ইতি, রৌদ্র

 
একদিন সকাল, সদ্যোজাত। ঘুম থেকে উঠেছি। দেখলাম, প্রতিদিনের চেনাসকালটা কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে! মনে হলো, আগে কখনও দেখিনি এমন! না কি চোখে পড়েনি? জানি না। জানালার গ্রিলের গোলগোল ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো আলো এসে পড়ছে, আর মনে হচ্ছে, আমার নগ্নহাতের বাহুতে, মুখে, খণ্ড খণ্ড হিরের টুকরো এসে এসে পড়ছে। ওরা এসে পুরো ঘরটায় এক অদ্ভুত লুডুখেলার ঘর এঁকে বসে আছে!
অনেকক্ষণ নিষ্পলক। স্থিরচোখে তাকিয়ে আছি, কেমন যেন মনে হলো, আলোর ছটা এসে আমার হৃদয় অবধি ছুঁয়ে গেছে! ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখাফোটার আঁচ পেলাম, নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললাম, ‘এই, পাগল হয়ে গেছ তুমি! এখনও মনে হয় ঘোরে আছ! সকাল হয়েছে তো! ওঠো!’ ঠিক তখনি, ফোনের উপরের ছোট্ট ছোট্ট ফোকরগুলোতে আবছা সবুজআলো জ্বলে উঠল, আর অমনিই মনের ভেতরে কীরকম জানি দপ্‌ করে উঠল! মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, তুমি একটা গন্ধরাজের সবটুকু মিষ্টিগন্ধের হলদে-সোনালি খাম বানিয়ে তাতে ‘শুভ সকাল’ লিখে পাঠালে। আহা, এ কী আনন্দ! এ কী মিষ্টি সকাল!
সমস্ত শরীরে একমুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেল! মনে হচ্ছিল, হৃদয়টা বোধহয় স্পন্দিত হচ্ছেই না আর, বরং ভারী ভারী শ্বাস নিচ্ছে! কোনওরকমে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। এসে কী দেখেছি, জানো? আবারও সেই আলোর ছটা! সাদা আর সোনালিরঙে জড়ানো জড়ানো মায়াসকাল! ভোরের প্রথমআলো, রৌদ্র! উঠোনের পেয়ারাগাছটার পাতায় পাতায় আলোর ফাঁদ! মনে হচ্ছে, কারা যেন ওই পাতার ফাঁকে উঁকি মারছে, আমায় দেখছে, আর খুব হাসছে! পেয়ারাগাছের ফুলগুলো সব ওদের ভেতর পরাগ নিয়ে ভারি অহংকারের দৃষ্টি ছুড়ে তাকিয়ে বলছে, কী হলো ঝরাপাতার শুকনো মানুষ, অমন করে আমাদের দিকে তাকিয়ে কী দেখছ, বলো? ভেবো না তুমি, ভেবো না অত! আমরাও আছি তোমারই মতো পাথরদেহের ভেতরে-পোরা লোহার এক দুর্ভেদ্য কারাগারেই! আমাদের এই কারাগারের আরও ভেতরে দেখো, আহা, কত কত মাখানো সুধা! এখানে অচিনদেশের ভ্রমর আসে, সুধাপান করে, আর সুখেতে হাসে! তোমারও কি আছে এমন কিছু? ওই সাদাজমিনে ছড়িয়ে-থাকা অতলসমুদ্রের মতো কালো দুচোখে আজও এসেছে কি কোনও দূরের মাঝি? গন্ধরাজের কলিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে চুপিসারে তোমার নিভৃততীরে রেখে গিয়েছে কি কেউ?


জানো, তখন খুব আচ্ছা করেই ওদের দিয়েছি জবাব! একটু অবহেলার চোখে তাকিয়ে বলেছি, তোমাদের ওই পরাগ যখন নতুনরসের ঘড়াঢেলে ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা দেবে, তখন তোমরা কই থাকবে? একটা একটা পাপড়ি তখন খসে খসে ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলোর ওই চড়ুইভাতের হাঁড়িতে গিয়ে মুখ লুকোবে! তখন এই পরাগ রাখার সুখটা বলো কই থাকবে? লোহার ওই কারাগারে গায়ে পরাগমেখে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঠোঁটছুঁইয়ে সুধাপান করবে বলে তখন আসবেটা কে? অচিনরাজ্যের ভ্রমরের দল তখনও মনে রাখবে নাকি আর তোমাদের? সুধাপানের পুরনো সে কথা স্মরণ করে টুকটুকে লাল রঙ্গনের পাপড়ি এনে তোমাদের তীরে রাখবে কি কেউ?


…এটুক বলেই জয়ের সুরে আকাশ ফুঁড়ে সে কী আমার অট্টহাসি! খুব খুশিতে আকাশের নীল ছুঁয়েই এলাম দৌড়ে গিয়ে! এসে বললাম,
আমার এক ব্যক্তিগত সমুদ্র আছে। সেখানে এক নাবিক আছে, তার কোনও ক্লান্তিই নেই, সে চিরঅমলিন, চিররঙিন, চিরউদ্ভাসিত! সে নাবিকের হাতেই থাকে---
প্রস্ফুটিত আমের মুকুল, নরমঘাসে শিশিরের ছোঁয়া, বৃষ্টিস্নাত মল্লিকাফুল, পুজোর ডালায় সেই মাধবীলতা…চেনো কি ওদের?
সে আসে টুকরো আলোর পসরা নিয়ে,
সে আসবেই প্রতিটি ভোরের শুরুর ক্ষণে,
সে আসে গন্ধরাজের সবটুকুটাই আমার জন্যে সাথেই নিয়ে,
সে আসবেই ফুলের প্রতিটি কলি ফুটবে যখন,
সে আসে একটুখানি ঘোরের বেশেই, আপনমনে…অবিশ্রান্ত মর্মর এক ধ্বনি হয়ে,
সে আসবে আমার নগ্নবাহুতে লুডু খেলতে!
…কী ভাবছ? কীসের লুডু? বোঝোনি কিছুই, তাই আকাশ-সাগর ভাবছ তো খুব, তাই না, বলো? আরে বাবা, সে-লুডু আলোর ঘরে সাজিয়ে-রাখা হাসির লুডু, খুশির লুডু, সুখের লুডু! বুঝলে, বোকা?


তোমার বোকা বোকা চাহনি দেখে অবুঝ শিশুর মতো একা একাই মাতালহাসির রোল ফেললাম! আর হাওয়ায়-দোলা চুলগুলোকে একহাতে ধরে মুঠো করে একপশলা বৃষ্টির মতো তোমার দিকেই ছুড়ে মারলাম! শেষে দুষ্টু দুষ্টু চাহনিতে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বিছানায় পড়ে হেসে গড়ালাম অনেকটা ক্ষণ! বালিশে এই মুখটা গুঁজে একমনে হেসে হয়েছি তখন এলোমেলো খুব, পুরো শরীরের অবয়বেই ক্ষণে ক্ষণে সুখের রেখা দিয়েছি টেনে!


…সত্যি সত্যিই এমন একটা সকাল আসুক! অনেক প্রতীক্ষাশেষে এই মনটা এমন একটা সকাল দেখুক!