এগিয়ে যাওয়া আর এগিয়ে থাকার ইতিবৃত্ত

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দুইজন সচিব মহোদয়ের কথা শেয়ার করছি।

“দেখুন, আমার সাথে যদি অমর্ত্য সেনের তুলনা করি, তাহলে আমি বলব, আমি নোবেল প্রাইজ না পেলেও উনার চাইতে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে আছি। কারণ, আমি একটা সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, উনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি চাকরি ছেড়ে এখানে না এলে এতদিনে উনার মতোই প্রফেসর হতাম। বরং সিভিল সার্ভিসে এসে আমার তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানও হয়েছে, যেটা অমর্ত্য সেনের নাই। তাই, এ দিক বিবেচনায় আমি উনার চাইতে কোন অংশেই কম নই, উল্টো বেশিই।”

“সলিমুল্লাহ খান আমার বন্ধুমানুষ। ও সিভিল সার্ভিসে আসে নাই, আমি এসেছি। সেদিন আমি গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছি, এসময় দেখলাম, ও রিকশায় করে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি ওকে দেখলাম আর মনে-মনে হাসলাম। ভেবেছিলাম, ওকে ডেকে গাড়িতে নিব। পরে আর নিলাম না; চড়ুক, রিকশায়ই চড়ুক। ও বড়-বড় কথা বলতে পারে, লিখতে পারে, কিন্তু সফল মানুষ হিসেবে আমি ওর অনেক উপরে।”

অমর্ত্য সেন আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ; এজন্য নয় যে উনার বাড়ি বাংলাদেশে, উনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ, লেখক হিসেবে এবং পাণ্ডিত্যের বিচারে অনেক উঁচুমানের একজন মানুষ, উনার স্ত্রী নবনীতা দেবসেনের সাহিত্যচর্চায় উনি স্বামী হিসেবে সবসময়ই পাশে থেকেছেন বলে আমরা বাংলা সাহিত্যে এমন একজন ভাল লেখিকা পেয়েছি; বরং এজন্য যে, আমাদের বাংলাদেশেকে নিয়ে উনি অনেক আশাবাদী, বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এবং বিভিন্ন বক্তৃতায় আর লেখায় আমাদেরকে নিয়ে অনেক ভাল-ভাল কথা বলেন। অমর্ত্য সেনের একটি কথা নিশ্চয়ই আরও একশোজন অর্থনীতির অধ্যাপকের একশোটি কথার চাইতে অধিক গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশের জীবিত পণ্ডিতদের তালিকা করলে সলিমুল্লাহ খানের নাম প্রথম ৫জনের মধ্যেই থাকবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। উনার লেখাগুলো পড়তেও বাড়তি যোগ্যতার দরকার হয়। অনেকবেশি পড়াশোনা আর গবেষণা করে লেখালেখি করেন, এমন পণ্ডিতের নাম বলতে বললে, সাম্প্রতিককালে উনার সাথে তুলনীয় শুধু দুইজনের নামই এই মুহূর্তে আমার মাথায় আসছে: একজন শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আরেকজন শ্রদ্ধেয় গোলাম মুরশিদ। এঁদের অবদানের এবং পাণ্ডিত্যের কথা ভাবলে মাথা এমনিতেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়। আমাদের পরম সৌভাগ্য, উনারা এদেশে জন্মেছেন। হ্যাঁ, সলিমুল্লাহ খানের কিছু চিন্তার সাথে আমার এবং অন্য অনেকেরই ভিন্নমত আছে। তবে সেটা তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কমিয়ে দেয় না। যেকোনও চিন্তাবিদই কিছু বিতর্ক এবং ফ্যালাসির জন্ম দেন।

জাতিগতভাবেই আমরা অকৃতজ্ঞ এবং বড় মানুষদের ছোট করতে ওস্তাদ। বিনীতভাবে মাথা নত করে নিজের অবস্থানকে চিনে নিয়ে বড় হওয়ার জন্য চেষ্টা করি না। ভাবি, আমিই বড়। নিজের দোষগুলোকে গুণ হিসেবে প্রমাণ করার এবং সেটিকে নিয়েই বেঁচে থাকার ব্যাপারে আমরা বিশ্বের যেকোনও উন্নত জাতির চাইতে নির্লজ্জ। নিজের দেশের কৃতি সন্তানদের সম্মান করতে জানি না, দেশে কিংবা দেশের বাইরে যাঁদের অবদানের জন্য বাংলাদেশেকে পুরো পৃথিবী সমীহ করে, তাঁদেরকেই নিচে নামাতে পারলে একধরনের অসুস্থ আত্মতৃপ্তি লাভ করি।

