(একটা চিঠি নিজের মত করে শেয়ার করলাম।)
ভাইয়া, পড়াশোনা করতে কখনওই ভাল লাগত না; এর ফলও হাতেহাতে পাইসি। ম্যাট্রিকে গোল্ডেন এ+ পাইসিলাম। চিটাগাং কলেজে ভর্তি হলাম। সবাই ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে জানত। ইন্টারমেডিয়েটে পড়াশোনা অনেকটা ছেড়েই দেই। স্যারদের বাসায় যেতাম আর আসতাম, পড়াশোনা কিসু করতাম না, রাস্তায়-গলিতে আড্ডাবাজি করতাম, বাসায় ফিরতাম রাত ১০টার পর। বাবা-মা’র কথা শুনতাম না, উল্টা ঝগড়া করতাম, বাসায় চিল্লাচিল্লি করতাম। মনে হত, ওইটাই জীবন। ভাইয়া, চিটাগাং কলেজ থেকে কেউ ফেল করে না, আর ইন্টারমেডিয়েটে ফেল করা সত্যিই কঠিন। অথচ আমি সেটাই করসিলাম। সায়েন্সে পড়তাম, কিসুই পারি না, বানায়ে কী লিখবো, সাদা খাতা জমা দিসি ভাইয়া। নিজেকে এই প্রথমবারের মত চিনতে পারলাম। দেখলাম, সবাই দূরদূর ছাইছাই করে, কেউ দুই পয়সারও পাত্তা দেয় না। খালি মা-বাবা কিছু বলত না, শুধু কাঁদত, শুধু কাঁদত। বন্ধুরা কেউ ফোন করলে ধরত না, আমাকে অ্যাভয়েড করে চলত। অথচ, আমি আগে ভাবতাম, বাকিরা সবাই আমার আপন, মা-বাবা’কে শত্রুর মত লাগত। খুব কান্না পেত ভাইয়া, আবার কাঁদতে লজ্জাও লাগত। মাঝেমাঝে মনে হত, মরে যাই। আবার মরে গেলে মা-বাবা আরও বেশি কাঁদবে, এটা ভেবে কষ্টও লাগত। মরে গেলে কী হবে, কী হবে না, এগুলা ভাবতাম, ভয়ও লাগত। পাগলের মত ছিলাম কয়েক মাস। এরপর বাবা-মা বুঝাল, একবার ফেল করলে কিছু হয় না। আমি ভালভাবে পড়লে পরেরবার অনেক ভাল করতে পারব, পুরা লাইফটা তো পড়ে আছে, আমি চেষ্টা করলে অনেকদূর যেতে পারব, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাইয়া, হাসি পাচ্ছে না শুনতে? কিন্তু জানেন, ওইসময়ে কেউ আমাকে ভাল কিসু বলত না, তাই একটু ভাল কিসু শুনলে মনটা অনেক বড় হয়ে যেত, মনে হত, আমিও পারব! আমি পরেরবার পরীক্ষা দেই, খুব বাজে রেজাল্ট করি, কিন্তু পাস করি। ভাইয়া, জানেন, পরীক্ষার সময় স্যাররা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়ে বলত, এই পেজটা এক টানে কেটে দাও, পুরো পেজ তো ভিজায়ে ফেলসো। আমার খুব কষ্ট লাগত, পরীক্ষার সময়ও কাঁদতাম, চোখের পানিতে পেজ ভিজে যেত। আমি কোনোদিন পরীক্ষায় ফেল করি নাই, ছোটবেলায় সবসময় ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। সেই আমি কিনা! যাই হোক, আমার বাজে রেজাল্ট দিয়ে ভাল কোথাও ভর্তি হওয়া দূরে থাক, পরীক্ষাও দিতে পারি নাই। বাবা বলসিলো, প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়াবে। বাবার অত টাকা ছিল না, লোন নিবে ভাবতেসিলো। হঠাৎ আমার মনে হল, অনেক কষ্ট দিসি বাবা-মা’কে, আর না। অনেকটা জোর করেই চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হলাম, বাবাকে অন্তত আমার জন্যে কারও কাছে হাত পাততে হবে না। আত্মীয়-স্বজন, পুরনো বন্ধু-বান্ধব, পাড়ার লোকজন কেউই আমাকে গুনত না, কেউ না, কেউ না! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের কেউ পাত্তা দেয় না, ভাইয়া। আমিও একসময় দিতাম না, আর সেখানেই আমাকে পড়তে হইসে। কী আইরনি, তাই না ভাইয়া? নিজের উপর খুব রাগ হত। ভাইয়া, ছোটোবেলায় ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে যাওয়াটা একটা বিশ্রী জিনিস, নিজেকে কিছুতেই আর ছোট ভাবা যায় না। আগে সবাই ভাল ভাল বলত, তখন আর কিসু বলে না। সবার উপরে কী যে রাগ হতো! মনে হত, কেউই আমাকে দেখতে পারে না, সবাই আমার শত্রু। কেউই ভালো না বাসলে খুব খারাপ লাগে, ভাইয়া; শুধু খারাপ লাগতেই থাকে। কারও সাথে খুব একটা কথা বলতাম না, কেউ কিসু বললে, কষ্ট পেতাম, কষ্ট চেপে রাখতাম, কিন্তু মুখে কিসু বলতাম না। মনে হত, বলবেই তো, সব দোষ তো আমার। ভাইয়া, আমি ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড জেদি, মুখে কিসু না বললেও জেদ ঠিকই ছিল। আপনি তো জানেন, ডিগ্রি ৩ বছরের কোর্স; আমি থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময় থেকেই ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ’র জন্য পড়াশোনা শুরু করি। আমার মনে হত, আইবিএ’তে যারা পড়ে, সবাই তো ওদেরকে ভাল স্টুডেন্ট ভাবে, ওখানে ভর্তি হয়ে যদি আমার ফেইলিউরগুলোকে একটু কম্পেন্সেট করা যায় তাহলে তো ভালই! খুব ভালভাবে প্রিপারেশন নিলাম। জীবনে এই প্রথম ডিসাইড করতে পারসিলাম, আমি আসলে কী চাই। ভাইয়া, আপনার একটা কথা আমার খুব প্রিয়। আপনার ফেসবুকে অ্যাবাউট মি’তে আপনি লিখসেন, It took me almost 2 decades to decide what I really want . When I’d decided finally, it took me only 1 year to get what I really want. আপনি জানেন না, আপনার অনেক কথাই আমার মুখস্ত, ভাইয়া। যা-ই হোক, আমার ফাইনাল রেজাল্ট বের হবার আগেই আমি আইবিএ’তে পরীক্ষা দিলাম, এবং টিকলাম। এখন সবাই ভাবে, আমি যে ফেল করসিলাম, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল, আমি আসলে অনেক ক্যালিবারওয়ালা ছেলে। অথচ, ওরাই একসময় বলতো, ও ফেল করবে না তো, কে ফেল করবে? সারাদিন টো টো করে, লেখাপড়া নাই, আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশে, আরও কত কিসু। ভাইয়া, বিশ্বাস করেন, ওরা যা যা বলতো, সব সত্যি ছিল না। কিন্তু আমি তো ফেল করসিলাম, তাই ওদেরকে কিসু বলারও ছিল না। আরও বেশি কষ্ট লাগত যখন দেখতাম, ওরা ওই কথাগুলো আমার মা-বাবা’কেও শোনাত। এখন ভাবি, মা-বাবা’কে কত কষ্ট দিসি! এখন আর কেউ কিসু বলে না আমার মা-বাবা’কে। এটাই আমার কাছে সবচে’ বড়কিছু, আইবিএ’তে পড়া একটা উছিলামাত্র। ভাইয়া, আমি বিশ্বাস করি, যদি কেউ আল্লাহর কাছে মন থেকে হালাল কিছু চায়, আর সেটা পাওয়ার জন্যে ঠিকভাবে পরিশ্রম করে, আল্লাহ কখনওই তাকে নিরাশ করেন না। ভাইয়া, আপনাকে এগুলা বলতে লজ্জা লাগতেসে, কিন্তু কেন জানি মনে হল, বলি। আপনার সম্পর্কে আমি কিসু-কিসু জানি, আপনি নিজেও অনেক বাজে অবস্থা থেকে আজকের অবস্থানে উঠে আসছেন। আপনি লিখসিলেন, “পৃথিবীতে নোবডি হয়ে থাকাটা সুখের নয়৷ যে যা-ই বলুক, এটা নিশ্চিত, নোবডি-দের জন্যে এই পৃথিবীতে শুধু নাথিং-ই বরাদ্দ থাকে৷ জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, আমরা কখনও তা ভাবতেই পারি না৷” এটা খুব বেশি সত্যি, ভাইয়া। অনেক বকবক করলাম, কিছু মনে নিয়েন না। ডিগ্রি পাস করে তো বিসিএস দেয়া যায় না, দেয়া গেলে চেষ্টা করে দেখতাম। আমি মাস্টার্স শেষ করেই বিসিএস পরীক্ষা দিব, একটু হেল্প কইরেন, ভাইয়া।