আকাশের সমান বড়

ঈশ্বরকে যে কয়েকটি কারণে আমি ধন্যবাদ দিই, সেগুলির মধ্যে একটি হলো, উনি আমাকে আকাশের সমান বড় একটি বাবা দিয়েছেন। আকাশ যেমনি কখনও পুরনো হয় না, তেমনি বাবাও! তাইতো ‘পুরনো বাবা’ বলেও কিছু নেই। বাবাদের বাবা হয়ে ওঠা যখন থেকে শুরু, তখন থেকেই বাবারা চিরন্তন হয়ে থাকে। তাই, বাবাদের এই রূপটি সব দেশেই এবং সব কালেই শাশ্বত।

আজ থেকে ঠিক ১ বছর আগে বাবাকে ‘শুভ জন্মদিন’ বলার পর বাবা বলেছিলেন, “আমি কি ছোট নাকি? জন্মদিন তো ছোটদের হয়।” আমি বললাম, তাহলে কেকটা কাটবে কে? বাবা শিশুদের মতো হাসছিলেন শুধু। সে হাসিতে সব প্রশ্নের উত্তরই আছে। অসুস্থতার কারণে বাবাকে রাত ১২টার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হয়। তাই সকালে বাবাকে ফোনে উইশ করলাম। আজকেও হুবহু তা-ই হলো!

বাবার সমসাময়িক প্রায় সবারই একটা ফ্ল্যাট আর অন্তত একটা করে গাড়ি আছে। আর বাবার আমরা দুই ছেলে আছি। বাবার অর্জন শুধু এইটুকুই—উনার দুই অপদার্থ পুত্র! স্রেফ এইটুকুতেই বাবা ভাবেন, বাবা অনেক ধনী! হুমায়ূন আহমেদের কবি’তেই বোধ হয় এরকম কিছু পড়েছিলাম, যে মায়ের ছেলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটে, সে মাও নিজের পঙ্গু ছেলের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে ভাবেন, আমার ছেলের মতন এতো সুন্দর করে ক্র্যাচে ভর দিয়ে পৃথিবীর আর কেউই হাঁটতে পারে না।…………. সকল বাবা-মা’ই নিজের ছেলেমেয়েকে পৃথিবীর সবচাইতে সেরা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার মতো অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। সে স্বপ্নেই বাঁচেন, সে স্বপ্নপূরণের জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবনবাজি রাখেন। কিছু-কিছু অপদার্থ সন্তান সেই স্বপ্নের কিছুমাত্র দাম না দিয়ে নিজের খামখেয়ালেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়, নিজের হাসিতে বাবা-মায়ের অশ্রুকে কবর দেয়। এমন জীবন কয়েক হাজার মৃত্যুর সমান! একটা সময় ছিল, যখন আমি স্রষ্টার কাছ থেকে শুধু এতটুকুই আয়ু চেয়ে নিয়েছিলাম, যতটুকু আয়ু পেলে আমি এমনকিছু করতে পারবো, যেটার জন্য আমার বাবা-মা সম্মানিত হন, গর্বিত হন, মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। সেই দিনটি আজ এসেছে। আজ আমি মৃত্যুও হাসিমুখে আলিঙ্গন করে নিতে পারি। এর পুরো কৃতিত্বই আমার বাবা-মায়ের। ওদের জন্যই আমি বেঁচেছিলাম, শুধু ওদের জন্যই আজ আমার কাছে মৃত্যুকে সহজ মনে হয়।