আমরা দরিদ্র জাতি। পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান সামগ্রিকভাবে খুব শক্ত, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। প্রাত্যাহিক ব্যস্ততায় আমাদের আনন্দের উৎসগুলোও আস্তে-আস্তে কমে আসছে। সুখের একটু কারণ ঘটলেই আমরা দারুণ হাসিখুশি হয়ে উঠি, রীতিমত নাচতে থাকি। এরকম উৎস যে কয়েকটা আছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হল, আমাদের ক্রিকেট। আমাদের গর্ব করার মতো অনেককিছুই দিয়েছে আমাদের ক্রিকেটাররা। ওরাই আমাদের ন্যাশনাল হিরো। আমাদের মন ভাল করে দেয়ার অনেককিছুই আমরা পেয়ে যাই ওদের কাছ থেকে। সুখের কথা, এ মন ভাল করার উপলক্ষ ইদানিং আসছে প্রায়ই। অথচ, আমরা কী করি? কিছু কষ্টের কথা লিখছি।

বাংলাদেশের জন্টি রোডস নাসির হোসাইন ওর ছোটবোনের সাথে একটা ছবি পোস্ট করল ফেসবুকে। অমন নিষ্পাপ চেহারার বোনটাকে দেখলেও যে কারওর মাথায় বিকৃতকাম চিন্তাভাবনা আসতে পারে, এটা আমরাই প্রমাণ করে দিয়েছি। আমরা পারভার্ট, অসুস্থ, বেহায়া। সুযোগ পেলেই আমরা আমাদের মুখোশটা খুলে দিই নগ্নভাবে। ছিঃ!

সাকিব আল হাসান বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। বাংলাদেশকে ক্রিকেট বিশ্ব যে কয়েকটি কারণে ঈর্ষা করে, আমাদের টিমে সাকিবের থাকাটা নিঃসন্দেহে সেগুলোর মধ্যে একটি। অথচ আমরা ওর সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে যেসব মন্তব্য করি, আমাদের স্ত্রীদের নিয়ে কেউ এর দশভাগের একভাগ কিছু বললেও আমরা ওকে খুনই করে ফেলতাম হয়তো। জাতি হিসেবে আমরা পরশ্রীকাতর এবং পরস্ত্রীকাতর। একটা মজার তথ্য দিই। পরশ্রীকাতরতা শব্দটির কোন ইংরেজি নেই। কেন নেই? এটি একেবারেই আমাদের প্রাণের শব্দ, আমাদের জাতিগত চরিত্রের প্রতীক।

সাব্বির রহমান যখন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি আপলোড করে, তখন আমরা কমেন্ট করি, কী ব্যাপার? কাজকাম নাই? রেস্টুরেন্টে-রেস্টুরেন্টে ঘোরেন কেন? অথচ আমরা ভুলে যাই, ওরাও মানুষ। আমাদের মতো ওদেরও কাজের ক্লান্তি দূর করার জন্য বিনোদনের দরকার হয়। ওর একটা বলে আমাদের দেশের যে সুনামটা আসে, সেটা আসে কয়েক সেকেন্ডে। আমাদের কয়েক জন্ম দিয়েও কি আমরা এর অর্ধেক সুনাম নিয়ে আসতে পারতাম দেশের জন্য? কিংবা আমাদের চৌদ্দগুষ্ঠির মধ্যে কেউ কি কখনও পেরেছে এ পর্যন্ত?

