অমৃত নয়, প্রেম/ প্রথম পর্ব

এখন আগের সেই মনটা আর নেই, কাউকে নিয়ে কিছু বলার মতো মন। জানেনই তো, ঠিক এই বয়সে এসে মানুষের কত রকমের প্রেশার থাকে, জীবনটা রীতিমতো একশো আশি ডিগ্রি কোণে ঘুরে যায়! আগে অনেক কথা বলতাম, কিন্তু এখন বেশি বলতে গেলেই দম আটকে আসে। এটা একটা কারণ কথা না বলার। আমার রিলেশনটা আমাকে প্রায়ই অনেক নাড়া দেয়। তাই এটা নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে। আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখলাম, আমার যে কাহিনি, তা ঠিক নাইনটি পার্সেন্টই মিলে যায় অনেকের ক্ষেত্রে। তাই প্রয়োজনটা বেশি অনুভব করছি বলার। আমার যা ঠকার, তা তো ঠকেছিই, কিন্তু অন্যরা যেন সাবধান হতে পারে, তাই এত করে বলতে চাওয়া।


যে গল্পটা আপনারা এই মুহূর্তে পড়ছেন, সেটা একদিনে লিখতে পারিনি। রোজার মাস। অনেক ইবাদত রয়েছে। আমি কয়েক দিনে একটু একটু করে লিখেছি। চেষ্টা করেছি পুরো বিষয়টা বলার। দুই-একদিনে লিখলে অনেক কিছুই মনে থাকত না। আর আমি যত এইসব নিয়ে ভাবি, তত আমার শ্বাসকষ্ট বাড়ে, আমি একবারে বললে আমার প্রবলেম হতো। এখন আমি তো ইনহেলারও নিতে পারব না, সারা দিনে। তাই গল্পটা লিখে শেষ করতে কয়েকদিন সময় লেগেছে। ওদিকে চাকরির পড়াও পড়ি তো, তাই।


এটা লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে নিজেকে কেমন জানি ছোটো ছোটো লাগছে। ভাবছি, আপনারা আমার কাহিনি পড়ে আমাকে কত বোকা বোকা ভাববেন, আবার আর-একটা ব্যাপার মাথায় আসছে, তা হলো, নিজেকে নীচ মনের মানুষ মনে হচ্ছে। এত লজ্জা, ঘৃণা লাগে নিজের উপর যে কী আর বলব। কিছুই ভালো লাগে না। গল্পটা লিখতামও না। কিন্তু আজ অনেক মাস ধরে খেয়াল করছি, একই ঘটনা প্রায় সবার সাথেই ঘটছে। এমন একটা ব্যাপার দাঁড়িয়েছে যেন সবারই একধরনের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। তাই অনেককে সতর্ক করতেই গল্পটা বলতে চেয়েছি। বোঝাতে চেয়েছি, মানুষ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে!


আমার প্রথম প্রেমটা আসলে কোনও প্রেমই ছিল না। এটা জানতে ও বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। বস্তুত, আমার সম্পর্কটা ভাঙার প্রায় চার বছর পর আমি তা প্রথম বুঝতে পারি। আর আমার সম্পর্কটা ছিল সাড়ে তিন বছরের। এখন তো একটু বড়ো হয়েছি। আমি অনেক আদুরে ছিলাম। আমার গায়ে কখনও আমার বাবা-মা একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেননি। এমনকি, আমি ঘরের সব কাজই পারা সত্ত্বেও আমাকে কখনও কাজ শেখার পর কাজ করতে দেওয়া হয়নি। হাত কেটে যাবে, হাত নষ্ট হয়ে যাবে, আমি ব্যথা পেতে পারি, আমার ঠান্ডা লাগতে পারে, এইসব ভেবে। মানে, এতটাই আদরে বড়ো করা হতো আমাকে! আর আমি যেহেতু বাইরের কারও সাথে মেশার তেমন একটা সুযোগ পেতাম না, তাই মাথামোটা হওয়াটা আমার জন্য অনেক সহজ ছিল। আমি ছিলাম মাথামোটা গোছের প্রাণী।


তো যা-ই হোক, আসলে ওটা কোনও সম্পর্কই ছিল না। ওটা ছিল আমার নিজের পক্ষ থেকে একপাক্ষিক ভালোবাসা। একধরনের বোকা বোকা ভালোবাসা বলতে পারেন। যতদিনই যা-ই ছিল, তা ছিল আমি টেনে নিচ্ছিলাম, তাই। তার নিজের কোনও দায় ছিল না এখানে।


মজার ব্যাপার, প্রথম প্রথম তাকে আমিই সহ্য করতে পারতাম না। কেন, তা জানি না। আমরা ছিলাম ক্লাসমেট। একসাথে কলেজে পড়তাম। ওকে দেখলে আমার বেয়াদব ধরনের ছেলে মনে হতো। এর একটা কারণ আছে। একদিন আমি আর আমার বান্ধবী অফপিরিয়ডে একটা বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম। সেটা যে ওর বেঞ্চ ছিল, তা জানতাম না। ও তখন ক্লাসে ছিল না। বোধহয় বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কী করছিল জানি না। আমি গার্লস স্কুলে পড়তাম আর আমার বাসায় হোম-টিউটর ছিল, তাই বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না আমার। ফলে কোনও ছেলের সাথে মিশতে পারতাম না। কোন ছেলে কী, মেয়েফ্রেন্ড কী, এসব বুঝতাম না। ও আচ্ছা, ভালো কথা! বাসা থেকে আমার মেয়ে ক্লাসমেটদের সাথেই আমাকে ভালো করে মিশতে দিত না। আমি কখনও স্কুল থেকে ৫ মিনিট দেরি করে বাসায় ফিরলেও আম্মুর প্রেশার লো হয়ে রীতিমতো যায় যায় অবস্থা হয়ে যেত। আম্মু আমাকে ভীষণ চোখে চোখে রাখত। তাই আমিও কারও সাথে মিশতাম না।


তো, যা বলছিলাম আরকি, সেই ছেলে, মানে পরে যে আমার কেবল নামেমাত্র বয়ফ্রেন্ড হয়, সে ফিরে এল ক্লাসে। এসেই আমাকে আর ফ্রেন্ডকে কী যে ঝাড়ি মারল সবার সামনে! আমি ছিলাম অনেক লাজুক। কী লজ্জা! কী লজ্জা! ইচ্ছে করছিল, লজ্জায় মরে যাই। তবু ওকে কিছু বললাম না, কারণ আমি আমার ওই একটা বান্ধবী ছাড়া আর কোনও মেয়ের সাথেই কথা বলতাম না। মেয়েদের সাথে অবধি কথা বলতে আমার লজ্জা লাগত। এখন অবশ্য এইসব কথা ভাবলে আমার খুব হাসি পায়। ভাবি, কী বোকাটাই না ছিলাম আমি! যদিও আমি এখনও আহামরি কিছু চালাক হইনি, আমার গল্পটা পুরো শুনলে বুঝবেন।