আমাদের বাবা আমাদের জন্য অতো পয়সা জমাননি। ৫টি মৌলিক চাহিদার বাইরে বাবার কাছ থেকে আমি ইচ্ছেমত যেটা পেয়েছি, সেটা হলো পড়ার বইয়ের বাইরের বইকেনার টাকা। বাবার কাছ থেকে টাকা নিতাম মায়ের মাধ্যমে। আমাকে কখনওই এই প্রশ্নটি শুনতে হয়নি, “এই বই তোর কী কাজে লাগবে?” বিত্ত গড়ার কারিগর বাবা কোনওদিনও হতে চাননি, তাই পারেনওনি। অহেতুক বিত্ত চিত্তকে বেড়ে উঠতে দেয় না। আমরা বড় হয়েছি বিত্তে নয়, চিত্তে। আমাদের দুইভাইয়ের জন্য সম্পদ জমানোর কথা কেউ বললে হেসে বলতেন, “ওদেরটা ওরা করে খাবে। আমি ওদেরকে মানুষ করে দিতে পারলেই খুশি।” তখন তো কিছু বুঝতাম না, তাই বাবার উপর ভীষণ রাগ হতো। বাবার বন্ধুদের একটা করে গাড়ি আছে, বাবার কেন নেই? ওদের কী সুন্দর বাড়ি আছে, আমাদের কেন নেই? ওরা রেজাল্ট ভাল করলে কত দামি-দামি উপহার পায়, তবে আমরা কেন শুধুই সস্তা বই পাবো? ওদের মা হাজার টাকার শাড়ি পরে, তবে আমার মায়ের শাড়িটা কেন ওরকম নয়? এরকম আরও কত কী অভিযোগ অনুযোগ!!

তখন ফোর কী ফাইভে পড়ি, পাপ্পু স্কুলে যাচ্ছে মাত্র। বাবা তো আইনজীবী, বাবার চেম্বার ছিল আমাদের বাসার সাথেই। আমরা বড়-বড় দুই রুমের একটা পুরনো ধাঁচের সস্তা বাসায় থাকতাম। ঢুকেই যে রুমটা, ওটাই বাবার চেম্বার। সে বাসার সিলিং আর দেয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে। দিনে নিয়ম করে ২বার জল আসে, প্রায়ই সেটাও আসত না কিংবা কম আসত, তখন আমাদের নিচ থেকে ৩তলায় বালতি-বালতি জল টানতে হতো। একটা রান্নাঘর, একটা বারান্দা, একটা বাথরুম। ঘরভর্তি তেলাপোকা, টিকটিকি আর মাকড়শা। দরোজা আর জানালা, দুইই কাঠের। চৌকাঠ ভাঙাচোরা, মেঝের শ্রী বলতে কিছু ছিল বলে মনে পড়ে না, সিলিংয়ের কোথাও-কোথাও বিশ্রীভাবে নাক বের আছে ইটগুলি। বর্ষায় জানালা গলে জল ঢুকত। কালবৈশাখী ঝড়ের রাতে নাইলনের দড়ি দিয়ে জানালা বেঁধে রাখতে হতো। এই ছিল আমাদের ছোটবেলার রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদে রাজা-রাণী আর আমরা ছোট্ট দুইটি রাজকুমার। আশ্চর্য রকমের সুন্দর ছিল সেইসব দিনগুলি! সেইসময়ের একটা রুপোলি চাঁদনী রাতে বাবার কোলে বসে বসে গল্পশোনা কিংবা শীতের পড়ন্ত রোদ্দুরে বিকেলে বারান্দায় মাদুরে বসে মায়ের হাতে ঘিয়েমাখা গরম ভাতের জন্য আজকের দিনেও জীবন দিয়ে দিতে পারি! খেতাম নিচে মাদুরে বসে। বাসার ডায়নিং টেবিলে বসে খেতে কেমন লাগে, সেটা বুঝেছি বড় হবার পর। সেইসব দিনগুলিতে ভিখিরির দশায় রাজভোগ খেতাম!

