অস্পষ্ট জার্নাল: ৩

পনেরো। যাকিছু আমাদের প্রিয়, তাকিছুকে আমরা বলি, আত্মার ধন। যে মানুষটি আমাদের প্রাণের মানুষ, তাকে বলি, আত্মার আত্মীয়। যে স্থানটি আমাদের শান্তি দেয়, সে স্থানটির প্রসঙ্গ এলে আমরা বলি, সেখানে গেলে যেন আত্মা জুড়িয়ে যায়! আমাদের সবচাইতে প্রিয় কোনোকিছুকে আমরা আমাদের হৃদয় কিংবা মনে জায়গা না দিয়ে আত্মায় জায়গা দিই, আত্মার সাথে মিশিয়ে পরম আদরে রাখি। যাকে আমরা ভালোবাসি, তার অন্ধকার দিকগুলি যতোটা জানি, তার চাইতে অনেকবেশি মাথায় আসে তার আলোকিত দিকগুলির কথা। সে যখনই ভয়ে কাতর হয়, তখন আমরা তার আত্মবিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করার চেষ্টা করি। যখন দেখি সে দুশ্চিন্তায় আকণ্ঠ ডুবে আছে, তখন তার রুদ্ধ ভাবনাগুলিকে মুক্ত করে দিই। আমরা তার অক্ষমতাগুলির খোঁজ যেমনি জানি, তেমনি তার অমিত সম্ভাবনার দরোজাগুলি এক-এক করে খুলে দিতে যা-যা করা দরকার, যেকোনো মূল্যে সেগুলি করি। জীবনে চলার পথে আমাদের কাকে সবচাইতে বেশি দরকার? যে আমাদের ভাল পরামর্শ দেয়, আমাদের সমস্যাগুলির সুন্দর সমাধান দেয়, আমাদের ক্ষতগুলি সারিয়ে তোলে, এমন কাউকে তো, না? জীবনে ভালোভাবে বাঁচার জন্য সমালোচক নয়, সমব্যথী দরকার। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে, মানুষ যতোটা না চায় দুঃখ দূর করতে, তার চাইতে বেশি চায় দুঃখ ভাগ করে নিতে। আমাদের এমন কাউকে দরকার, যে আমাদের কষ্টে সমব্যথী হতে পারে, যে আমাদের অভিন্ন আত্মা হয়ে আমাদের সব আঘাত তার নিজের হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। স্রষ্টার ঘরে প্রার্থনা করার সময় যেমনি কিছু প্রার্থনাসঙ্গী আমাদের প্রার্থনা করার কাজে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি আমাদের দুর্দশার সময়ে, একাকীত্বের সময়ে, বিষাদের মুহূর্তে, দয়ার্দ্র হৃদয়ে কোমল হাত দুটো বাড়িয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এমন কাউকে আমাদের বড় বেশি দরকার। আচ্ছা, ভালোবাসা কী? একসাথে থাকা? সমাজসিদ্ধ বন্ধনের সমাপ্তিতেই ভালোবাসার সমাপ্তি? এক দম্পতির বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এর পরপরই স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই আবার বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীটি তাঁর দুই পা হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। এরপর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী অক্ষম স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়। তাঁকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। তখন তাঁর প্রথম স্ত্রী আর তাঁর নতুন স্বামীটি সেই পঙ্গু মানুষটির সব ধরনের দেখভাল করার দায়িত্ব নেন। পরম মমতায় সেই তিনটি মানুষ অভিন্ন আত্মা বন্ধু হয়ে দিব্যি জীবন কাটাচ্ছেন। গত ২৬ বছর ধরে এভাবেই চলছে। প্রথম স্ত্রী আর তাঁর নতুন স্বামী তাঁদের পুরো বিবাহিত জীবনটিই পার করে দিলেন পঙ্গু অসহায় মানুষটির সেবা করতে করতে। এই মানুষটির যাতে কোনো ধরনের অযত্ন না হয়, সেজন্য দ্বিতীয় স্বামীর পরামর্শে স্ত্রী তার উঁচু মাইনের চাকরিটাও ছেড়ে দেন। ভালোবাসার আর বন্ধুত্বের এর চাইতে বড় উদাহরণ আর কী-ই বা হতে পারে? মতের অমিল, কলহ, কিংবা দূরত্বের সূচনা মানেই ভালোবাসার অবসান নয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ মানেই চিরজন্মের শত্রুতার শুরু নয়। ভালোবাসার মানুষটি যখন সত্যিকারের বন্ধু হয়ে ওঠে, তখন অসাধ্যকে সাধন করা যায়। ক্রিস নরটন ২০১০ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে মেরুদণ্ডে সুষুম্না জখমের ফলে ঘাড় থেকে নিচের দিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে প্রায় চলৎশক্তিহীন হয়ে যান। তিনি আর কখনো হাঁটতে পারেননি। সেসময় তার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে পরিস্থিতির হাতে সমর্পণ করা, কিংবা সে পরিস্থিতির কাছে হার না মেনে অসীম কষ্ট স্বীকার করে নিজের যোগ্যতায় পরিস্থিতিকে হার মানানো। তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি চেষ্টা করলে সেই ট্র্যাজেডিকে