অস্পষ্ট জার্নাল: ১১

 
একাত্তর।

যা-কিছু সত্য, তার সবকিছুকেই প্রকৃতিতে মিলিয়ে যেতে হয়, কেননা সত্যে কোনও কৃত্রিমতা থাকে না। অকৃত্রিম কিছু প্রকৃতিরই অংশ। এমনকি প্রকৃত বিজ্ঞানী, যারা প্রকৃতির পক্ষে কথা বলে, তারাও প্লাস্টিককে ভয় পায়, কেননা প্লাস্টিককে কখনও মেরে ফেলা যায় না, এর কোনও বিনাশ নেই। একইভাবে, মিথ্যারও অদৃশ্য হবার শক্তি নেই, এটি প্রকটভাবে আমাদের মাঝে কোথাও-না-কোথাও থেকে যায়। এটিকে পুনরায় শোষিত করা যায় না। অকৃত্রিম সবকিছু আমাদের মাঝে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। মিথ্যা যুগের পর যুগ স্থায়ীভাবে থেকে যায়, কারণ তাদের নিজেদের ভেতর সময়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সকল গুণাগুণ রয়েছে, এটি সময়েরই একটি কূট অথচ জরুরি অংশ। কিন্তু সত্য নিরন্তর, নিরবধি। সত্য নিজ সময়ে মিরাকল হয়ে প্রকাশিত হয়, এটি সময়ের আবর্তে নিজেকে প্রকাশ করে। এমন একটি মিরাকল, যা প্রয়োজনীয়তার নিয়মের বিরূদ্ধে কাজ করতে সক্ষম, যা শক্তিকে অনুসরণ করে, যা স্বাভাবিক আচরণের মাধুর্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রকাশিত হয়। সত্য একটি আলোকরশ্মি হয়ে আসে এবং একটি ঝলক দেখিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা নিজেদের ধার্মিক বলে জাহির করে, যারা মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় যায় এবং ধর্মকে সস্তায় পেতে চায়, তারা কেবল আনুষ্ঠানিক ধর্মের মর্মে দীক্ষিত। তারা এমন কেউ, যারা কেবল রবিবার গির্জায় যায়, যারা কেবল শুক্রবারের নামাজি।


তারা সত্যের পথে সত্যকে জানার জন্য, সত্যকে পাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নয়, তারা ধর্মের নামে খেলায় লিপ্ত এবং তাদের পার্থিব জীবনের এই জুয়ায় তাদের এর জন্য চড়ামূল্য দিতে হবে। আমাদের আশেপাশে কিছু মানুষ আছেন, যারা নিয়মিত প্রার্থনা করেন, ফলে এসব ব্যক্তি খুব সহজেই অন্যের সম্মানের পাত্র হয়ে ওঠেন, আর কিছু মানুষ সম্মানের অজুহাতে সেটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে থাকেন, কেননা অন্যের চোখে শ্রদ্ধেয় হয়ে প্রতারণা করা সহজ। নিয়মিত গির্জায় যাওয়া ব্যক্তিকে অধিক ধার্মিক মনে হয়, সকলের মনে এই ধারণা জন্মে যে, এমন মানুষ কখনও প্রতারক কিংবা ঠগ হতে পারে না। অথচ এমন লোক খুব সহজেই ধর্মের পোশাকে মানুষকে ঠকিয়ে থাকে! ধর্মালয় এমন এক স্থান, যেখানে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে খুব সহজে নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে নেওয়া যায়। যিশু, বুদ্ধ, মোহাম্মদ, সক্রেটিস…এঁরা সকলেই হয়তো তাঁদের নিজের স্থানে বেমানান ছিলেন, না হলে কেন যিশুকে ক্রসবিদ্ধ করা হলো? কোনও ধর্মযাজককে কি ক্রসবিদ্ধ করা হয়? কেন সক্রেটিসকেই বিষ পান করতে বাধ্য করা হয়েছিল? কেন মোহাম্মদকে পাথর ছুড়ে আহত, ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করা হয়েছিল? একজন ধর্মযাজক, পুরোহিত, পীর সকলেই যদি বিনা বাধায়, আহত না হয়েই আমাদের জীবন আরও সহজ, বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সদাতৎপর যোদ্ধা হয়ে থাকেন, তবে তাঁদের কেন আহত হতে হয় না?


এর কারণ হল, তাঁরা মিথ্যাকে এত মার্জিতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, যা আমাদের কাছে বেমানান মনে হয় না। যিশুখ্রিস্ট মারা যাবার প্রায় একশত বছর পর তাঁকে নিয়ে লেখা শুরু হয়। ততদিনে কি তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, বাঁচার ধরন পুরোপুরি অবিকৃত অবস্থায় থাকতে পারে? বোঝাই যায়, এক শ্রেণির যাজকসম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থে যিশুকে কাজে লাগিয়েছিলেন। এঁরা আমাদের একটা মিথ্যা, ছদ্মবেশী জীবনযাপনের জন্য সকল উপায়ে সাহায্য করে থাকেন। তাঁরা আমাদের প্রকৃত সত্যকে ভুলে যেতে সর্বপ্রকারে সাহায্য করেন এবং তাঁদের তৈরি বানোয়াট এমন এক সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরেন, এমন এক সস্তা স্রষ্টাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, যেন আমাদের কোনও কিছু হারাবার ঝুঁকি না নিতে হয়। খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ হয়ে জন্মানো অথবা এইসবের যে-কোনও ধর্মাবলম্বী হওয়াতে কোনও সমস্যা নেই, আমাদের সব সমস্যা এই ধর্মপ্রচারকদের নিয়ে। আমরা যদি তাঁদের অনুসারী হই, তাঁদের দেখানো পথে চলি, তবে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা যদি তাঁরা সত্যের জন্য প্রকৃতই তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত না হন, তাঁরা যদি তাঁদের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত না হন, তবে তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীগণ সত্যের দেখা পাবেন না।


কষ্টের হলেও সত্যি, লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই প্লাস্টিকের ফুলকেই চায়। কারণ সেটিকে বেড়ে ওঠার জন্য যত্ন করতে হয় না, পরিচর্যা করতে হয় না, সেটিতে কোনও শ্রম দিতে হয় না। এটি বেশ নির্ঝঞ্জাট, সুবিধাজনক একটি ফুল। একটি প্রকৃত ফুলকে বেড়ে ওঠার জন্য কষ্ট করতে হয়, সেটিকে বেড়ে ওঠার জন্য সময় দিতে হয়, পর্যাপ্ত পানি, সূর্যালোকের ব্যবস্থা করতে হয়, এর চারপাশে দেয়াল দিতে হয়, যেন সেটি কেউ নষ্ট করতে না পারে। এতকিছুর পরেও একটা অনিশ্চয়তা, একটা ভয় ভেতরে থেকে যায় যে আসলে কেমন ফুল ফুটবে অথবা আদৌ ফুল ফুটবে কি না, গাছটি বাঁচবে কি না। প্লাস্টিকের ফুলে এতসব ঝামেলা নেই বলেই লক্ষ কোটি মানুষ সেইটিকেই ঘরে তুলে আনে। কারণ সেটি রেডিমেড, সেটির পেছনে বাড়তি শ্রম বা ব্যয় নেই, এমনকি যেখানে সেখানে যেমন তেমন করে ফেলে রাখলেও ঠিক টিকে থাকে। এটির রঙ বদলায় না, এমনকি এটিকে যদি বেশ কিছুদিন পর পর ধুয়ে দেওয়া যায়, তবে সেটি আবার তার চাকচিক্য ফিরে পায়।