তারপর আর-একদিন আমি আমাদের গ্রুপের দুই শাখা মিলে হাইয়েস্ট নম্বর পেয়েছিলাম কিছু সাবজেক্টে। যেখানে অনেক ভালো ভালো স্টুডেন্ট কম নম্বর পেয়েছিল, সেখানে আমি এত নম্বর পেলাম, তাই সবাই আড়চোখে দেখছিল আমাকে। কিন্তু ও-ই একমাত্র ছেলে ছিল যে কিনা, স্যার যখন বললেন আমার রেজাল্টের কথা, তখনও মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘বাব্বাহ্‌!’ শুনে আমার মেজাজটা যে কোন লেভেলের খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কী আর বলব! আমার তখন খুব রাগ ছিল। শুধু আমি ওর সাথে কথা বলি না বলে ওকে কিছুই বলিনি তখন। তখন থেকে আমার কাছে আমার কলেজের একমাত্র বেয়াদব ছেলে ছিল ও-ই। এর কিছুদিন পর কলেজ থেকে গ্রুপ গ্রুপ করে একটা কাজ করতে দিল। কাকতালীয়ভাবে ও আমার গ্রুপে পড়ে গেল। ধুউর কী একটা ঝামেলা! এর মানে, এখন ওর সাথে কথা না বললে আমার গ্রুপে কাজ হবে না, আর আমি নম্বর পাবো না। কিন্তু আমি তো ভালো রেজাল্ট করতে চাইতাম সব সময়।


বাধ্য হয়ে কাজ করতে গিয়ে কথা বললাম আমি। দেখলাম, যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা খারাপ কিন্তু ও না। গ্রুপে কাজ করতে গিয়ে কলেজে ওই যা কথা হতো। একদিন ও আমার ফোননম্বর চেয়েছিল। আমি তখন লোকজনকে ‘না’ কথাটি বলতে পারার মতো ক্ষমতা রাখতাম। কিন্তু পরে পরে আর পারতাম না। প্রেমে পড়লে নাকি লোকে বোকা হয়ে যায়। আমি এখন বুঝি, মাঝে মাঝে ‘না’ কথাটি বলতে পারা যে কী পরিমাণ জরুরি। যে লোকজনকে ‘না’ বলতে জানে না, তার চাইতে ঝামেলায় আর কেউ থাকে না। তো আমি ওকে যথারীতি ‘না’ বলে দিলাম। আর আমার ওই বান্ধবী বাদে আর কারও কাছে আমার নম্বর ছিল না। কিন্তু ও আমার নম্বরটা পেতে ছিল মরিয়া, যা আমি পরে বুঝতে পারি। একদিন হঠাৎ ও দৌড়াতে দৌড়াতে এল, আর বলল যে ওর বাসায় খুব প্রবলেম হয়েছে, ওকে বাসা থেকে কল করেছে, কিন্তু ওর মোবাইলে ব্যালেন্স নেই, তাই ও ব্যাক করতে পারছে না। আমি যদি একটু আমার ফোনটা দিতাম!


ও খুব হাঁপাচ্ছিল। ফ্যামিলির ব্যাপার, তাই আমার দেখে মায়া হলো, আমি আমার ফোনটা ওকে দিলাম। কিন্তু আমি তখন এতটাই বোকা ছিলাম যে, আমার এটা মাথায় আসেনি, ক্লাসে ওর এত ফ্রেন্ড থাকতে আমার কাছেই কেন ও এল? অনেক বেশি বোকা ছিলাম কিনা আমি, তাই বুঝিনি ওর চালটা। ফোনটা পাওয়ার পর, ও একটা নম্বর ডায়াল করল, এরপর কানে ধরল, তারপর হাসতে হাসতে আমার ফোন ফেরত দিল। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’ ও বলল, ‘ইউরেকা ইউরেকা, পেয়ে গেছি আমি!’ আমি তখনও বুঝিনি, ও পেলটা কী ঘোড়ার ডিম! আমি বললাম, ‘আরে, কী পেয়েছ বলবে তো!’ ও আমার থেকে একটু দূরে গেল আর বলল, ‘তোমার নম্বর পেয়ে গেছি।’ আমি জোরে বললাম, ‘হোয়াট!!’ তারপর ওর পেছনে দৌড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম মাত্র। ও তো আমাকে ছেড়ে কত দূরে চলে গেল। আর ছেলেমানুষের সাথে দৌড়ে অত পারাও যায় না।


তো আর কী! সেদিনের মতো বাসায় এলাম। আমি বাসায় ফেরার পর দেখলাম, আমার ফোনে একটা মেসেজ এল। তখন তো আর ফেইসবুকের এত প্রচলন ছিল না। তখন ছিল, বাংলালিংকে এসএমএস-বান্ডেল কিনে কথা-বলার ট্রেন্ড। আমার সব সময় এসএমএস কেনাই থাকত, কারণ আমি আমার বান্ধবীদের সাথে কথা বলতাম অল্প টাকায়। তো আমি মেসেজটা দেখলাম। ও খুব সুন্দর একটা প্রেমের কবিতা লিখেছে, আর নিচে ওর নাম দিয়েছে। আমি ওর নম্বর জানতাম না। নিচে ওর নাম দেওয়াতে আমি জানলাম যে এটা ওর নম্বর। কিন্তু আমি কিছুই বললাম না, আসলে তখন…কবিতাটা আমার ভালোই লেগেছিল। এখানে বলে রাখি, গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি কবি কবি গোছের হয়, আমি খেয়াল করেছি। কিন্তু ওই বয়সে আমাদের শহরের ছেলেমেয়েরা তো নিজেদের পানিটাও ঢেলে খেতে জানে না, কবি হবে কী করে? আমি যেহেতু গল্প আর কবিতা পড়তে দারুণ ভালোবাসতাম, সেহেতু ওর কবিতা আমার খুবই ভালো লেগেছিল। আরও তার উপর ছিল উঠতি বয়স। খারাপ লাগার তো কথাই নেই। কিন্তু এখন টের পাই, ও আসলে সবই ফেইসবুক থেকে ঝেড়েছিল। জাস্ট কপি আর পেস্ট! ফেইসবুক নামে কিছু যে আছে, তখন তা-ই জানতাম না, আর ও নিজেই একটা আইডি চালাত। গ্রামের যে ছেলেরা চালু হয়, ওরা একটু বেশিই চালু হয়!


সেইদিন গুনে গুনে ও আমাকে ১৪টা মেসেজ পাঠাল, আর সবই ছিল প্রেমের। সিম-টু-সিম মেসেজ পাঠালে, অপর পাশের মানুষ পড়ছে কি না, তা তো আর ফেইসবুকের মতো বোঝা যায় না, তাই ও বুঝল না আমি পড়েছি কি পড়িনি। ও আমাকে আরও লিখল, আমি কেমন আছি, কী করছি, খেয়েছি কি না। আমি একটারও জবাব দিইনি। মনে মনে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিকই উপভোগ করতে লাগলাম। আবার সে জিজ্ঞেস করতে লাগল যে কেন উত্তর দিচ্ছি না। আমি তা-ও কিছু বললাম না। পরের দিন কলেজে গেলে ও জিজ্ঞেস করল, কেন আমি উত্তর দিই না। আমি অনেকখানি ভাব নিয়ে বললাম যে, ‘আমি সবার এসএমএস-এর উত্তর দিই না।’ তারপর আমি ক্যানটিনে চলে গেলাম খেতে। কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা। আমাকে মেসেজ পাঠিয়েই যায় পাঠিয়েই যায়।