সুযোগে পরিণত করতে পারবেন, এবং তাকে দেখে তার আশেপাশের সবাই শিখবে। তিনি অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। শারীরিকভাবে অক্ষম, এমন মানুষদের তিনি ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের জোরে তিনি ২০১৫ সালে গ্র্যাজুয়েট হন। দুর্ঘটনার ৩ বছর পর তার সাথে এমিলি সামার্সের পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেম। সামার্সের সংস্পর্শে এসে নরটন মানসিকভাবে আরো শক্ত হয়ে ওঠেন। যদি তিনি হাল ছেড়ে দিতেন, আর নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করতেন, তবে নিশ্চয়ই এই অসামান্যা ভাল মানুষটির সাথে তার কখনোই দেখা হতো না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর বাগদত্তার আন্তরিক সহযোগিতায় গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে তিনি অতি কষ্টে পায়ে হেঁটে তাঁর সার্টিফিকেটটি সংগ্রহ করেন। তিনি সবাইকে প্রায়ই বলেন, “আমি চাই, আপনারা লড়াই করে যাওয়ার কঠিন পথটিই জীবনে বেছে নিন। আপনার সকল দুর্ভাগ্য, সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্য থেকেও আপনার জন্য ইতিবাচক দিকগুলিকে আবিষ্কার করুন। আমাদের সবার মধ্যেই জীবনের সম্ভাবনাগুলিকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে। যদি আপনি এই কাজটি করতে পারেন, আর ধৈর্য ধরে নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নেন, আমি শপথ করে বলতে পারি, অবিশ্বাস্য রকমের ভাল অনেককিছুই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” ভালোবাসার শক্তি আর বিশ্বাস এভাবেই অসম্ভবকে সম্ভব করে। প্রিয় মানুষকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেলে কোনো বাধাকেই আর বাধা মনে হয় না। কারো হৃদয়ের সুন্দর ইচ্ছের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যিকারের বন্ধুত্ব জীবনের সুন্দর দিকগুলিকে তুলে ধরে, সত্যিকারের বন্ধু পাওয়ার চাইতে বড় সৌভাগ্য আর হয় না, আর যদি সে বন্ধুটি জীবনে থেকে যায়, তবে জীবন সার্থক হয় ওঠে। ভাল বন্ধু এক পেয়ালা মদের মতো। সময় যতো সামনের দিকে গড়ায়, বন্ধুত্বের বন্ধন ততো অপূর্ব হয়। ভাল বন্ধু আমাদের দুর্বল দিকগুলি ধরিয়ে দেবে, যাতে করে আমরা সেগুলিকে দূর করে নিজেদের শুধরে নিতে পারি। আমাদের দুর্বলতা আমাদের ভাল বন্ধুদেরও দুর্বল করে দেয়, আমাদের দুর্দশা আমাদের ভাল বন্ধুদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। সুন্দর হৃদয়ের এমন ভাল মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা আজো সুন্দর, এখনো এখানে হেসেখেলে কয়েক জন্ম দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়।

ষোলো। মরুভূমির এক ছোট আশ্রমে মওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কাজ করছিলেন। ওইসময় ওই পথ দিয়ে কিছু মুসাফির হেঁটে যাচ্ছিল। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তারা হাঁটা থামিয়ে আশ্রমের ভেতরে গিয়ে দেখল, আশ্রমপ্রাঙ্গণে শিষ্যরা আর ছাত্ররা বসে আছে, আর মওলানা সাহেব তাদের কথার উত্তর দিচ্ছেন। প্রশ্ন আর উত্তর দুইই ছিল অদ্ভুত ধরনের। এটা দেখে মুসাফিররা বিরক্ত হয়ে ওই স্থান ত্যাগ করে নিজেদের পথে চলে গেল। কয়েক বছর ভ্রমণ শেষে সেই মুসাফিরের দল আবারো ফিরে এল, এবং আগের বারের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, ওখানে কী হচ্ছে। এবার তারা দেখল, সেখানে শুধু মওলানা রুমি একা বসে আছেন, উনার শিষ্যরা নেই। অবাক হয়ে ওরা ভাবলো, কী হলো? ওরা সবাই কোথায়? “কী হয়েছে?” ওরা জিজ্ঞেস করলো। মওলানা হেসে বললেন, “এটাই ছিল আমার কাজ। ওদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এখন তাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। তাই আমি ওদের বলেছি, যাও, আমি যা করেছি, তোমরাও ফিরে গিয়ে অন্যদের সাথে এই কাজটাই কর, যদি এমন কাউকে পাও, যার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছ না, তবে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।” আমাদের মনে যতো বেশি প্রশ্ন থাকবে, আমাদের মন ততো বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকবে, আর সঠিক পথ থেকে আমরা ততো বেশি দূরে সরে যাবো। মন চঞ্চল হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় কাজটা ঠিকভাবে করা যায় না। যখন সব প্রশ্ন মন থেকে দূর হয়ে যায়, তখন আমাদের মন সেই শৈশবে ফিরে যায়, যে সময় আমরা ছিলাম নিষ্পাপ, আমাদের মনে কোনো কদর্য ভাবনা ছিল না, পৃথিবীর কোনোকিছুতেই মন অশান্ত হতো না। ব্যাকুল মনকে সাথে নিয়ে কোনও মহৎ যাত্রা শুরু করা যায় না। নীরবতার শপথ নিয়ে আমরা আমাদের জিভকে স্থির করে ফেলতে পারলে, শব্দহীন পরিবেশে ভাবনার নিরবধি শান্তধারায় অবগাহন করলে, কোনোকিছু উচ্চারণ না করেই সবচাইতে সুন্দর কথাটিও বলে দেয়া যায়, সবচাইতে আশ্চর্য প্রচ্ছন্ন সত্যটিও প্রকাশ করে ফেলা যায়। এই নীরবতাই সকল প্রশ্নের উত্তর। এ উত্তরে কোনো কথা থাকে না, এ উত্তর নির্দিষ্ট কোনো প্রশ্নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও নয়। নীরবতা এমন এক অবস্থায় আমাদের নিয়ে যায়, যে অবস্থায় কিছু না বলেও অনেককিছু বলে দেয়া যায়। প্রাত্যাহিক জীবনে আমাদের অজস্র ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসব ঝামেলার অনেকগুলিই এমন, যার শুরু বা শেষ, কোনোটাতেই আমাদের কোনো হাত নেই। সেগুলি আমাদের বিহ্বল ও অসহায় করে দেয়। তখন একমাত্র নীরবতাই আমাদের সাহায্য করতে পারে। ঝড় থামার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ অপেক্ষা সহজ নয়, তবে এটা করা ছাড়া তো আর অন্যকিছু করারও থাকে না। প্রত্যেক ধর্মদর্শনের সারকথাই হলো, জীবনকে বোঝা। এই বোঝার কাজটা কোলাহলে করা যায় না, বিস্রস্ত হৃদয়ে প্রকৃত উপলব্ধি সহজে আসে না। আমাদের কথা যদি হয় নদীর মতো খরস্রোতা, তবে আমাদের নীরবতা সমুদ্রের মতোই গভীর। কথা হচ্ছে বন্দুকের গুলির মতো। গুলি বেরিয়ে গেলে বন্দুকের আর কী দাম থাকে? যে গুলি এখনো ছোঁড়া হয়নি, তার শক্তি ও প্রভাব দুইই বেশি। যে তীরন্দাজ তার তীরটা এখনো ছোঁড়েনি, সাথে রেখে দিয়েছে, সে কি বেশি বিপদজনক নয়? তার মূল শক্তি তার নিজের কাছেই আছে, যা সে যেকোনো সময়ই ব্যবহার করতে পারে। যে কথাটি এখনো বলা হয়নি, সে কথা যতোটা শক্তি ধারণ করে, তার চাইতে অনেকবেশি অর্থ ও অনর্থ প্রকাশ করে। এই ব্যাপারটিই লোককে বিভ্রান্ত ও শঙ্কিত করে দেয়। যার হৃদয়ে এ কথাটি লুকিয়ে আছে, ঠোঁট পর্যন্ত আসেনি, সে ব্যক্তি ওই কথার বাহ্যিকতার সম্ভাব্য বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত। লোকে তার এই রহস্যময় নীরবতার বিভিন্ন অর্থ বা অনর্থ নিজেদের মতো করে বের করে, তবে সে অর্থ বা অনর্থে কথার অধীশ্বরের কোনো দায় থাকে না। কথা বলে ফেলার লোভ সামলানো সত্যিই খুব কঠিন, তবে এ কাজটি যারা করতে পারেন, তারা অপেক্ষাকৃত অধিক ক্ষমতা ও স্বস্তি উপভোগ করেন।

সতেরো। কখনো-কখনো নীরবতা প্রার্থনার সমান ফল দেয়। যে মুহূর্তে আমাদের সকল কথার তীক্ষ্ণতা ব্যর্থ হয়ে আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, সে মুহূর্তে নীরবতার সমুদ্র সাঁতরে আমরা শান্তির খোঁজ করতে পারি, এমনি করে একসময় নৈঃশব্দ্য স্বস্তি ও সুখের বারতা বয়ে আনে। এই নৈঃশব্দ্য খুবই পীড়াদায়ক, চুপ থাকার চাইতে কঠিন কাজ আর হয় না। কিন্তু শব্দহীনতার যাদুতে সুন্দরতম মুহূর্তগুলি রচিত হয়। আমাদের হৃদয় এমনকিছু দেখতে পায়, যা আমরা দেখতে পাই না, এমনকিছু শুনতে পায়, যা আমরা শুনতে পাই না। আমরা এখন যেমন আছি, তা মূলত আমরা আগে যেমন ছিলাম তার ফলাফল। সাধারণত, বর্তমান অতীতকে অনুসরণ করে। আমাদের হৃদয়ের শস্যক্ষেত্রে আমরা যে ফসলের বীজ বুনেছি, চাষ করেছি, সে ফসল গ্রহণ করেই আমাদের জীবন এগোচ্ছে। আমরা যা ভাবি, আমাদের ভাববার ক্ষমতা তার চাইতে বেশি। আমরা যা জানি, আমাদের জানবার ক্ষমতা তার চাইতে বেশি। আমাদের প্রতি মুহূর্তের ভাবনা ও কাজ আমাদের যা আছে, সেটাকে বাড়িয়ে তুলছে, বা কমিয়ে দিচ্ছে। যে মুহূর্তে আমরা আমাদের সকল অবচেতনকে চৈতন্যের সাথে যুক্ত করতে পারবো, সে মুহূর্তে আমাদের সকল নীরবতা সমস্বরে জীবনের জয়গান গেয়ে উঠবে। আমরা যাকিছু আমাদের অবচেতনায় করি, যারা আমাদের চাইতে এগিয়ে, তারা সেসব কাজ সম্পূর্ণ চৈতন্যেই করেন। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি প্রায়ই একটা বই পড়তেন। বইটা তিনি কারো সামনে পড়তেন না, লুকিয়ে-লুকিয়ে পড়তেন। মজার ব্যাপার হল, এই বইটার প্রথম ক্রেতাও ছিলেন তিনিই। বইটা নিয়ে তাঁর শিষ্যদের আগ্রহ আর কৌতূহলের কোনো সীমা ছিল না। তাদের ঔৎসুক্য বেড়ে গিয়েছিলো, কারণ মওলানা সাহেব বইটা কখনোই কারো সামনে পড়তেন না। সবাই সামনে থেকে চলে গেলে, তিনি বইটা তাঁর বালিশের নিচ থেকে বের করে নীরবে পড়তে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যাপারটা সবার মধ্যে অসীম কৌতূহলের জন্ম দেয়। সবাই ভাবতো, “এই রহস্যময় বইতে এমন কী লেখা আছে?” এটা জানার জন্য অনেকেই খুব চেষ্টা করতো। কেউ-কেউ মওলানা রুমির ছাদে গিয়ে ছাদের টালি সরিয়ে দেখার চেষ্টা করতো, রুমি কী পড়ছেন। কিন্তু কেউ কখনো জানতে পারেনি, ওই বইতে আসলে কী আছে। যেদিন জালালুদ্দিন রুমি মারা গেলেন, সেদিন উৎসাহী শিষ্যরা মৃত রুমির চাইতে বইটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা মওলানা রুমিকে খুব ভালোবাসতেন। আর কোনো সূফী সাধক এমন অসীম ভালোবাসা পেয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। মওলানা শব্দটির অর্থ হচ্ছে, প্রাণপ্রিয় শিক্ষক। রুমি ছাড়া আর কাউকে এই নামে ডাকা হয় না। রুমিকে যারা এতোটাই ভালোবাসতেন, তারাও রুমির মৃত্যুর পর ভুলেই গিয়েছিলেন যে, রুমি আর নেই। রুমির মৃতদেহের চাইতে তাদের নিজেদের কৌতূহল নিবৃত্ত করাই তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। ব্যক্তি রুমির চাইতেও তাদের কাছে বড় ছিল, যেকোনো উপায়েই হোক, তাদের কৌতূহল মেটানো। রুমির মৃতদেহের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সেই রহস্যময় বইটা। তারা রুমির বালিশের নিচ থেকে বইটা টেনে বের করলেন, এবং অবাক হয়ে দেখলেন, সেই বইতে কিছুই লেখা নেই। পাতার পর পাতা উল্টে দেখা গেলো, কিছুই নেই ওতে, সেই বইতে পড়ার মতো কিছুই পেলেন না তারা। রুমির ভক্তদের মধ্যে যারা ছিলেন তাঁর খুব কাছের, তারা বুঝেছিলেন, সেই আপাত অর্থহীন বইয়ের প্রকৃত অর্থটা কী। অক্ষরশূন্য সেই বইতে পৃথিবীর সকল অক্ষর সুপ্ত ছিল। যখন ঠোঁট কথা বলে না, তখন হৃদয় কথা বলে ওঠে। হৃদয় যখন কথা বলতে থাকে, তখন পৃথিবীর সব কথাই হৃদয়প্রভুর বিশ্বস্ত অনুগামী হয়ে সঠিক পথে অনুগমন করে। কেউ যখন কোনোকিছু বলতে বা বোঝাতে অনেকবেশি শব্দ ব্যবহার করে, তখন সেটার গুরুত্ব কমে যায়। শব্দের বাহুল্য যতো বাড়তে থাকে, কথার ওজন ততো কমতে থাকে। লোকে পয়সা বাঁচানোর জন্য কত সময় নিয়ে বুদ্ধি বের করে, অথচ কথা বাঁচানোর বুদ্ধি নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবা দূরে থাক, এই ব্যাপারটা লোকের মাথায়ই আসে না। হৃত ধন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, কিন্তু হৃত কথার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। মুক্তোর খোলসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, “তোমার ভেতরে এতো দামি জিনিস এলো কোত্থেকে?” নিশ্চিতভাবেই উত্তর পাবেন, “নীরবতা থেকে—যতো কষ্টই হোক, বুকের ভেতরে যতো যন্ত্রণাই হোক, এই এতোগুলি বছর ধরে আমি কখনোই আমার ওষ্ঠযুগল উন্মুক্ত করিনি।” চুপ করে থাকার সময়ে নিজের সাথেই নিজের অবিরাম যুদ্ধ চলতে থাকে, নিজের মতামত প্রকাশ করার ক্রমাগত তাড়না মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে, কিছুতেই ঠোঁট দুটো বন্ধ রাখা যায় না। কিন্তু, একটাসময়ে এই নীরবতাই অসীম শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে। আমরা যতো নীরবতার অনুশীলন করবো, ততোই আমাদের প্রার্থনাগুলি সুন্দর ও নিখুঁত হবে, ততোই আমরা স্রষ্টার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারবো। আমাদের সবচাইতে যৌক্তিক কথাটির চাইতেও নৈঃশব্দ্য অনেকবেশি কিছু শেখাতে পারে।