প্লাস্টিকের ফুল কেবল ধুলো জোগাড় করে, আর ধুলোকে ঝেড়ে ফেলা যায়, ধুয়ে ফেলা যায়। আমাদের বিশ্বাসগুলিও এমন প্লাস্টিকের ফুলের মত। যদিও আমরা নিজেরাও জানি যে আমরা ধর্মযাজক কর্তৃক প্রতারিত হব, তা সত্ত্বেও আমরা তাঁর কাছেই প্লাস্টিকের ফুল কিনতে যাই। অর্থনীতির একটি বিশেষ কার্যকরী নীতি হলো: যেখানে চাহিদা আছে, সেখানেই যোগান রয়েছে। সুতরাং যেখানে মিথ্যার চাহিদা রয়েছে, সেখানে অবধারিতভাবে মিথ্যাপন্থিও রয়েছে। যখন কেউ সচেতনভাবে প্রতারণা করে থাকে এবং যখন কেউ স্বেচ্ছায় প্রতারিত হয়, উভয়েই যথাস্থানে সঠিক। যদি আমরা কারও সাথে প্রতারণা করতে না চাই, তবে যারা স্বেচ্ছায় প্রতারিত হতে চায়, তাদের কী হবে? আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা জানেন তাঁরা প্রতারিত হচ্ছেন, তা সত্ত্বেও তাঁরা সেটিকে ঘটতে দেন এবং যখন পুরোপুরি প্রতারিত হন, তখন তাঁরা প্রতারকের উত্তরাধিকারসহ গোটা বিশ্বকে দোষারোপ করতে থাকেন। তাঁরা এমন কেন করেন? কেননা তাঁরা নিজেরাও প্রতারণার আশ্রয়ে বাঁচেন এবং যখন তাঁরা অন্যের দ্বারা প্রতারিত হন, তখন তাঁরা জানেন, এটা তাঁদের অতীতেরই কর্মফল। এজন্যেই তাঁরা যদিও বিশ্বসুদ্ধ লোক জড়ো করে দোষারোপ করতে থাকেন, তবু মনে গভীরে তাঁরা সেটিকেই প্রশ্রয় দেন। এমন দ্বিচারী মানুষ আমাদের আশেপাশে অসংখ্য।


বাহাত্তর।
অন্যকে দোষারোপ করে অথবা অন্যের উপর সকল দোষের বোঝা চাপিয়ে বাঁচেন এবং বেশ শান্তিতেই বাঁচেন, এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। অন্যের উপর দোষের বোঝা চাপিয়ে, অন্যের দ্বারা স্বেচ্ছায় প্রতারিত হয়ে এবং প্রতারণা করতে দিয়ে তাঁদের নিজের দোষের, নিজের পাপের বোঝা একটু হলেও কমে আসবে, এই ধারণা থেকেই মূলত তাঁরা এমনটি করে থাকেন। এটি তাঁদের মানসিকভাবে স্বস্তিতে রাখে, আর যা-কিছু আমাদের মানসিকভাবে স্বস্তি দেয়, তা যদি আমাদের অনেক মূল্য দিয়েও নিতে হয়, আমরা তাতেও রাজি। এতে করে তাঁরা সেভাবেই বাঁচতে পারেন, যেভাবে তাঁরা বাঁচতে চান। তাঁরা মূলত স্বস্তির অন্বেষণে প্রতারণাকে লুকাতে পছন্দ করেন। আমরা যদি সেভাবেই স্বস্তিতে বাঁচতে চাই, তবে আমাদের চারপাশে সেরকম অনেক কিছুই রয়েছে যা-কিছু পুঁজি করে আমরা ব্যবসায় নেমে পড়তে পারি। এক সত্যান্বেষক ছিলেন যিনি সব সময় কেবল নতুন নতুন বিষয় জানার জন্য অন্বেষণ চালিয়েই যেতেন। এর ফলে তিনি সব সময় কিছুটা অস্বস্তিতে থাকতেন। তাঁর এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী ছিলেন যিনি কোনও বিষয়েই কিছু জানতেন না, তাঁর কোনও বিষয়ে জানার কোনও প্রকার আগ্রহও ছিল না, কিন্তু তিনি তাঁর জায়গায় বেশ সুখী ছিলেন। একবার সেই সত্যান্বেষকের কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘আপনি কি কোনও বিষয় জানার জন্যে সর্বদা অস্বস্তি নিয়ে না বেঁচে বরং আপনার প্রতিবেশীর মতো কোনও বিষয়ে না জেনে স্বস্তিতে বাঁচতে চান না?’ তখন তিনি বললেন, ‘কোনও কিছু না জেনে ততদিনই নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্তে, স্বস্তিতে বাঁচা যায়, যতদিন আমরা কোনও দুর্ঘটনায় না পড়ছি। যখন আমরা হঠাৎ কোনও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হব, তখন সেই আকস্মিক দুর্ঘটনা আমাদের যতটা না ক্ষতি করবে, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি ক্ষতি সাধিত হবে আমাদের অজ্ঞতার ফলে এবং আমি অবশ্যই কোনওভাবেই এমন অজ্ঞতা নিয়ে স্বস্তিতে বাঁচতে চাই না।’


আমরা সকলেই কোনও না কোনও ধর্মের অনুসারী। সুতরাং কোনও-না-কোনওভাবে কখনও-না-কখনও আমাদের স্বেচ্ছায়, অজ্ঞতায়, অনিচ্ছায় প্রতারিত হতেই হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সত্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে আমাদের কাছে প্রকট হবে এবং যখন এটি প্রকট হবে, অবধারিতভাবে সেটিও মৃত্যু আলিঙ্গন করে নেবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা অধিক সংখ্যক মানুষই ধর্মের বেড়ায় আবদ্ধ হয়ে কেবল একটা ফাঁকা জীবনে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কাটছি, কেননা এই মুহূর্তে আমাদের সময় পার করবার মতো গুরুত্বপূর্ণ অথবা অর্থবহ আর কিছু নেই। আমরা প্লাস্টিকের ফুলের মতো নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় একটা পরিশ্রমবিহীন ঈশ্বর কিনে এনেছি, আমাদের সব কাজ ওখানেই শেষ। আর যদি আমরা অচিরেই সত্যকে জেনে ফেলি, তবে সেই সব স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীদের কী হবে, যারা যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের পোশাক গায়ে জড়িয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে? তাদেরও নিশ্চিতভাবে করার মতো একটা কাজ প্রয়োজন। যদি আজ এই মুহূর্তে আমরা সত্যের দেখা পেয়ে যাই, তবে এমনকি শয়তানেরাও কর্মহীন হয়ে পড়বে, দুষ্টলোকেরা কর্মহীন হয়ে পড়বে, দুষ্ট প্রকৃতির ভূত যারা সর্বদা আমাদের মস্তিষ্কে অযাচিত ভুলভাল সব তথ্য দিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, তারাও আকস্মিক কর্মহীন হয়ে যাবে।


পথিবী জুড়ে যত প্রকার ভণ্ড, নকল ব্যবসা চলে আসছে, তার সবকিছু আজ এই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবী জুড়ে যুগে যুগে যত সত্যান্বেষক এসেছেন, তাঁরা গত হবার সাথে সাথেই দুষ্ট লোকজন ভুলগুলিকে পুনরায় সংগঠিত করতে নেমে পড়েছে এবং অচিরেই তারা তাদের ইচ্ছেমত কৃত্রিম নানান সত্য তৈরি করে ফেলছে। এগুলি দিয়েই তারা হাজার হাজার বছর ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে আসছে, যতদিন পর্যন্ত না কোনও নতুন সত্যান্বেষকের আবির্ভাব ঘটছে। ততদিন পর্যন্ত এসব শয়তান ভূত সত্যকে তাদের নিজের তৈরি পোশাক জড়িয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে, যাতে করে তারা বিরামহীনভাবে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হয় এবং আবার যখন সত্য অন্য কোনও রূপে আমাদের সামনে ধরা দেবে, অতঃপর সেটি তার আলোর ঝলক দেখিয়ে আবার মিলিয়ে যাবে, ঠিক তার পরপরই সেইসব দুষ্ট ভূতেরা মিলে সেটিকে পুনরায় নকল ও আমাদের মনোরঞ্জন-ক্ষম উপায়ে বিকৃত করতে কাজে নেমে পড়বে এবং এভাবেই যুগ যুগ ধরে আবারও তারা তাদের রাজত্ব চালিয়েই যাবে। এভাবেই প্রতিটি বিকৃত সত্যই তথাকথিত ধর্মে পরিণত হয়।


