একটি অনর্জিত ব্যর্থতার গল্প

 
ফরিদ সাহেব। বয়স চল্লিশোর্ধ্ব, চারটি মেয়েসন্তানের বাবা। কোনও ছেলে নেই। বউ আর চার মেয়ে নিয়ে দুঃখের ঘর-সংসার তাঁর। ফরিদ সাহেব চুপচাপ, গম্ভীর ধরনের মানুষ। কম কথা বলেন, হাসেনও কম। কম হাসেন ঠিক তা নয়, আসলে জীবনের রুক্ষতা তাঁকে এমন বেরসিক করে তুলেছে।


তিনরুমের ছোট্ট বেড়ার ঘর ওদের, টিনের চালের। ঘরের সামনে ছোট উঠোন। উঠোনের চারপাশটা বাঁশগাছ, আমগাছ, জামগাছসহ নানান গাছে ঘেরা। গাছের সারি পেরিয়ে একটা ছোট পুকুর, পুকুরপাড়ে আরও কিছু গাছের ভিড়ে একটা মাঝারি উচ্চতার আমগাছ। ওটাই সবচেয়ে পুরনো ও বুড়ো গাছ।


ফরিদ সাহেব যখন ছোট ছিলেন, সন্ধে ঘনালে তাঁর বাবা ছেলেকে নিয়ে এই গাছের গোড়ায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন জ্যোৎস্না নামলে। ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাক, জোনাকির উড়াউড়ি আর জ্যোৎস্নার আলোয় সে গাছের তলায় উজ্জ্বল হয়ে থাকত। সেসময় এখনকার মতো বিদ্যুৎ ছিল না। কেরোসিনের পিদিম জ্বালিয়ে রাতের বুক চিরে আলো ছিনিয়ে আনতে হতো। মিটিমিটি পিদিমের আলোয় ফরিদ সাহেবদের ছোটবেলা ভালোই কেটে গেছে। পয়সার অভাব ছিল, তবে সুখের অভাব ছিল না। সেই পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্র্যের উত্তরাধিকারী এই ফরিদ সাহেব। জমিজমা অল্প কিছু আছে। ওতেই চলে। হালের গরুও আছে।


ভালোবেসে পাশের গ্রাম থেকে সালেহাকে বিয়ে করেছিলেন ফরিদ সাহেব ২১ বছর বয়সে। সেই ঘরে এখন চার মেয়ে। অভাবের টানাপোড়েনের সংসারে সুখের তেমন ঘাটতি নেই। অ-সুখ শুধু একটাই, একটা পুত্রসন্তানের অভাব। মেয়েদের যে তিনি ভালোবাসেন না, তা কিন্তু মোটেও নয়। ফরিদ সাহেবের মৃত্যুর পর কী হবে, মেয়েদের বিয়ের পর বংশের বাতি কে জ্বালাবে, এসব নিয়েই ফরিদ সাহেবের যত দুঃখ। তবে মেয়েদের তিনি নিজের চেয়েও ঢের বেশি ভালোবাসেন।


বড় মেয়ে যেদিন জন্ম নিয়েছিল, সেদিন ফরিদ সাহেবের মতো খুশি পৃথিবীর আর কোনও প্রাণীই ছিল না। বউয়ের যখন প্রসবযন্ত্রণা উঠেছিল, তখন ফরিদ সাহেব অস্থির হয়ে উঠোনের এ-কোণ ও-কোণ হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তিনি প্রথম বাবা হবার সুখ পেতে চলেছেন। সে কী আনন্দ! খানিক বাদে ঘরের বেড়া ভেদ করে উয়াওঁ উয়াওঁ করে কান্নার শব্দ ভেসে এল, সে শব্দে যেন ভেসে গেল ঘর, উঠোন আর ফরিদ সাহেবের পুরো দুনিয়াটা। সেই কান্নার শব্দে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফরিদ সাহেব উঠোন থেকে দৌড়ে আঁতুড়ঘরে গেলেন প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে। আহা, সে কী সুখ, সে কী প্রশান্তি, সে কী মধুময় মুহূর্ত! পৃথিবীর সবচাইতে আনন্দের মুহূর্তটিই বাবা হবার মুহূর্ত! কন্যাকে তিনিই প্রথম কোলে নিলেন। ছোট ছোট হাত, ছোট ছোট পা, ছোট ছোট চোখ-মুখ-গাল। যেন বেহেস্তফেড়ে ছিটকে-আসা একটুকরা পরী! কোলে-নেওয়া কন্যা তাঁর উয়াওঁ উয়াওঁ করে কেঁদেই চলেছে, আর ফরিদ সাহেব খুশিতে আত্মহারা হয়ে হেসেই চলেছেন। এটাই তো বাবা-মায়ের একমাত্র সময়, যখন সন্তান কাঁদে আর বাবা-মা হাসেন! সে কী মধুর মুহূর্ত!


স্বভাবগতভাবেই মেয়েদের বেশি ভালোবাসেন বাবারা। ফরিদ সাহেবেরও তাঁর কন্যাদের প্রতি ভারি টান। ওরা দুনিয়ার যত বড় অপরাধই করুক না কেন, ফরিদ সাহেবের কাছে তাঁর কন্যারা নিরপরাধ, নিষ্পাপ। মেয়েদের জন্য ফরিদ সাহেব করতে পারেন না, এমন কোনও কাজ দুনিয়ায় নেই।