বাবা অনেক সিনিয়র লইয়ার, চট্টগ্রাম জজকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন ১৯৭৬ সাল থেকে। সেসময় তৎকালীন লিভার ব্রাদার্সে (বর্তমানে ইউনিলিভার) চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ঠাকুরমাকে মৃত্যুর পূর্বে কথা দিয়েছিলেন, ‘আইনজীবী হবেন’ সে কথা রাখতেই সেই বেশি বেতনের চাকরিকে গুডবাই বলে দিয়ে বাবার কোর্টে জয়েন করা। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখেছি, কত মানুষের কাছ থেকে কোনও পয়সা না নিয়েই মামলা লড়েছেন। স্বামী ছেড়ে দিয়েছে, এমন অসহায় অনেক মেয়েকে আইনি সহায়তা দিতে গিয়ে কোর্টের যে আনুসাঙ্গিক খরচ, সেটাও দিয়েছেন নিজের পকেট থেকে। গ্রামের দরিদ্র অনেক মানুষকেই নিজের খরচে মামলা লড়ে হারানো জমি উদ্ধার করে দিয়েছেন। অনেকের কাছ থেকেই ন্যায্য ফিসের চাইতে কম নিয়েছেন, কখনওই কারও কাছ থেকে বুজরুকি করে বাড়তি পয়সা নিতে বাবাকে দেখিনি। (এই ফাঁকে অকপটে বলে রাখি, আমি বাবার এইসব মহত্ত্বের ছিটেফোঁটাও পাইনি।) এই মুহূর্তে দুটো ঘটনা মনে পড়ছে।

চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার একটা ৫তলা বাড়ি। সে বাড়িতে এক বিধবা মহিলাকে হত্যা করে কৌশলে বাড়িটা দখল করার ষড়যন্ত্র চলছে অনেকদিন ধরেই। আরও কিছু ঝামেলাও ছিল। ওই অসহায় মহিলা একেবারে নিরুপায় হয়ে ছেলেদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আইনের শরণাপন্ন হলেন। উনি বাবাকে ‘ভাই’ ডেকেছিলেন। বাবা সে মামলা লড়লেন এবং জিতলেনও। মজার ব্যাপার হলো, সে মামলায় বাবার প্রতিপক্ষের উকিল ছিলেন আমার সেজো দাদু, মানে বাবার সেজো কাকা। ক্যারিয়ারের শুরুতে বাবা উনার অধীনেই শিক্ষানবিশ হিসেবে ছিলেন। এরকম অসংখ্য মামলায় বাবা উনার গুরুকে হারিয়েছেন। বারবারই দাদু বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাইকে গর্ব করে এই কথা বলতেন। যে মামলার কথায় ছিলাম। বাড়িটা জিতে ওই ভদ্রমহিলা চাইলেন, বাড়িটা বাবার নামে লিখে দিতে। যে মানুষটি তার সন্তানদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরে আসে, তার আর হারানোর কিছুই থাকে না। সে ভদ্রমহিলা শুধু চেয়েছিলেন তার বাকি জীবনটাতে একটু নিরাপত্তা আর সম্মান। বাবাকে অনুরোধ করে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, শুধু একটা রুমে তাকে থাকতে দিয়ে বাকি বাড়িটায় আমরা যেভাবে খুশি সেভাবে থাকতে পারি। এরকম আরও অনেক ধরনের অনুরোধ সত্ত্বেও বাবা কিছুতেই সে বাড়ি নিতে রাজি হলেন না। তখন সেই আন্টি আমার মায়ের হাতদুটো ধরে বলেছিলেন, “ভাবি, আপনি ভাইয়াকে বোঝান। বোনের অধিকার নিয়ে আমি আপনাদের ছায়ায় থাকতে চাইছি! আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।” বাবা তখন উনাকে বলেছিলেন, “আপা, আপনি শুধু আমার এই দুই ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ভগবান যেন ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন। ওরা যেন মানুষ হয়। আপনি ভাল থাকবেন, আমাকে ভগবান অনেক ভাল রেখেছেন।” আমি সেসময় বাবার কোলে আর পাপ্পু মায়ের কোলে বসে কী একটা নিয়ে পরস্পরকে ভেংচি কেটে-কেটে বারবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। উনার স্নেহচুম্বন আর চোখের জলে যেন সেইদিনের পরিতপ্ত হৃদয়ের সকল আশীর্বাদ পূর্ণতা পেল। বিত্তের অমোঘ ইশারা বাবার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো। বাবার যে চিত্ত ছিল, সে তুলনায় সে বিত্ত ছিল অতি তুচ্ছ!