আমি কথা বলতে পছন্দ করতাম খুব। ওই বয়সে যেটা আমাদের সবারই হয়, বাবা-মায়ের সাথে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। বাবা-মা যেটা বলে, ঠিক ওটা বাদে পৃথিবীতে সব কথাই ঠিক, শুধু ওদের কথাই ভুল, এমন একটা ধারণার জন্ম নেয়। আমি একটু চুপচাপ ছিলাম, কিন্তু কাউকে পেলে কথা বলেই যেতাম, বলেই যেতাম। খাওয়া নাই, ঘুম নেই, শুধু কথা আর কথা, এসবই আমার হতো। মা জানতেন আমি কেমন, তাই আমাকে নিষেধ করেছিলেন যে ফোন যেন আমি বেশি না ঘাঁটি। ও আচ্ছা, এখানে বলে রাখি, পৃথিবীতে এমন কোনও ছেলে বা মেয়ে আছে কি না আমি জানি না, যে কিনা একটা ফোন পাওয়ার জন্য বাবা-মায়ের কাছে কখনও ঘ্যানঘ্যান করেনি। আমার বড়ো ভাইও তা করেছিল। কিন্তু আমি ঘ্যানঘ্যান করা ছাড়াই পেয়েছিলাম ফোন, তা-ও আবার ওই বয়সে! আমার বয়স তখনও আঠারো হয়নি। তো যা-ই হোক, বয়সটা ছিল এমন যে গুরুজন যেটাতে মানা করবেন, ঠিক ওটাই বেশি বেশি করতে হবে। আর আমি এমন বেয়াড়া ধরনের একটু বেশিই ছিলাম। ভাবতাম, ইস্‌! সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া, কারও সাথে মেশার অনুমতি নেই, আবার ফোনও ঘাঁটব না। তো বাঁচব কী করে! আমি শুনতাম না কারও কথা। যেইদিন আমি এই কথা ভেবেছিলাম, আমি এখন মনে করি যে আমার জীবনের পতনের বীজ ঠিক সেইদিনই বপন করা হয়ে গেছে। আর বাবা-মা’ও আমাকে তেমন একটা বকতেন না কিংবা কোনও কাজে বাধাও দিতেন না। এটাই আমার সর্বনাশটা করেছিল। ঠিক সময়ে সন্তানকে শাসনে না রাখলে পরবর্তীতে বাবা-মা’ও সাফার করে, সন্তানও সাফার করে।


যা-ই হোক, ওর সেই রোমান্টিক রোমান্টিক কথা আমার মধ্যে দোলা দিতে লাগল, আর আমি দুলতেই লাগলাম। আমিও টুকটাক ওর মেসেজের উত্তর দিতে শুরু করলাম। আর ওই কাব্যিক কথা, কবিতা আমার ভালোই লাগত। ধীরে ধীরে আমাদের ফোনে কথা শুরু হলো। আমরা কলেজে কোনও কথাই বলতাম না। ওটা ওর নিষেধ ছিল। কারণটা ছিল এই যে, ও যখন গ্রামে থাকত, তখন ও একটা মেয়েকে পছন্দ করত, আর সেটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল তখন। আর কলেজে এসে আর-একটা মেয়ে ওকে প্রপোজ করেছিল, সেটা নিয়েও ঝামেলা হয়েছিল। অবশ্য, এই কাহিনি আমি জানতাম না। কারণ, আমার কাজ তখন একটাই ছিল---কলেজে যাও, রোল প্রেজেন্ট দিয়ে ক্লাস পালাও। আমি ক্যানটিনে গিয়ে খাই, আর লাইব্রেরিতে গিয়ে আড্ডা দিই। তা-ও কলেজে একটাই বান্ধবী ছিল আমার। কারণ আমি বেশি লোকের সাথে মিশতে পছন্দ করতাম না। আর যার সাথে মিশব, তার সাথে অনেক অনেক কথা বলব, এইরকমই ছিলাম আমি।


ওর কথায় ফিরে আসি। একটা ব্যাপার ছিল, আর সেটা হলো, ও কিন্তু মেয়েদের সাথে মিশত, এমনকি আমার বান্ধবীর সাথেও, অথচ আমার সাথে কলেজে কোনও কথা নাই। যত কথা ছিল, সে ছিল বাসায় ফিরলে। কত কত যে কথা! একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কেন কলেজে আমার সাথে কথা বলো না?’ ও আমাকে বলেছিল, ‘তুমি অন্য সব মেয়ের চাইতে স্পেশাল আমার কাছে, তাই বলি না।’ মানে, ও যে আমাকে পছন্দ করে, সেটাই বোঝাল। এমনকি নানান মেসেজের মাধ্যমে ও আমাকে এটা বলত। কিন্তু আমার তখনকার মোটামাথায় ওর কূটচাল ঢুকত না। হঠাৎ একদিন ও নিজেকে নিয়ে আমাকে অনেক কথা বলে। ওদের অবস্থা, ওর চিন্তাভাবনা।


আমি সেইদিন জানতে পারি যে, ওরা অনেক গরিব। ওদের জমি আছে ভালোই, সেইখান থেকে ফসল, ফল সবই আসে কিন্তু সেটা দিয়ে সারামাস চলে না। ওদের মাসিক কোনও আয় নাই। ওর বাবা পরের জমিতে বর্গা চাষ করে, সে কাজটাও সব সময় থাকে না। যখন ওদের ঘরে ফসল বা ফল আসে, তখন চলে আরকি কোনও রকমে। কিন্তু মাসের আর বাকি দিনগুলি খুব কষ্টে চলে। এই বাড়ির উঠানে কিছু সবজি, পুকুর থেকে মাঝেসাঝে কিছু মাছ, বাগান থেকে তুলা, এই আরকি। তবে ওদের এমন হওয়ার কথা ছিল না। ওর বাবা অনেক জমি বিক্রি করে বা ধারদেনা করে ওর চাচা, ফুফুকে পড়িয়েছে। চাচা-ফুফুরা এখন খুব ভালো পজিশনে আছে, কিন্তু ওদের দেখে না। আর সেই ঋণের ভার বইতে হচ্ছে ওর বাবাকে এখনও (মানে তখনও)। আর ওর পড়ার খরচ চালায় ওর আপুরা। তা-ও কীভাবে? টিউশন করে, নিজেরা খেয়ে, না খেয়ে এইভাবে। ও নিজেও অনেক সময় না খেয়ে থাকে। ওর কষ্ট হলেও ও বলে না কাউকে।


আমি শুধু শুনছিলাম, আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি নিজে এত গরিব না। আবার বড়োলোকও না। আমার বাবা যথেষ্ট হ্যান্ডসাম স্যালারি পান, যা দিয়ে আমাদের চোখ বন্ধ করে চলে যায়। আমি নিজে কখনও অভাব দেখিনি। আসলে আমাকে কখনও কিছু বুঝতে দেয়নি পরিবার থেকে, আমি একটা মেয়ে বলে। এখানে বলে রাখি, আমার বড়ো ভাই যখন হয়েছিল, তখন আমার বাবা-মা কেউই খুশি ছিলেন না, তাঁরা চেয়েছিলেন একটা মেয়ে। তারপর যখন আমি হলাম, তখন তাঁরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তাই আমি তাঁদের দুইজনেরই জান প্রাণ, যা-ই বলি না কেন। আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন ভাবতাম, আমাকে তাঁরা ভালোবাসেন না। কিন্তু আমি যে তাঁদের কাছে কী, কিংবা তাঁরা যে আমার জন্য কতখানি, সেটা তো এই ধাক্কা না খেলে জানতামই না। আমি আমার পরিবারে আর্থিক অভাববোধটা করিনি কখনওই, তবে আমার বাবা বলতেন, তিনি অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। আমার দাদা বেঁচে ছিলেন না। বড়ো ভাই-বোনরা বাবাকে দেখতেন না। খেয়ে, না খেয়ে আজ তিনি এখানে।