সৌম্য সরকার আমাদের দেশকে ওর পারফরমেন্স দিয়ে কোন উচ্চতায় যে নিয়ে গেছে, এটা আমরা খুব ভাল করেই জানি, বুঝি। এমন একজন ওপেনার থাকাটাও যেকোনো টিমের জন্যই গর্বের। অথচ আমরা ওকেও খেলা চলাকালীন বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করি, ও রোজা রেখেছে কিনা। অমুসলমানদের জন্য রোজা রাখার বিধান ইসলাম ধর্মে কোথায় বলা আছে? আমাদের ওই অসুস্থ কটূক্তিতে যদি ওর মাথায় রাগ চেপে যায়, একটা ক্যাচ মিস করে, আর আমরা ম্যাচে হেরে যাই, তবে কোটি-কোটি মানুষকে আনন্দ আর গৌরব থেকে বঞ্চিত করার অপরাধের শাস্তি কি আমাদের প্রাপ্য নয়? ওরকম বিকৃত মানসিকতার লক্ষ কটূক্তিকারী মিলেও কি একজন সৌম্য সরকারের একশ ভাগের একভাগ সম্মানও এ অভাগা জাতির জন্য এনে দিতে পেরেছে কোনদিনও? ও যখন অন্যদের সাথে বসে ইফতার করে, তখনও আমরা কটূক্তি করতে ছাড়ি না। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব আমাদের প্রিয় নবীজির জীবনাদর্শ থেকে কি আমরা এই শিক্ষা পেয়েছি? সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের প্রিয় বই, যেটা উনি উনার কোটের পকেটেই বহন করতেন সবসময়, মির্জা গুলাম আহমেদের লেখা স্যার মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান অনূদিত দ্য ফিলসফি অব দ্য টিচিংস অব ইসলাম পড়ে দেখুন। (এই বইয়ের বঙ্গানুবাদও কিনতে পাওয়া যায়। সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে পারেন। জীবন সম্পর্কে অনেককিছু শিখতে পারবেন।) আনা কারেনিনা লেখার পর উনি মানসিকভাবে প্রচণ্ড দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য উনি ইসলাম এবং মহানবীর বাণী এবং আদর্শে নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা করেন। উনার উপলব্ধি, এমন শান্তি উনি উনার জীবনে কখনওই পাননি। উনি আমাদের প্রিয় নবীজির একটা ছোট্ট জীবনীগ্রন্থও রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি মহানবীকে বর্ণনা করেছেন একজন আদর্শ মানব হিসেবে যাঁর সকল ধর্ম এবং মতের মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মহানবীই নির্দেশ দিয়ে গেছেন, একজন মুসলমানের পবিত্র দায়িত্ব, ইসলাম ধর্মের মানুষের চাইতে অন্য ধর্মের মানুষকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া। তবে আমরা কেন, কোন মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহানবীর দেখানো ইসলামের উদার পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

মাশরাফি বিন মোর্তজার মতন অমায়িক ভদ্রলোক আমি খুব কমই দেখেছি। এয়ারপোর্টে চাকরি করার সুবাদে উনার সাথে আমার দুএকবার দেখা হয়েছে এবং প্রতিবারই উনার বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। একেবারেই সাদামাটা ঠাণ্ডা মেজাজের একজন মানুষ। বাংলাদেশের এই রত্নকেও রাগ করে উনার ফেসবুক পেইজটি বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়! আমাদের অতিবেয়াদবিতে বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশের সফলতম ক্যাপ্টেনকে এরকম একটা দুঃখজনক সিদ্ধান্তে আসতে হয়! উনার দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও যদি আমাদের কারওর মধ্যে থাকত, তবে আমরা এরকম বেহায়াপনা করতে পারতাম না।

