আসি, বলার কালে

আমার প্রিয় মানুষ,


প্রীতিপ্রদ বর্ণিল শুভেচ্ছা নিয়ো। কোনও প্রশ্নবাক্যে বিদ্ধ করে অযথাই তোমার বিরক্তি আর বাড়াতে চাই না বলেই জানতে চাইলাম না, তুমি কেমন আছো। ভালোই আছো বোধ করি।
অবশ্য না থাকলেও বা তার ব্যাখ্যাসম্বলিত কোনও উত্তরপত্র আমি অবধি কোনও দিনই পৌঁছাবে না, সে খবর আমি দিনকতক আগেই পেয়েছি। না, ভেবো না, আমি এখন আর কোনও কিছুতেই অবাক হই না...আমার জন্য এখন সবকিছুই সহজ, স্বাভাবিক।


দিবস-রজনী কেটে যায়, রাত্রিঞ্চর হুঁশিয়ারি দেয়, মাসের দীর্ঘসূত্রতাও হার মেনে বিদায় জানান দেয়, শুধু স্মৃতি-বিস্মৃতির সুধাপটে দাগ রেখে যায় কিছু কথা, কিছু সময়, কিছু অনুভূতি।
সেরকমই কোনও এক রংচটা ক্যানভাসে শুকিয়ে যাওয়া তুলির আঁচড়ে অস্পষ্টতার সাথে আঁকা হয়েছিল তোমার আর আমার কিছু বিস্মৃতবক্তব্য।


সুইনবার্নের কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে… His life is a watch or a vision/Between a sleep and a sleep…জন্ম-মৃত্যুর আলিঙ্গনে জীবন সদাকুণ্ঠিত। জীবনের প্রারম্ভেও ঘুম, অন্তিমেও ঘুম। এরই মধ্যিখানে ক্ষণিকের জন্যে চোখ মেলাই হলো জীবন, আর সেই জীবনের অনন্ত ধাবমান সময় থেকে কতগুলো খণ্ডমুহূর্ত তোমার সাথে কাটাব বলে আহরণ করার আকুল আকুতিতেই জীবনকে এক নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময়! আহা সময়! হায় মহাকাল!


বার বার
কারো পানে ফিরে চাহিবার
নাই যে সময়,
নাই নাই।
…রবীন্দ্রনাথ বলেছিল, বুঝিনি আমি এই মূর্খ সামান্যা!
তুমি এবং তোমরা বুঝেছিলে…বুঝেছিলে বলেই তুমি এবং তোমরা আজ তুমি এবং তোমরা হয়েছ।


ওয়াটারলুর যুদ্ধে সেনাপতি কিছু সময় পরে এসেছিল বলে সে-পক্ষের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। একটি জার্মান প্রবাদকে ভাঙলে এমনই হয়…
For want of a nail the shoe was lost.
For want of a shoe the horse was lost.
For want of a horse the rider was lost.
For want of a rider the message was lost.
For want of a message the battle was lost.
For want of a battle the kingdom was lost.
And all for the want of a horseshoe nail.
...আর সেই মহামূল্যবান সময় কিনা তোমায় আমি আমার মতো তুচ্ছ কাউকে দিতে বলেছিলাম!


আজ মহাকালের যাত্রাধ্বনিতে সর্বগ্রাসী হয়ে কালগর্ভে হারিয়ে গিয়েছ তুমি। আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে অতীতে গলেছে ও ঝলছেসে বহু বহু বামন, সে উপাখ্যান আমি ক্ষণিকের জন্যে হলেও হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম।
...কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে।
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে…
এ গানটি গাইবার আগে আমি ভুল মেরে বসেছিলাম আমার ক্ষুদ্র সীমানাটুকু! মার্জনা প্রার্থনা করছি!