হ্যাঁ, আমার বাবা অনেক বড়ো অফিসার না। কিন্তু আমার জীবনে আমার বাবা কোনও বড়ো অফিসারের চেয়ে কম কেউ না। একটা অজপাড়া গাঁ থেকে এসে তিনি মানুষ হয়েছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। পাশে কখনও কাউকে পাননি, নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, চাকরিজীবনে একটি পয়সাও হারাম উপার্জন করেননি, রক্ত পানি করা টাকা একটু একটু করে জমিয়ে বাড়ি করেছেন। তিনি আমার কাছে পৃথিবীর সেরা আদর্শ পুরুষ। সবার কাছেই তো তার নিজের সবার বাবা বেস্ট, অন্তত প্রত্যেক মেয়ের কাছে তো বটেই! কিন্তু আমার কাছে আমার বাবা একটু বেশিই সেরা! এমন পরিস্থিতি আমার ক্ষেত্রে এলে কবেই যে স্রোতে ভেসে যেতাম, তার নেই ঠিক, কিন্তু তিনি ভেসে যাননি। মাথা উঁচু করেই বেঁচে আছেন আজও। বাবা-মা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন, এখনও বাসেন। কিন্তু তখন ভালোবাসা বোঝার মতো বোধ আমার ছিল না। কারণ অনেক বেশি আদরের ছিলাম, তাই বোধ কম ছিল। আদর বেশি পেলে মানুষ নির্বোধ হয়ে বেড়ে ওঠে। তার উপর সে যদি থাকে সারাদিনই ঘরকুনো, তাহলে তো আর কথাই নাই, রীতিমতো মাথামোটা হয়েই তৈরি হয় সে, যেটা ছিলাম আমি। বাবার কথা এত বলার কারণ আমার প্রাক্তন জাহিদির সাথে বাবার খুব মিল পেলাম। আমার বাবার মতো সেও কষ্ট করে পড়ছে। আবার বাবার মতো সেও খুব কেয়ারিং। মনে হচ্ছিল, ওহ্‌, একদম পারফেক্ট ম্যাচিং আমার জন্য! ওর মুখে ওর নিজের জীবনের গল্প শুনে আমার ওর প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। ভালোবাসা না কিন্তু! কেবলই শ্রদ্ধা বাড়ছিল ক্রমেই…


তার পরে আর মনে হয় দুই-তিন দিন রোমান্টিক কবিতা পাঠিয়েছিল, আর পাঠায়নি। কিন্তু আমাদের কথা বাড়তে লাগল। আমরা দুজন দুজনকে নিয়ে আরও বেশি জানতে লাগলাম। ও হ্যাঁ, আমার বাবা-মায়ের পরে যদি আমার কেউ বেশি কেয়ার করত, তবে সে মানুষটা ও-ই ছিল। আমি ঠিক এরকম করেই ভাবতাম, যা ছিল আমার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যেই জিনিসটা নিয়ে সে বেশি বলত, তা হলো, আমার যে পেটে অনেক বেশি সমস্যা ছিল, আমি খেতে পারতাম না কিছু, তা নিয়ে। আমি আমার জীবনের ২১টা বছর কী পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি খাওয়া নিয়ে, তা বলার বাইরে। তিনবেলা ভাত হালকা তরকারি আর মাছ দিয়ে ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে খেয়েছি তো, সাথে সাথেই বমি করে দিয়েছি। কখনও যদি ফ্রেন্ডের চাপে পরে কিছু খেতাম বা নিজের ইচ্ছায় কিছু খেতাম, তখন আমাকে আর পার কে! হড়হড় করে বমি আর বমি! কী যে কষ্টের দিন ছিল সেগুলি!


তো যা-ই হোক, আমাকে সে এটা সেটা ট্রাই করতে বলত, যাতে আমার প্রবলেম দূর হয়ে যায়। আমার একটা স্বভাব ছিল, পেটের সমস্যার জন্য যে যা বলত, আমি তা-ই খেতাম। শুধু তিনবেলা ভাত বাদে আর কিছু খেতাম না বলে আমি চিকন ছিলাম অনেক। সে আমাকে পেটের সমস্যা নিয়ে অনেক কথা বলত। আমি এত বেশি চিকন, সেটা নিয়েও বলত। আমাকে কেউ চিকন বললে আমার খুব বেশি লজ্জা লাগত। মনে হতো, এটা যেন আমার একটা অপরাধ! আমি নিজে আল্লাহর কাছে থেকে চেয়ে চেয়ে এনেছি এই অপরাধ! লোকের একটা স্বভাব আছে, নিজের বাড়ির খবর না রেখে পরের বাড়ি নিয়ে পড়ে-থাকা। তবে অনেক ছোটো মনের মানুষরা, মানে ছোটোলোকরা এইসব করে বলে আমি মনে করি। আমি চিকন, এটা নিয়ে হেসে হেসে খোঁটা দেয়নি, এমন লোক পাওয়া খুবই কঠিন ছিল। কী ভয়ানক লজ্জা আমি পেতাম তখন, তা আমি এখন ভাবতেও পারি না! কিন্তু মোটা হওয়ার কোনও উপায়ই আমি পেতাম না। তখনও আমি জানতাম না যে আমি হাইপারথাইরয়েডের রোগী। এরা পৃথিবীটাকে গিলে খেলেও এই জীবনে কখনও মোটা হবে না। এই ব্যাপারগুলি নিয়ে, দিন যদি ছিল ২৪ ঘণ্টার, তো আমি ২৫ ঘণ্টাই আপসেট থাকতাম।


সে আমাকে অনেক বেশি বোঝাত। তা দেখে আমার তো আরও বেশি মুগ্ধতা বাড়তে লাগল। মানুষ তার নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে যখন সংকুচিত অবস্থায় থাকে, তখন সেটা নিয়ে যদি কেউ তাকে ইতিবাচকভাবে বোঝায়, তবে তাকে সে খুব সহজেই আপন করে নেয়। আমি মোটা হতে ওষুধ পর্যন্ত খেয়েছি, কিন্তু তখনও পারছিলাম না মোটা হতে। এইদিকে ছোটোলোকগুলি বাবা-মাকে, আমাকে অনেক শোনাত। কেন আমি এমন, কেন আমি মোটা হই না, এরকম আরও অনেক কিছু। বাবা-মা এসব শুনে মন খারাপ করতেন। আমি তাঁদের ভালোবাসা বুঝতে না পারলেও তাঁদের আমি তখন অসম্ভব রকমের ভালোবাসতাম, যা আজও বাসি। যা-ই হোক, সে আমাকে এইসব নিয়ে বোঝাতে লাগল আর আমাদের কথার পরিমাণ দিন দিন বাড়তে লাগল। আমি ক্রমেই ওর উপর নির্ভরশীল হতে লাগলাম। তখন আবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড (যাকে আমি জানতাম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে, কিন্তু আসলে সে বেস্ট ফ্রেন্ড তো দূরে থাক, ফ্রেন্ড হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না, এখন বুঝি!)-এর সাথে একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে ফ্রেন্ডশিপ শেষ হয়ে গেল। আমার বোন ছিল না, তাই আমার সেই ফ্রেন্ডই ছিল আমার সবকিছু। ও চলে যাওয়ায় আমি খুব বেশি ভেঙে পড়ি ও একা হয়ে যাই।


