অস্পষ্ট জার্নাল: ১২


আটাত্তর।
আমরা আমাদের অন্তরে যা-কিছু ধারণ করি, আমাদের বাইরের পৃথিবীর সব জায়গাতেই আমরা তা-কিছুই দেখতে পাই। আমরা যদি নিষ্পাপ মনের অধিকারী হই, তবে আমাদের চোখে পৃথিবীর সব কিছুই নিষ্পাপ হয়ে ধরা দেয়। অন্যথায়, আমরা যখন নিজেদের মনে ময়লা জমিয়ে রাখি, তখন আমরা আমাদের চারপাশে কেবল ময়লাই দেখি, চারপাশের খারাপ দিকগুলোই কেবল আমাদের নজরে পড়ে। একজন পবিত্র ব্যক্তি কখনও সর্বত্র পাপীকে খুঁজে বেড়ায় না, এমনকি সে যদি হাজারো মন্দ সাহচর্যেও থাকে, সেখান থেকেও সে কিছু-না-কিছু সৌন্দর্য খুঁজে বের করে আনে। যখন চারপাশের মন্দের মাঝেও আমরা সৌন্দর্য খুঁজে পাবো, কেবল তখনই আমরা স্রষ্টার উপস্থিতি অনুভব করতে পারব। সুন্দর কিছুর উপস্থিতি নিজের মধ্যে তৈরি করতে না-পারলে স্রষ্টার উপস্থিতি টের পাওয়া সম্ভব নয়। স্রষ্টা এক্ষেত্রে দৃশ্যমান, স্রষ্টাকে খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে নিজের কাছেই ফিরে আসতে হবে। আমাদের নিজের ভেতরে সৃষ্ট ভালো কাজের সৌন্দর্যবোধ, শিল্পীগুণ, সংবেদনশীলতা এই সকল অনুভূতির মাধ্যমেই স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায়, কেননা স্রষ্টা আমাদের সকলের মাঝে সচেতনভাবেই বিদ্যমান। আমাদের সমস্ত সক্রিয় কাজের মাঝেই স্রষ্টার বাস। আমরা যখন আমাদের সকল কাজ সচেতনতার সাথে সম্পাদন করব, তখন আমাদের কাজগুলো আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সকল ধরনের স্বচ্ছতা এবং পবিত্রতাই আমাদের আত্মাকে ধারণ করে, ফলে সেগুলিই হচ্ছে ধর্ম।


আমরা মাঝে মাঝে সব জায়গায় কী একটা যেন খুঁজতে থাকি, আর খুঁজতেই থাকি। আমরা নিজেরাও জানি না আমরা কী খুঁজছি। আমাদের চোখ, আমাদের হৃদয় অধৈর্য হয়ে কেবলই এক অদৃশ্যের খোঁজ করে যেতেই থাকে। বছরের পর বছর আমারা কেবল খুঁজতেই থাকি। আমরা কখনও একে সত্যের খোঁজ বলি, কখনওবা একে স্রষ্টার খোঁজ বলি। যদি আমরা সত্যকে না-ইবা খুঁজে পাই, তবে একে হারাবার কিছু কি আছে? যদি আমরা কখনও দৃশ্যমানভাবে স্রষ্টার সান্নিধ্যে না-ইবা যাই, তবে কি স্রষ্টাকেও হারিয়ে ফেলার অথবা স্রষ্টা থেকে আলাদা হবার কিছু কি আছে? যেহেতু আমরা আমাদের স্রষ্টার দৃশ্যমান কোনও নিশ্চিত রূপ আজ পর্যন্ত পাইনি, তবে এর অর্থই-বা কি এই যে স্রষ্টা বলে কিছু নেই? আমরা জানি, এমনকি আমাদের অবর্তমানেও স্রষ্টা সদাবিরাজমান। অথচ আমরা পাগলের মতো কেবল মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, এবং পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মালয়ে স্রষ্টাকে পাবার আশায় ভিড় জমাই। যদি স্রষ্টা আমাদের মাঝেই না থাকেন, তবে কী করে তিনি ধর্মালয়ে থাকবেন? যদি আমাদের কাছেই স্রষ্টা অদৃশ্য হন, তবে কি তিনি ধর্মালয়ে দৃশ্যমান হবেন? যার নিজের মধ্যে স্রষ্টা নেই, সে কোনও ধর্মালয়ে গিয়েও তাঁকে খুঁজে পাবে না। আমরা এমনভাবে স্রষ্টাকে ধর্মালয়গুলোতে খুঁজি, যেন সেখানে না গেলে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলব, নয়তো তিনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবেন!


আমরা যদি ধর্মসত্য-সচেতন মানুষ হই, তবে সত্যের খোঁজে আমরা প্রতিটি ধর্মালয়ের দরজায় কড়া নাড়ি। আমরা ভাবি, যা আমরা হারিয়েছি অথবা যে সত্যকে আমরা এতকাল অবহেলা করে এসেছি, হয়তো সেখানে তার দেখা পাবো, এবং বেলাশেষে আশাহত হয়ে আবার শূন্যহাতে ভগ্নহৃদয়ে নিজের কাছেই ফিরে আসি। আমরা সব সময় ভাবি, আমাদের কী যেন হারিয়ে গেছে, কিন্তু যতদিন না আমরা কী হারিয়েছি, তা জানতে পারব, ততদিন পৃথিবীর সব ধর্মালয়ে গিয়েও কি আমরা তার খোঁজ পাবো? আমরা আসলে কী হারিয়েছি? আমরা কি ভাবছি যে আমরা আমাদের স্রষ্টাকেই হারিয়েছি? স্রষ্টাকে আসলে আমরা কবে কখন হারিয়েছি, অথবা কখনই-বা আমরা আমাদের স্রষ্টাকে পেয়েছিলাম? আমাদের স্রষ্টা কি সশরীরে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন? তিনি কি বলেছিলেন যে তিনি আমাদেরই হয়েছেন, অথবা তিনি কি আমাদের ছেড়ে যাবার বেলায়ও বলে দেন যে, তিনি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন? তাহলে যা আমাদের হাতেই আসেনি, যা-কিছু আমরা কখনও দেখিনি, যা-কিছুর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করিনি, যা সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণই অজ্ঞ, সেই মহান সত্তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কী করে আমাদের গ্রাস করে নেয়? আমরা সেই সত্যকেই-বা কী করে হারাই, যা এমনকি আমরা পরিপূর্ণভাবে জানিও না?