সত্যকে অবিকৃত পেতে চাইলে যখনই সত্য কারও মাধ্যেমে আমাদের মাঝে পুনরায় এসে প্রকট হবে, তখনই তার থেকে যতটা পারা যায়, তার সর্বোচ্চটুকু গ্রহণ করতে হবে। যদি আমরা সত্যের খোঁজে অনিশ্চিতে ঝাঁপ দিতে ভয় পাই, তবে বুঝতে হবে আমরা এখনও যৌক্তিক ও দ্বিধান্বিতই রয়ে গেছি। সত্যকে জানতে হলে একেবারে শূন্য হাতেই মন থেকে সকল প্রকার দ্বিধাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঝুঁকি নিতে হবে। আমরা যদি আগে এই পথ সম্পর্কে জেনে নিয়ে তারপর ঝাঁপ দিতে মনস্থ করি, তবে আমরা কোনও দিনই সত্যের পথে হাঁটতে পারব না। কেননা সত্যকে জানতে হলে এর পথে হেঁটেই জানা যায়, তেমনি আধ্যাত্মিকতার জগত সম্পর্কে জানতে হলে এ পথেই হাঁটতে হবে। কোনও কিছুকে না জেনে এতে ঝাঁপ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, আমি একে সকল যৌক্তিকতার ঊর্ধ্বে ভালোবাসি, সুতরাং এর জন্য আমি সমস্ত ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। যৌক্তিকভাবে কোনও কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অর্থ ভালোবাসা নয়, ঝুঁকির অর্থ হচ্ছে অনিশ্চিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন জেনেও তাতে ঝাঁপ দেওয়া এবং এটি যত দীর্ঘ হতে থাকে, ততই স্বচ্ছ হতে থাকে।


ধীরে ধীরে পুরনো মেঘ সরে যায়, নতুন পথের সূচনা হয়, এভাবেই এই প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকে। এই ঝুঁকিটা ক্রসবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মতো এবং এর মধ্য দিয়েই পুনরুত্থান ঘটে। আধ্যাত্মিকতার জগতে আমাদেরকে এভাবেই সকল যৌক্তকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যদি আমরা এই পথের সবকিছু জেনে তারপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাই, তবে সেটাকে অনিশ্চিতে ঝাঁপ দেওয়া বলে না, এটি আমাদের মস্তিষ্কের একধরনের স্বেচ্ছাবিরতি এবং তখন আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই। আধ্যাত্মিকতার জগতে ঝাঁপ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, আমরা আমাদের মস্তিষ্কের খেলায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সব মূঢ় খেলাগুলি দেখে ফেলেছি, এখন আমরা সচেতনভাবে এই খেলার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছি, আমরা আমাদের মস্তিষ্কের এই খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি। ভালোবাসা আমাদের মস্তিষ্কের সাময়িক পতন ঘটায়। আমরা বলি, আমরা প্রেমে পড়েছি। আসলে প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের নোংরা খেলা থেকে মুক্ত হয়েছি। যদি আমরা মস্তিষ্কের দিক থেকে বিচার করি, তবে এটি একপ্রকার পতন, কিন্তু যদি আমরা হৃদয়ের দিক থেকে বিচার করি, তবে আমরা দেখতে পাব, আমাদের আসলে পতন হয়নি, বরং আমরা সৃষ্টিশীলতার দিকে আরও উপরে উঠেছি।


আসলে আমাদের যৌক্তিক মন এমনটি কখনও মেনে নেয় না। আমাদের যৌক্তিক মনের কাছে এটি একপ্রকার মূর্খের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া। যৌক্তিকতার বিচারে আমরা আবেগী, ভাবপ্রবণ। যুক্তির কাছে আবেগের কোনও মূল্য নেই, কেননা এটি যুক্তির বিনাশ ঘটায়। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একপ্রকার ভালোবাসা, এটি সত্যের পথে গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা। এটি সম্পর্কের প্রতি ভালোবাসা। সাধনা কোনও দর্শন নয়, এটিকে কেবল অনুভব করতে হয়। এটির স্বাদ আমরা তখনই বুঝব, যখন আমরা এটিকে কীভাবে পরখ করতে হয়, সেটি জানব। যদি আমরা ধ্যানের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করেই আগে পরখ করে দেখতে চাই, তবে আমরা কখনওই এটার অনুভূতি জানতে পারব না, কেননা এর অনুভূতি এটির মধ্যে দিয়ে চলার মাঝেই লুকায়িত। এটি এমন কিছু নয়, যা বুদ্ধিমত্তাগত উপায়ে মস্তিষ্কে বসিয়ে দেওয়া যায়। এটির কোনও অবয়ব নেই। এটি ঠিক ফুলের সৌন্দর্যের মত। আমরা যদি কোনও বিজ্ঞানীর কাছে ফুলের সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ হেসে উঠবেন, কেননা তিনি ফুলের সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি একটি ফুল কী কী রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত, ফুলটিতে কত শতাংশ পানি এবং অন্যান্য উপাদান রয়েছে, ফুলটি কতটা সৌরশক্তি গ্রহণ করেছে, তার সবই তিনি ফুলটিকে কেটে টুকরো টুকরো করে বলে দিতে পারবেন, কেননা সেগুলিকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব, কিন্তু ফুলটির সবকিছু পরীক্ষার শেষে তিনি ফুলটিকে আর আগের অবস্থানে নিয়ে আসতে পারবেন না।


একটা ফুল নিয়ে এত পরিমাণ গবেষণা সত্ত্বেও তিনি কোথাও ফুলের সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন না, কেননা সৌন্দর্যের কোনও অবয়ব নেই, এটিকে কেবল অনুভব করা যায়, সৌন্দর্য কখনও দৃশ্যমান এবং কখনও অদৃশ্য, কিন্তু এটিকে কখনই কোনও পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে বা যুক্তির সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আধ্যাত্মিকতা, ধ্যান এই সব বিষয়ও ঠিক তেমন, একে দেখা যায় না, এটিকে কোথাও প্রতিস্থাপন করা যায় না, এটিকে ভাঙা যায় না, এটির স্বাদ কাউকে আগে থেকে চেখে দেখানোর কোনও উপায় নেই, এটিকে কেবল এতে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। আধ্যাত্মিকতা এমন একটি জ্ঞানের জগত, যেখানে যখন তখন অনুপ্রবেশ অথবা কিংবা সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। এটিতে প্রবেশ করতে হলেও এর অনেক ধাপ পেরুতে হয়, তেমনি এর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়, কেননা এটি কোনও দৃশ্যমান বস্তু নয় যাকে চাইলেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ কখনও আধ্যাত্মিকতাকে ভেঙে দেখেন না। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ আধ্যাত্মিকতাকে না ভেঙেই এর গভীরে প্রবেশ করেন এবং একজন গবেষকের চোখে যা কখনও ধরা পড়ে না, তিনি তার খোঁজ পান।


ঠিক একজন কবি যেভাবে প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করেন প্রকৃতিকে ধ্বংস না করেই এবং এই উপায়েই প্রকৃতির আত্মাকে ছুঁয়ে যান, ঠিক যেভাবে ফুলকে না ছিঁড়েই ফুলের সৌন্দর্যে হারিয়ে যান, এর সুবাসে মোহিত হন, ধ্যান ঠিক এমনই এক জগত। এটি কোনও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নয়, এটি একটি কবিসত্তাগত অভিজ্ঞতা। সুতরাং যদি আমরা আধ্যাত্মের জগতে অংশগ্রহণ না করেই এর স্বাদ পেতে চাই, তবে আমরা কখনওই ধ্যানী বা যোগী নই, গবেষকের আচরণ করে অথবা গবেষণালব্ধ কাজ করে আধ্যাত্মিক হওয়া অসম্ভব। শর্ত দিয়ে কখনও কবিত্ব অর্জন করা যায় না, কবিত্বের জন্যে প্রকৃতির হৃদয়ে প্রবেশ করতে হয়। একটি অস্থির মন নিয়ে, সবকিছুকে যুক্তির মাপকাঠিতে বিচার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করা গেলেও একটি কবিসত্তার জন্য এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রকৃতিতে হৃদয় দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটাতে হয়। বিজ্ঞান শর্তাধীন, কিন্তু আধ্যাত্মের কোনও শর্ত হয় না। ভালোবাসায় প্রবেশের আগে ভালোবাসা কী, তা কি জানা সম্ভব? ভালোবাসায় প্রবেশ না করেও ভালোবাসা নিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলা হয়তো যায়, কিন্তু কেবল কাউকে ভালোবাসলেই প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা কী, সেটা জানা যায়।