কারও চলে-যাওয়া ব্যাপারটা আমি মানতেই পারি না। এখন বুঝি, আমি লোককে যতটা সহজ করে নিই, ওরা অতটা সহজ করে নেয় না আমাকে। এটা কি আমার, না তাদের দোষ, জানি না আমি। তবে আমি সবকিছুই নিজের দোষই ভাবি। অপরকে দোষ দেওয়ার মতো ছোটোলোক আমি না। আবার আমি বড়ো মানসিকতার কেউও না। মা আমাকে বলতেন, যখন কেউ তোমাকে একটা চড় মারে, তখন ধরে নিয়ো, তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু একটা করেছ, যে ভুলের কারণে তুমি নিজেকে চড়টা থেকে বাঁচানোর দূরত্বে সরিয়ে নিতে পারোনি। তো যা-ই হোক, তখন সব মিলিয়ে আমি খুব বিমর্ষ হয়ে ছিলাম। আর সে আমাকে বিভিন্ন ভাবে মেনটাল সাপোর্ট দিত। দিন দিন আমার তার উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে লাগল আরও অনেক বেশি করে। আমি চট করে যে-কোনও বিষয়ে কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে যাই। খুবই বাজে এই অভ্যেসটা। অবশ্য, অনেক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এখন আর হই না। আসতে আসতে বুঝবেন এই ব্যাপারটা। এত কাহিনির মাঝে হঠাৎ একদিন দেখলাম, জাহিদির মন খারাপ।


আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মন খারাপ কেন?’ ও বাংলা সিনেমার কাহিনির মতো করে ওর সেই মুহূর্তের কষ্টগুলির কথা বলল। যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় যে, ওর ফাইনানশিয়াল প্রবলেম চলছে। আমার খুব খারাপ লাগল শুনে। আমি ভাবলাম, একটা মানুষ, যে কিনা এত কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, আর সেখানে আমি কী করছি? আমি তো না চাইতেই সব পাই। আসল কথা হলো যে, আমি পড়তে কিন্তু চাইতাম। তবে তখন শুধু কলেজে যাওয়া ছাড়া আমি বাইরে যেতে পারতাম না। কারও সাথে মিশতে পারতাম না। আবার আমার শারীরিক এত সমস্যার মাঝে আমি চাইলেও পড়ায় মন দিতে পারতাম না। কারণ আমি মাসের ৩০ দিনের মধ্যে ২৯ দিনই থাকতাম অসুস্থ। আমার শরীরের মাঝে কী পরিমাণ যন্ত্রণা যে সারাদিন হতো, তা আমি কাউকে বলতাম না, কাউকে বুঝতেও দিতাম না। এখনও দিই না। আমি খুব চাপা স্বভাবের ছিলাম। কিন্তু জীবনে একজনের সাথেই মন খুলে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলাম, যার সবই ছিল আমার একান্ত আবেগের কথা, আর সেখানেই আমি খেয়েছি ধরা!


আমার বাবাও কষ্ট করে পড়ালেখা করার কারণে আমি জাহিদির কষ্টটা যেন বেশি করে ফিল করতে পারতাম। আর আমি কারও কষ্টই দেখতে পারতাম না। তো ও একদিন আমার কাছে কিছু আর্থিক সাহায্য চাইল। আমি করলাম। এর মাঝে আমরা ফোনে বা মেসেজে দুজন দুজনকে চিনতে লাগলাম। আমার খুবই ভালো লাগত, কেননা কলেজে বাদে বাসায় আমার কথা বলার মতো কেউ ছিল না। আসলে এটা ছিল আমার আর একটা ভুল ধারণা। আমার বাবা-মা চাইতেন কিন্তু কথা বলতে। ওদিকে আমার মন ছিল উড়ু উড়ু, তাই আমিই উপেক্ষা করতাম তাঁদের, আর ভাবতাম, তাঁরা আমার সাথে কথা বলেন না। আসলে ওই বয়সে যত যা-ই থাকুক না কেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করেই। তো আমারও তা-ই করছিল। এর মাঝে আমি আমার হেলথ চেকআপটা করালাম। তখন ধরা পড়ল যে আমি থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছি। আর আমার অন্য কিছু সমস্যার জন্য আমাকে ডাক্তার আরও অনেক মেডিসিন দিলেন। আমার এক পরিচিত ফার্মেসি ছিল। সেই ফার্মেসির মালিক প্রেসক্রিপশন দেখে ভুলে অন্য কারও প্রেসক্রিপশনের সাথে গুলিয়ে আমাকে অন্য একটা ওষুধ দিলেন, যেটা কিনা প্রেশার কমায়। সেই ফার্মেসির আঙ্কেলটি আমাদের এত বেশি বিশ্বস্ত ছিলেন যে তিনি যেভাবে ওষুধের গায়ে লিখে দিতেন, যে কয়টা দিতেন, আমরাও ঠিক ওরকম করেই ওষুধ খেতাম, প্রেসক্রিপশনটা আর দেখতাম না।


তো তখনও তা-ই করলাম, আর আমার প্রেশার দিন দিন নিচে যেতে লাগল। আর ওই সময়, আমার নামে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’-এর সাথে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ফ্রেন্ডশিপ শেষ হয়ে যায়। আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আর ওষুধের রিঅ্যাকশনে একদিন হঠাৎ আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো। আস্তে আস্তে আমি সব জানলাম কেন আমার এমন হলো। তারপর আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম এক মাস। বিছানা থেকে নিজে ওঠার মতো আমার কোনও রকম ক্ষমতা আমার ছিল না। সব কিছু আম্মুই করে দিতেন। তো সামনে ছিল আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি ভাবতাম, ওহ্‌! সবাই-ই তো পড়ছে এক আমি বাদে। আমি এইবার পাস দূরে থাক, পুরো কলেজে সবচাইতে খারাপ রেজাল্টটাই করব। আমি আবার যে-কোনও কিছু অনেক বেশিই ভাবতাম। এত ভাবতাম যে মাথায় ব্যথা উঠে যেত। কিন্তু পরে দেখা যেত, তেমন কিছুই হয়নি। মনের বাঘটাই আমাকে খেয়ে সাবাড় করে দিত!


তো যা-ই হোক, আমি আবার ভাবলাম, জাহিদি এত ভালো স্টুডেন্ট (আমি ওরকমই ভাবতাম। আমার থেকে যারা হাফ-নম্বরও বেশি পেত, তাদের আমি ভালো ভাবতাম, আর অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম। তাদের সাথে মিশতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।), ওর সামনেই-বা মুখ দেখাব কী করে…এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে আমার খুব মাথাব্যথা হতো, আর আমি খুব বেশি আপসেট থাকতাম সারাক্ষণই। আর তখন জাহিদি আমাকে অনেক বেশিই মোটিভেট করত। আমি শুধুই অবাক হতাম। ছেলেটার বয়সই-বা কত? এই আমার মতোই তো, তার নিজের জীবনে এত প্রবলেম, কিন্তু সে-ই আমাকে মোটিভেট করে। আর সেখানে আমি কী না করছি! নিজেকে অনেক বেশি ছোটো লাগত। আর ওর প্রতি মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা দুটোই আমার দিন দিন বাড়তে বাড়তে পাহাড়সম হচ্ছিল।