যতদিন না আমরা জানব আমরা কী হারিয়েছি, ততদিন পর্যন্ত আমাদের খোঁজ কি শেষ হবে? যদি আমরা স্রষ্টাকে সর্বত্র, সকল ধর্মালয়ে, সকল ধর্মগ্রন্থে কেবল খুঁজেই যেতে থাকি, তবে একসময় স্বয়ং আমাদেরই নিজস্ব সত্তা আমাদের একই বাক্য বলে যেতে থাকবে যে, আমরা ধর্মালয়ের সব দরজা ঘুরেছি, কিন্তু বেলাশেষে আমাদের সেই শূন্যহাতেই ফিরতে হয়েছে। তবে কি তখন আমরা ধর্মালয়ের দোষ দেবো? এক্ষেত্রে আমাদের ধর্মালয়গুলোর কিছুই কি করার আছে? খোঁজার নিয়ম হচ্ছে, শুরুর স্থান থেকে খুঁজতে হয়। যে শূন্যতা আমার হৃদয় থেকেই শুরু, তার খোঁজ আমরা বাইরে কী করে পাই? যখনই আমরা নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রষ্টার খোঁজ করতে যাব, তখনই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা আসলে কী হারিয়েছি এবং আমরা কীসের খোঁজ করছি। আমরা যাকে হারিয়েছি বলে ভাবছি, সেটি কি আদৌ হারানো গেছে, না কি আমাদের মাঝেই আছে? যদি আমরা কোথায় হারিয়েছে, সেটাই না জানি, তবে আমরা কোথা থেকে খুঁজতে শুরু করব? যদি আমাদের কী অসুখ, সেটাই না জানি, তবে কীসের ওষুধ খাবো? অথবা আমরা যদি আমাদের রোগটিকে নির্ভুলভাবে সনাক্ত করতেই না পারি, তবে ডাক্তারের উপস্থিতিতেও কি আমাদের আরোগ্যলাভ করা সম্ভব? কিছু রোগ আছে, যেগুলি কিনা শ্রেষ্ঠতম ডাক্তারের পক্ষেও সারানো সম্ভব নয়।


যা কিনা সকল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং কৌশলের ঊর্ধ্বে, সেই রোগটি হচ্ছে হৃদয়ের রোগ। এমনকি আমরা যদি পৃথিবীসুদ্ধ সব ডাক্তার একত্র করেও এই রোগের নিরাময় করতে যাই, আমরা বরাবরই ব্যর্থ হব, কেননা আমরা ভুল জায়গায় নিরাময় খুঁজতে গিয়েছি। ঠিক তেমনি আমরা যদি আমাদের স্রষ্টাকে সকল ধর্মালয়েও খুঁজি, তারপরও আমাদের পক্ষে স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব নয়, কেননা আমরা ক্রমাগত ভুল জায়গায় তাঁর খোঁজ করে চলেছি। ঠিক এই মুহূর্তে যখন আমরা আমাদের স্রষ্টার খোঁজ করে চলেছি, তখন আমাদের কোনও ধর্মালয়ে নয়, বরং একজন আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে যেতে হবে। একজন গুরুও একজন চিকিৎসক, কিন্তু আমাদের বাহ্যিক শরীরের চিকিৎসক নন, তিনি আমাদের হৃদয়ের চিকিৎসক, আমাদের মনের চিকিৎসক। এবং একজন গুরুর প্রথম কাজই হচ্ছে, শিষ্য কীসের খোঁজ করছে, প্রথমেই সেটি তাঁর নিজের কাছে পরিষ্কার করা। কেননা যখনই আমরা জানতে পারব, আমরা কীসের খোঁজ করছি, তখন আমাদের খোঁজা আরও সহজ হয়ে যায়। যখন রোগীর রোগ সনাক্ত হয়ে যায়, তখন তার ওষুধ দেওয়াও ডাক্তারের জন্য সহজ হয়ে যায়।


উনআশি।
আমরা যদি আমাদের সমস্যার প্রকৃত স্থান সনাক্ত করতে না পারি, তাহলেও আমাদের পক্ষে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সমস্যা যদি পেটে থাকে, আর আমরা যদি দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাই, তবে আমাদের পক্ষে সেরে ওঠা কি আদৌ সম্ভব? বলা হয়ে থাকে, রোগ সনাক্ত করতে পারলেই অর্ধেক অসুখ সেরে ওঠে। কিন্তু যদি আমরা আমাদের রোগটাই সনাক্ত করতে না পারি, তবে পৃথিবীর সকল ওষুধেও কিছুতেই আরোগ্যলাভ হবার নয়, বরং বিপদের আশঙ্কা আরও কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। আমাদের হৃদয়টা একটা সিংহাসন। যখনই আমরা সত্যের খোঁজে বহির্মুখী হই, তখনই আমরা আমাদের সেই সিংহাসন থেকেই পালিয়ে বেড়াই। অন্যত্র জায়গা খুঁজে ফিরি। জন্মগতভাবেই মানুষ ভালোবাসা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, পরিবার, আত্মীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ এই সব কিছুর সমন্বয়ে এসে ভালোবাসার আশীর্বাদটুকু সে হারাতে শুরু করে। এই হারানো থেকেই মূলত আমাদের মাঝে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। অতঃপর আমরা স্রষ্টার খোঁজ করি। আসলে আমরা স্রষ্টার অজুহাতে আমাদের হারানো ভালোবাসারই খোঁজ করে থাকি।


কোনও কিছু ফিরে পেতে হলে আগে সেটিকে হারাতে দিতে হয়, আর আমাদের প্রকৃতি এক চক্রাকারে আমাদের মাঝ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ভালোবাসা হারানোতে সাহায্য করে থাকে। আমরা আসলে কখনও স্রষ্টাকে হারাই না, আমরা কেবল আমাদের স্রষ্টার কাছে যাবার যে মাধ্যম, সেটিকে হারাই। আর স্রষ্টার কাছে যাবার প্রধান মাধ্যমই হচ্ছে ভালোবাসা। ঠিক যেই মুহূর্তে আমরা আমাদের হারানো ভালোবাসাকে, অর্থাৎ ভালোবাসার অনুভূতিগুলো ফিরে পাই, সেই মুহূর্ত থেকেই আমরা আমাদের স্রষ্টার দরজায় পৌঁছই। স্রষ্টার কোনও রূপ নেই। আমরা আমাদের স্রষ্টাকে কখনওই খুঁজে পাবো না, যদি না আমরা আমাদের স্রষ্টার সাথে কোনও সম্পর্কে না জড়াই। কাউকে পাওয়ার মূল পদ্ধতিটি হচ্ছে, তার সাথে নিজের আত্মিক সংযোগ তৈরি করা। আর সেই আত্মিক সম্পর্কের শুরুটা হয়ে থাকে ভালোবাসার মাধ্যমেই। যখন আমরা পুরোপুরি অন্ধ থাকি, তখন আমাদের পক্ষে কিছু দেখা সম্ভব নয়। যদি আমরা অন্ধ হই, তবে কি আমাদের পক্ষে সূর্যের আলো দেখা সম্ভব? সুতরাং যে সত্য সর্বদা আমাদের চারপাশেই বিদ্যমান, তাকেও দেখা সম্ভব হবে না, যদি আমরা অন্ধ হই। যখন আমাদের কোনও দৃষ্টিশক্তিই না থাকে, তবে যদি সত্য আমাদের চোখের সামনেও থাকে, তারপরও আমাদের পক্ষে সত্যকে দেখা বা জানা সম্ভব হবে না। ভালোবাসা আমাদের চোখের সেই জ্যোতি, যা আমাদেরকে অদৃশ্য কিছু দেখতে সাহায্য করে।


স্রষ্টা আসলে আমাদের সামনেই রয়েছেন, কিন্তু তাঁকে দেখার সেই দৃষ্টিশক্তি আমাদের নেই। ভালোবাসা স্রষ্টাকে অনুভব করতে পারার একমাত্র শক্তি। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করার আগে আমাদের নিজেদের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে হবে। আমাদের নিজেদের সম্পূর্ণরূপে জানতে হবে। নিজের সকল দোষ, অযোগ্যতা, অপারগতা, খুঁত, সব কিছু জেনে নিয়ে নিজেকে নিজের কাছে পুরোপুরি উন্মোচিত করতে হবে। এজন্য আমরা একটা কৌশল প্রয়োগ করতে পারি। আমরা একটা আয়নার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারি। এতে করে আমাদের সৌন্দর্য, আমাদের অসম্পূর্ণতা, আমাদের খুঁতগুলো আমাদের নজরে আসবে। প্রতিবার আমরা নিজেদেরকে যখন আয়নার সামনে দেখব, তখন স্থিরদৃষ্টিতে একাগ্রতা নিয়ে ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ আমরা একদিনে অনেক বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই কথাটি বলব এবং বেশ কিছুদিন আমরা আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে এই নিজের উপর এই কৌশলটি প্রয়োগ করব। এতে করে আমাদের নিজের প্রতি একটা অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি হতে থাকবে, আমাদের নিজেদের ভেতরে নিজেকে নিয়ে ভালো অনুভূতি জাগবে।