এর পর দ্বিতীয় কন্যার জন্ম। তৃতীয় কন্যার জন্মের পর ফরিদ সাহেবের স্ত্রী হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর বড় সাধ ছিল একটি পুত্রসন্তান হবে। কিন্তু না, এবারও কন্যা। ফরিদ সাহেব স্ত্রীকে আদরের সুরে বকে দিয়ে সদ্যোজাত কন্যাকে কোলে তুলে আগের মতোই আদরে আদরে চোখ-মুখ-গাল ভরে দিচ্ছেন, আর স্ত্রীকে বকার স্বরে বলেই যাচ্ছেন…কন্যারা হলো বেহেস্তের পরী, ঘরের লক্ষ্মী। খোদা আমাকে ভালোবেসেই কন্যা দিয়েছেন। কন্যাসন্তান হচ্ছে সৌভাগ্যের ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। আমি অনেক খুশি।


তিনি হেসে হেসে প্রায়ই বলতেন, আমার এক কন্যা চুল টেনে দিবে, আর এক কন্যা হাত-পা টিপে দিবে, আর এক কন্যা তেল ডলে দিবে গায়ে। আমার কাছে আমার কন্যারা এক একটা হিরের টুকরো। আর কী লাগে জীবনে!...আসলেই তেমন কিছু লাগে না এই জীবনে। একচিলতে সুখ, দুবেলা ভাত, আর মাথার উপর একটা ছাদ। ভালোই তো আছেন ফরিদ সাহেব! ফরিদ সাহেবের সংসারে তেমন অ-সুখ নেই। গোয়ালে হালের দুটো বলদ আছে, চাষের কিছু জমি আছে, সামনে যে পুকুরটা আছে, ওটাও ফরিদ সাহেবেরই। ছোট ছোট সুখে ঘেরা একজন ফরিদ সাহেবের সংসার।


সারাদিন হালচাষ শেষ করে ক্লান্ত ফরিদ সাহেব যখন সন্ধে হতেই ঘরে ফেরেন, বড় মেয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে যা-ই রান্না করা থাকে, তা-ই বেড়ে নিয়ে আসে, মেজো মেয়ে হাতপাখা নিয়ে বাবার পিঠে-বুকে আলতো আদরে ঘষে দিতে দিতে বাতাস করে। সেজো মেয়ে ভারি আহ্লাদি। বাবার পা উঠোনে পড়তেই সদ্য হাঁটতে-শেখা মেয়ে খুশিতে পা ছড়িয়ে আঁকাবাঁকা কদম ফেলতে ফেলতে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাবার কোলে উঠে পড়ে, বুকের ভেতর মাথাগুঁজে রেখে চুপ থেকে ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে আঠার মতো লেগেই থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চোখের আড়াল-হওয়া বাবার আদরের সবটাই যেন সুদে-আসলে উসুল করে নিচ্ছে। ফরিদ সাহেবও ভারি আদরে তাঁর কন্যা তিনটিকে বুকের সাথে বেঁধে বেঁধে রাখেন। কখনও কখনও তিন কন্যাতে ঝগড়া বেধে যেত বাবার আদরের ভাগ নিয়ে। ফরিদ সাহেব চুপচাপ দেখতেন আর ভাবতেন, আহা, আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে!


সারাদিন খেতখামারের কাজ শেষ করে ফরিদ সাহেব সন্ধ্যার পর উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে কন্যাদের নিয়ে শুয়ে থাকেন। ফরিদ সাহেব লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন, আর ছোট মেয়ে বাপের ঠিক বুকের উপর উপুড় হয়ে বুকের সাথে বুক লাগিয়ে গল্প শুনতে শুনতে সেই বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। বড় মেয়ে আর মেজো মেয়ে বাপের ডানপাশে বামপাশে শুয়ে থাকে। চাঁদের আলোয় উঠোন ভরে যায়। জ্যোৎস্নার জোয়ার যেন শীতলপাটির বুক ভেদ করে মাটি ছুঁই ছুঁই করে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁপোকার অবিশ্রান্ত বেসুরো সুর। জোনাকির পেট-গলা সবুজাভ প্রদীপশিখা উঠোনের এদিক ওদিক মিটমিট করে জ্বলে আর নিভে। ফরিদ সাহেব আকাশের দিকে মুখ করে চাঁদবরাবর একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে গতজীবনের যত গল্প, তার সবকটা মেয়েদের একের পর এক শুনিয়ে যান। সেই ছোটবেলার দস্যিপনা, বাবার সাথে ওই পুকুরপাড়ের সবচেয়ে পুরনো আমগাছটার তলে পাটি বিছিয়ে শুয়ে-থাকা, ধানকাটার মৌসুমে বাপ-বেটার ধান-মাড়ানো, নদীর জলে ঝপাঝপ ঝাঁপ-দেওয়া, বর্ষামৌসুমে নদীর পানিতে জাল মেরে মাছ-ধরা, ঝিলের পানিতে পানি সেচে সেচে পুঁটি, টাকি, শোল, ছোটমাছ ধরে এনে টমেটো দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করে গরম গরম ভাতমেখে খাওয়া, পুকুরপাড়টায় লাফালাফি দাপাদাপি দুষ্টুমি, বাপ-বেটায় মিলে ধান-কাটা, গরু-চড়ানো, আরও কত কী! গল্প চলত, রাত বাড়ত।


আহা, কী সুখের জীবন! কী শখের যৌবন! সময় কত দ্রুতই গায়ে বয়সের চাদর বিছিয়ে দেয়! যৌবনের বেলা ফুরাতে না ফুরাতেই কখন জানি বার্ধক্য এসে ঢুকে পড়েছে ফরিদ সাহেবের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। দিন গড়াচ্ছে। মেয়েরা বড় হচ্ছে। এর মধ্যে ফরিদ সাহেবের ঘরে আরও একটা কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। এবারও পুত্রের আশায়, নিরাশ-হতাশ হয়ে চতুর্থকন্যা জন্ম দেওয়ার সময় ফরিদ সাহেবের স্ত্রী কেঁদে কেঁদে উঠছেন। ফরিদ সাহেব প্রতিবারের মতো এবারও স্ত্রীকে আদরমাখা স্বরে বকে দিয়ে পরম মমতায় কন্যার চোখে-মুখে-গালে বারবার চুমু খাচ্ছেন।


ছেলে বা মেয়ে যেটাই হোক না কেন, সে তো সন্তানই! সন্তানদের যে আলাদা কোনও লিঙ্গ থাকে না। সন্তান শুধুই সন্তান হয়। একটা সুস্থ সন্তান---এর চেয়ে বড় ঐশ্বর্য আর কী আছে!