ও আমাকে হঠাৎ একটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে যে, আমি যদি ওর থেকে বেশি নম্বর পাই তো ও আমাকে খাওয়াবে। আর ও আমার থেকে বেশি নম্বর পেলে আমি ওকে খাওয়াব। আমার বেশি নম্বর পাওয়ার ব্যাপারটা ছিল একদমই অসম্ভব। কারণ তখন পরীক্ষার বাকি ছিল মাত্র ২৫ দিন। আমি বইয়ের চেহারাও দেখি নাই, আর ও ছিল কিন্তু ভীষণ চালাক। যতই কথা বলত, আর যা-ই করত, পড়ত কিন্তু ঠিকই। আমি বললাম, এটা অসম্ভব। কিন্তু ও বলল, তোমার মনের জোর আনতে এটা পারতেই হবে। এদিকে আমি আবার চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতাম; জেদি ছিলাম কিনা, তাই। তো আমি ওর চ্যালেঞ্জটা নিলাম। খাওয়ানোর ভয়ে না, সবার সামনে মুখ রাখার জন্য। তখন কী পরিমাণ যে কষ্ট করেছিলাম একটু ভালো নম্বর পেতে! কারণ আমার কাছে অজানা ছিল যে ও ঠিক কত নম্বর পাবে। যে নম্বরটা যে কেউ হেসে খেলে পেতে পারত, আমার ঠিক সেই নম্বরটা পেতে অসম্ভব কষ্ট করতে হতো। কারণ, জোরে কথা বললেও আমি জোরে পড়তে পারতাম না। জোরে পড়লে আমার গলা ভেঙে যেত, টনসিল ফুলে যেত। আর টনসিল ফুলে গেলে আমার জ্বর আসত। আর জোরে না পড়লে আমি পড়া মনে রাখতে পারতাম না। ফলে পড়া মনে রাখতে গেলে আমার অনেক বেশি সময় ব্যয় হতো।


এতগুলি পড়া অত অল্প সময়ে শেষ করা আমার জন্য অনেক বেশিই কঠিন ছিল। আমি তা-ও অনেক চেষ্টা করলাম, পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট দিল। আমি এ গ্রেড পেয়ে মোটামুটি ভালো একটা জিপিএ নিয়ে পাস করলাম। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার ছিল, আমি জাহিদির চাইতে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। সেইদিন আমার খুশি ছিল দেখার মতো। আমি জিতে গেলাম। তবে চ্যালেঞ্জের শর্ত ভেঙে আমিই ওকে খাইয়েছিলাম। কারণ ওর তো ফাইনানশিয়াল প্রবলেম ছিল। আর আমি কারও উপর চাপ দিতে পারি না কখনও। পরীক্ষা শেষে একদিন হঠাৎ জাহিদি আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি তো অবাক। তখনও আমি ওকে ভালো স্টুডেন্ট ভাবতাম। ভাবলাম, এত ভালো স্টুডেন্ট আমাকে প্রপোজ করছে! তা-ও আমি ভাবতে সময় নিলাম এক মাস। ‘আমাকে কেন ভালো লাগে?’ এটা আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে ও আমাকে বলেছিল, আমার হাতের লেখা সুন্দর, আমার ভয়েস সুন্দর, আমি কথা বলি সুন্দর করে, কথায় আঞ্চলিকতা নেই। আমি এমন একটা রেজাল্ট করলাম এত বাধার মাঝেও, মানে আমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা আমি প্রকাশ করতে পারি না।


অবশ্য আমি নিজে এইগুলি কি না আমি নিজেই জানি না। কিন্তু ও এত ভালো করে বলত যে ওর কথাই আমার ভালো লাগত। ওই বয়সটাই তো ছিল একটা ছেলের মিষ্টি মিষ্টি কথায় পটে ছারখার হয়ে যাওয়ার বয়স! তবে ভাবতে সময় নেওয়ার কারণ ছিল, ও বলত, ওর ফ্যামিলিতে সেইম ইয়ার রিলেশনশিপ মানবে না, এর আগে ওর ফ্যামিলিতে যত সেইম ইয়ার বিয়ে বা প্রেমের বিয়ে হয়েছে, তার একটাও ভালো অবস্থায় নেই। ওর ভাষায়, কিন্তু আমি এত ভালো যে ওর বিশ্বাস, আমি সবই ঠিক করে দেবো একদিন। সবার সব ভুল ধারণা ভেঙে দেবো। এদিকে আমি এমন একজনকে চাইতাম যে বড়োলোক নয়। আমাদের খুব ছোটো একটা সংসার হবে। সেখানে কোনও বিলাসিতা থাকবে না। সে আমাকে অনেক ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করত, তাই আমি অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হয়ে গেলাম। আর আমাদের প্রেমের যাত্রা শুরু হলো।


প্রেমে এ পড়লে মানুষ চেইঞ্জড হয় জানতাম। কিছু মাস ভালোই ছিল। আর এর মাঝে মাঝে ওর যত রকমের ফাইনানশিয়াল হেল্প লাগত, আমি করতাম। কারণ আমি চাইতাম, ও অনেক বড়ো হোক। ফাইনানশিয়াল হেল্প বলতে যা বোঝাচ্ছি, সেটা হলো…ওর মেসে খালা আসেনি, আমি খাবার কিনে দিতাম; ওর প্র্যাক্টিকালের জন্য যা যা দরকার, আমি দিতাম; মাঝে মাঝে ওর ফোনের বিল দিতাম; ড্রেস কিনে দিতাম; বইপত্র কিনে দিতাম…এরকম আরও অনেক কিছুই। ও চাইত, আমি রান্না শিখি। বাবা-মার আদরের মেয়ে হওয়াতে আমি কখনও রান্না করিনি। কিন্তু ওর জন্যই তা শিখেছিলাম, আর ওকে খাইয়েওছিলাম। আমাদের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠা ছিল, সেইগুলি অবধি বানিয়ে খাইয়েছিলাম। আমাদের কলেজে কথা হতো না। যা হতো, সবই ফোনে। শুধু খাবার আর যে-কোনও কিছু দেওয়ার বেলায় ক্লাস শেষে দিতাম। খাবারগুলি যেন নষ্ট না হয়, তার জন্য অনেক চেষ্টা করতাম। যা-ই হোক, এইভাবে আমরা এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। আমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশি বাধত, আর সেটা হলো, ও প্রেম করার পর থেকেই বেশি বেশি বলত যে আমি অনেক বেশি চিকন। আরও বলত, আমি লোকের সাথে মিশি না। আমি তাকে কী করে বোঝাই যে, আমি যা-ই খাই না কেন, আমি কখনও মোটা হবো না। আর তখন লোকের সাথে মিশতে আমার ভালো লাগত না। সবাই তো আর একসময়ে ম্যাচিউরড হয় না, সেটা সে বুঝত না।


অথচ, প্রেম করার আগে ঠিক এই বিষয়গুলিই তার ভালো লাগত। প্রেম করার আগে বিপরীত পাশের মানুষের যা যা ভালো লাগে, তা তা যদি প্রেম করার পর উড়ে যায়, তবে সেটা কখনওই প্রেম না, এটা বোঝার মতো বয়স আমার ছিল না। আর তখন থাকারও কথা না। আমি একে তো আদুরে দুলালি, বয়সও কম, আর তার উপর প্রেমে অন্ধ। আর-একটা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে লাগত, সেটা হলো, ও চাইত, আমি জব করি। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, আমি তখন, কাজ করতে পারব কখনও, এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না, বাস্তবে তো নয়ই। এ নিয়ে ও যখন আমাকে বলত, তখন আমার খুব লজ্জা লাগত, আর রাগ হতো। আর এটা নিয়ে ঝগড়াও হতো। আবার ও নিজেই মিটিয়ে নিত ব্যাপারটা। কারণটা আমি এখন বুঝি। আসলে তখন আমাকে ওর অনেক বেশিই প্রয়োজন ছিল। এর বাইরে যা ছিল, তা হলো, আমরা অনেক বেশি স্বপ্ন দেখতাম আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ওই বয়সে এইসব দেখতে ভালোই লাগত। চোখে লাল নীল স্বপ্ন আমার। আহা! কী এক শান্তির জীবন ওটা!