এটি করার সময় আমাদের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি কাজ করতে থাকবে। আর প্রতিবার আমরা যখন নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই ‘ভালোবাসি’ বলব, তখন লক্ষ করলে বুঝতে পারব, আমাদের মন সে কথায় ঠিক সায় দিতে চাইছে না, ঠিক ওই মুহূর্তে আমাদের খুঁতগুলো বারে বারে মনের কোথায় যেন চাপ সৃষ্টি করতে থাকবে। আমাদের মন তখন আমাদের বোঝাতে চাইবে, আমি নিজেকে মোটেও ভালোবাসি না, কেননা আমি নিজের সাথে কিছুদিন আগে অমুক একটি অযাচিত কাজ করেছি, নয়তো আমার মন আমাকে বলবে, আমাকে ভালোবাসা যায় না, কারণ আমার গায়ের রঙ কালো, নয়তো কখনও মন বলবে, আমি ভালো কাজ করিনি, এজন্য আমি নিজেকে ভালোবাসতে পারি না। আমার মন আমাকে বোঝাবে, আমি যেসব কাজ করেছি, সেগুলো যে মেনে নেওয়ার মতো না, এটা যদি লোকে জানত, যদি আরও জানত আমি কী কী সব ঘৃণ্য কাজ করেছি, তবে ওরা কেউই আমাকে ভালোবাসতে পারত না। মাঝে মাঝে নিজেকে নিজের কাছে একটা ঠগ, প্রতারক বলে মনে হবে, যে কিনা কখনও কখনও নিজের সাথে, আবার কখনও অন্যের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে, অথবা আমাদের মনে হতে পারে, যদি আমরা আরও একটু লম্বা হতাম, তবে আমাকে ভালোবাসা যেত! আসলে এভাবে কখনওই আমরা করতে পারি না, কেননা যখন আমরা নিজেদের দিকে সচেতন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাই, তখন আমাদের সব কিছু নিজেদের কাছে এভাবেই ধরা পড়ে, অবচেতন মনেই আমরা এসবই ভাবতে থাকি।


ঠিক এমন সময়, অনেকেই এই খেলাটি বন্ধ করে দিতে চায়, কেননা কেউ কেউ নিজের কাছেও নিজেকে উন্মোচিত করতে চায় না, অথবা নিজের ভেতরে একধরনের অন্তর্দ্বন্দ্বে পুড়তে থাকে, অনেকেই এটিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই খেলা চালিয়ে যেতে হবে, ধৈর্যহারা হওয়া যাবে না, এটিই এই খেলার কৌশল। যখনই আমরা খেলাটি চালিয়ে নেবো, পরক্ষণেই আমাদের ভেতরে আরও এক আশ্চর্যজনক কিছু ঘটে যাবে, আমাদের মন আমাদের এত শত অক্ষমতা, খুঁত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ভালোবাসতে চাইবে, নিজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে এটিই আমরা নিজেদের সাথে এবং আমাদের অন্যান্য সম্পর্কগুলির সাথে করে চলেছি। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা, যা আমাদেরকে নিজের থেকে এবং অন্যের থেকে সব সময় আলাদা করে রাখে। আমাদের প্রতিটি সম্পর্কই এরূপ এক-একটি আয়নার মতো, যা আমরা আমাদের নিজেকে দেখার সময় কাজে লাগাই। আমরা যখন নিজের সামনে আয়না তুলে ধরি, সেটি আমাদের নিজেদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কী, সেটি দেখতে সাহায্য করে, ঠিক তেমনি যখন অন্যরা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন এটি প্রকৃতপক্ষে সেই আয়নাটিই, যেটির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এটি নিজের সাথে আমাদের সম্পর্ক, নিজের প্রতি আমাদের মনোভাব, অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক, অন্যের প্রতি আমাদের মনোভাব এই সব কিছুই একে একে মেলে ধরে।


আশি।
আমরা নিজেদের সাথে কীরূপ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি, সেটি অপরের প্রতি আমাদের ব্যবহার, আমাদের মনোভাব খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারব। যখন আমাদের প্রিয়জন আমাদের সাথে এমন কোনও খারাপ আচরণ করে, যা আপাতদৃষ্টিতে দেখতে দৃষ্টিকটূ মনে হতে পারে, কিন্তু একটু ভালো করে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব, এটি আসলে আমাদের নিজের সাথে নিজেরই সম্পর্কের ফল। আমরা আমাদের প্রিয়জনকে, আমাদের প্রিয়জনের কোনও মনোভাব কিংবা কোনও আচরণকে মেনে নিতে পারিনি, অথবা পারছি না, কারণ আমরা আমাদের নিজেদের ভেতরের সেই আচরণটিকে মেনে নিতে পারিনি, আমরা আমাদের সেই আচরণটিকে ছেঁটে ফেলতে চাইছি বিধায় আমরা অন্যের মাঝেও যখন তেমন কিছু দেখছি, আমরা সেটিকে মেনে নিতে আর পারছি না। এই পুরো ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরিই আমাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। এটিকে প্রকৃত ভালোবাসা বলে না, নিজের প্রকৃত সত্তা থেকে বের হয়ে যে ভালোবাসা, সেটি কখনওই প্রকৃত ভালোবাসা নয়। এভাবে অন্যকেও ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমরা যদি নিজের সকল কদর্যতাকে মেনে নিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে পারি, নিজেকে গ্রহণ করতে পারি, তবে কেন আমরা অন্যকে সেভাবে মেনে নিতে পারছি না? আদৌ কি এটিকে কোনও ভালোবাসা বলে?


আমরা যদি প্রতিমুহূর্তে নিজের প্রতি বিচারকের দৃষ্টি ছুড়ে দিই, নিজেকে নিজের চোখে নিচু করে, কৌতুক করে উপস্থাপন করি, তবে আমরা অন্যকেও সে চোখেই দেখব, কেননা আমরা নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি, আমরা নিজের রাজ্যে পুরোপুরি ঢুকতে পারিনি, আমরা কোথাও-না-কোথাও নিজেকেই অস্বীকার করে চলেছি। ঠিক এ সকল কারণেই ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাই। আমাদের চিন্তাভাবনার শক্তি প্রচুর, যদি আমরা কোনও কিছু চিন্তা করে বিশ্বাস করি, তারপর যদি আমরা সেটি নিয়ে আর কখনওই আর মাথা না ঘামাই, তা সত্ত্বেও সেটি ঘুরে ফিরে বাস্তবে রূপলাভ করে আমাদের পূর্ণ অবচেতন মনের সাহায্যে। যদি আমরা অন্যের প্রতি, আমাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালো আচরণ বজায় রাখতে চাই, তাদের ভালোবাসতে চাই, তবে আমাদের নিজেদেরকে সবার আগে নিজেদের চোখে ভালো থাকতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে, সে আমরা যত অগ্রহণযোগ্যই হই না কেন! নিজেকে আমাদের পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে, নিজের কাছে নিজেকে ভালো হতে হবে। আমাদেরকে নিজেদের ভেতর থেকে সকল অশুভ চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমরা নিজেদের ভালোবাসার আগে সব সময় একটা শর্ত জুড়ে দিই। কীরকম?