তিয়াত্তর।
আমরা কি ভালোবাসার সম্পর্কে প্রবেশের আগে কোনও শর্ত দিয়ে সম্পর্কে জড়াই? যদি জড়াই, তবে সেটি কখনও প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা নয়, সেটি একটি চুক্তি আর কেবল চুক্তিতেই একাধিক শর্ত প্রযোজ্য, ভালোবাসায় নয়। ভালোবাসায় প্রবেশ করতে হলে সকল চুক্তি, শর্ত, অহম সবকিছুকে পেছনে ঝেড়ে ফেলে ভালোবাসার অন্তরে প্রবেশ করতে হয়, নয়তো সেটি ভালোবাসা নয়। ভালোবাসায় কোনও বোঝাপড়া নেই, কোনও শর্ত নেই, কোনও নিয়ম নেই। ভালোবাসা নিজেই নিজের পথ তৈরি করে এবং প্রতিটি ভালোবাসার পথ একটি আর-একটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা যদি পৃথিবীতে এযাবতকালের সকল ভালোবাসার গান, কবিতা, উপন্যাস, সিনেমা, গল্প সবকিছুই দেখে ও পড়ে থাকি, তারপরও আমরা ভালোবাসা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারব না, যদি না আমরা ভালোবাসার কোনও সম্পর্কে নিজেকে জড়াই। ভালোবাসাকে জানা জ্ঞানমূলক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনও উপায় নয়। এটি পুরোপুরি উপলব্ধির বিষয়। ভালোবাসা সম্পর্কে জানা এবং ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানো দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা ভালোবাসা সম্পর্কে একেবারে কিছুই না জেনেও ভালোবাসায় জড়াতে পারি, ভালোবাসাকে অনুভবে জড়াতে পারি কেবল কাউকে ভালোবেসেই। এমনকি, ভালোবাসা সম্পর্কে আগে থেকে অতিরিক্ত জানা থাকলে আমরা ভালোবাসার উলটো পথেও চলে যেতে পারি।


ভালোবাসা অনিশ্চিত আত্মোপলদ্ধি হলেও এটি ভাবনাজগতের ঊর্ধ্বে নয়। মূলত কোনও বিষয় জানার দুটি উপায় রয়েছে, এর একটি পর্যবেক্ষণ, অপরটি হচ্ছে অংশগ্রহণ। পর্যবেক্ষণ মূলত একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং এটিকে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় জানা যায়। অন্যটি অংশগ্রহণ, এটি মূলত গভীরভাবে আধ্যাত্মিক। বিষয়টির সাথে আবেগের সংযোগ আছে। এর জন্য অনেক মানসিক শক্তির প্রয়োজন। এই পৃথিবীতে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, অজানায় ঝাঁপ দেওয়া। আর এটি কেবল এক কৌতূহলী হৃদয়ের পক্ষেই করা সম্ভব। মূলত আধ্যাত্মিকতা কোনও কঠিন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের জন্যে নয়, এটি গুটিকয়েক কোমল হৃদয়ের মানুষের জন্য, যারা সিংহের গর্জনে জানা থেকে সম্পূর্ণ অজানায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যদি আমরা আধ্যাত্মিকতা যৌক্তিকতা দিয়ে গ্রহণ করতে চাই, যদি আমরা সবকিছুকেই কেবল যৌক্তিক করে তুলি, তবে আমাদের পুরো জীবন একটা অগভীর ভাসাভাসা জ্ঞানের উপরে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। গভীরতা কেবল ভালোবাসা থেকেই পাওয়া সম্ভব, আর ভালোবাসা হচ্ছে একটি পাগল-করা সম্পর্ক। যে সম্পর্ক আমাদের পাগল করে দেয় না, সে সম্পর্কে ভালোবাসা থাকতে পারে না, সেখানে কেবল যৌক্তিকতা থাকে, আর যৌক্তিকতা কখনও কোনও কিছুকে গভীরতা দান করে না।


হ্যাঁ, আমরা চাইলেই এর বিরূদ্ধে তর্ক জুড়ে দিতে পারি। তর্ক জিনিসটা আনন্দের জন্য সব সময় ভয়ানক। আমরা যদি আমাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে সবকিছুতেই তর্ক জুড়ে দিই, তবে সেটি আমাদের মানসিক প্রশান্তিগুলিকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলবে। দেখা গেল, আমরা আধ্যাত্মিকতার জগতে বাস করি, সেটি আমাদের ভালোবাসার মানুষ চায় না, কেননা তার কাছে এটিকে একপ্রকার ভণ্ডামি, একপ্রকারের ব্যবসা মনে হতে পারে। তার কাছে এমন মনে হওয়া কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়, কেননা সে এর থেকে আর-একটি ভিন্ন জগতে আছে, সুতরাং সে কিছুতেই এই জগতের বাইরে থেকে এই জগত সম্পর্কে জানতে পারবে না এবং এর থেকেই তার ভেতরে নানা রকম ভুল ধারণা জন্মাবে। আমরা যদি সেই মুহূর্তে তাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য অথবা তার ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য তর্ক জুড়ে দিই, তবে ধীরে ধীরে আমাদের মানসিক শান্তিগুলি কমতে শুরু করবে, আমাদের শক্তির অযথা অপচয় হবে। এর চেয়ে বরং আমরা যদি তাকে তার উপর ছেড়ে দিই, এবং তার প্রতি আমার ভালোবাসা বোঝাতে চেষ্টা না করে তাকে বুঝে নিতে সাহায্য করি, তাকে তার মতো করেই ছেড়ে দিই, কেবল আমার ভেতরের শক্তি সম্পর্কে তাকে বুঝতে দিই, তবে সে একাই আমার কাছে ফিরে আসবে।


অন্যথায়, আমরা যদি তাকে আমাদের বোঝার জন্য তর্ক জুড়ে দিই এবং সে যদি আমাদের মানসিক প্রশান্তিগুলিকে নষ্ট করতে সফল হয়, সে যদি বুঝে নেয়, সে যা চাইছে, অর্থাৎ সে যেভাবে আমাদের মানসিক প্রশান্তিগুলিকে নষ্ট করতে চাইছে, সেই ক্ষেত্রে সে সফল, এতে করে ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরে নিজেকে নিয়েই নিজের সন্দেহ জন্মে যাবে। তখন কোথাও-না-কোথাও, কখনও কখনও, আমাদের নিজেদেরই মনে হবে, আমরা ভুল আর সে-ই আসলে সঠিক। আমরা যদি সত্যি ভালোবাসি, তবে সেখানে যে-কোনও ধরনের সন্দেহপ্রবণতাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, কেননা ভালোবাসা জানে, কী করে ধৈর্য ধরতে হয়। তাকে আমাদের ভালোবাসা অনুভব করার সুযোগ এবং সময় দিতে হবে। ভালোবাসার মানুষকে তর্কে পরাভূত করার কোনও কারণ নেই, কেননা ভালোবাসা তর্কে জেতার কোনও বিষয় নয়। যদি আমরা তর্ক করি, তাহলে হয়তো আমরা চাইলে তর্কে জিতেও যেতে পারি, তবে অবশ্যম্ভাবীরূপে আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষটিকে হারাব। নিশ্চিত তর্কে জেতার চাইতে আমাদের কাছে আমাদের ভালোবাসার মানুষটিই বড়ো, তা-ই নয় কি?