বছর গড়াচ্ছে। মেয়েরা বড় হচ্ছে। বড় মেয়ের বয়স এবার সতেরোয় পড়ল। পিঠাপিঠি হওয়ায় মেজো মেয়েকেও দেখতে বড় মেয়ের সমানই লাগে। যতই দিন গড়াচ্ছে, ফরিদ সাহেবের কপালে চিন্তার বলিরেখাগুলো ততই গাঢ় হচ্ছে। বড় মেয়ের জন্য এদিক ওদিক থেকে সম্বন্ধ আসছে। কিন্তু পণের দাবিটা কেউ ছাড়ছে না। পাশের গ্রাম থেকে একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে হালচাষ করে, কিছু জমিজমাও ওদের আছে। সবই ঠিকঠাক আছে, কিন্তু পণ হিসেবে ছেলেকে দুইলাখ টাকা নগদ দিতে হবে। এত টাকা কোথায় পাবেন ফরিদ সাহবে? আবার এর চেয়ে ভালো কোনও সম্বন্ধও সহজে মিলবে না হয়তো, কেননা বড় মেয়ে দেখতে একটু কালো। তার উপর ফরিদ সাহেব একেবারেই হতদরিদ্র মানুষ। এমন গরীবলোকের কালো মেয়ের বিয়ে কি আর অত সহজে হয়?


ধনীঘরের সুন্দরীদের বিনাপণে ঘরেতোলার অহরহ নজির জগতে মিললেও গরীবঘরের কালোমেয়ে বিনাপণে ঘরে তুলে নেয়, এমন মহামানব জগতে তেমন একটা জন্মায়নি। পণের দুইলাখ যেকোনওভাবে জোগাড় করতেই হবে। চাষের জমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হলো। হালের গরু আছে দুটা, একটা বলদ। চাষের জমি বিক্রি করা মানে ফরিদ সাহেবের দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া। কিন্তু অন্য কিছু করার পথ খোলা নেই। বাস্তবে গরীবের সাথে মানবতা দেখায়, এমন মহান মানুষ হাতেগোনা। জমি বিক্রি করে একলাখ আশি হাজার আর হালের বলদটা বিশ হাজারে বিক্রি করে মোট দুইলাখ টাকা জোগাড় করেছেন ফরিদ সাহেব। গোলার ধান বেচতে হয়েছে বিয়ের অন্যান্য খরচ মেটাতে।


বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে কন্যাকে পাত্রস্থ করা হলো। ফরিদ সাহেবের বড় আদরের কন্যা, বড় লক্ষ্মী শান্তশিষ্ট কন্যা বরের ঘরে চলে যাচ্ছে। বিদায়বেলায় বাবাকে জড়িয়ে বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদেকেটে বুকভাসিয়ে দিচ্ছে মেয়ে। মেয়ের মাথা বুকের সাথে সজোরে চেপে ধরে ফরিদ সাহেব যেন জন্মের মতো চিৎকার করে কেঁদে চলেছেন। বাপ-বেটিতে বিচ্ছেদ। একঘরের মায়া ছিঁড়ে অন্যঘরে মায়া বাঁধতে যাচ্ছে মেয়ে।


বরযাত্রী কন্যাকে নিয়ে চলে গেল।


বড় মেয়ের বিয়ে হলো ছয় মাস। জমি, হালের গরু বেচে মেয়ে বিয়ে দেবার পরও নিয়মিত পণের জন্য চাপ আসে। এটা দাও, ওটা দাও, এই মৌসুমে অমুক পাঠাও, ওই মৌসুমে তমুক পাঠাও। যৌতুক হিসেবে ঝাড়ু থেকে শুরু করে বদনাটা পর্যন্ত পাঠাতে হলো। তবুও সারাবছর এটা ওটার বাহানা লেগেই থাকে, যেন মেয়ে জন্ম দেওয়াটাই ফরিদ সাহেবের বড় পাপ, আর এই পাপের প্রায়শ্চিত্তই এই ধারাবাহিক পণতালিকা। দারিদ্র্যের কশাঘাতে ফরিদ সাহেবের পিঠ যতটা ঝাঁঝরা, তারচে বেশি ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো পণের দাবিদাওয়াগুলো।


এদিকে মেজো মেয়ের জন্য সম্বন্ধ-আসা শুরু হয়েছে। সেও গায়েগতরে বড় হয়ে উঠেছে। তার পরের জনেরাও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। বড় মেয়ের বিয়ের দেড় বছরের মাথায় মেজো মেয়েকে বিয়ে-দেওয়ার পালা। হালের গরু, জমিজমা, গোলার ধান সবই বড় মেয়ের বিয়েতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে সেগুলি কিনতেও পারেননি ফরিদ সাহেব। এবার মেজো মেয়ের বিয়েতে কী করবেন তিনি? অনেক ভেবেও কোনও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। জমি বলতে ওই পুকুর আর ভিটেবাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নেই তাঁর। চাষযোগ্য জমিগুলো বড়মেয়ের বিয়ের সময় বেচে দেবার পর ফরিদ সাহেব এখন অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করেন। আগে দারিদ্র্যের সীমানা দরজা পর্যন্ত থাকলেও এবার ভাতের ডেকচির আর পাতিলের ভেতরেও তার অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। তিন মেয়ে আর বউ নিয়ে বেচারা পড়েছেন মহাবিপাকে।


দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। পণ হিসেবে বড় মেয়ের মতোই দুই লাখ নগদ দিতে হবে ওদের। নইলে ওরা এই বিয়ে করাতে রাজি না। ফরিদ সাহেবের মাথায় পুরো দুনিয়া আছড়ে পড়েছে। মাথায় হাত দিয়ে হতাশ ফরিদ সাহেব উঠোনেই বসে পড়লেন। কী করবেন এখন? কার কাছে হাত পাতবেন? কে দেবে দুটাকা দান? কে দেবে দশটাকা ধার? গরীবদের জন্য তো এ দুনিয়ায় কোনও ব্যাংকও নেই। ব্যাংকগুলো তো তৈরিই হয়েছে গরীবদের রক্ত চুষে খেতে, আর ধনীদের ধন আরও আরও বড়িয়ে দিতে।


ফরিদ সাহেব চোখের সামনে আঁধার দেখছেন। একদিকে ঘরে অভাবের টানাটানি, একবেলা রান্না হয় তো আর একবেলা উপোসে কাটে। একবেলা নুন দিয়ে খায় তো আর একবেলায় সে নুনটুকুও জুটে না। এমন অবস্থায় ফরিদ সাহেব পণের দুইলাখ কী করে জোগাড় করবেন? কোত্থেকেই-বা করবেন? ঋন করলে সে ঋণ শোধ করবেন কী করে? প্রতিমাসের সুদই-বা কোথা থেকে পাবেন? গোয়ালের গরু, চাষের জমি বলতে তো আর কিছুই বাকি নেই। কী করবেন তিনি? উপায়?


রফিক সাহেব মাতব্বর মানুষ। লোকজনকে কড়াসুদে ঋণ দেন। ফরিদ সাহেব মেয়ের বিয়ে পাকা করে ফেলেছেন। তিনি রফিক সাহেবের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নেবেন বেশ কড়াসুদে। কিন্তু কীভাবে শোধ করবেন সে ঋণের টাকা? ফরিদ সাহেব দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে রফিক সাহেবের কাছে গেলেন। ভারি মিষ্টভাষী রফিক সাহেব ফরিদ সাহেবকে দেখেই মৃদুহাসি ছুড়ে দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। রফিক সাহেব আগেই বুঝেছিলেন ফরিদ সাহবের আসার কারণটা। মাথানিচু করে রফিক সাহেবের হাত সজোরে চেপে ধরে সে হাতের উপর মুখ রেখে ফরিদ সাহেব এবার ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে কেঁদে ফেললেন। রফিক সাহেব সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে ফরিদ সাহেবকে বসা থেকে টেনে তুলে খাটে বসালেন। বসাতে বসাতে রফিক সাহেব বলতে লাগলেন, আরে ফরিদ সাহেব, করছেনটা কী! শক্তি রাখুন বুকে, সাহস যোগান নিজেকে! আরে, আমি আছি না? আপনার মেয়ে কি আমার মেয়ে না? আমি জানি, মেজো মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। টাকা লাগবে লোনের। এই তো কথা?


এবার ফরিদ সাহেব চোখ মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, পাত্রপক্ষ দুলাখ নগদ চেয়েছে। আপনি তো জানেনই রফিক সাহেব, ওই ভিটেবাড়ি আর পুকুরটা ছাড়া বেচার জন্যও তো কিছু নেই। বর্গাচাষে তো নিজের পেটই চলে না ঠিকঠাক। কিন্তু পাত্রপক্ষ টাকার দাবি ছাড়ছেই না। এই সম্বন্ধটা ভেঙে গেলে মেয়ের হয়তো আর বিয়েই হবে না, গরীব বলে তো তেমন কোনও সম্বন্ধই আসে না। এরা তাও রাজি হয়েছে, কিন্তু কড়াপণের দাবি রেখেছে।


ফরিদ সাহেব এবার রফিক সাহেবের পায়ের কাছে বসে পড়ে কাঁদো কাঁদো ধরাগলায় হাতজোড় করে বলে বসলেন, আমাকে দুলাখখানেক টাকা ধার দেন সাহেব, আমি বর্গাজমি আরও নেব, ঠিক সময়ে শোধ করে দেবো। রফিক সাহেব নরমগলায় ফরিদ সাহেবের হাতদুটোকে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলতে লাগলেন, টাকা দেবো, নিশ্চয়ই দেবো, তবে দুলাখ না, একলাখের বেশি পারব না ফরিদ সাহেব, বাকি একলাখ আপনি ব্যাংক থেকে নিতে পারেন। যে একলাখ দেবো, ওটাতে কিন্তু সুদটা প্রতিমাসের এক থেকে দশ তারিখের মধ্যে শোধ করে দিতে হবে। আসল নাহয় যখন পারেন তখন দিবেন, এই আরকি!


ফরিদ সাহেব উপায়ান্তর না দেখে রফিক সাহেবের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। ধারটা সুদে হলেও তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে তো দেওয়া যাবে। বাকি টাকা নাহয় ব্যাংক থেকে নেবেন। চোখ মুছতে মুছতে ফরিদ সাহেব উঠে চলে যাবেন, এমন সময় রফিক সাহেব বিনীতস্বরে বলে উঠলেন, তো ফরিদ সাহেব, কাল তবে টাকাটা নিয়ে যাবেন। আর মনে করে আপনার ভিটেবাড়ির দলিলটা একটু নিয়ে আসবেন।