আমরা মনে মনে বলি, যদি আমি আর-একটু চিকন হতাম, যদি আর একটু সুন্দর হতাম, যদি আমাদের চোখদুটো আরও সুন্দর হতো, যদি অমুক ব্যক্তিটি দেখতে আর-একটু সুদর্শন হতো, তবে আমি তাকে ভালোবাসতাম, অথবা যদি সে আমাকে ওই কাজটি করে দিত, তবে আমি তাকে ভালোবাসতাম। প্রতিটি সময় আমরা নিজেকে এবং অন্যকে ভালোবাসার পূর্বে কোনও-না-কোনও শর্ত জুড়ে দিচ্ছি, যার ফলে আমরা প্রকৃত ভালোবাসার দরজাটি খুলতে পারছি না। আমাদেরকে অবশ্যই এরূপ শর্তাধীন ভালোবাসার মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। জীবনের প্রকৃত সুখটি অনুভব করতে চাইলে আমাদেরকে নিঃশর্তভাবেই ভালোবাসতে হবে। নিঃশর্ত ভালোবাসা কী, তা অনেকেই আমরা জানি না। আমরা অন্যকে আমাদের মতো হতে বলি। আমরা ভাবি, যদি সে আমাদের মতো হয়, যদি সে আমার মনমতো হয়, আমার মনমতো চলে, তবেই আমি তাকে ভালোবাসবো। এটি কিছুতেই নিঃশর্ত ভালোবাসা নয়। নিঃশর্ত ভালোবাসা হলো, মানুষটি যেমনই হোক না কেন, তার আচার-আচরণ, তার যোগ্যতা, তার বাহ্যিক অবয়ব, তার মানসিকতা, সমাজে তার অবস্থান যা-কিছুই হোক না কেন, সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমি মানুষটিকে ভালোবাসবো। নিঃশর্ত ভালোবাসায় মানুষ মানুষের কাছে কিছু আশা করে না, এমনকি প্রতিদানে ভালোবাসাও আশা করে না, সে কেবলই দিয়ে যায়।


এমন নিঃশর্ত ভালোবাসা ভালোবাসার অনুভূতিকে অসীম করে তোলে, আমাদের ভেতরের ভালোবাসাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এ এক অনন্য অসাধারণ পরমানুভূতির সৃষ্টি করে! আমরা যখন নিজেদের সকল কদর্যতা, খুঁত, অপারগতা, অক্ষমতা, সব কিছু জেনেও নিজেকে ভালোবাসতে পারব, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত ভালোবাসা। এরূপ ভালোবাসায় কোনও কৃত্রিমতা থাকে না, থাকে না নিজেকে লুকাবার ব্যর্থ চেষ্টাও। এটাই ভালোবাসার প্রকৃত রূপ। ভালোবাসা আমাদের ভেতর সেই সংবেদনশীলতা তৈরি করে, যাতে আমরা আমাদের ভেতরের সকল অপবিত্রতাকে ধুয়ে মনের সকল দরজা খুলে দিতে পারি, যেন আমাদের দোরে যা-কিছুই আসুক না কেন, তাকে আমরা আমাদের মমতা দিয়ে গ্রহণ করতে সক্ষম হই। এমন সময় আমাদের চারপাশের সকলেই আমাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠে। আমাদের দোরে কোনও শত্রু এলেও আমরা তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করি। কেননা আমরা তখন জানি যে আমাদের নিজেদের ভেতরেও অনেক কুৎসিত রূপ রয়েছে, রয়েছে অসম্পূর্ণতাও, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা নিজেদের ভালোবাসতে পারি, আর এর ফলে আমরা আমাদের চারপাশে যারা রয়েছে, তাদেরকেও তাদের অপূর্ণতা নিয়েই ভালোবেসে গ্রহণ করতে শিখে যাই।


যখন আমরা পুরো পৃথিবীকে ভালোবেসে পরম মমতায় গ্রহণ করতে শিখে যাই, তখন এই পুরো পৃথিবীটাই আমাদের ঘর হয়ে ওঠে, তখন আমাদের কাছে কেউ আর অচেনা অথবা পর হয় না। সকলেই আমরা একই বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের কোনও শত্রু নেই, আমাদের কাউকে ভয় পেতে হয় না। যখন আমরা প্রকৃত ভালোবাসার অর্থ খুঁজে পাই, তখন সর্বত্রই কেবল বন্ধু আর প্রিয়জন দেখতে পাই। যে মানুষ ভালোবাসার দরজা খুঁজে পায়, সে মানুষ স্রষ্টার দরজা খুঁজে পায়। যদি আমাদের মাঝে ভালোবাসাই না থাকে, অথবা যদি আমাদের মাঝে ভালোবাসার বোধটুকু কখনওই না জন্মায়, তবে আমরা কখনওই আমাদের স্রষ্টার দেখা পাবো না, কেননা ভালোবাসা স্রষ্টারও ঊর্ধ্বে। যদি আমরা ভালোবাসাকে না জানি, খুঁজে না পাই, তবে আমরা আমাদের স্রষ্টার মহিমা কী করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব? স্রষ্টার মহত্ত্ব, স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব কেবলই ভালোবাসার অনুভূতিলাভের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। যদি আমরা ভালোবাসার অনুভূতি না পেতাম, তবে আমাদের কাছে আমাদের স্রষ্টাও সংকীর্ণই থেকে যেত। স্রষ্টার উপস্থিতিও কখনও আমাদের মাঝে ভালোবাসার জন্ম দেবে না, কিন্তু যদি আমরা ভালোবাসাকে ধারণ করতে পারি, তবে নিশ্চিতভাবেই সেটি আমাদের মাঝে স্রষ্টার অনুভূতি এনে দেবে।


একাশি।
স্রষ্টার মাধ্যমে ভালোবাসাকে পাওয়া সম্ভব নয়, বরং ভালোবাসার মাধ্যমেই স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব। আর ভালোবাসাকে খুঁজে পেতে হলে আমরা সর্বপ্রথম আমাদের ভালোবাসাকে কোথায় হারিয়েছি, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কেননা হারানো জিনিস সেখান থেকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যেখানে আমরা সেটি হারিয়েছি। কিন্তু সেটি করতে গেলে আমাদেরকে প্রথমেই স্রোতের বিপরীতে ছুটতে হবে, অর্থাৎ আমাদেরকে আবার পেছনের দিকে ফিরে যেতে হবে। আমরা যত বস্তুগত জিনিসের দিকে অগ্রসর হব, ততই আমরা ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলব। আমরা যত বস্তুগত সুখের বিপরীতে ছুটব, ভালোবাসা তত জলদিই আমাদের দিকে অগ্রসর হবে, স্রষ্টাকে পাওয়া অথবা স্রষ্টার দ্বারে পৌঁছানো আমাদের জন্য ততই সহজ হবে। একটি মইয়ের দুটি প্রান্ত থাকে, যার দুই প্রান্ত দিয়ে দুটি বিপরীত গন্তব্যে যাওয়া যায়। ভালোবাসা এবং বস্তুগত মোহ আমাদের একটি মইয়ের দুটি প্রান্ত। ভালোবাসা আমাদেরকে স্বর্গের পথ দেখায়, আর বস্তুগত মোহ আমাদেরকে নরকের দিকে টেনে নেয়। একটি ঊর্ধ্বমুখী হলে অপরটি নিম্নমুখী। আমরা যত ভালোবাসার পথে অগ্রসর হই, এটি তত ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। যখন আমরা ভালোবাসাকে পরিত্যাগ করে কেবল বস্তুগত প্রাপ্তির দিকে ঝুঁকে পড়ি, আমরা ততই নিম্নমুখী হতে থাকি, ক্রমেই নরকের দ্বারের দিকে অগ্রসর হই।


