ফেলি--
কেবল রাগ কি অভিমানে
সবসময়ই, তা কিন্তু নয়!
অতীত নিয়ে চলা মন
যখনই পেছন ফিরে ওকে দেখে,
বুঝে ফেলে ঠিক--
যে শূন্যতায় বাঁচে,
উড়ন্ত ঘুড়ি কত সুন্দর,
তা সে কীকরে আঁচে?
কাটাঘুড়ি যেখানে খায় না কাট্টি,
ফিরতি চোখে
ঘুড়িকে দেখে
যায় না চেনা কোনো কিছুতেই!
 
ওপাশের চোখ
ওরা এসেছে কেনো, কোত্থেকে-বা,
রাখে না খোঁজ সেটুকরও,
ওরা তখন,
আছে যে অমন,
জানায় না তাও!
 
চারপাশে দেখি
কত হাসিরাশি,
আরো রস এলে
সুখের কি দুঃখের,
শ্বাসরা বড্ড বিষম খায় তো!
 
মন যদি না চায় ওদের
খুবটি করে,
ওরা পালায়, হারায়!
 
সাত।
বৃষ্টির সাথে কাপড়ের
হয়তো সখ্য নেই কোনোই।
একছাদ কাপড় ভিজিয়ে
ঝমঝম অবাধ বৃষ্টি,
একপেয়ালা জল
উনুনের তাপের প্রতীক্ষায়।
 
যেখানে অস্তিত্ব কেবলই
প্রতিধ্বনিতে বাঁচে,
সেখানে মনের বর্ণদের বাঁচারজন্যে
বাইরের যা আলো, তা
খুব অচেনা, বড়ো অস্বস্তির!
 
শুভেচ্ছারা যখন কেবলই নাচতে থাকে
জোকারের মুখে,
মেঘকে তখন পাই না ছুঁতে,
যদি বৃষ্টি হয়ে না পড়ে ঝরে।
নামলে বৃষ্টি
ছুঁয়ে দেখি ওকে,
যদিও বুঝি
আমার জন্য নামেনি তো সে!
 
বৃষ্টি তো তবু ছুঁয়ে দেখি হাতে,
তাকে তো কেবলই মন দিয়ে ছুঁই!
 
আট।
হ্যাঁ ঠিক, খুব করে ঠিক--
আমি ভাল থাকতে চাই,
কিংবা থাকার চেষ্টা করি
নিজের মতো করে ভেবে নিয়ে।
 
যা বলেছি,
সময়েসময়ে যা বলি,
তার সত্যের গভীরতা
তুমি খুব করে জানো, বোঝো,
জানি। বুঝি আমিও, জেনো!
 
তবুও দেখো,
মনেমনে মন কী ভেবে নেয়!
ওসব নাকি সব মিথ্যে!
সত্য কেবলই
আমি যা ভাবি!
 
তবু হায়, যে কাপড় জলেভেজা,
তাকে শুকনো ভেবে,
যতই জড়াও শরীর,
শরীর যে ভিজবেই!
 
জানো জীবন,
সম্পর্কের খাঁজেভাঁজে বেঁচেথাকা মিথ্যে আছে যা,
তার খোঁজ আমি জানি।
তবু ভুলে থাকি......
এই আশায়, যদি মিথ্যে সত্যি হয়!
সেদিন দেখো,
আমার এই আমি’টাকে চিনবো না আর!
 
নয়।
দেখো,
ভোরের ফুল কেমন সজীব, সতেজ.....
রোজ আমায় যে ঘৃণাটা কর,
ঠিক তারই মতন!
 
অতোটা ঘৃণা কোরো না আমায়,
ফুরিয়ে যে যাবে!
জানো তো প্রিয়,
আমি চলে গেলে
ওই ঘৃণা ঠিক থেকে যাবে,
তার সাথেই থাকবো আমিও!
 
প্রিয়, ফুরালে ঘৃণা,
বাঁচবো আমি কেমন করে তোমার মাঝে?
সেদিনের জন্য ভালোবাসা নয়, ঘৃণাটুকু রাখো!
 