এবার ফরিদ সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মনে মনে ভাবলেন, ভিটের কাগজও দিতে হবে? খোদার এই জগতে মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য দরদ, দয়াও কি আজ আর অবশিষ্ট নেই? তিনি বুঝলেন, মানুষ মানুষের জন্য---কথাটা কেবলই বইয়ের পাতায় আটকে আছে। চোখভর্তি টলটল জল নিয়ে রফিক সাহেবের দিকে ফিরে না তাকিয়েই হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে উত্তর দিয়ে ফরিদ সাহেব দ্রুতপায়ে বের হয়ে গেলেন। বাইরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছেন, দুনিয়াটাকে যতই গোলাকার বলা হোক না কেন, দুনিয়াটা আসলে বন্ধুর। স্বার্থের সুতোয় নিখুঁতভাবে বাঁধা পুরো এই জগত-সংসার, অথচ ওরা কিনা বলে, মানুষ মানুষের জন্য! ফরিদ সাহেবের মনে আজ কেন জানি কারও জন্য, কিছুর জন্য, কোনও কারণে একধরনের অদ্ভুত রাগ আর ঘৃণা কাজ করছে।


একরাশ দুঃখ নিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফরিদ সাহেব ঘরে ঢুকে পাটি বিছিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ হয়ে শুয়ে আছেন। কিছুই বলছেন না। তাঁর মনে পুরো জগতের প্রতি কেমন এক বিতৃষ্ণা জমেছে। গ্লাসে করে জল নিয়ে স্ত্রী ফরিদ সাহেবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাঁর কী হয়েছে জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ফরিদ সাহেবের কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছেন।


বাবা আসার শব্দ পেয়ে ছোট মেয়ে আহ্লাদি-স্বরে বাবা বাবা বলে ডেকে ডেকে ফরিদ সাহেবের বুকের উপর বুক লাগিয়ে ধপাস করে বুকের উপরেই উপুড় হয়ে শুয়ে গেছে। এবার ফরিদ সাহেবের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ভেঙে দেখা দিল বৃষ্টির ঘনঘটা। মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আর একহাতে চোখদুটো ঢেকে রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না গিলতে চাইছেন প্রাণপণে। কিন্তু না। তিনি তা পারছেন না। মেয়েকে ওভাবেই একহাতে বুকে চেপে ধরে ফরিদ সাহেব ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। লুকাতে-চাওয়া চোখ দুটোর বাঁধ ভেঙে হাতের দেওয়াল ভেঙে চোখের জল টপটপ করে কানের পাশের পথ ধরে ঘাড় বেয়ে পিঠ ছুঁয়ে শীতলপাটি ভিজিয়ে দিচ্ছে।


ছোট মেয়ে আর স্ত্রী সেই ক্ষণের বিষণ্ণতায় বিহ্বল হয়ে আর খানিকটা অবাক চোখে ফরিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কেঁদেই চলেছেন নিঃশব্দে। এবার ফরিদ সাহেবের স্ত্রী কান্নার কারণ বুঝতে পেরে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ছলছল চোখে দ্রুত উঠে গিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। ফরিদ সাহেবের শোক এবার দ্বিগুণ হলো। তিনি এবার শোয়া থেকে উঠে বসে মেয়েকে আরও জোরে বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ফরিদ সাহেবের সেই চোখের জল মেয়ের পিঠে পদ্মার জলের মতো পিঠের পুরোটা ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে এবার বাবার বুকে মুখটাকে আরও একটু গুঁজে দিয়ে বাবা বাবা ডেকে কেঁদে উঠল। ফরিদ সাহেব কাঁদছেন দুনিয়ার নিষ্ঠুরতার চাবুকে ক্ষতবিক্ষত বুকের ব্যথায়। পৃথিবীর মারপ্যাঁচ না-বোঝা মেয়ে কাঁদছে তার পুরো পৃথিবী বাবাটা কাঁদছে, তাই।


অদূরেই আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল মেজো মেয়ে। বাবার বুকফাটা কান্নার শব্দে মেজো মেয়ে মুখে ওড়না ঢুকিয়ে দিয়ে মুখচেপে ধরে বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে আর নিঃশব্দে কাঁদছে। এমনভাবে কাঁদছে যাতে পাছে বাবা শুনে না ফেলে। ছেলে না থাকলেও মেয়েদের বড় ভালোবাসেন ফরিদ সাহেব। বড় আদরের, বড় সোহাগের মেয়ে ওরা। মেয়েদের সামান্য মশার কামড়ালেও অস্থির-হয়ে-ওঠা বাবা সন্তানের চোখের জল সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন না, এই জ্ঞানটুকু মেজো মেয়ের আছে বলেই সে চুপিচুপি কাঁদছে এই ভয়ে যে যদি বাবার কষ্ট আরও বেড়ে যায়!


ওই ঘরের কোনায় কোনায় লুকিয়ে থেকে কেউ কাউকে না দেখিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘরের প্রতিটা প্রাণী অঝোরে কাঁদছে। সেই কান্নার নিঃশব্দ চিৎকারে খোদার আরশ হয়তো কেঁপে কেঁপে উঠছে।


পরের দিন ফরিদ সাহেব ভিটের দলিল জমা দিয়ে রফিক সাহেবের কাছ থেকে একলাখ টাকা চড়াসুদে ধার নিয়েছেন। বাড়ির সামনের পুকুরটি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন একলাখ। আরও একজন সুদি-ব্যবসায়ী মহাজন থেকে পঞ্চাশ হাজার নিয়ে মোট আড়াই লাখ টাকা জোগাড় করে ঘরে ফিরেছেন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল।


ফরিদ সাহেব খেতে বসেছেন। এমন সময় ধীরপায়ে হেঁটে এসে বারান্দার খুঁটি ধরে নিজের পায়ের আঙুলের দিকে ঠায় দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে মাথানিচু করে এসে দাঁড়িয়েছে বড় মেয়ে। মাথায় শাড়ির আঁচলে ঘোমটা দেওয়া। ফরিদ সাহেব খুশি হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদর ঢেলে দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। মেয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না গিলে মাথানিচু রেখেই চুপচাপ পায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ফরিদ সাহেবের মন এবার হালকা বিষাদে ভরে উঠল। তিনি মেয়েকে আদরের সুরে গালে, মুখে, গলায় হাত বুলাতে বুলাতে পরক্ষণেই খেয়াল করলেন, মেয়ের গলায়, পিঠে, গালে, চোখেমুখে কালোকালো ছোপছোপ দাগ।