তখন খুব সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি। সে হিসেবে সালটা ১৯৯৬ হওয়ার কথা। সন্ধ্যার পর পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে বাবার চেম্বারের কাঠের দরোজার ফাঁক দিয়ে বাবা কী করছে, সেটা লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা আমার সে সময়ের প্রিয় কাজগুলির একটি। একদিন দেখলাম, বাবার এক স্টুডেন্ট বাবাকে একটা বড়সড় বাদামি রঙের খামে ৩ লাখ টাকা খুশিমনে দিতে চাইছেন আর বাবা সে টাকাটা বারবারই ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তখন উনি বললেন, “স্যার, আপনি তো আমার বাবার মতন। আপনার জন্যই আমাদের দেড় কোটি টাকার জমিটা উদ্ধার করতে পেরেছি। এটা আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি, স্যার। আমার বাবা বেঁচে থাকলে বাবাকে কি আমি কিছু কিনে দিতাম না?” বাবা বলেছিলেন, “আমাকে যদি বাবাই ভাবো, তবে ওটা বোলো না। আমার ছেলে বিপদে পড়লে ওকে আমি না দেখলে কে দেখবে? তুমি শুধু তোমার ছোট দুইভাইয়ের জন্য দোয়া কর। আপাকে ওদের জন্য দোয়া করতে বোলো। আমার আর কিছুই লাগবে না। ঈশ্বর আমাকে অনেক ভাল রেখেছেন। আর তাছাড়া আমার প্রাপ্য ফিসটা তো তুমি আমাকে দিয়েছোই!” উনি বাবার টেবিলে খামটা রেখে বললেন, “স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না। এটা এখানে থাকল। আপনি না লাগলে পরে ফেলে দেবেন।” এটা বলে উনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন বাবা উনাকে পেছন থেকে ডেকে বললেন, “আমার পাপের বোঝাটা একটু ভারি করে তোমার যদি ভাল হয়, তবে আমি এটা নেবো। তবে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, এই টাকাটা আমি কোনও ভাল কাজে দান করে দেবো। সে কাজটি কি তুমি তোমার এই বাবার জন্য করতে পারো না?” বাবার সেই স্টুডেন্টটা এটা শুনে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বলেছিলেন, “স্যার, আল্লাহ্ আপনাকে কোনওদিনও কোনও কষ্টে রাখবেন না। আমি নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করবো।”

আমাদের পাশে বাবার বন্ধুর বাড়ি ওঠে। আমরা বাবাকে বলতাম, বাবা, দেখো, সবার বাড়ি আছে, আমাদের কেন নেই? তখন বাবা হাসতে-হাসতে বলতেন, “বাড়ি থাকলে কী হবে?” “ওমা! আমাদেরও একটা বাড়ি হবে। এটা ভাল না?” “ভাল তো! তো, তোরা বড় হলে বানিয়ে নিস!” “তুমি বানাও না কেন?” “আমার যে অতো টাকা নেই!” “তুমি মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতে জানো না।” “সেটা ঠিক।” “মানুষ তোমাকে কম টাকা দিয়ে ঠকায়।” “টাকা নিতে জানলেই জিততাম?” “হ্যাঁ, আমরা আরও ভাল থাকতে পারতাম।” “এখন খারাপ আছিস?” “আছিই তো!” “এটা কখনওই বলবি না। এর চাইতে বেশি টাকা আমার লাগবে না। তোদের লাগলে তোরা টাকাকড়ি করে নিস।” “বাবা, তুমি ঠকেই গেলে সারাজীবন। তোমাকে দিয়ে জীবনেও কিছু হবে না।” “বাবা, সবাইকেই জিততে হবে কেন? তোরা বড় হবি, জিতবি; এতেই আমার জেতা হয়ে যাবে।” সেদিন বাবার এই কথাটির মানে বুঝিনি। শুধু রাগ হয়েছিল আমার ব্যর্থ অথর্ব বাবার ওপর। বাবার বন্ধুর ৩তলা বাড়িটা উঠে গেলে বাবা একটা রঙিন ঘুড়ি কিনে দিয়ে বলেছিলেন, “যা, কাকুর ছাদে গিয়ে ওড়া!” মাকে রাগ করে বলেছিলাম, “মা, বাবাটা এমন কেন? তুমি বাবাকে নিয়ে কীভাবে যে আছো!” মা কিছুই বলতেন না, মিটিমিটি হাসতেন শুধু। মাকে বাবা দামি-দামি শাড়িগহনা কিনে দেননি; আজকে বুঝি, যা দিয়েছিলেন, সে ঐশ্বর্যের কোনও তুলনা চলে না।