আঠারো। লোকে প্যাঁচা বা কাককে খাঁচায় আটকে রাখে না, ময়না-টিয়াকে খাঁচায় আটকায়। সুন্দরকে বাহুশক্তির বলে অসুন্দর করে দেয়ার মধ্যেই লোকের যতো আনন্দ। লোকে তার উপরেই থুতু ছিটিয়ে সুখ অনুভব করে, যার থুতুর ফেনার সমান যোগ্যতাটুকুও তার নেই। যারা স্রষ্টার প্রিয় মানুষ, তাদেরকে স্রষ্টার অপ্রিয় মানুষগুলি ক্রমাগত আঘাত করে যায়। যে হৃদয় স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে, লোকে অমন হৃদয় নোংরা করে আনন্দ পায়। এমন যুক্তিহীন অহেতুক আচরণ মানুষকে কদর্য পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা সহজভাবে নিতে শেখায়, নিষ্ঠুরতায় বাঁচার দীক্ষা দেয়। হাসিমুখে নীরবতাকে সঙ্গী করে অযাচিত কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে মানুষ শক্তিশালী হয়। সে পথই শুদ্ধ পথ, যে পথ মানুষকে নিকষিত করে। মানুষ অতিচতুরতা বা অতিপাণ্ডিত্য দিয়ে জীবনে কিছু করতে পারে না। জীবনে কিছু করতে চাইলে প্রথমেই শুদ্ধ পথের অনুসন্ধান করতে হবে। সংকটজনক মুহূর্তে লোকে সৎবুদ্ধি দিতে পারুক না পারুক, অর্থহীন কথার তীব্র তীর ঠিকই ছুঁড়তে পারে। কথার ওজন যে যতো কম বোঝে, সে ততো বেশি নির্বোধের মতো কথা বলে। এমন কথায় প্রভাবিত হওয়াটা সহজ। এ সমাজ কথার যাদুকরদের কথার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। দায়িত্বহীন কথার মায়াজালে সমস্যা কমে না, বাড়ে। ওই সময় নীরবতা মানুষকে সুবুদ্ধি দিতে পারে। শান্ত হৃদয় অলৌকিকভাবে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় বলে দেয়। প্রচণ্ড কোলাহল, সংঘাত, বিক্ষোভ, কিংবা অরাজকতা, যা-ই থাকুক না কেন, নিজেকে শান্ত রেখে অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। চাইলেই তো আর সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। যতটুকু সম্ভব, সবার সাথে সদ্ভাব রেখে কাউকে আহত না করে সময়টাকে কাটতে দিতে হবে। সময়ের ধর্মই হচ্ছে, সময় প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর, দুইই সাথে নিয়ে সামনের দিকে বয়ে চলে। অন্যদের কথা যতোই বিরক্তিকর কিংবা অযৌক্তিক শোনাক না কেন, স্থির হয়ে তা শুনতে হবে। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, কারো কথারই কোনো প্রত্যুত্তর দেয়া যাবে না। নীরব পরিবেশে মনটাকে স্থির করে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে আমাদের স্বজ্ঞা বৃদ্ধি পায় এবং এর সাথে-সাথে আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও কাণ্ডজ্ঞান অসীম মাত্রায় কাজ করে। আমাদের মন সকল কষ্ট ও দুর্দশার ভার বহন করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আমরা আমাদের মনকে সান্ত্বনা দিই—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের মন যা, আমরা মূলত তা-ই। আমাদের মনই আমাদের পরিচালিত করে, মনভেঙে গেলে মন শান্তি খুঁজে বেড়ায়, মনের অদ্ভুত সব রসায়নে আমরা ভালোবাসি কিংবা ঘৃণা করি। আমাদের অবয়ব আমাদের সম্পর্কে মিথ্যে একটা ধারণা দেয়, লোকে আমাদের বাইরেরটা দেখলে যা দেখে বলে ভাবে, আসলে আমরা ওরকম নই। লোকে যদি আমাদের মনটা দেখতে পেতো, আমাদের মনের ভেতরে কী চলছে তা বুঝতে পারতো, তবে আমরা আসলে কী, সেটা লোকে ধরে ফেলতো। আমাদের মনকে আমরা যেমন করে সাজাই, আমরা ঠিক তেমন করেই ভাবি, কাজ করি। মনের ক্ষমতাই আমাদের সকল ক্ষমতার পরিমাণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। মন যখন ভালোবাসায় পূর্ণ হয়, তখন মনের ক্ষমতা বেড়ে যায়। আমাদের যা করতে হবে, যদি তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কাজ করে, তবে তা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তি বা একঘেয়েমি কাজ করে না। কাজটাকে বোঝা মনে হয় না, ফলে কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। কাজের প্রতি সততা আর একাগ্রতা থাকে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজটা এমন আশ্চর্য পূর্ণতায় করা যায় যে, আমরা মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও সেই কাজের জন্য যুগের পর যুগ সবাই আমাদের মনে রাখে।