ফরিদ সাহেবের বুকের ভেতর এবার দপ্‌ করে উঠল। দাগগুলো হাত দিয়ে পরখ করতেই মেয়ের মুখ থেকে ব্যথায় উঃ বাবা! অস্ফুট শব্দ বের হলো। ফরিদ সাহেব ওই দাগগুলোতে কাঁদো কাঁদো স্বরে বারবার আলতোভাবে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন। ‘এই চামড়াটাতে তো আমি কখনও একটা মশার কামড়ও বসতে দিইনি, এই চামড়ায় কখনও কোনও পোকার কামড়ও সহ্য করতে পারিনি, আর ওরা কিনা আমার মেয়েটাকে এমন অমানুষের মতো করে মেরে সারাগায়ে দাগ দাগ করে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে?’ বলেই রাগে, দুঃখে, কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। এবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে-ওঠা মেয়ে বলতে লাগল, ‘বাবা, ওরা বলেছে, এক সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারলে তবেই ওরা আমাকে ঘরে তুলবে, নইলে নাকি ও-বাড়িতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না।’


ফরিদ সাহেব এবার বাকরুদ্ধ। ‘মেজো মেয়ের বিয়ের জন্য চড়াসুদে যে টাকা নিয়েছি, ওগুলি কীভাবে দেবো, তা-ই তো জানি না, এদিকে আবার বড় মেয়ের জন্য যৌতুকের নতুন বাহানা!’ সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ফরিদ সাহেবের মনে হচ্ছে, কেবল ফরিদ সাহেবকে কেন্দ্র করেই পুরো পৃথিবীটা বনবন করে ঘুরছে! তাঁর মাথায় কিছুই কাজ করছে না।


দিন গড়াচ্ছে। সামনের সপ্তাহের বিশ তারিখ মেজো মেয়ের বিয়ের দিন ধার্য হলো। এদিকে তিনি রফিক সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সকল রীতি অনুযায়ী মেজো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়ে চলল শ্বশুরবাড়ি। বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে দাবিকৃত পঞ্চাশ হাজার টাকা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফরিদ সাহেব বড় মেয়েকেও শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। এই মুহূর্তে ফরিদ সাহেবের কাছে খোদার ইবাদতের চেয়েও মেয়েদের সুখ বেশি প্রিয়।


দিন যতই যাচ্ছে, রফিক সাহেব, ব্যাংক আর মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ধারের সুদের দিন ততই ঘনিয়ে আসছে। দিন যতই যাচ্ছে, ফরিদ সাহেবের নির্ঘুম রাতের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। দিন যতই গড়াচ্ছে, ফরিদ সাহেবের কপালের ভাঁজে ভাঁজে দুশ্চিন্তার বলিরেখারা দ্বিগুণ, তিনগুণ…শতগুণ হয়ে উঠছে। দিন যতই গড়াচ্ছে, ফরিদ সাহেবের দম ততই বন্ধ হয়ে হয়ে আসছে।


আজ মাসের নয় তারিখ। রফিক সাহেব বলেছেন দশ তারিখের মধ্যে সুদ দিয়ে দিতে। কিন্তু বর্গাচাষে যে ধানটুকু আসে, ওতে তো নিজের ঘরের ভাতই জুটে না, সুদ কী করে দেবেন ফরিদ সাহেব? আসলই-বা কী করে জোগাড় করবেন? দীর্ঘদিন টাকা ফেরত না দিলে তো ভিটেটাও নিয়ে যাবে ওরা! ব্যাংকের লোকও এসেছেন ব্যাংক থেকে নেওয়া টাকার জন্য, সুদ দিতে বলছেন। আর মহাজন লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছেন যাতে ওঁর টাকা সামনের সনেই সুদসহ ফেরত দিয়ে দেন ফরিদ সাহেব।


ফরিদ সাহেবের কাছে দুনিয়াটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। তিনি ভাবছেন, ঠিক এই মুহূর্তে খোদা যদি এসে বলে, তোমার সারাজীবনের সকল পুণ্যের বিনিময়ে এই ধারগুলো থেকে মুক্তি মিলবে, তবে খোদার পায়ে মাথা ঠুকে বলতাম, ‘খোদা, নাহয় মরার পর আমাকে জন্ম-জন্মান্তর ধরে দোজখের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ো, তবুও এই ঋণ থেকে আমাকে রক্ষা করো!’…না, ঈশ্বর শুনছেন না। গরীবের আকুতি শোনার অত সময় ঈশ্বরের নেই।


আরও কয়েকটা মাস গড়াল। ঘরের গোলায় চাল যা ছিল, তাও ফুরিয়ে গেল। এদিকে মেজো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকেও যৌতুক হিসেবে এটা ওটা পাঠানোর বাহানা আসে। ফরিদ সাহেব ভাবেন, মেয়ে বিয়ে দেবার চেয়ে বরং না দেওয়াই ঢের ভালো ছিল! যতই দিন গড়াচ্ছে, অভাবের অবাধ্য-খুর ঘরের দরজা ভেঙে রান্নাঘরের ডেকচি-পাতিলে পর্যন্ত ঢুকে কী এক মহোৎসবে ফরিদ সাহেবের বুক, কলিজা, হৃৎপিণ্ড সবটা চিবিয়ে চিবিয়ে ভাঙছে।