আমাদের ভাঙা ঘরে মুঠো-মুঠো সুখ খেলা করতো। সন্ধ্যার টিফিন আর রাতের খাবার আমরা ৪ জন কখনও কেউ আলাদা খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাবা বাইরে একা-একা কিছু খেতেন না। কোর্ট থেকে ফেরার সময় টিফিন নিয়ে আসতেন। যা খাওয়ার, আমাদের সবাইকে নিয়েই একসাথে খেতেন। ছুটির দিনগুলিতে আমাদের ফেলে একটা খাবারও মুখে দিতেন না। মানুষের সাফল্যে বাবাকে সবসময়ই খুশি হয়ে উঠতে দেখেছি। আজকের দিন পর্যন্ত বাবার মধ্যে ‘ঈর্ষা’ ব্যাপারটা কোনওদিনই দেখিনি। “একেবারেই ঈর্ষা না করে বাঁচা” আমাদের দুইভাইকে এই দীক্ষাটা বাবাই দিয়েছেন। বাবা কখনওই কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন না। যার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাকে হারানো অসম্ভব! সে যে সে কবেই জিতেই বসে আছে! বাবা সেই পুরনো দিনগুলির মতন করে এখনও জিতেই বাঁচেন! মাঝেমাঝে মনে হয়, ইসস! বাবার বাঁচাটা একবারের জন্য হলেও যদি বাঁচতে শিখতাম!

আজ এই সহজ মানুষটির ৬৯তম জন্মদিন। বাবা এখন অতো ভাল নেই। শরীর ভেঙে গেছে, স্ট্রোক করেছেন বেশ কিছুদিন হলো। এইতো সেদিন চেন্নাই থেকে চেকআপ করে এলেন। হার্টেও কিছু ব্লক ধরা পড়েছে। ওষুধপত্র খাচ্ছেন। মাও তো অসুস্থ। আগে থেকেই স্পন্ডিলাইটিস ছিল, স্পাইন্যাল কর্ডের বেশ কয়েকটি হাড় স্থানচ্যুত হয়ে নার্ভ সিস্টেমকে ব্যাহত করছিল, একটা মেজর অপারেশন করে ঠিক করতে হয়েছে। বাবা-মা চিকিৎসা করে এলেন মাত্র সপ্তাহ দুয়েক হলো। দুইজনই এখনও বেশ অসুস্থ। এদিকে জীবিকার তাগিদে আমি পড়ে আছি সাতক্ষীরাতে। আমি তো বাবা-মা’র একটুখানি সেবাও করতে পারছি না। বাসায় কোনও কাজের লোক পাচ্ছি না। পাপ্পুই সব দেখাশোনা করে। আমার ছোটকাকিমা এসে রান্না করে দিয়ে যান। ঘরের এমন কোনও কাজ নেই, যেটা পাপ্পুকে করতে হয় না। ওর পড়াশোনা আছে, অন্য কাজও আছে, এর সাথে, আমার একটি বোন থাকলে যেসব কাজ করতো, সেগুলি সহ অন্যান্য সব কাজও ওকেই করতে হয়। প্রায়ই রান্নাও করে। ওরা কেউ আমাকে এসবের কিছুই বলে না। আমি তো সব বুঝি! মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে, এসব চাকরিবাকরিকে লাত্থি মেরে সব ছেড়েছুঁড়ে বাসায় চলে যাই। কিন্তু হায়! চাকরিবাকরি লাত্থি মারতেও যে একটা চাকরি থাকা লাগে! যার চাকরি আছে, সে চাকরিকে লাত্থি মারে। যার চাকরি নেই, তাকে সবাই লাত্থি মারে! দুনিয়াটা এরকমই! বাবা-মা আমাদের মানুষ করে। আমরা মানুষ হই চাকরি পাওয়ার পর। এরপর অমানুষের মতো বাবা-মা’কে ছেড়ে চাকরি নিয়ে থাকি। হয়তো এটাই জীবন!