এইদিকে আমি প্রেমে পড়ার পর পড়াশোনা আমাকে রেখে তালগাছে চড়ে বসে আছে। ওদিকে ও কিন্তু ঠিকই পড়ে। আস্তে আস্তে আমার কলেজের রেজাল্ট খারাপ হতে থাকল। আমি অনেক ভালো স্টুডেন্ট না হলেও এত খারাপও ছিলাম না। বাসার হোম-টিউটর, বাবা-মা সবাই বকা দিতে লাগল। সবাই মিলে খুঁজে পেল যে, আমার খারাপ রেজাল্ট করার একটাই কারণ, আর সেটা হলো মোবাইল। কারণ আমি তখন সারাদিনই মোবাইল টিপতাম। তো এটা নিয়ে তারা আমাকে অনেক বকাঝকা করতেন। আর আমি দিন দিন তাদের সাথে আরও বেশি খারাপ ব্যবহার করতাম। আমাদের বাসার সব থেকে পারফেক্ট দরজা ছিল আমার রুমের দরজা। এক-একবার রেগে রেগে জোরে লাথি মেরে আটকাতে আটকাতে ওই দরজাটাকে আমি ইমপারফেক্ট বানিয়ে ফেলেছিলাম। আর বাবা-মাকে বেশিই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতাম না খেয়ে খেয়ে। তারা সেটা সহ্য করতে পারতেন না। তাই আর কিছু বলতেন না। এখন মনে হয়, ওঁরা আমাকে ভয় পাওয়ার কারণেই আমার ক্ষতিটা হয়েছে।


এখানে বলে রাখি, আমার প্রেমের সে কয়টা বছর আমি বাবা-মার সাথে এত বেশি খারাপ ব্যবহার করেছিলাম যে, তাঁরা যদি আমাকে মাফ না করতেন, তবে আমি নিশ্চিতভাবেই মরে যেতাম! কিংবা বেঁচেও যদি থাকতাম, ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতাম। আমি এখন ভাবতেও পারি না, কতটা বেশি অন্যায় আচরণ আমি সেসময় তাঁদের সাথে করেছিলাম, তা-ও জাহিদির মতো একটা ছেলের জন্য! কিন্তু মা-বাবা তো আসলে এমনই! সন্তানের খুনও মাফ করেন। আমার তখন মনে হতো, আমি যা-ই করছি, তার সবই ঠিক, আর বাবা-মা যা বলছে, তার সবই ভুল। তো সেইসব দিনের জন্য আমার আজও অনেক বেশিই খারাপ লাগে, যদিও এখন আমি আর তাদের সাথে একটু জোরেও কথা বলি না। আসলে কিছু বোঝার জন্য হলেও একটা বয়স দরকার। কারও সে বয়সটা আগে হয়, কারও পরে। আমি বেশি আদর পেয়ে বাঁদর হয়ে গিয়েছিলাম, তাই আমি পরে বুঝেছি। বাবা-মায়ের তখন উচিত ছিল আমাকে ওঁদের পায়ের স্যান্ডেল খুলে পিটানো, তাহলে আমার জীবনটা আরও সুন্দর হতো।


এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার পর আমাকে ভার্সিটি অ্যাডমিশন কোচিং করতে হবে। তখন বাসা থেকে কুমিল্লা বাদে কোথাও কোচিং করতে দেবে না। আবার ওদিকে ওকে কোচিং করতে পাঠাবে ঢাকাতে। আমি চাইছিলাম না যে ও ঢাকাতে যাক। এই নিয়ে আমাদের মাঝে খুব ঝামেলা হয়েছিল। যা-ই হোক, পরে অবশ্য ওর সেই কথিত ফাইনানশিয়াল প্রবলেমের জন্য ও ঢাকা না গিয়ে কুমিল্লায় ভর্তি হয়। আমি যেই কোচিং-এ ভর্তি হয়েছিলাম, সেই একই কোচিং-এ, একই সময়ে। কোচিং-এ আমরা ২ জন পাশাপাশি বসতাম। আমার তখন মনে হতো, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমি শুধু কোচিং-এ যা পড়া দিত, অল্প স্বল্প সেইটুকুই পড়তাম। এর বাইরেও নিজের যে কিছু পড়া উচিত, সেটা আমি আর পড়তাম না। আমি তো তখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। আর কোচিং-এর ওই পড়াটুকু পড়তাম শুধু ওর সামনে মানসম্মান রাখার জন্য। কিন্তু ও ছিল বড়োই চালাক। ও বলত, ও পড়ে না, কিন্তু ও ঠিকই পড়ত। কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার পর ওর পড়ালেখার সব বই, খাতা, খাবার প্রায় জিনিসই আমি কিনে দিতাম। তবে আমি কখনও এইসবের জন্য বাবার উপর প্রেশার দিইনি। আমি বাসা থেকে আমার নিজের জন্য একটা হাতখরচ পেতাম। আর কলেজে থাকতে আমি বৃত্তি পেতাম, কলেজ ছাড়ার পরও একটা ভালো পরিমাণে টাকা আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেইগুলিই খরচ করতাম। আজ বুঝতে পারি, এই অ্যাডমিশন টেস্ট কোচিং-এ গিয়ে কত ছেলেমেয়ে যে প্রেম করে বেড়ায় আর নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতেই ধ্বংস করে ফেলে, তা যদি গার্ডিয়ানরা একটু খোঁজ রাখতেন, তাহলে অনেক ছেলেমেয়েকেই সারাজীবন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো না। ওই বয়সে প্রেম করেছে, অথচ একইসাথে জীবনও গঠন করতে পেরেছে, এমন নজির খুব কম।


ও নিজেও কিন্তু বৃত্তি পেত, যদিও ও আমাকে কখনও একটা ক্যান্ডিও কিনে দেয়নি। আমার তা নিয়ে আফসোস ছিল না কখনও। আমি সব সময়ই কিছু দিতেই খুশি ছিলাম, কিছু নিতে নয়। এরপর রোজা এল। ওর ইফতারির খরচও আমিই দিতাম। তারপর ঈদ এল। ঈদে আমি ওকে ড্রেসও কিনে দিয়েছিলাম। কারণ সেই ঈদে ওকে বাসা থেকে ড্রেস দেয়নি। সেটা অবশ্য দিয়েছিলাম, আমার মামারা ঈদের ড্রেস কিনতে আমাকে প্রতিবছরই টাকা দেয়, সেই বারও দিয়েছিল, সেই টাকা দিয়ে। তারপর ঈদে ও বাড়ি গেল। ঈদ শেষে ফিরেও এল। ঈদের পরে অবশ্য সেইভাবে কোচিং হয়নি। যদিও আমি কোচিংটা ঠিক সঠিকভাবে কবে করেছিলাম, সেটাই আমার মনে নেই। যা-ই হোক, ভালোই যাচ্ছিল সব। এইভাবে কুরবানির ঈদ এল। ও এইবার মেস ছেড়ে একেবারে বাসায় চলে গেল। কারণ মেসে থেকে চলার মতো সামর্থ্য ওর ছিল না। আর আমারও অত ক্ষমতা ছিল না, যে আমি ওকে মেসে রেখে পড়াব।