পড়ে রইল গো সবই!
তোমার শহরের কোনও এক গলির মোড়ের মাথায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে ছড়ানো নিয়নআলো, কোনও এক স্বর্ণালি সন্ধে, একজোড়া রেশমি চুড়ি, কাজলকালো চোখ, কপালের কালো টিপ, একগুচ্ছ শুভ্র রজনীগন্ধা, লাজে রাঙা লালচে আঁচল....সব পড়ে রইল গো তোমার পদধূলিরাশি-বিজড়িত ধূলিস্য ধূলি হিসেবে।
অনুরোধ, তোমার সাদা শার্টটিকে নিয়ে যেতে ভুলো না। ওটাতে যে তোমায় বড্ড বেশিই মানায়! পরম যত্নেই রেখেছিলেম গো, কোনও ধূলিকণায় ধূলিসাৎ হতে দিইনি ভুলেও কখনও।


প্রিয়, তোমার মাঝে যে অদ্ভুত নিরন্তর সাধনা, পরিশ্রম, অনুসন্ধিৎসা, প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর সৃজনশীলতা রয়েছে, তা কখনও হারিয়ে যেতে দিয়ো না কোনও কিছুরই বিনিময় হিসেবে!
তোমার প্রতিভাকে বিকশিত হতে দিয়ো তার নিজস্ব পূর্ণব্যাপ্তিতে!
অবশ্য, তোমার প্রতিভা বোঝার যোগ্যতা আমি রাখি না, প্রিয়!
আমি তো ছড়াও বোঝার যোগ্যতা রাখি কি না সন্দেহ, সেখানে তোমার লেখার গভীরতা কী করে বুঝি, বলো তো!
দেখেছ, আমি কতটা অজ্ঞ! এত মূর্খতা নিয়েও আমি নাকি কখনও কোনও অজুহাতে তোমার লেখা নিয়ে কথা বলেছি!
হায়, একি উপহাস্য!


সে যা-ই হোক,
কত কথা বাকি রয়ে গেল! কত পথই তো হলো না হাঁটা! সময়টা কেমন যেন থমকেই গেল!...তাই না, প্রিয়?
অবশেষে হারটা মেনেই আজ বিদায় নিতে হলো!
দিনের শেষে, হেরেই গেলাম! হ্যাঁ, I was a loser, a stupid, a disturbing element, a street beggar, an unqualified pathetic existence and a girl too ordinary to deserve you!


না প্রিয়, কোনও অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নেই গো তোমার প্রতি আমার!
তুমি আমায় যা দিয়েছ না চাইতেই, তা-ই তো অনেক!
তোমার এই ভৃত্যের প্রতি প্রদর্শিত দয়ায় আমি কৃতজ্ঞ, আরও একবার, বিমুগ্ধ! আমি অভাগিনী, অযোগ্যা বলেই সেটা রাখতে পারিনি। তুমি নির্দোষ…মহান!


কথা ছিল, চিঠির উত্তরের প্রতিউত্তর হিসেবেই আমি দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠাব। হ্যাঁ, কথা তো কতকিছুই ছিল!
কথা ছিল বলে আসলে আর কিছু হয় না, বুঝলে তো প্রিয়! আমিও ঠেকে শিখলাম! জানি, এর উত্তর আসবে না, তাই অপেক্ষার দ্বারপ্রান্তে নিজেকে আর ফেলে রাখব না।
তবে হ্যাঁ প্রিয়, এই চিঠির কোনও উত্তর তুমি পাঠিয়ো না, কেননা যদি পাঠাও, তবে সেটির প্রতিউত্তর পাঠাবার জন্যে হয়তো আমিই আর থাকব না। অবশ্য, সেটা তোমার কাছে নেহায়েতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো বিষয় বইকি! হয়তো এর নামই সম্পর্কের চোরাবালি!


আসলেই প্রিয়, সম্পর্কের চোরাবালিতে ডুবুরি হবার এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই!
আসি বা বিদায় বা ভালো থেকো…এসবের কিছুই বলব না, শুধু এইটুকুই জানিয়ে যাই---তোমায় আমার নিরাপদ আশ্রয় বানিয়ে নিজেকে কষ্ট দিতে আর চাই না, প্রিয়!


ইতি
এক অপরিচিতা