আমাদের স্রষ্টার খোঁজ না করে বরং কেবলই ভালোবাসার খোঁজ করে যাওয়া উচিত, কেননা এই একটিমাত্র পথ দিয়েই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। যদি আমরা কেবল ভালোবাসাকে অনুসরণ করতে পারি, তবে আমাদের আশেপাশের যাবতীয় সব কিছু কেবল আমাদেরকে অনুসরণ করতে থাকবে, ঠিক যেমন করে আমাদের ছায়া কেবল আমাদের পথই অনুসরণ করে। ভালোবাসাই সেই একমাত্র গন্তব্য, যার মাধ্যমে সব কিছু পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি আমরা উদ্‌ভ্রান্তের মতো কেবল স্রষ্টার খোঁজই করি, তবে আমরা যতই পরিশ্রম করি না কেন, শেষপর্যন্ত আমাদেরকে কেবল একখানা ভগ্নহৃদয় আর শূন্যহাতেই ফিরে আসতে হবে। কেননা ভালোবাসাই আমাদেরকে স্রষ্টাকে খুঁজে পাবার সেই শক্তি, সেই আলো ধারণ করে। একজন নিস্তেজ, নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল মানুষের পক্ষে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের ঘুমন্ত সত্তা, ক্রোধ, ঘৃণা, বৈরিতাপূর্ণ মানসিকতা আমাদেরকে কখনও স্রষ্টার খোঁজ দিতে পারে না। কেবল ভালোবাসার অমৃতই পারে আমাদের মাঝে আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দিতে। শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে দেখতে যেমনই হোক না কেন, আমাদের তাকে ভালো লাগে। একটি শিশু কালো, ফরসা, এমনকি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও আমরা তাকে সমান আদর, ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করি, কারণ সে তখন ভালোবাসায় পূর্ণ একটি সত্তা নিয়েই জন্মায়, আর ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে।


তারপর ধীরে ধীরে সে যখন বড়ো হতে থাকে, তার ভেতর থেকে ভালোবাসাগুলোও হারাতে শুরু করে। অথচ প্রতিটি শিশুই কত না প্রাণবন্ত, মায়াবী, সজীব, ভালোবাসায় পূর্ণ। আজ পর্যন্ত আমরা কোনও কুৎসিত শিশুকে কি দেখেছি? এর একমাত্র কারণ, সে তার বিচারবিবেচনা ছাড়া তার চারপাশে কেবলই ভালোবাসা ছড়াতে থাকে। শিশুর সেই ভালোবাসাই সকলকে তার কাছে টেনে নিয়ে আসে, সে যেমনই হোক না কেন, তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। কিন্তু ধীরে ধীরে বড়ো হবার সাথে সাথে সে এটি হারাতে থাকে, কেননা আমরা তাকে সেই কুৎসিত পথে হাঁটতে সাহায্য করি। আমরা তাকে এটি শেখাই না যে কী করে ভালোবাসতে হয়, বরং আমরা তাকে এই শিক্ষা দিয়ে বড়ো করি, পৃথিবী কতটা হিংস্র, কতটা নির্মম, ভয়ানক। আমরা তাকে শেখাই, কী করে আমাদের আশেপাশের মানুষ তার ক্ষতি করতে পারে, কী করে তাদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা যায়, কী করে এই সব হিংস্রতাকে এড়িয়ে টিকে থাকতে হয়। এর ফলে শিশুটির মধ্যে তার আশেপাশের সকলের বিরূদ্ধে একপ্রকার ভীতির জন্ম হয়। আমরা শিশুকে এটা মেনে নিতে বাধ্য করি যে ভালোবাসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি কিছু। আমরা শিশুর মাঝে ভালোবাসা নিয়েই একটি সন্দেহ তৈরি করি। আমরা তাকে শেখাই, মানুষ বাইরে ভালোবাসা দেখায়, কারণ এটি প্রতারণার একটি কৌশল, এই কৌশলের মাধ্যমে মানুষ আমাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা আদায় করে নেয়। আমরা তাকে আরও শেখাই, নিশ্চয়ই এ সকল মানুষ ভণ্ড!


আমরা সকলে এটাই করি বিধায় সকলের ভেতরটা এভাবেই একত্রে এই মানসিকতায় বেড়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকের মাঝে এক দেয়াল তৈরি হয়ে যায়, যার ফলে একসময় আমরা আমাদের কাছের মানুষের কাছে থেকেও একটা সূক্ষ্ম দেয়াল তৈরি করে ফেলি। তারপর আমরা আমাদের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করি। আমরা সব সময় মনে করি, পৃথিবীটা বাটপার দিয়ে ছেয়ে গেছে, অথচ আমরা কী সহজেই এই কঠিন সত্যটি ভুলে যাই যে স্রষ্টা সর্বত্র বিরাজমান। আমরা আমাদের শিশুদের শেখাই, কী করে এ সকল বাটপারদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, কী করে তাদের দিকে সর্বদা নজর রাখতে হয়। আমরা তাদের শেখাই, কী করে সকলকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হয়, যাতে করে যখনই কেউ আমাদের আঘাত করতে আসবে, আমরা যেন তাকে প্রথমেই আক্রমণ করতে পারি। আমরা আমাদের শিশুদের সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে শেখাই এতটাই যেন তা না করলে যে-কোনও সময় আমাদের উপর বড়ো কোনও আঘাত আসতে পারে। এরপর আমাদের শিশুরা একটা সময় এই অভ্যাসগুলো পুরোপুরি রপ্ত করতে শিখে যায়। আমাদের শিশুরা নিজেকে পুরোপুরি মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়, আমরা তখন আমাদের শিশুদের ‘ম্যাচিউর’ বলি। আমরা তাকে বুদ্ধিমান বলে মনে করি। কেননা এখন সে নিজেকে সকলের সামনে একজন আরোপিত গুণসম্পন্ন মানুষ বা ভণ্ড হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছে।


আমরা আসলে বুঝি না যে ঠিক এমন মুহূর্ত থেকেই একটা শিশু তার ভালোবাসার ক্ষমতাকে এসবের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে। সে তার ভেতরের প্রকৃত ভালোবাসার অনুভূতি, বিশ্বাস সব কিছু হারিয়ে ফেলে। এখন থেকে সেই শিশু নিজের চারপাশে কেবলই শত্রুই দেখতে পাবে। কাউকে সে বন্ধু ভাবতে পারবে না। এবং, যখন একটা শিশু এমনকি তার বাবাকেও অবিশ্বাসের চোখে দেখে, তখন আমরা তাকে বলি, ‘এখন সে পৃথিবীতে টিকে থাকার যোগ্য হয়ে উঠেছে!’ আমরা তখন বলি, তাকে এখন কেউ ঠকাতে পারবে না, তার সাথে কেউ এখন প্রতারণা করতে পারবে না, কেননা এখন সে আর সেই শিশুবাচ্চাটি নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুঃখের বিষয় এই যে, শিশুটি এখন নিজেই অন্যদের সাথে প্রতারণা করতে শুরু করে দেবে। কেননা এত কিছুর মধ্য দিয়ে সে নিজেও, কী করে প্রতারণা করতে হয়, কী কী করলে ভণ্ড হওয়া যায়, সেই সব কিছু শিখে ফেলেছে, আমরা সবাই মিলে তাকে সে পথেই ঠেলে এগিয়ে দিয়ে এসেছি! প্রকৃতপক্ষে আমরা যখন অন্যের দ্বারা প্রতারিত হই, তা সে যত বড়ো প্রতারণাই হোক না কেন, তাতে আমাদের কিছু খোয়া যায় না, কিন্তু আমরা যখন অন্যদের সাথে প্রতারণা করি, তখন আসলে আমরাই সব কিছু হারাই। এটি কীভাবে হয়?