তার চেয়ে বরং যখনই সে আমাদের তর্কে নেওয়ার চেষ্টা করে, তখন তাকে আরও বেশি ভালোবাসা যায়, তাকে জড়িয়ে কাছে নেওয়া যায়, নয়তো তাকে আরও কিছু বেশি ভালোবেসে সেই মুহূর্তে আরও কিছুটা পাগল করে দেওয়া যায়…যদি আমরা তার তর্কে কম মনোযোগ দিই, তবে সে আমাদের ভালোবাসায়, আমাদের মানসিক পরিবর্তনের দিকে বেশি মনোযোগ দেবে, ফলে তার মনে আমাদের নিয়ে, আমাদের ধ্যানধারণা ও আচারআচরণ নিয়ে যে ভিন্ন সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি ধীরে ধীরে কেটে যাবে। সে তখন আমাদের নিয়ে যা ভেবেছিল, আমাদের কাজ সম্পর্কে, আমাদের আধ্যাত্মিক জগত সম্পর্কে তার যা ধারণা ছিল, সেই কালো মেঘগুলি তার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে কেটে যাবে। ভালোবাসার মানুষকে কখনও তাড়িয়ে দিতে নেই। তাকে কখনও চলে যেতে বলতে নেই, বিশেষ করে তখন, যখন সে আমাদের আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে সন্দেহ করছে, যখন সে এই জগতকে একটা বাবসা বলেছে, যখন সে এই জগতকে ভণ্ডামি বলেছে; বরং তখন তাকে সেটাই বলে যেতে দেওয়া উচিত। তার সব কথা আমাদের সেই মুহূর্তে মেনে নিতে হবে। তার মনের সকল সন্দেহ, আমাদের নিয়ে তার সব ভয়, সকল ধারণাকে তাকে বলে ফেলতে দিতে হবে। যদি সে বলে এটি একটি ব্যবসা, মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা, তবে সেটিই মেনে নিতে হবে।


হ্যাঁ, প্রকৃতই এটি একটি ব্যবসা! কিন্তু এটি কোনও সাধারণ ব্যবসা নয়, এটি এক ঐশ্বরিক ব্যবসা। কিন্তু এখনই সে এটি কী করে বুঝবে, যখন সে এটি সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ? সে বরং এখন এই ভেবে ভয়ে আছে যে তার ভালোবাসার মানুষটি তাহলে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে! সে এখন আমাদের বোঝাতে শুরু করবে, আমাদের সাথে তর্ক জুড়ে দেবে এবং আমরা যদি তার সাথে তর্ক জুড়ে দিই, সেটাই বরং ভয়ানক। তার তর্ক জুড়ে দেওয়ার কারণ, সে ভাবছে, সে আমাদের হারিয়ে ফেলছে, সে ভাবছে, সে তার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলছে। এই আকস্মিক ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলাটা তার মধ্যে হিংসার জন্ম দিচ্ছে। এ হিংসা আমাদের এই দুর্বোধ্য জগতের প্রতি হিংসা। এ জন্যেই সে আমাদের বোঝাবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আমাদের উচিত, ধৈর্য নিয়ে তার তর্কগুলি শুনে যাওয়া, তার ঝগড়াগুলিকে আমাদের আনন্দের সাথে উপভোগ করা উচিত। বরং যখন সে ঝগড়া করে, তাকে আরও ঝগড়া করতে দেওয়া উচিত। তার মনে যত ঝড়, যত অশান্তি, যত অজানা ভয় লুকিয়ে আছে, সবকিছু তাকে তার মতো করে বলে যেতে দিতে হবে। এরপর একটা সময় আসবে, তার ভেতরে ঝগড়া করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, পৃথিবীতে আর কী-ইবা এমন বিষয় আছে, যা নিয়ে গোটা জীবন তর্ক করা যায়! যদি আমরা ধৈর্যের সাথে, ভালোবাসার সাথে তার সব কথা শুনে যাই, তবে একটা সময় আমরা তার মাঝেও একটা পরিবর্তন দেখতে পাব। যারা লিখে, যারা ছবি আঁকে, যারা গায় - নাচে - অভিনয় করে, যারা রান্না করে, যারা কোনও একটা শিল্পের বা সৃষ্টির বা সাধনার সাথে জড়িত, তাদের সবারই সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে এমন অদ্ভুত ও অনিবার্য কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতেই হয়। কিছুই করার নেই।


চুয়াত্তর।
যাবতীয় অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যে সত্যে পৌঁছই, সেটাই বৈধসত্য। আর ধ্যান হচ্ছে সেই শক্তি, যা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অর্জন করতে হয়। যখন আমরা আমাদের শরীরের কোনও অংশ সার্জারি করাই, তখন সেই ব্যথাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। সার্জারি যে ব্যথা, এটাকে মেনে নিতে হবে, কারণ ব্যথা না দিয়ে সার্জারি করা অসম্ভব। এ সময়টুকু মাঝে মাঝে আমাদের রাগিয়ে তুলবে, আমাদের অধৈর্য করে তুলবে, আমাদের আহত করবে, আমাদের আশ্চার্যান্বিত করবে, তারপরও আমাদের ধৈর্য ধরে থাকতে হবে, কেননা এটি কষ্টদায়ক হতেই বাধ্য। সত্যের পথে আমরা কোনও কিছুই বেছে বেছে পছন্দ করতে পারি না। সত্যকে এটি ঠিক যেমন, তেমন করেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি ভোরের সূর্যোদয় মেনে নিই, তবে আমাদের গভীর রাতকেও নেমে নিতে হবে, কেননা এটা প্রকৃতিরই একটি অংশ। আমরা প্রকৃতির একটি অংশ গ্রহণ করে অন্য অংশ, যেটি আমাদের পছন্দনীয় নয়, সেটিকে বাদ দিতে পারি না। প্রকৃতি যেমন, আমাদের তেমন করেই মেনে নিতে হবে।


ভালোবাসারও এমন হাজারো পথ রয়েছে, যেটকে আপাত অর্থে মেনে নেওয়া আমাদের জন্য অসম্ভব। কিন্তু যদি আমরা ভালোবাসাকে বুঝি, তবে আমাদের এটি মেনে নিতে কষ্ট হবে না যে ভালোবাসা কেবল দুটি হৃদয় দেখে, এটি লিঙ্গ বা শর্ত বোঝে না। আমরা আসলে সব সময় অন্যকে নিয়ে হাসিঠাট্টা পছন্দ করি। একজন প্রকৃত মানুষ কখনও প্রকৃতির খুঁত ধরে বসে থাকে না। প্রকৃত মানুষ্যত্ব কখনও জনপ্রিয়তা খোঁজে না। একটি প্রকৃত মানবসত্তা প্রকৃতি যেমন, তাকে ঠিক সেভাবেই তুলে ধরে। আমরা সাধারণ মানুষ এটিকে স্বাভাবিভাবে মেনে নিতে পারি না। আমরা সব সময় অন্যকে নিয়ে হাসাহাসি করি, কারণ সেই ব্যক্তিটি আমাদের চোখে ব্যতিক্রম! অথচ আমরা যদি ভাবতাম, এটি প্রকৃতি, আর প্রকৃতি সব জায়গায় সমান নয়, এটি বৈচিত্র্যময়, তাহলে আমরা আমাদের আশেপাশের সবকিছুকে সেটি যেমন, তেমন করেই মেনে নিতে পারতাম। যখন কেউ তার কাজগুলি নিয়ে ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধ করতে থাকে, তখনই সে নিজের সেই কাজগুলিকে সবার থেকে লুকোতে চায়, যা নিয়ে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে হেয় করছে। আমরা সবাইকে তার বিশেষ আচরণের কারণে চিনতেই বোধহয় বেশি পছন্দ করি, যার ফলে আমরা নিজেদের নিয়ে কম, আর অন্যদের নিয়ে বেশি হাসাহাসি করি।


প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে, নিজের সকল বৈচিত্র্যময় কাজগুলি নিয়ে হাসাহাসি করতে বেশি পছন্দ করে, সে ব্যক্তিই হাসির প্রকৃত রহস্য জানে। অন্যদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করার মাঝে নতুন কিছুই নেই, ঠিক যেমন অন্যদের নিয়ে সমালোচনারও কিছু নেই। আমরা আমাদের ভুলগুলি, আমাদের সবচেয়ে নোংরা রূপটি সকলের থেকে আড়াল করে তারপর অন্যকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে থাকি। আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতি আসলে কাউকেই নিখুঁত করে তৈরি করেনি, সুতরাং আমরা যেমন, আমাদের নিজেদের তেমন করেই মেনে নিতে হবে এবং অন্যেরা যেমন, অন্যের সবচেয়ে যেটা বাজে দিক, যা আমাদের ভীষণভাবে মনকে নাড়া দেয়, সেটিকেও মেনে নিতে হবে। আসলে লুকিয়ে রাখলেও কি সবকিছু চাপা থাকে? অথবা যা-কিছু সত্য, তা কি চিরকাল চাপা পড়ে থাকে? আমরা হয়তো অনেক বন্দোবস্ত করে কোনও কিছু লুকোতে চাই, কিন্তু একদিন ঠিকই সবকিছু আমাদের সামনে প্রকট হয়, সেটা অন্যের অথবা নিজের যা-ই হোক না কেন।


ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ রয়েছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা, উভয়লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা, সমলিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা, এই সবগুলিই ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ। এগুলির কোনওটি থেকে কোনওটিকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই, কেননা ভালোবাসা কেবল হৃদয়ই দেখে। আমরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে ভালোবাসা, সেটিকেই কেবল স্বাভাবিকভাবে নিই। অন্য সকল ভালোবাসা আমাদের কাছে অগ্রাহ্য, কেননা সেটিই আমাদের পূর্বপুরুষদের নির্দেশনা। আমরা যদি প্রত্যেকটি মানুষকে তার নিজের হিসেবে ছেড়ে দিতে জানতাম, তবে আমাদের মনে এ ধরনের ধারণাগুলি কখনও স্থান পেত না। ধ্যানের জগতে মানুষের এসব পার্থক্য করা হয় না। এখানে নারী, পুরুষ, সমকামী, উভকামী সকলের স্থান সমান। এর মাধ্যমে মানুষের মুখোশের আড়ালের প্রকৃত মানুষকে বের করে আনা হয়। ধ্যান এমন এক বাগান, যেখানে সব ধরনের ফুলগাছের জায়গা সমান। এখানে আগাছা থেকে শুরু করে সব রকম গাছকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এতে কারও প্রতি কারও রাগ, বিদ্বেষ, ঘৃণা কিছুরই কোনও স্থান নেই।


ধ্যানের রাজ্যে মানুষের আত্মাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ রাজ্যে যে আত্মা যেমন রূপে আছে, ঠিক সেভাবেই তাকে গ্রহণ করা হয়। কারও প্রতি কোনও নিন্দা, কোনও রায় না দিয়ে মানুষকে স্বাধীনভাবে গ্রহণ করা হয়। সুতরাং এখানে কেউ যদি সমকামী হয়, তবে আমাদের কিছু এসে যায় না, কেননা এটি প্রকৃতির একটি বৈচিত্র্য, প্রকৃতি ওই মানুষটিকে ওভাবেই তৈরি করেছে, সুতরাং আমাদেরকেও তাকে তার মতো করেই গ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় শোনা যায়, পৃথিবী খ্যাতনামা লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, কবি, চিত্রকর অনেকেই সমকামী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে একজন সৃজনশীল মানুষ আমরা সাধারণ মানুষেরা পৃথিবীটাকে যেভাবে যে দৃষ্টিতে দেখি, তার চাইতে কিছুটা বা অনেকটা ভিন্নদৃষ্টিতে দেখেন বলেই এমন হয়। তাঁরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে ভালোবেসে প্রকৃতির সাথে মিশে যান বিধায় তাঁরা প্রকৃতির কোনও কিছুকে ভেঙে গ্রহণ করেন না। তাঁরা প্রকৃতির অপার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে চান বিধায় তাঁরা প্রকৃতির সবকিছুতেই প্রবেশ করেন। সেই রাজ্যে বিচরণ করার সময় যা-কিছু তাঁকে আনন্দ দেয়, সুখী করে, তিনি সেখানেই থেকে যান, ওটা নিয়ে কে কী বলল, তা অগ্রাহ্য করেই।


পঁচাত্তর।
আমরা কাউকে তিনি যেমন, তেমন করে মেনে নিতে পারি না, এটা আমাদের নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। কেননা আমরা যুগ যুগ ধরে প্রকৃতিকে ভেঙে গ্রহণ করাতে অভ্যস্ত। কিছু মানুষ তার মতো সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করে, এটা তার প্রকৃতি। সেটিকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই, সেটিকে নিয়ে অত চেঁচামেচি করার কিছু নেই, তাকে তার নিজস্ব নিয়মেই বাঁচতে দেওয়া উচিত, যদি আমরা তা করতে না পারি, তবে এটি আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা। সাধারণত সৃষ্টিশীল মানুষ সর্বদাই নতুনের খোঁজে বিভোর থাকেন, তাঁরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যে নিজেকে বিলীন করে দেন। তাঁরা মানুষকে লিঙ্গের ভিত্তিতে কম, আত্মার ভিত্তিতে অধিকমাত্রায় গ্রহণ করেন, অর্থাৎ যাঁর আত্মা শুদ্ধ ও তাঁর নিজের সাথে মিলে, তাঁকে গ্রহণ করে নিতে তাঁর মনে কোনও বাধা কাজ করে না, এজন্য তারা এ বিষয়টিকে আলাদা করে দেখেন না। এমনকি একজন সমকামীও নিজের কাছে মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী মনে করে, কেননা সে সামাজিক প্রথার বাইরের আচরণ করছে, যদিও সেক্ষেত্রে তার নিজেকেও অপরাধী ভাবা বেমানান, কেননা প্রকৃতি তাকে সেভাবেই তৈরি করেছে, এতে তার হাত নেই ও অপরাধবোধের কোনও কারণ নেই।


নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী মনে করার কারণ হচ্ছে, মনের গভীরে কোথাও ক্ষত তৈরি হতে দেওয়া এবং যখনই মানুষের ভেতরে নিজেকে নিয়ে কোনও ক্ষত তৈরি হয়, সেখান থেকেই সে তার অপরাধগুলিকে মুখোশের আড়ালে ঢেকে ফেলতে চায়, কেননা সমাজ তার অপরাধগুলিকে তার থেকে আলাদা করে দেখে। অর্থাৎ, সমাজ মানুষের তথাকথিত বা সমাজ-অস্বীকৃত বা অগ্রহণীয় অপরাধগুলিকে তার থেকে আলাদা করে নেয়, ফলে সে ভালো কি মহান, তা সমাজের চোখে অল্প গুরুত্ব পায়। যার ফলে মানুষ নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন হবার ভয়ে মুখোশের আড়াল করে রাখে। আমাদের সবাইকে অন্যেরা যেমন তাকে তেমন করেই গ্রহণ করতে শিখতে হবে। আমরা ঠিক-ভুলের যে হিসেব করে বসে আছি, এগুলি সবই আমাদের ভ্রান্ত ধারণা, যা আমাদের সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে, আর এই বিভেদ থেকেই সকল যুদ্ধের সূচনা। আমরা যেমন, আমরা যতটা ভালো অথবা যতটা মন্দ, তার সবই প্রাকৃতিক। যদি দুজন সমলিঙ্গের মানুষ একসাথে থেকে যদি ভালো অনুভব করে, তবে সেটা সম্পূর্ণই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।


কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা তার জন্মগত অধিকার লংঘনের সমান অপরাধ। এ বিষয়ে কোনও ধর্ম, কোনও প্রার্থনালয়, কোনও সরকার, কোনও আইন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি দুজন ব্যক্তি একে অপরের সাথে ভালো থাকে অথবা একে অপরের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমরা একটা সুখী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। সেখানে কেউ যদি অন্যের কোনও প্রকার ক্ষতিসাধন না করে পৃথিবীতে সুখ ছড়িয়ে দিতে পারে, তবে আমরা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে মতামত দেবার কেউ নই। বরং আমরা যদি তাদের অপরাধবোধ করাই, তবে সেটা আমাদের জন্যেই ক্ষতিকর, কেননা আমরা এক শ্রেণির মুখোশধারী মানবসমাজ তৈরি করছি। ওরা আমাদের জন্যই মুখোশ ধারণ করে বাঁচতে বাধ্য হবে। এটা সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না কখনওই। যখনই আমাদের মাঝে কোনও বিষয়ে অপরাধবোধ তৈরি হয়, তখনই আমাদের ভেতরে এক প্রশ্ন আসে---আমরা হয়তো গুরুতর কিছু খারাপ করছি, অন্যথায় আমরা নিজেদের পাগলামো নিয়ে নিজেরাই হাসাহাসি করতে পারতাম! কিন্তু যখন থেকে আমরা নিজেকে অপরাধী মনে করছি, তখন থেকেই আমরা আমাদের সেই কাজগুলিকে যুক্তিসহকারে লুকিয়ে ফেলতে শুরু করে দিই।