এখন দিনে শুধু একবেলা রান্না হয়। দুপুরের রান্না-করা ভাতের ফেন রেখে দিয়ে রাতে সেই ফেনটাই খাওয়া হয়। ফরিদ সাহেব আর তাঁর স্ত্রী শুধু দুপুরে খান। খেয়ে যেটুকু বেঁচে যায়, সেটুক ছোট দুই মেয়েকে খেতে দেন। ফেনটুকুকে দুভাগ করে স্বামী-স্ত্রী দুজনে ফুরুৎ ফুরুৎ করে খান। ফরিদ সাহেব আর তাঁর স্ত্রী ক্ষুধা সহ্য করতে পারলেও ছোট মেয়ে দুটো ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। ওদের মুখ দুটো শুকিয়ে থাকে। দুনিয়া ভেঙেচুরে গেলেও ফরিদ সাহেব সব সহ্য করতে পারবেন, কিন্তু মেয়েদের সামান্য ব্যথাতুরা শুকনো মুখ সহ্য করার ক্ষমতা তিনি রাখেন না। বড় আদরের মেয়ে ওরা। বড় ভালোবাসার মেয়ে ওরা। বেঁচে থাকতে ফরিদ সাহেবের বড় কষ্ট হচ্ছে।


বর্গাচাষ করে টুকটাক যা পান, তা সুদ দিতে দিতেই চলে যায়, খুবই সামান্য বাঁচে। ওই যৎসামান্যতে চলে না, মোটেও চলে না, একদমই চলে না। একদিকে সুদ, ঋনের কষাঘাত, আর এক দিকে বড় দুই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুকের জন্য উপর্যুপরি চাপ। সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে দিয়ে মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব, শূন্য, রিক্ত হয়ে গেছেন ফরিদ সাহেব।


আর পেরে উঠছেন না। প্রতিদিনই কোনও না কোনও পাওনাদার দুয়ারে আসবেই আসবে। কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। এত বেশি ধারের কারণে নতুন কেউ আর ধার দিচ্ছে না তিনি ধারশোধ করতে পারবেন না বলে। পথেও নামা যাচ্ছে না। দুই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বদনাম হবে। মেয়েদেরকেও নানান খোঁচা ও খোঁটা শুনতে হবে। একটা লজ্জারও তো ব্যাপার আছে। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা তো দিনদিন ভয়ংকর থেকে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে!


এখন কী করবেন ফরিদ সাহেব? গত দুদিন থেকে মাত্র একবার রান্না হয়েছে…গতকাল দুপুরে। সেই ভাতের ফেনটুকুতে নুন মিশিয়ে মেয়ে দুটোকে আজ সকালে খেতে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। আর ফরিদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী কিছুই খাননি। ঘরে খাবার বলতে কিছুই নেই। ঘরের আনাচে-কানাচে কোনও প্রকার খাবার নেই। এই দুইদিন নাহয় ফেন খেয়ে কেটে গেল। এর পর? আগামীকাল? পরশু? তার পরের দিন? অথবা তারও পরের দিন? কী খাবেন তাঁরা? কার কাছে যাবেন? কে দেবে? ধারগুলো শোধ করবেন কী করে? আর সুদগুলো? কাল সকালে সবাই টাকার জন্য ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ালে কী বলবেন ওদের? কাল তো দশ তারিখ। টাকা ফেরত দেওয়ার লাস্ট-ডেট। কাল ভিটে দখলে নিতে আসবেন রফিক সাহেব। সামনের পুকুরটা দখলে নিতে আসবে ব্যাংকের লোকেরা। আর মহাজনটি হয়তো কিছুই দখলে নিতে না পেরে ফরিদ সাহেবকে চড়, থাপ্পড়, লাত্থি মারবেন সবার সামনেই।


না, ফরিদ সাহেব আর ভাবতে পারছেন না। হাজার হাজার নেই-জবাব প্রশ্নে ফরিদ সাহেব ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছেন। না, এভাবে আর হয় না। আজ যে করেই হোক, এর একটা বিহিত করবেন ফরিদ সাহেব!


সন্ধ্যা ঘনিয়ে পৃথিবীর বুকে রাত নেমেছে। বাইরে ভরা-জ্যোৎস্না, পূর্ণিমারাত। কিন্তু ফরিদ সাহেবের কাছে এই পূর্ণিমাকে এখন থেঁৎলে-যাওয়া তেলাপোকার চেয়েও বীভৎস মনে হচ্ছে। বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয় গোটা দুনিয়া আলোকিত, কিন্তু ফরিদ সাহেবের কাছে দুনিয়াটকে অমাবস্যা-রাতের চেয়েও ঘুটঘুটে অন্ধকার মনে হচ্ছে। এই ঘরে আজ আলো নেই, ফরিদ সাহেবের সকল আলো আজ নিভে গেছে।


মেয়ে দুটো ঘুমাচ্ছে। তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন। পাশের বাড়িগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে একপ্লেট ভাত এনেছেন দুজন মিলে। শুধুই ভাত। তরকারি কেউ দেয়নি। ঘরে একটা পেঁয়াজ ছিল। ভাতে নুন মিশিয়ে ফরিদ সাহেব সে ভাতে বিষ মিশিয়ে দিলেন। মেয়ে দুটোকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। মেয়েদের মাথায়, চোখে, মুখে, গালে, গলায়, পিঠে বারবার চুমু খাচ্ছেন ফরিদ সাহেব। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। মাটিতে পড়ামাত্রই জলগুলোকে মাটি শুষে-চুষে খেয়ে নিচ্ছে যেমনি করে জোঁকের মতো শুষে-চুষে ফরিদ সাহেবদের খেয়ে নেয় ওই সুদখোর টাকাওয়ালা মহাজনেরা আর এই সমাজ, ঠিক তেমনিই।


আহা, ওরা ফরিদ সাহেবের বড় আদরের কন্যা, বড় ভালোবাসার কন্যা। ফরিদ সাহেব আজ মেয়েদের নিজহাতে খাওয়াবেন। বড় আদর করে। দুদিন ধরে ক্ষুধার্ত তাঁর আদরের মেয়েরা। মেয়েরা ভারি খুশি ভাত দেখে। হোক সেটা নুন দিয়ে, হোক সেটা পেঁয়াজ দিয়ে! ক্ষুধার সময়ে দুচোখের সামনে রাখা একপ্লেট ভাতের চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী আছে পৃথিবীতে?