বিরাশি।
ধরুন, আপনি আজ কারও সাথে খুব মিষ্টি ভাষায় কৌশলে প্রতারণা করলেন। যার সাথে প্রতারণা করলেন, আপনার কাছ থেকে প্রতারিত হবার পর সেই ব্যক্তিটি হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু এরপর যখন তার সামনে এমন পরিস্থিতি আবার আসবে, তখন সে ঠিকই বুঝে নেবে, কেউ তার সাথে এর আগে কীভাবে প্রতারণা করেছে, সুতরাং সে এবার থেকে সেই বিষয়ে সাবধানী হয়ে যাবে, এবং তার বিবেকের কাছে তাকে কারও ক্ষতি করার জন্য নিজেকে ছোটো হয়ে থাকতে হবে না। আপনি আবার যখন সেই ব্যক্তিটির দ্বারস্থ হবেন, তখন সে আর যা-ই করুক, আপনাকে বিশ্বাস করা অথবা আপনার উপর আস্থা রাখা ছেড়ে দেবে। এতে করে আপনি এক সৎসান্নিধ্য হারাবেন, আর সে হারাবে কেবলই এক ভণ্ড অথবা প্রতারককে! মানুষ হিসেবে এর চাইতে বড়ো পরাজয় আপনার জীবনে আর কী হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে যখনই আমরা ছলনার আশ্রয় নিই, তখন আমাদের ভালোবাসার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। আমরা কী করে এমন এক মানুষকে ভালোবাসবো, যার সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতার সিদ্ধান্ত নিয়েছি? যখন আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হাজারো ভয়ে জর্জরিত হয়ে পড়ি, তখন আর তাকে ভালোবাসা যায় না, কেননা ভয় এক প্রকার বিষ, যে বিষ একা একাই ভেতরে ভেতরে বাড়তে থাকে।


তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কিছুটা যৌক্তিক ভয় থাকা সম্পর্করক্ষার ক্ষেত্রে ভালো। অনেক সময় যখন আমরা ভালোবাসার মানুষটিকে হারাবার ভয়ে থাকি, তখন তাকে কিছুটা বেশি যত্নে রাখি। কিন্তু যখনই আমরা সম্পূর্ণ নিঃশঙ্ক থাকি যে যত যা-ই হোক, মানুষটা হারাবে না, তখন বরং আমরা তাকে অবহেলা করি, অহেতুক অত্যাচারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিই। কেবল একজন ভণ্ড মানুষের পক্ষেই নিঃশঙ্কভাবে বেড়ে ওঠা সম্ভব। যখনই আমরা অর্থ, বাসস্থান, ব্যাংকব্যালেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা দিতে চাই, তখন আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে সেই সাথে আমরা আমাদের ভালোবাসার দরজাটাও বন্ধ করে দিচ্ছি। মূলত আমরা যখন আমাদের ভেতরে প্রবেশের সব দরজাই বন্ধ করে দিই, তখন হয়তো আমাদের ভেতরে ধুলোময়লা প্রবেশের সুযোগ পায় না, কিন্তু সেই সাথে সাথে আমাদের ভেতরে আলো-বাতাস, রোদ সব কিছুর অনুপ্রবেশই বন্ধ হয়ে যায়। এটিকে একটি সমাধির মতোই দেখায়, যেখানে আমরা মৃত্যুর পর থাকি, সেখানে এই পৃথিবীর কিছুরই প্রবেশের সুযোগ নেই। মৃত ব্যক্তিকে কি কোনও কিছু দিয়ে অথবা তার জন্য কিছু ত্যাগ করে, তাকে সহ্য করে, তাকে যত্ন করে, তার ভালো-মন্দর খোঁজ করে ভালোবাসতে হয়? সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে ভালোবাসা বরং খুব সোজা।


স্রষ্টাকে ভালোবাসা আরও সহজ, কেননা স্রষ্টার জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না। আমাদের কখনও স্রষ্টার গালমন্দ শুনতে হয় না, স্রষ্টার ক্রুদ্ধ চেহারা দেখতে হয় না, স্রষ্টার চেহারা ভালো কি কুৎসিত, তা-ও আমরা জানি না, কেননা আমরা বাহ্যিক সৌন্দর্যকে সর্বাবস্থায় গ্রহণ করতে রাজি। এমনকি যদি সেটি ‘ভয়ংকর’ও হয়, তবুও রাজি। এজন্য স্রষ্টাকে ভালোবাসা সহজ। একটি শিশুকে ভালোবাসা সহজ, কেননা তখনও তারা জীবনের বাস্তবতার সম্মুখীন হয়নি। সুতরাং সে আমাদের জন্য নিরাপদ! অন্তত ক্ষতি করার দিক থেকে পুরোপুরিই নিরাপদ। আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের চারপাশে এত দেয়াল দিয়ে রেখেছি যে সেটিসহ আমাদের পুরো চারপাশটাই একটি সমাধিক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে। আমাদের নিজেদের নিরাপত্তাই এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মৃত্যু যদি একবার তার থাবা বসায়, তখন আমাদের এই নিরাপত্তার দেয়ালগুলো কি আমাদের বাঁচাতে পারবে? বস্তুত অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তাই জীবন রচনা করে। যেখানে অনিশ্চয়তা, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা নেই, সেখানে জীবনের স্পন্দন নেই, এবং সেখানে জীবন মৃত, সরল। জীবনের মূলমন্ত্রই হচ্ছে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা।


জীবনটাকে আমাদের এতটাই সহজ করে নিতে হবে, যেন এর কোনও নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকে। একটি পাথর নিরাপদ, কেননা সেটি মৃত। সেটির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাক, বৃষ্টি ঝরুক, রৌদ্রের তাপ তার গায়ে লাগুক, তবুও পাথরটি ঠিক একই জায়গায় পড়ে থাকে। সে জীবনের কোনও স্বাদ গ্রহণ করে না, কিন্তু সে নিরাপদ, কেননা কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। অথচ একটি ফুল, সেটি সুবাস ছড়ায়, বাতাসে দোল খায়, রোদের আলো গায়ে মাখে, বৃষ্টিতে ভেজে, ঝড়ে উড়ে যেতে পারে, এমনকি একটি শিশুও ফুলটির প্রাণ নিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে একটি জীবন নিয়ে বেঁচে থাকে। আমরা কি পাথরের মতো হয়ে কেবলই একটি নিরাপদ জীবন চাইব, না কি ফুলের মতো অনিরাপদ, কিন্তু জ্যান্ত জীবন চাইব? আমরা যখন আমাদের চারপাশে এমন দেয়াল দিয়ে রাখি, তখন আমরা একটা পাথরের জীবনযাপন করি, কিন্তু ভালোবাসা হচ্ছে সেই ফুলের মতো, যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনিরাপদ, কিন্তু সুন্দর। ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ফুল, যা সব সময় অনিরাপদ। কিন্তু একমাত্র ভালোবাসাই আমাদের মধ্যে জীবনসঞ্চার করে।


ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে একটি উন্মুক্ত দরজা, যাতে আমরা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। সকল দরজা খুলে রাখা, খোলা আকাশের নিচে থাকা হয়তো ভয়ানক, কিন্তু এটিই জীবনকে একটি সারাংশ এনে দেয়। এর মাধ্যমে সাধারণত দুটি বিষয় ঘটতে পারে। এক, এটির মাধ্যমে হয়তো আমাদের কোনও শত্রু এসে আমাদের শেষ করে দিয়ে যেতে পারে। দুই, একজন বন্ধু এসে আমাদের ভালোবাসায় জড়িয়ে নিতেও পারে। কিন্তু যদি আমরা শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, তবে আমরা বন্ধু হারাব। কেননা আমরা জানি না ভবিষ্যতে আমাদের কাছে কোনটি আসছে। যদি আমরা এভাবে আমাদের চারপাশে দেয়াল তৈরি করি, তবে আমরা আসলে আমাদের সমাধিক্ষেত্রই রচনা করছি, এবং এমন মুহূর্তে আমরা সব সময় কেবল এটিই ভাবতে থাকব---আমরা কী যেন হারিয়ে ফেলছি, কী যেন আমাদের আর নেই। আসলে আমরা কিছুই হারাইনি। আমরা এসবের মাধ্যমে কেবল নিজের হৃদয়কে বন্ধ করে রেখেছি। আমরা আমাদের হৃদয়কে সেই খোলা আকাশের নিচে কখনও শ্বাস নিতে দিইনি, যার ফলে আমাদের হৃদয় তার সুবাস ছড়াতে ভুলে গেছে। এর অর্থ কেবল এই যে, আমরা ভালোবাসতেই শিখিনি।


তিরাশি।
আমরা আমাদের সন্তানদের প্রতিনিয়ত এমন একটি পাথরতুল্য নিরাপদ জীবনের জন্য গড়ে তুলছি। যখন আমাদের সন্তানেরা স্কুল থেকে মেধাতালিকায় প্রথম হয়ে বাড়ি ফেরে, তখন আমরা অনেক খুশি হই, তাকে আদর করি, বুকে জড়িয়ে নিই, অন্যদের সামনে তাকে বাহবা দিই, অন্যদের মিষ্টি বিতরণ করি। এর মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের সন্তানদের কী শিক্ষা দিচ্ছি, তা কি কখনও ভেবে দেখেছি? আমরা আসলে তাকে শেখাচ্ছি, তাকে সব সময়ই এভাবে প্রথম হতে হবে। আমরা তাকে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে শেখাই, যুদ্ধ করতে শেখাই, সব সময় লক্ষ্যে অবিচল থাকতে শেখাই, আমরা তাকে শেখাই, যে করেই হোক, যা-কিছুর বিনিময়েই হোক না কেন, তাকে প্রথম হতেই হবে। আমরা তাকে শেখাই, কী করে সব সময় প্রথম হতে হয়। একটা সময় সে শিখে যায়, সে জীবনের প্রতিটি পর্বে প্রথম হয়, কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে সে উপলব্ধি করে, সে হয়তো প্রথম হতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু সে তার ভালোবাসার শক্তিটি হারিয়েছে। পৃথিবীতে কেবল তারাই ভালোবাসা পায়, যারা জানে কী করে সবার শেষে থাকতেও রাজি হতে হয়। যে ভালোবাসার শক্তি হারায়, সে জীবনের সব থেকে মূল্যবান কিছু হারায়। যে সর্বদা ক্ষমতা ধরে রেখে রাজত্ব করে বেড়ায়, আপনার মনেই হতে পারে, সে হয়তো খুব ভাল আছে, কিন্তু একটু দেখা যাক, বড়ো বড়ো রাজনীতিবিদেরা আসলে কেমন ছিলেন!


একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে তাঁদের প্রকৃত অর্থে কোনও বন্ধুই ছিল না। তাদের চারপাশে ছিল ক্ষমতার লোভ-করা কিছু মানুষ। ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক বড়ো বড়ো রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদেরই খুব কাছের কিছু মানুষের হাতে, যাদের তারা প্রাণের নিরাপদ বন্ধু ভাবতেন অথবা যারা তাঁদের জীবনরক্ষার পেশায় নিয়োজিত থেকেছে। একজন রাজনীতিবিদ প্রকৃতপক্ষে তাঁর চারপাশে কেবল ক্ষমতার লোভে জড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের সান্নিধ্যে থাকেন, যারা কেউই তাঁকে নয়, বরং তাঁর ক্ষমতাকে ভালোবাসেন। এজন্যই রাজনীতিবিদেরা সাধারণত তাঁর কোনও মন্ত্রীকেই এক পদে খুব বেশিদিন বহাল রাখেন না, কেননা কেউ যদি একবার ক্ষমতার শীর্ষে চড়ে বসেন, তবে তিনি যে-কোনও সময়ই তাঁর ক্ষমতাকে বাজেভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এটি রাজনীতির চিরাচরিত একটি কৌশল। মূলত রাজনীতিতে কখনও কোনও বন্ধু হয় না, এটি সম্পূর্ণরূপেই শত্রু দিয়ে ঘেরা, এখানে একজনের সাথে অন্যজনের কেবল প্রতিযোগিতাই চলে। যখন আমরা আমাদের সন্তানদের প্রতিযোগী করে গড়ে তুলি, আমরা আসলে তাকে এরূপ ঘৃণ্য, আত্মঘাতী, হিংস্র, প্রতিদ্বন্দ্বী করে গড়ে তুলি।


ওরা একসময় কেবল টাকা তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়। তারা ভালোবাসা থেকে বিভক্ত হয়ে যায় এবং একটা সময় তাদের জীবন পুরোপুরি ভালোবাসাশূন্য হয়ে পড়ে। যারা প্রকৃতই ভালোবাসে, তারা কখনও অর্থের পেছনে, ক্ষমতার পেছনে লেগে থাকে না। সম্পদ সব সময় ভালোবাসার বিপরীতে কাজ করে এবং একজন কৃপণ ব্যক্তির পক্ষে কখনও কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। যখন আমরা আমাদের চারপাশে যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হব, তখন একদিন আমাদেরই প্রয়োজনে এটি বন্যার আকারে আমাদের জীবনে বয়ে যাবে। যখন আমাদের জীবনে কিছু ভালোবাসার মানুষ থাকে, তখনই আমরা বুঝতে পারি যে স্রষ্টা আমাদের দেখভাল করছেন। এমন সময় আমাদের মনে হবে, যদি স্রষ্টা এই পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসেরও দেখভাল করে থাকেন, তবে কেন তিনি আমাদের দেখভাল করবেন না! আর যখন আমরা ভালোবাসার বদলে সম্পদকে আমাদের বন্ধু বানিয়ে ফেলি, তখন আমাদের বিপদের দিনে আমরা কেবল আমাদের সম্পদের দিকে চেয়ে থাকি। কিন্তু যখন আমরা আমাদের জীবনের শেষপর্যায়ে যাব, তখন যদি আমাদের ভালোবেসে আগলে রাখার, আমাদের চিন্তা করার কেউই না থাকে, তবে আমরা কার ভরসায় থাকব? কে আমাদের ক্লান্তিতে আমাদের আশ্রয় দেবে? কে আমাদের পরম আদরে বুকে জড়িয়ে নেবে?