আমরা যদি জানতাম, আমরা আসলে এক-একটি আত্মা, সেখানে বাহ্যিক গঠন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়---অন্তত কিছু মানুষের জন্য, যারা আমাদের সমাজেরই অংশ, তাহলে আমাদের ভেতরে এই সব বিষয়কে সহজভাবে মেনে নেওয়া সহজ হতো। ধ্যান মূলত যৌনসম্পর্কের ঊর্ধ্বে যেতে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে থাকে। সমকামিতা, উভকামিতা নয়তো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, এই সবকিছুই আত্মার প্রতি মানুষের আকর্ষণের কাছে গৌণ। মানুষ মূলত আত্মার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটা এক আত্মার সাথে অন্য আত্মার মিলন। আমরা যখন নিজেকে পুরোপুরি এসব ভাবনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারব, তখনই আমাদের সাথে ভিন্ন কিছু ঘটবে। কৌমার্য একটি নেতিবাচক শব্দ, যার অর্থ, যৌনসম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত না থাকা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সর্বপ্রকার যৌন-উত্তেজনার ঊর্ধ্বে থাকা। এটা সম্ভব কি আদৌ? এর অর্থ একপ্রকার এটা দাঁড়ায় যে, ঐশ্বরিক শক্তি নিজের মাঝে ধারণ করে বেঁচে থাকা অথবা ঐশ্বরিক হয়ে থাকা। সাধারণত এটি সন্ন্যাসীদের জীবনধারা। ওঁরা কৌমার্য নিয়ে থাকেন বলেই নিজেকে সাধনায় মগ্ন রাখাটা ওঁদের পক্ষে সহজ হয়। তবে যৌনতা নিয়ে নিজের মাঝে ক্ষুদ্ধ থাকার চাইতে ভালো নিজেকে এর থেকে মুক্ত রাখা। নিজসত্তা যতটা শুদ্ধ অথবা যতটা নোংরা হোক না কেন, এটা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে-থাকা অবাঞ্ছনীয়, কেননা নিজের সকল ভয় কাটিয়ে নিজেকে খুঁজে পাবার একটাই একমাত্র রাস্তা---নিজেকে সুখে ও স্বস্তিতে রাখা।


ছিয়াত্তর।
অনেক সময় আমরা আমাদের খ্যাতি, জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য আমাদের কিছু দিক, যা অন্যেরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে না অথবা যা সামাজিক নিয়মবহির্ভূত, এমন কিছু সকলের থেকে আড়াল করে রাখি। আমরা হয়তো ভাবি, এটি সকলের সামনে আমাদের আসল চেহারা তুলে ধরবে। প্রকৃতপক্ষে, নিজের স্বরূপ লুকিয়ে কখনও কোনও সৎ-সত্তা, সৎ-আত্মা ধারণ করা যায় না। যেদিন থেকে আমরা আমাদের স্বরূপ লুকিয়ে সকলের সামনে নিজেদের তৈরি একটা খোলস তুলে ধরি, আমরা আসলে সেদিন থেকেই আমাদের ভেতরের কিংবদন্তি সত্তাটিকে মেরে ফেলি। কেননা একজন কিংবদন্তি কখনও তার অনুসারীদের হারিয়ে ফেলার ভয় করে না, এমনকি অন্য কোনও ভয় তাকে তার স্বরূপ তুলে ধরতে বাধ সাধে না। মাথায় রাখতে হবে, একজন কর্তৃত্বপূর্ণ মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোনও কর্তৃত্ব থাকে না। যিনি এরূপ দাবি করেন, তিনি একজন ভণ্ড। মানষের অভ্যন্তরীণ সত্তাই তার কর্তৃত্ব বহন করে, কোনও বাহ্যিক সত্তা তার কর্তৃত্ব বহনের কাজটা করে না। যখনই একজন কিংবদন্তি তার কর্তৃত্ব হারাবার ভয়ে কোনও কিছু লুকোয়, ঠিক সেদিন থেকেই সে তার প্রকৃত কর্তৃত্ব হারায়। একজন কিংবদন্তি হতে চাইলে একজন কিংবদন্তির মতোই আচরণ করতে হয়। যারা তা করতে পারে না, তাদের পক্ষে ওরকম হওয়া সম্ভব নয়। যে লোক জয়ীর বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে না, তার পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। পরাজিতের মতো করে চললে ও ভাবলে, আজীবন পরাজিত হয়েই কেটে যাবে।


আমাদের মানসিক দ্বন্দ্বগুলি যতই নোংরা, পানসে, অদ্ভুত হোক না কেন, এই সবকিছু নিয়েই আমরা মানুষ এবং একজন সুস্থস্বাভাবিক মানুষের কাজ, তার প্রকৃতসত্তাটিকে বেড়ে উঠতে সর্বপ্রকারে সাহায্য করে যাওয়া। ধ্যান মানুষের সেই সত্তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে। আমরা যেমনই হই না কেন, এ থেকেই আমরা আলোর দেখা পেতে পারি। সুতরাং যখন আমরা আমাদের স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক কোনও আচরণ নিয়ে চিন্তিত হই, তখন আমাদের আরও ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেননা এই ব্যথার মধ্য দিয়েই আমরা আলোর পথ খুঁজে পাব। সত্যকে কখনও ব্যক্ত করা যায় না। এবং যদি সত্যকে ব্যক্ত করা না যায়, তবে আমরা যা বলি, সেগুলি কেবল কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন সত্যকে ব্যক্ত করার কোনও ভাষা না থাকে, তবে সেটিকে বোঝার কোনও অবকাশ নেই। সত্যকে বরং আমাদের বোধশক্তির মাধ্যমেই বুঝে নিতে হবে। কেননা সমস্ত অব্যক্ত গভীরতাকে নিজের সর্বোচ্চ বোধকে কাজে লাগিয়ে বুঝে নিতে হয়।


একজন শিষ্য কেবল তার গুরুকে আত্তীকরণ করবে। সব সময় প্রত্যেক শব্দের অর্থ খুঁজতে নেই। বরং দেখতে হবে, সেই শব্দ আমাদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এনে দিচ্ছে, তা। সবকিছুর ব্যাখ্যা খোঁজার মানেই হলো, নিজেকে একটা মহৎ জীবনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। ধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই শক্তির প্রধান উৎস। প্রতিটি দিন, প্রতিমুহূর্ত বেঁচে-থাকাই আমাদের প্রধান কাজ। আমরা সব সময় আগামীকালের হিসেবে ব্যস্ত হয়ে আজকের সময় নষ্ট করি। আমরা বলি, আমরা যদি আজকে থেকে ধ্যান শুরু করি এবং আগামীকাল যদি আমাদের গুরু মৃত্যুবরণ করেন, তবে আমরা কার কাছে ধ্যানের জ্ঞানার্জন করব? তখন কি আমরা আর-এক গুরুর খোঁজ করব, না কি আমাদের মৃত গুরুকেই অনুসরণ করব? আর এইসব অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের মাধ্যমেই আমরা আমাদের বর্তমানে না-বেঁচে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা খুঁজে ফিরি। আমাদের বুঝতে হবে, ভবিষ্যৎ নিজে নিজের ভার নিয়ে নেবে, ঠিক যেমন আমরা আজ গুরুর খোঁজ পেয়েছি, তেমনি আগামীকাল তার নিজ নিয়মে নিজের প্রয়োজনে সেই সবকিছু আমাদের কাছে প্রকট হবেই হবে, যা যা আমাদের প্রয়োজন। কেননা শিষ্য যখন তৈরি হয়, তখনই গুরুর আগমন ঘটে।