দশ।
এখন তো নয় ভোর আর,
সে পেরিয়েছে কাল সেই কতখানি আগে!
বলো, চাইলেই কি এখন
ভোরের শিশিরে
যায় তোমায় ভেজানো?
মধ্যরাত্রির
নেশামাখা সুরে
বাঁধবো তোমায়,
সে উপায় কী, বলো?
 
জানি,
একএক করে ফুরোবে সবই,
শুধু একা থেকে যাবো আমি!
 
এগারো।
যদি তুমি আসো ফিরে
সেই চেনা প্রথম নীড়ে
অনামিকা রেখে খালি,
যত চোরাবালি
সঁপে বিষাদের ক্ষণে,
শুধু জেনে রেখো,
এ সময় আমি চাইনি তো মনে।
 
ভুলে গেছি আজ ব্যথা যত,
ভুলে আছি ভাল, খুবভালমত,
নেই যে আর তোমাকেই মনে।
 
আমি তোমার জন্য বিষ রেখেছি
বুকের ভেতর পুষে,
কতো ছলনায়, মধুর কথায়
সেই বিষ তোমায় পান করাবো,
এ-ই ছিল মনে।
 
হায়, সে বিষ তোমায় পান করাতে
একদিন আমিই হলাম অমৃতধারা!
বুঝিনি আজো,
সে নীল তুমি
কোন জাদুর ছোঁয়ায়
সুধা করে নিলে!
 
বারো।
যুদ্ধ করে কী আর হবে?
চুপই তো রয়েছি, হয়ে গেছি কবেই!
আর কতোটা চুপ হতে বল?
দূরেই যে আছি--
বহুবহু দূরে!
আর কতটা দূরে সরতে বল?
 
অনুভূতির বাইরে তো আছি,
একেবারে শেষ সীমানার প্রান্ত ঘেঁষে,
তবু বলো, কেনো প্রমাণ কর ভুল আমারই?
যে ভুল আমি নিয়েছি মেনেই,
সে ভুলও কেনো সামনে আনো?
 
যে গাড়ি ছুটে যায় জোরে,
তার সাথেও স্থির হাওয়ার
একটা সম্পর্ক থাকে--
হয়তো ক্ষণিকের,
তবুও তো থাকে!
 
চলেই যে যাই,
চলেই যেতে হয়,
চলেই তো যাবো!
(দৃশ্যত)
তবুও কেন
চলে যাবার আগেই
অমন করে
চলে যেতে
বাধ্য কর, বলো?
(অদৃশ্যত)
 
যা নেই কিছুতেই,
তা কতভাবে
আরো ‘নেই’ হতে পারে,
বলতে পারো?
 
তেরো।
শরৎবাবু হারিয়ে গেছেন।
আমি কাকে গল্প লিখতে বলবো, বলো?
একটি আটপৌরে সাধারণ মেয়ের গল্প
অসাধারণ ভঙ্গিতে?
এক শোষিত নারীর গল্প,
পরিশেষ কি ক্ষমার হবে, নাকি অসীম শৌর্যের?
 
সে যা-ই হোক....
আমায় তুমি ভালোবাসোনি,
তবু একটি গল্প লিখো!
কালি নয়, এক কাজলের কালো দাগ দিয়ে,
গোলাপ নয়, একটি ঝরাশিউলি নিয়ে।
 
কিংবা তোমার গল্পে রেখো
নষ্টা কোনো বঙ্গললনা,
যে ভ্রষ্টা হয়েছে;
তাকে যে ভ্রষ্টা করেছে,
সে কখনো ভ্রষ্ট হয়নি!
 
আমায় পাবে সে মেয়ের মধ্যে,
কিংবা আমাকেই রেখো।
তবু লিখবে না?
তোমার কলম কি তবে বসলো বেঁকেই?
নাকি তুমি সেই পুরুষমানুষ
যে ভ্রষ্টা করে, নিজে ভ্রষ্ট হয় না?
 
জীবনেই কেবল আছে ভ্রষ্ট, অভিধানে নেই।