ফরিদ সাহেব ভাত মাখছেন। তাঁর চোখের জল দরদর করে ভাতের প্লেটে পড়ে ভাতের সাথে মিশে যাচ্ছে। ওতে ফরিদ সাহেবের নজর নেই। নজর ভাতের গ্রাসে, নজর মেয়েদের খাওয়ানোর দিকে। গ্রাস মেখে ছোট মেয়ের মুখে তুলে দিতেই তাঁর স্ত্রী পাশ থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ফরিদ সাহেবের হাত চেপে ধরে ফেললেন। ফরিদ সাহেব সজোরে হাত সরিয়ে দিয়ে গপাগপ করে ছোট মেয়ে আর সেজো মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছেন। মেয়েরাও দুদিন অনাহারে থেকে নোনতা ভাতগুলোকেও সুস্বাদু বিরিয়ানি মতো করে গপাস গপাস করে গিলে গিলে খাচ্ছে। বাবা তাঁর অভুক্ত ক্ষুধার্ত নিষ্পাপ সন্তানদের নিজহাতে ভাতমেখে খাইয়ে দিচ্ছেন। আহা, কত সুন্দর একটা দৃশ্য!


মেয়েদের খাইয়ে দিতে দিতে স্ত্রীর মুখেও তুলে দিলেন ভাত। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কখনও স্বামীর অবাধ্য হননি। আজও হলেন না। স্ত্রীকেও খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলেন গপাগপ। ফরিদ সাহেব বিয়ের পর মাঝে মাঝে স্ত্রীকে যেরকম আদর করে খাইয়ে দিতেন, আজও ঠিক একইভাবে খাইয়ে দিচ্ছেন। তবে আজ তাঁর চোখে-মুখে কোনও লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। দুজনের চোখবেয়েই নিঃশব্দে টপটপ করে জল ঝরছে, এই ঝরে-যাওয়া জলে জগতের সকল দুঃখকে বিসর্জন দিতে পারার অপার সুখ মিশে আছে।


দুদিন উপোসের পর ফরিদ সাহেবের জোগাড়-করা অল্প ভাত ক্ষুধায় থেঁৎলে-যাওয়া পরিবারের চারটা মানুষ বড় তৃপ্তিভরে খাচ্ছে, শেষবারের মতো খাচ্ছে। ফরিদ সাহেব তাঁর জীবনে শেষবারের মতো পরিবারের সকলের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার গুরুদায়িত্বটি পালন করছেন পরম নিষ্ঠার সাথে। আজকের পর তাঁকে আর কারও ক্ষুধার কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠতে হবে না। জগতের সকল ভার, বাঁচার দায়, জীবনের বোঝা থেকে তিনি আজ মুক্তি পেতে চলেছেন। আজ তাঁর বড়ই সুখের দিন।


কিছুক্ষণ পর মেয়ে দুটো যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ওখানেই মুখ হাঁ করে চুপ হয়ে গেল। নিথর, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ হয়ে গেল। ফরিদ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী দুজন দুই মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে সজোরে চেপে ধরে আছেন। ক্ষুধার কাছে হেরে-যাওয়া দুটো নিষ্পাপ সন্তানের বুকের সাথে বুক লাগিয়ে দিয়ে ফরিদ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী নিথর হয়ে পড়ে আছেন। মুখ হাঁ করে রেখেই ফরিদ সাহেব কন্যাদের জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে হঠাৎ একসময় নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। একজন ব্যর্থ মানুষ ফরিদ সাহেবের চূড়ান্ত পরাজয় হলো। অবশ্য এতে এই জগতের কারও কিছু এসে যায় না। ফরিদ সাহেবদের এই অনর্জিত ব্যর্থতার দায়ভার এ সমাজ আগেও নেয়নি, আজও নেবে না।


ক্ষুধামুক্তির অথর্ব-আন্দোলনে চার-চারটা সদ্যশহীদ প্রাণ। সমাজপতিদের বড় বড় বিরিয়ানির ডেকচিতে লাত্থি মেরে চারটা মানুষ নিমিষেই সকল ক্ষুধা আর ঋণ থেকে মুক্তি নিয়ে নিয়েছে! মৃত্যুর সকল দায় পৃথিবীর নড়বড়ে কাঁধে সঁপে দিয়ে ফরিদ সাহেব সপরিবারে এই জঘন্য সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি একজন অক্ষম পিতা, অক্ষম স্বামী, অক্ষম মানুষ। জীবন থেকে ভীরু কাপুরুষের মতো পালিয়ে-যাওয়া ফরিদ সাহেবের এই সপরিবার স্বেচ্ছাপ্রস্থান এমন কিছু স্পর্ধিত উত্তরের জন্ম দিয়ে গেছে যে উত্তরগুলির প্রশ্ন খোঁজার দুঃসাহস বা আস্পর্ধা, কোনওটিই এই ঘুণেধরা সমাজের নেই।


মৃত্যুর এই অতিক্ষুদ্র সাদামাটা শোভাযাত্রা নিয়ে এ সমাজের কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই, কেননা যে সমাজ বেঁচে-থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সে সমাজ মরে-যাবার বিরোধিতা করারও অধিকার রাখে না।