উনিশ। ভাল নিয়ত নিয়ে কোনো বিনিময় প্রত্যাশা না করে কাজ করে গেলে হতাশা আসে না। গভীর মমতা ও আন্তরিকতা নিয়ে কারো পাশে এসে দাঁড়ালে আনন্দের ঝর্ণাধারায় সকল বেদনা আর কষ্ট দূরে সরে যায়। ভালোবাসার মাধ্যমে আমাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পৃথিবীর মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়। প্রকৃত ভালোবাসা স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে এক করে দেয়। যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ঘৃণা কিংবা ঈর্ষার আগুন নিজেকেই তিলে-তিলে পুড়িয়ে মারে এবং নিজের ক্ষমতার উপর সকল বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। অন্তর্জগত আর বহির্জগতের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন মনুষ্যত্বকে দেবত্বে উন্নীত করে। তখন স্রষ্টার সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়ায় সকল সাধারণই অসাধারণত্বে পরিণত হয়। আমাদের যা আছে, তা যতো সামান্যই হোক না কেন, তা দিয়েই জীবনটাকে সুন্দরভাবে কাটানোর দীক্ষার নামই জ্ঞান। আমরা যখন আমাদের জীবনের সকল অনুষঙ্গকে ভালোবাসতে শিখে যাবো, তখন আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে প্রেম ও ভালোবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ বাইরে এসে কোমল ধারায় আমাদের সাথে আমাদের ভালোবাসার বস্তুকে এক করে দেবে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের শরীর আমাদের আত্মাকে ধারণ করে, যেমনি করে প্রার্থনাগৃহ স্রষ্টাকে ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটি এমন নয়। কোনো প্রার্থনাগৃহই স্রষ্টাকে ধারণ করে না, বরং যেখানেই স্রষ্টার অধিষ্ঠান, সেখানেই প্রার্থনাগৃহ। আমরা সবাই একেকটি আত্মা, যাকে নিপুণ দক্ষতায় আড়াল করে শরীর নামের এক বিশাল খাঁচা। যখন আমাদের সকল ভাবনা আর কাজকে আমাদের শরীর নয়, বরং আমাদের আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, তখন আমাদের বাইরের জগত আর ভেতরের জগত অভিন্ন সুতোয় গেঁথে যায়। আত্মা যাকে প্রেমে বাঁধে, তাকে সারাজীবনের জন্যই বাঁধে। মন বা শরীর যাকে প্রেমে বাঁধে, তাকে নির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ধরনে ক্ষণিকের মোহের বাঁধনে বাঁধে। আত্মার ভালোবাসায় কোনো বৈষম্য থাকে না, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা সে ভালোবাসায় নেই, কাল ও প্রেক্ষিতের সকল পরীক্ষায় সে ভালোবাসা উত্তীর্ণ। এমন ভালোবাসায় প্রেমিক আর প্রেমের বস্তুর মধ্যে শুধু বাহ্যিক ভিন্নতা ছাড়া আর কোনো ভিন্নতা থাকে না, দূরত্ব থাকে না। দেহের বাহ্যিক অস্তিত্বের দ্বৈততা থাকলেও ভালোবাসার স্বর্গীয় স্রোতে ভাসতেথাকা দুটি সত্তা একত্ব লাভ করে। যে চেতনার স্পর্শে হৃদয়মথিত স্রষ্টার সাথে কোনো সংযোগ ঘটে না, অনির্বচনীয় সুখে কী এক আশ্চর্য সুরে হৃদয় নেচে ওঠে না, শরীর ও মন একক সত্তায় চলে না, সে চেতনা স্খলিত বিভ্রম মাত্র।

বিশ। যাদের দেখে, যাদের সাথে থেকে আমরা বেড়ে উঠি, একসাথে থাকতে-থাকতে যাদের জন্য আমাদের ভালোবাসা আপনিই জন্মে যায়, একসময় তারা আমাদের ছেড়ে চলে যান। সেসময়, এ জীবনে আর কখনোই তাদের সাথে দেখা হবে না, এটা মাথায় এলেও তো আমরা কষ্টে অস্থির হয়ে পড়ি! এই যে ভালোবাসার জন্য এমন আর্তনাদ, যদি সে ভালোবাসাটা অন্য কারো মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারতাম, কিংবা ভালোবাসার জন্য আর কাউকে সামনে না পেতাম, তবে ভালোবাসার মানুষটির বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় আমরা কি আদৌ পৃথিবীতে বাঁচতে পারতাম? ভালোবাসা একটা চিরন্তন সত্তা। এর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। পৃথিবীতে সেই সৃষ্টির সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মোট ভালোবাসা একই পরিমাণেই আছে। আমাদের আবেগ ও চিন্তাচেতনাই ভালোবাসাকে গ্রহণ করে, কিংবা বর্জন করে। ভালোবাসা যখন আমাদের হৃদয়ে জন্মে, তখন মূলত আমাদের হৃদয়ে যে ভালোবাসাটা সুপ্ত ছিল, সেটা প্রকাশ পায় মাত্র। আমাদের জীবন থেকে কারো প্রস্থানের ফলে ভালোবাসাটা আবার পুরনো সুপ্তাবস্থায় ফিরে যায়। জীবনে অন্য কারো আগমনে সে ভালোবাসা পুনরায় জেগে উঠতে পারে। এক প্রেমের প্রস্থানে আরেক প্রেমের আগমন, এমনকি এর পরেও বারংবার প্রেমের আগমন-যাত্রা চিরস্থায়ী না হোক, সাময়িক ভালোবাসার উদ্বোধন ছাড়া আর কী? এমনও হতে পারে, নতুন কেউ জীবনে এলো না, কিন্তু