আমরা কেবল আজকের পথ অনুসরণ করে যাব, আজকের দেখানো পথ পুরোটা নিজের মাঝে ধারণ করব। আমাদের কাজ, আজকে নিজের সাথে পরিপূর্ণ সৎ হয়ে বাঁচা। আর সেভাবে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরকে সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোনও কিছু মুখস্থ করে জানা এবং কোনও কিছু অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানবার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আমরা যখন কোনও বিষয় পড়ে জানি, তখন আমরা সেটুকু জ্ঞানই কম্পিউটারের মতো অনর্গল বলে দিতে পারি। আবার কোনও কিছু যখন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জানি, তখন আমরা সে-বিষয়ে সম্ভাব্য সকল প্রশ্ন এবং তার উত্তর করতে পারি। ধ্যান কী, এ বিষয়টা নিয়ে যদি আমরা ব্যাপক পড়াশোনা করি, তবে হয়তো আমরা এর কৌশলগুলি বলে দিতে পারি, কেননা সেগুলি আমরা মুখস্থ করেছি, কিন্তু যদি আমাদের এর গুণগত দিক সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হয়, তবে আমাদের অবশ্যই ধ্যানের গভীরে প্রবেশের মাধ্যমেই সে সম্পর্কে বলতে হবে।


সাতাত্তর।
আমরা প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় অনন্য, অর্থাৎ আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা। আমরা প্রত্যেকেই অসাধারণ। এরপরও যদি আমরা আবারও নিজেদের অসাধারণ করে গড়ে তুলতে চাই, তবে মূলত আমরা বোকার রাজ্যে বসবাস করছি, কেননা স্বর্ণকে পুনরায় স্বর্ণে রূপান্তর করা যায় না। সুতরাং আমরা যদি এই চিন্তায় বিভোর থাকি যে আমরা নিজেদের অসাধারণ করে গড়ে তুলব, তাহলে আমরা যতবারই এই চেষ্টা চালিয়ে যাব, ঠিক ততবারই ব্যর্থ হব। আমরা বারে বারে ব্যর্থ হয়ে ভাবতে পারি যে আমাদের হয়তো নিজের উপর আরও অধিক মনোযোগ দিতে হবে এবং এরূপ ক্রমাগত ব্যর্থতায় আমাদের পুরো জীবনটাই হতাশায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। আমাদের থেকে উৎকৃষ্ট অথবা আমাদের থেকে নিকৃষ্ট বলে কেউ নেই। আমরা সকলেই যার যার স্থানে উৎকৃষ্ট। তাহলে কী করে আমরা নিজেদেরকে অন্যের সাথে তুলনা করতে পারি? আমাদের কারও সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা সম্ভব নয়। যখনই আমরা নিজেদের অন্যের সাথে তুলনায় জড়াব, তখন থেকেই আমাদের মাঝে সমস্যার সৃষ্টি হবে। যখন আমরা নিজেদের অন্যের সাথে তুলনা করি, তখন আমাদের মাঝে দুটি জিনিস দেখা দেয়। এক, যখন আমরা নিজেকে আমাদের থেকে নিম্নস্থ কারও সাথে তুলনা করি, তখন আমাদের মাঝে একপ্রকার আত্মতৃপ্তি কাজ করে। দুই, যখন আমরা নিজেকে আমাদের থেকে উচ্চস্থ কারও সাথে তুলনা করি, তখন আমাদের মাঝে একপ্রকার হীনমন্যতা কাজ করে।


এই দুইটি অবস্থানই মূলত সাময়িক। এটির কোনও দীর্ঘস্থায়ী ফল নেই, কেননা এই দুটি অবস্থাই প্রকৃতপক্ষে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো কাজ করে। আমরা হয়তো কারও থেকে কিছুটা উচ্চস্তরে, আবার সেই আমরাই অন্যদিক দিকে অন্য কিছু সংখ্যকের চাইতে নিম্নে। সুতরাং আমরা একটি মুদ্রার যেকোনও এক দিক নিয়ে চলতে পারি না, আমাদের একই সাথে দুটো দিক নিয়েই চলতে হয়। মানুষ যেখানে গেলে নিজেকে নিম্নস্তরের মনে করে, সে সেখানে যায় না। আবার যেখানে গেলে সে অন্যের থেকে কিছুটা উচ্চে থাকতে পারে, সেখানেই বেশি বেশি যায়। এর অর্থ, মানুষ নিজেকে নিজের অবস্থানের সাথে সব সময় অন্যকে তুলনা করতে পছন্দ করে এবং যেখানে গেলে যেই পরিবেশে তার নিজেকে রাজা মনে হয়, সে ওই পরিবেশেই বেশি থাকতে পছন্দ করে। এটি নিজেকে তুলে ধরার একটি ভুল পথ, কেননা কেউ হয়তো আমাদের চেয়ে দেখতে কিছুটা কুৎসিত, কিন্তু সেই ব্যক্তিটাই হয়তো আমাদের চাইতে অনেক বেশি মেধাবী। কেউ হয়তো আমাদের চাইতে কিছুটা নোংরা, কিন্তু সেই ব্যক্তিটিই হয়তো আমাদের থেকে অধিক প্রজ্ঞাবান, হয়তো আমরা প্রজ্ঞার দিক থেকে তার তুলনায় শূন্য। এমনকি আমরা যদি শীর্ষেও চলে যাই, তারপরও আমাদের কিছু অপ্রাপ্তি থেকে যাবে এবং আমরা যদি কেবল অন্যের সাথে নিজেকে তুলনাই করতে থাকি, তবে আমরা শীর্ষাবস্থা থেকেও হতাশ অনুভব করব।


নেপোলিয়ন উচ্চতায় মাত্র ৫ ফিট ৫ ইঞ্চি ছিলেন, তারপরও তিনি তাঁর খাটো পা দিয়ে বিশ্ব জয় করেছেন, যা কিনা একজন ৬ ফিট বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট মানুষ পারেনি। তারপরও নেপোলিয়ন সর্বদাই হতাশায় থাকতেন যখন তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনির সামনে দাঁড়াতেন, কেননা তাঁর সেনাদের সকলেই তাঁর থেকে উচ্চতায় এবং শক্তিতে অধিক ছিল। তিনি যখন তাঁর সৈন্যদের সামনে দাঁড়াতেন, তখন তাঁকে ক্ষুদ্রকায় এক পিগমির মতো দেখাত, যা তাঁকে সারাজীবনই হতাশ করেছে। একবার নেপোলিয়ন তাঁর কক্ষে কাজ করছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডারটি পড়ে যায়। তিনি তাঁর খাটো হাত দিয়ে টেবিলে বসে সেটি তুলতে পারছিলেন না। তখন তাঁর এক সৈন্য তাঁকে বলেছিলেন, আমি তুলে দিচ্ছি, স্যার। আমার হাত আপনার হাতের চাইতে লম্বা। নেপোলিয়ন সেই মুহূর্তে খুব রেগে যান।


নেপোলিয়ন ছোটোবেলায় বিড়ালকে খুব ভয় পেতেন, এতটাই যে, এটা তাঁর একটা ফোবিয়া হয়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, তিনি তাঁর প্রথম যুদ্ধটি বিড়ালের জন্যেই হেরেছিলেন, কেননা সে যুদ্ধে প্রতিপক্ষের প্রথম সারিতেই ৭০টি বিড়াল ছিল। নেপোলিয়ন অনায়াসে সিংহের সাথে যুদ্ধে জিতে যেতেন, কিন্তু বিড়াল তাঁর দুর্বলতা ছিল। তাই বলছি, মূলত তুলনা জিনিসটিই অসমীচীন, কেননা কেউ কারও ঊর্ধ্বে নয়, কেউ কারও নিম্নে নয়, কারণ কেউ কারও সমকক্ষও নয়। তুলনার ব্যাপারটা ভুলে বাঁচলে যদিও এটি আমাদেরকে সাময়িক সুখ অথবা দুঃখপ্রাপ্তির হাত থেকে সরিয়ে নেয়, তবু এটি আমাদের এক অপার আশীর্বাদ এনে দেয়। আশীর্বাদ কোনও সুখ অথবা দুঃখ নয়, এটি এক প্রকট অনুভূতি, যা আমাদের চোখে জল এনে দেয়, যা আমাদের নৈঃশব্দ্যের ভাষা বুঝতে শেখায়।