আমাদের জীবনে বাবা হচ্ছেন সেই গাছটি, যেটির পুরু কাণ্ড দিয়ে দোলনা বানিয়ে সেটির ডালেই দোল খেয়ে খেয়ে আমাদের শৈশব শুরু হয়, যেটির ছায়ায় আমাদের উত্তাল বেয়াড়া যৌবন প্রশান্তি খুঁজে ফেরে এবং যেটির কাঠবিক্রির পয়সায় জীবিকা নির্বাহ করার জন্য সেটিকে কেটে ফেলার পরও সেটিরই কাটা-গুঁড়িতে বসে পড়ি ক্লান্তি দূর করতে। পৃথিবীতে এই গাছটির ছায়ায় মানুষ সবচাইতে বেশি নিরাপদ নিরুদ্বিগ্ন নিঃশঙ্ক! কিছুই না পেয়ে শুধু দিয়েই যায়, পৃথিবীতে এমন সাধক শুধু বাবারাই! বাবা-মা আমাদেরকে বড় করে পৃথিবীর পথে ছেড়ে দেন, আর আমরা সারাজীবনের জন্যই শুধু পৃথিবীর হয়ে যাই। সে পৃথিবীতে তাঁদের স্থান নিতান্তই গৌণ। আমাদের উপর পৃথিবীর দাবি হয়ে ওঠে বাবা-মা’য়ের দাবির চাইতে বড়। এ এক অদ্ভুত নির্মম রহস্য! শুধু অন্যের জন্যই নিজের ছেলেমেয়েকে বাবা-মা বড় করে। বাবা আর মাকে যতই দেখি আর আজকের এই আমি’র দিকে তাকাই, ততই আমার সবচাইতে প্রিয় লেখাগুলির একটি, কাহলীল জিব্রানের নিচের লেখাটির কথা ঘুরেফিরে মাথায় আসে……..

Your children are not your children.

They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.

They come through you but not from you,

And though they are with you yet they belong not to you.

You may give them your love but not your thoughts,

For they have their own thoughts.

You may house their bodies but not their souls,

For their souls dwell in the house of tomorrow,

which you cannot visit, not even in your dreams.

You may strive to be like them,

but seek not to make them like you.

For life goes not backward nor tarries with yesterday.

You are the bows from which your children

as living arrows are sent forth.

The archer sees the mark upon the path of the infinite,

and He bends you with His might

that His arrows may go swift and far.

Let your bending in the archer’s hand be for gladness;

For even as He loves the arrow that flies,

so He loves also the bow that is stable.

বাবা, তবুও ভাল থেকো। স্বার্থপরের মতো বলছি, তুমি ভাল থাকলে আমরাও ভাল থাকবো। হে ঈশ্বর! তুমি যেমনি করে পিতা বাবরের জীবনের বিনিময়ে পুত্র হুমায়ূনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলে, ঠিক তেমনি করেই আমার নিজের জীবনের ১০টি বছর আয়ু কমিয়ে দিয়ে আমার বাবার জীবনের আয়ু ১০ বছর বাড়িয়ে দিয়ো। বাবা-মায়ের কিছু অসুখ আমার শরীরে দিয়ে দাও। ওরা যে সহ্য করতে পারছে না, আমি তো পারবো! দেখি, এতেও যদি কিছুমাত্রও পুত্রের দায়মুক্তি হয়! বাবা, আমার সকল অক্ষমতাকে ক্ষমা কোরো।