পুরনো কোনো অস্তিত্বের জন্য যে ভালোবাসা হৃদয়ে আগেই ছিল, সেটা বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে। প্রায়ই দেখা যায়, স্বামীর অকালমৃত্যুর পর সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা আগের চাইতেও প্রবল হয়ে যায়। ভালোবাসার বিনাশ নেই, শুধু স্থানান্তর আছে। যখন ভালোবাসা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমাদের মনে হতে থাকে, “আমার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। আর কখনোই আমি কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারবো না। কোনোদিনই আর কারো প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ জন্মাবে না। এমন ভালোবাসাহীনতায় আমি বাঁচবো কীকরে?” কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। ভালোবাসাকে দুই বা এমন কোনো সংখ্যার ফ্রেমে বাঁধা যায় না। প্রায়ই দেখা যায়, একটা স্বীকৃত সম্পর্কের মধ্যে থাকার সময়ই মানুষ অন্য কারো প্রতি প্রেম বা ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। এমন নয় যে, প্রথম সম্পর্কে প্রতি সে উদাসীন বা দায়িত্বজ্ঞান শূন্য, তবু সে অন্য কারো প্রতি এক ধরনের আকর্ষণবোধ করে। কখনো-কখনো সে আকর্ষণ মানুষকে ঘরছাড়াও করে দেয়। এমন হতে পারে, প্রথম ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে এমন কোনোকিছুর অনুপস্থিতি আছে, যা সে মনে-মনে কামনা করে। যখনই অন্য কারো মধ্যে ওই বিশেষ দিকটির অস্তিত্ব দেখতে পায়, তখনই তার হৃদয়ে সে নতুন মানুষটির জন্য ভালোবাসার জন্ম নেয়। শারীরিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে বহুগামিতা শুধুই দৈহিক বা মানসিক অতৃপ্তি থেকে নয়, স্রেফ অভ্যাস বা ভালোলাগা বা নিছকই ইচ্ছা থেকেও ভালোবাসা জাগতে পারে। মানসিক ভালোবাসায়ও এটা দেখা যায়। এমন নয় যে, বর্তমান সম্পর্ক তার দৈহিক বা মানসিক চাহিদা মেটাচ্ছে না, কিংবা বর্তমান সম্পর্কের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নেই বা ফুরিয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও সে ভালোলাগা বা অভ্যস্ততা বা স্রেফ ইচ্ছে পূরণ করার জন্য নতুন কোনো সম্পর্ককে প্রশ্রয় দিতে পারে। যাকে আশ্রয় দিতে পারে না, তাকে প্রশ্রয় দেয়ার এই বিষয়টি উৎপত্তি ও বিকাশ দুইই পারস্পরিক সম্মতি বা কোনো মোহ থেকে। এরূপ প্রশ্রয়ের ভিত্তি যতদিন পর্যন্ত শরীর থাকে, ততদিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। কিন্তু যখনই মন এসে শরীরের জায়গাটা দখল করে, তখনই শুরু হয় আসল বিপর্যয়। শরীর স্রেফ প্রশ্রয়ের মধ্যে সন্তুষ্ট থাকলেও মন প্রশ্রয়ের সাথে-সাথে আশ্রয়টাও চায়। পুরনো আশ্রয়কে ধ্বংস না করে নতুন আশ্রয়ের সৃষ্টি ভূসম্পত্তির আধিকারিককে ধনী করে বটে, কিন্তু ভালোবাসার আধিকারিককে একেবারে নিঃস্ব পথের ভিখিরি করে ছেড়ে দেয়। কোনো না কোনো সময়ে, আমাদের ভালোবাসা আমাদের অবচেতনেই এক আত্মা থেকে অন্য আত্মায় সরে যায়। আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার এমন পুনঃউদ্বোধন খুবই সাধারণ স্বাভাবিক একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রপঞ্চ। ভালোবাসার এমন স্থানান্তরের ফলে আমাদের হৃদয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে, যেসব পরিবর্তনের কথা হয়তো আমরা কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। আমরা বিশ্বাস করতে শিখি, হ্যাঁ, আমি যেমন চাই, এই মানুষটি তেমনই এক অনন্য মানুষ। (অনন্যতা ভালোবাসার জন্ম দেয় না, ভালোবাসাই অনন্যতার জন্ম দেয়। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকে সে অনন্য হিসেবেই ভাবতে চায়।) কিংবা, যে মানুষটা চলে গেছে, সে মানুষটা এ মানুষের মধ্যে আমার জীবনে ফিরে এসেছে। কিংবা, আমাকে এতোটা ভালো কেউ কখনো বাসেনি, বাসবেও না। কিংবা, আমার ভালোবাসাকে আমি এই ভালোবাসার মাঝেই বাঁচিয়ে রাখবো। কিংবা, আমার যে দিন গেছে, তা তো আর কখনোই ফিরবে না, তাই বলে কি আমি আর কখনোই স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবো না?—অথচ, একটাসময়ে এই সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারটাই কেউ আমাদের শত চেষ্টাতেও বিশ্বাস করাতে পারতো না। কোনো সম্পর্কই চিরন্তন নয়, একমাত্র ভালবাসাটাই চিরন্তন। তাই এই চিরন্তন ভালোবাসার পরিচর্যার জন্যই সম্পর্কের যতো বাহ্যিক বা মনোগত পালাবদল।