বাড়ি গিয়েই সে অনেক চেইঞ্জড। ফোন দেয় হঠাৎ, মেসেজ দেয় না। কল দিতে দিতে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায়, তখন ফোন ধরে, আর বলে, সারাদিন প্রেম প্রেম করলে হবে? পড়তেও তো হবে। পড়াশোনা করো, বেশি বেশি খাও, নিজের খেয়াল রাখো। এসব শুনে কেমন যে লাগত আমার, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইত। কিন্তু আমি কাঁদতাম না। ফোন রেখে দিলে কাঁদতাম। অনেক বেশিই কাঁদতাম। এর কারণ, আমি ওর সাথে কথাবলায় খুব বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। কথা বলতে না পেরে যে কেমন লাগত, তা বলে বোঝাতে পারব না। কারও সাথে কথা বলতে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়লে সেখান থেকে সরে আসাটা রীতিমতো অসম্ভব পর্যায়ের কঠিন! আর মন খারাপ থাকায় আমি বাবা-মায়ের সাথেও খারাপ ব্যবহার করতে লাগলাম। যদিও সেটা আমি করতে চাইতাম না, তবু কেন যেন হয়ে যেত। আমার খুবই খারাপ লাগত, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না আমি। মনকে কোনও দিক থেকেই কনট্রোল করতে পারছিলাম না। এমনও দিন গিয়েছে, আমি তাকে বলতাম, আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু একটা মিনিট চাই। তোমার এক দিনের ১৪৪০ মিনিটের ১ মিনিটও আমার কাছে অনেক কিছু। ওটা আমাকে দাও, তাহলে আমি ভালো থাকব, আমিও পড়তে পারব।


অথচ আমাকে দেওয়ার মতো তার কাছে এক সেকেন্ডও সময় ছিল না। ভাবতে অবাক লাগত খুব, আমার ভয়েস না শুনে যার দিন শুরু হতো না, আমি দিনে নাকি গুনে গুনে ৩০০টা মেসেজ না দিলে যার ভালো লাগত না, যে আমার পিছে পাগলের মতো ঘুরত, তার আমার জন্য আজ একটা মিনিটও সময় নাই? কীসের এত পড়া? এই ঘটনার ঠিক এক মাস আগে সে নিজেই আমাকে একটা ফেইসবুক আইডি খুলে দেয়। আমার তখন বাটন-ফোন ছিল। আমি ফেইসবুকের আগামাথা কিছুই বুঝতাম না। আর ওই ফোন দিয়ে আহামরি কিছু বোঝাও যেত না। আমি শুধু তখন শিখেছিলাম, কেউ অনলাইনে আছে কি না, সেটা কী করে দেখতে হয়। কীভাবে মেসেজ দিতে হয়, সেটাও জানতাম না। আমি যখন দেখতাম, সে অনলাইনে, তখন তাকে আমি তখন তাকে কল দিতাম। সে ধরত না। আমার খুব বেশি কষ্ট হতো। কিন্তু এরপরও তাকে নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ ছিল না। সে কী চাইছে, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতাও আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অথচ ঠিক এই আমিই, কেউ রাস্তায় আমাকে বা কাউকে বিরক্ত করলে প্রতিবাদ করতাম। কেউ আমার দিকে আঙুল তোলার মতো সাহস পেত না, সেই আমিই কেমন জানি হয়ে গেলাম। আয়নার সামনে আমি দাঁড়াতাম আর ভাবতাম, এই আমি কোন আমি? আসলে কী জানেন, পৃথিবীর সবচাইতে অবাধ্য মেয়েটিও একজন মানুষের কাছে অতি বাধ্য হয়ে বসে থাকে, তার সব কথাই মেয়েটি মেনে নেয়,---সে ছিল আমার সেই মানুষটি। এইসবের মাঝে আমি যতটুকুই পড়েছিলাম, তা-ও সব ভুলে বসে ছিলাম। আর ভুলব না-ইবা কেন? পড়াশোনা হলো প্র্যাকটিসের জিনিস। আর আমি না চাইতেও খুব বেশি মেনটাল প্রেশার নিচ্ছিলাম। তাই সবই ভুলে গেলাম---পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, নিজের জীবনযাপন…


আস্তে আস্তে আমাদের অ্যাডমিশনের ডেট এগিয়ে আসতে থাকে। আমি অনেক জায়গা থেকে ফরম কিনেছিলাম। এমনকি, আমি সেইসব জায়গায় যাওয়া-আসার টিকিট এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলাম। যেখানে আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজন ছিল না, সেখানে হোটেল ভাড়াও করেছিলাম। আমার সাথে বাবা যাবেন। কোনও রকমের কমতি রাখেননি বাবা। কিন্তু আমার কপালে ছিল না ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া। আমি সব কষ্ট সহ্য করে যখন পড়া শুরু করলাম, তখন আমার জরায়ুর নাড়িতে ইনফেকশন দেখা দিল। আমার অনেক হাই-পাওয়ারের ওষুধ চলতে লাগল, আর আমাকে সম্পূর্ণ বেডরেস্ট দিয়ে দিল ডাক্তার। আমি আর কোথাও পরীক্ষা দিতে পারলাম না। তবে ও পরীক্ষা দিল। বেশ কয়েকটি ভার্সিটিতে। তখনও ও আমার সাথে কোনও কথা বলে না। সেই বেডে শুয়ে শুয়ে কী যে যন্ত্রণা লাগত আমার! একে শারীরিক কষ্ট, তার উপর মানসিক কষ্ট। সব মিলিয়ে আমি ঘেঁটে ঘ হয়ে ছিলাম। আমি কল দিলে ও মাঝে মাঝে ধরত। কিন্তু নিজে নিজে কল দিত না কখনওই। ও কোথাও চান্স পাচ্ছিল না। আমি মেনে নিতে থাকলাম যে, ও তো টেনশনে আছে, থাক এখন। আবার নিজের মন তবু মানত না।


বেডে ক্রমাগত শুয়ে থাকলে তো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। আমিও তা-ই হতে লাগলাম। ও রাজশাহী ভার্সিটি থেকে পরীক্ষা দিয়ে আসার পর আমি একদিন কল দিলাম। ও আমাকে বলল, ‘তুমি সব সময় কল দাও কেন, বুঝি না তো আমি! তোমার কাজ নাই? আমি কি তোমার মতো বেকার নাকি? লজ্জা করে না তোমার?’ এই কথা শোনার পর যেন আমার ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গেল। এমনিতেই প্রতিদিনই তো আমি এক ভাঙা-রেডিও’র আওয়াজ শুনছিলাম। এইসব শুনতে শুনতে আমি নিজেও হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম, ‘তুমি এটা কী বললে? তুমি সব সময় এমন করো। কেন, বলো তো? কী প্রবলেম?’ ও বলল, ‘তুমি কি অন্ধ? তুমি চোখে দেখো না যে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি?’ আমি বললাম, ‘পরীক্ষা কি পৃথিবীতে তুমি একাই দিচ্ছ? তুমি এমন কেন করো?’ এইবার ও বলা শুরু করল, ‘তুমি আমাকে অনেক বেশি জ্বালাও। আমার এইসব ভালো লাগে না।’ আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ঘুরছে! আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘এত বছর পর তোমার মনে হচ্ছে যে আমি জ্বালাচ্ছি তোমাকে?’ ও বলল, ‘হুম। দেখো, তুমি একটু স্বাভাবিক হও। আমি তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলতে চাই।’


(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)