চুরাশি।
যে জীবনে কোনও ভালোবাসা নেই, কোনও সাহায্যকারীর হাত নেই, কেবলই চারপাশটা সম্পদে পূর্ণ, কেমন লাগবে তখন আমাদের সেই জীবন? আমরা কি একবারও ভেবে দেখি? কেবল আর্থিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণ একজন ধনী ব্যক্তি এতটাই জীবনশূন্য যে একটা সময় তার সম্পদের বোঝাই নিজের কাছে সবচেয়ে বড়ো বোঝা হয়ে ওঠে। ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে, নিজের ভালোবাসাকে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়া। আমরা আমাদের ভালোবাসাকে যত আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে দেবো, সেটি তত বৃহদাকারে চারপাশে আরও ছড়িয়ে পড়বে। ঠিক যেমন কোনও পুকুরে একটি ঢিল ছুড়লে এটি ক্রমান্বয়ে বৃত্তাকারে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, সেভাবেই ভালোবাসা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। একজন হৃদয়বান মানুষ এভাবেই তার চারপাশে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়। আমাদের হৃদয় আমাদের ভালোবাসার সেই কেন্দ্র, যা থেকে এটি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা যতই আমাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করব, ততই আমাদের কেন্দ্রের উত্তালতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আমরা অনেক সময় আমাদের সন্তানকে আমাদের সম্মানের খোরাক রক্ষার্থে, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে তার ওপরে এক বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিই, যেখানে কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থই লুকিয়ে থাকে।


আমরা তাকে দেশের সরকারের বড়ো পদে দেখতে চাই, আমরা তাদের নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার বানাতে চাই, এত শত চাপের মাঝে আমরা আমাদের সন্তানদের প্রকৃত একজন মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করতে ভুলে যেই। কেননা আমরা ভাবি, সে যদি একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে, তবে তার পক্ষে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অথবা রাষ্ট্রের তথাকথিত কোনও গণ্যমান্য ব্যক্তি হওয়া সম্ভব হবে না। কেননা এর কোনওটিই আমাদের সন্তানকে অনেকটা নিশ্চিত অর্থোপার্জনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে না। ভালোবাসা আমাদেরকে স্রষ্টার পথে নিয়ে যায়, এই কঠিন সত্যটি আমরা আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি, কেননা আমাদের অর্থের প্রয়োজন। এর ফলে আমাদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে নিজের আত্মার কাছে থেকে দূরে সরে যায়, সে তার নিজ ব্যক্তিসত্তাকে কখনও জানার প্রয়োজনও মনে করে না। আসলে সে তার নিজের সত্তা বলে কিছু যে আছে, এটিই আর জানতে পারে না। সে তার নিজের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। সে নিজের সাথে তার হৃদয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। সে ভিত্তিহীন অবস্থায় বাঁচতে শুরু করে এবং নিজের শেকড়কে উপড়ে ফেলে বাঁচতে গিয়ে সে সারাজীবনই একধরনের শূন্যতা নিয়ে বাঁচে। তাকে দেখলে মনে হয় যেন তার জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেছে, অথচ সে জানেই না তার জীবন থেকে কী হারিয়ে গেছে!


যখন সে এটি হারাতে শুরু করেছিল, তখন সে অনেক ছোট্ট ছিল। আর যখন সে এই শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করে, তখন সে যথেষ্ট বোধশক্তিসম্পন্ন একজন যুবকে পরিণত হয়েছে, কিন্তু সে তার সকল বোধশক্তিই তখন তার বিরূদ্ধে কাজ করে, কেননা তার সমস্ত জ্ঞান, সচেতনতাকে কাজে লাগিয়েও সে জানতেই পারে না সে কী হারিয়েছে, কখন যে হারিয়েছে! যখন আমরা আমাদের সন্তানদের প্রকৃত ভালোবাসার কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে নিই, তখন সে খুব ছোটো থাকে, তখন তার ভেতরে এই মানসিক বোধ থাকে না যে আমরা আসলে তার কাছ থেকে কী সরিয়ে নিচ্ছি, তাকে কীসের থেকে আলাদা করে ফেলছি। সে আমাদের বিশ্বাস করে, সে তার বাবা-মায়ের সব আদেশ-নিষেধ বিশ্বাস করে। সে তার বাবা-মা, শিক্ষক সকলের উপদেশ মেনে চলে, সে আমাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, কেননা আমরা ছাড়া তাকে শিক্ষা দেওয়ার মতো এতটা কাছের আর কেউ নেই। যার কারণে বলা হয় সন্তানের প্রথম শিক্ষাটা হয় তার পরিবার থেকে। আমাদের সন্তান এমনকি জানেই না তার অজ্ঞতায়, অসচেতনতায় তার সব থেকে কাছের কাছের মানুষগুলোই তাকে তার নিজের আত্মা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তাকে তার ভিত্তি থেকে আলাদা করে ফেলেছে।


জাপানে একপ্রকার গাছকে কিছু আলাদা আকারে পরিকল্পিতভাবে পরিচর্যা করে থাকে। গাছগুলোকে বনসাই বলা হয়। যদিও বনসাইয়ের অনেক রূপ আছে, কিন্তু এদের প্যাটার্নটি মূলত একই। এই গাছগুলো প্রায় দুই থেকে তিনশত বছরের পুরনো, অথচ উচ্চতায় মাত্র ৬-৮ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এত পুরনো গাছ হওয়া সত্ত্বেও এগুলো কেন আকার-উচ্চতায় দীর্ঘ হয় না? কারণ, এই গাছগুলোকে শত শত বছর ধরে একটি বিশেষ উপায়ে পরিচর্যা করে রাখা হয়, ফলে এরা বেড়ে ওঠে না। এই গাছগুলোকে একটি কঠিন লোহার ছোট্ট এক পাত্রে লাগানো হয় এবং সীমিত মাটিতে নিয়মিত সার, পানির মাধ্যমে এর শেকড়কে কিছুদিন পর পরই কেটে দেওয়া হয়, যাতে এটি ইচ্ছেমাফিক বাড়তে না পারে। দিনের পর দিন বছরের পর বছর এটি অল্প জায়গায়, একটি নির্দিষ্ট স্থানে বাড়তে তাকে। এটিকে কখনও উন্মুক্ত মাটিতে পোঁতা হয় না বিধায় এটি কখনও বেড়ে উঠতে পারে না। যদিও এর দেহ দেখতে অনেক ক্ষয়প্রাপ্ত আর বৃদ্ধ মনে হয়, যদিও এটি বয়সে অনেক বৃদ্ধ, কিন্তু আকৃতির দিক থেকে সেটি সর্বদা ছোট্ট হয়েই বেঁচে থাকে। গাছটি কী করে বড়ো হবে, যদি তার শেকড়টিকে কিছুদিন পর পরই ছেঁটে দেওয়া হয় এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্বল্প পরিসরে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়? ঠিক এই কাজটাই আমরা আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করে থাকি। তাদেরকে নিয়মিত একটু একটু করে কিছুদিন পর পরই নিজের হৃদয়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে আলাদা করতে থাকি, তাদের ছাঁটতে থাকি, তাদের ধীরে ধীরে ভালোবাসার থেকে সরিয়ে নিতে থাকি, তাদের প্রকৃত শেকড় থেকে আলাদা করতে থাকি। ঠিক যেমন করে এই গাছটি কখনও জানতেও পারে না তাদের সাথে কী করা হচ্ছে, তেমনি আমরাও বড়ো হয়ে জানিই না যে আমাদের সাথে কী করা হয়েছে!