একুশ। অন্যের কাছে বা নিজের কাছেই আমাদের সকল ভুল কাজ আর ঠিক কাজের কৈফিয়ত দিতে-দিতে আমাদের সময়গুলি চুরি হয়ে যায়। একসময় কোনো এক বিস্তীর্ণ মাঠে আমার সাথে তার দেখা হয়। যখন দুটো হৃদয় একই সমতলে এসে মিলে, তখন আমাদের ভেতরে এমনকিছুই থাকে না, যেটার কৈফিয়ত দিতে হয়। সব ধারণা, ভাষা, এমনকি আমরা ওই দুজনও ওই সময়ের কাছে তুচ্ছ নিরর্থক হয়ে পড়ি। শুধু দুটো আত্মার মধ্যে নীরব কথোপকথন চলতে থাকে। সেখানে কোনো কথা থাকে না, কোনো অভিযোগ থাকে না, কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকে না। এই কথোপকথনের কোনো কালিক বা স্থানিক সীমা নেই। একই অনুরণনে, একই ছন্দে, একই লয়ে, একই মাত্রায় দুটো হৃদয়ের মধ্যে অনুভূতির নিঃশব্দ স্থানান্তর চলতে থাকে। কোনো এক নির্মল দিনে একজন স্বাভাবিক মানুষ কোনো উঁচু পর্বতের চূড়ায় উঠে যতোদূর পর্যন্ত দেখতে পায়, তার চাইতেও বেশি দূর পর্যন্ত নিজের দৃষ্টিসীমাকে পৌঁছে দিতে, এমনকি কালের যেকোনো সীমানায় নিজের দৃষ্টি ও ভাবনাকে সাবলীলভাবে পৌঁছে দিতে, হৃদয়ের সকল শক্তিকে একসাথে জড়ো করে জীবনকে স্বপ্নের চাইতেও সুন্দর করে সাজাতে সময় আর অর্থ ব্যয় করে দূরে কোথাও যেতে হয় না। বরং, নিজের হৃদয়প্রদেশের দুর্জ্ঞেয় দুর্বোধ্য দুর্গম পরম প্রার্থিত স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে শান্ত সমাহিত স্থির হয়ে স্রষ্টা বা আপন স্বজ্ঞার ধ্যান করতে হয়। সকল সিদ্ধ মহাপুরুষের সকল প্রজ্ঞা আর উপলব্ধিই আমাদের হৃদয়মন্দিরে প্রোথিত আছে, সেসব ঐশ্বর্যকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হলে নিজেকে ত্যাগ, শ্রম, বিনয়ের সহযোগে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। প্রাচীনকালে পারস্যে এক ধরনের ধ্যানের প্রচলন ছিল। সূর্য ওঠার আগে সবাই মিলে একসাথে ধীর লয়ে গাইতে-গাইতে, কিংবা কবিতা আবৃত্তি করতে-করতে নাচতে থাকত। এ ধ্যানের নাম ছিল সামা। এই ধ্যানের মাধ্যমে পার্থিব সকল অনুভূতিকে ভুলে নিজেকে স্রষ্টার অনুগ্রহের প্রতি নিবেদন করা হতো, অর্থাৎ নিজের হৃদয়ের রহস্যময় রাজ্যে ঘুরে আসার প্রক্রিয়ায় স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করার চেষ্টা করা হতো। সুর এবং নাচের দ্যোতনায় স্রষ্টার ধ্যান করার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা হতো, নিজের অনুভূতিকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করা হতো। হৃদয়ের নিগুঢ় প্রকোষ্ঠে যে ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে, তাকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে মনের সকল সংশয় দূর হয়ে অসীম আনন্দ নিয়ে পালকের মতো হালকা হয়ে মন স্রষ্টার কাছে পৌঁছে যেত। কখনো-কখনো সামা-ধ্যানের সময় লোকে বাহ্যিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মাতাল অবস্থায় আধ্যাত্ম-সাধনায় মেতে উঠত। এসময় মানুষের সকল অভিমান, অহংবোধ, অসূয়া সহ বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তি দূরে সরে হৃদয় মন আত্মা নির্মল হতো, স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভের জন্য উপযুক্ত হতো। ওই সময় স্রষ্টা আর ধ্যানীদের হৃদয় এক হয়ে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ভালোবাসা আসে আত্মার ভেতর থেকে। আমাদের আত্মা হলো ভালোবাসা, আবেগ আর সমবেদনার এক মহাসমুদ্র। আত্মা স্রষ্টার একমাত্র প্রতিরুপ, একমাত্র চিরস্থায়ী আশ্রয়। ভালোবাসা কোনো কাল মানে না, ভালোবাসা কোনো কারণ মেনে চলে না, ভালোবাসায় কোনো শর্ত থাকে না, ভালোবাসা হয় শুধুই ভালোবাসার কারণে, ভালোবাসা অমরত্ব রচনা করে যা চিরকাল টিকে থাকে। ভালোবাসাই একমাত্র বিশুদ্ধ অনুভূতি যা আত্মার ভেতর থেকে আসে, এসে হৃদয়ে শান্তি ছড়িয়ে দেয়। জোর করে কিংবা হিসেব কষে যে ভালোবাসার জন্ম, ওতে পাপ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।