আমরা আমাদের জাতীয় বীরদের নিচে নামিয়ে কী আনন্দ পাই? অন্যকে সম্মান করার মাধ্যমে নিজের উন্নত ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। একটু ভেবে দেখি তো, যাঁদেরকে টেনে নিচে নামিয়ে অসুস্থ বিকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করি, আমাদের দেশের জন্য তাঁদের যে অর্জন, আমাদের মতো এক লক্ষ বেয়াদবের এক লক্ষ চৌদ্দপুরুষ মিলেও কি এর শতভাগের এক ভাগ অর্জনও আনতে পেরেছেন দেশের জন্য? আমাদের মতো একশ বরাহশাবক রাস্তাঘাটে মরলেও দেশের কিচ্ছুটি এসে যায় না, কিন্তু একজন সাকিব আল হাসান ইনজুরিতেও পড়লেও আমাদের দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান করতে জানে না, সে জাতি কোনওদিনও বড় কিছু পায় না। কারণ, যাঁদেরকে অসম্মান করা হয়, তাঁরা একটা সময়ে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন; আর যারা অসম্মান করে, তারা দেশের তেমন কোনও কাজেই আসে না। ওরা বাঁচে শুধু নিজের জন্য আর নিজের পরিবারের জন্য। বড় মানুষেরাও ওভাবেই বাঁচেন, কিন্তু সেই বাঁচার মধ্য দিয়ে জাতি উপকৃত হয়। সবাইই বাঁচে, তবে কেউ-কেউ ওই বাঁচাটাকেই একটু ভিন্নভাবে বাঁচে।

বালিকাকন্যা ইন্দিরাকে জেলে বসে লেখা পিতা জওহরলাল নেহরুর চিঠির সংকলন বিশ্ববিশ্রুত বই ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ পড়ে দেখুন। নেহায়ত শিশুবয়েসি একটা মেয়ে, যে কিনা ওর টিনএজ কাটিয়েছে এমন মহৎ ব্যক্তিত্বের পিতার কাছ থেকে বিশ্ব ও ভারতবর্ষের ইতিহাসপাঠের সাথে উন্নত মনীষা ও প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মানবিক কাঠামো গঠনের দীক্ষায়, সে মেয়েটি বড় হয়ে ইন্দিরা গান্ধী হবেন না তো কে হবেন? আমরা সাধারণ চিন্তাভাবনা করে অতি সাদামাটা জীবন কাটিয়ে শুধু নিজের জন্যই বাঁচি আর যাঁরা অন্যের কাজে লাগেন, তাঁদেরকে ছোট করে করে ভাবি, তুমি আর এমন কে? তুমিও তো আমারই মতো সাধারণ। নিম্নমানের চিন্তাভাবনার স্বাচ্ছন্দ্যই আমাদের বড় হতে না পারার সবচাইতে বড় কারণ।

আমি খুব বেশি অন্ধভাবে শ্রদ্ধা করি, যাঁদের কথা মাথায় এলে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, এমন কয়েকজন মানুষের মধ্যে এ পি জে আবদুল কালাম একজন। আমাকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে, এরকম কয়েকটি বইয়ের মধ্যে উনার আত্মজীবনী ‘উইংস অব ফায়ার’ অন্যতম। বইটি আমি মাঝেমাঝেই পড়ি আর বেঁচে থাকার ফুয়েল নিই। এটা পড়লে বোঝা যায়, কেন আমি সাধারণ আর উনার মতন মানুষেরা অসাধারণ। “যার মনে বিশ্বাস আছে, সে কখনও কারওর কাছে নতজানু হয় না, কখনও নাকে কাঁদে না, বলে না, অত পারব না; বলে না, কেউ তার সহায় হচ্ছে না, তার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। তার বদলে এমন লোক সমস্যার মুখোমুখি হলে, যা করবার সরাসরি করে, তারপর বলে, আমি ঈশ্বরের সন্তান, আমার যা-ই ঘটুক না কেন, আমি সেই ঘটনার চেয়ে বড়।” শুধু উনার একথাটি মাথায় রেখেও জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এমন একজন মানুষ একটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও বড়। উনার মৃত্যু আমাদের কাছে প্রিয়জন হারানোর মতোই বিষাদময়।

এরকম আরও অনেকেই আছেন। আমরা তাঁদের কাছ থেকে শিখি না। শিখব কীভাবে? আমরা যে নিজেরাই ওঁদের চাইতেও বড়! অকৃতজ্ঞতা আমাদের চরিত্রের মধ্যে এমনভাবে প্রোথিত হয়ে আছে যে, কারওর মহানুভবতার কিংবা কাজের মাধ্যমে পাওয়া উপকার বেশি সহজলভ্য হয়ে গেলে, সেটাকেই নিজের অধিকার ভেবে বসি। সে মানুষটা আমাদের ক্ষতি করেছে বলে নয়, স্রেফ কিছুসময়ের জন্য উপকার করতে না পারলে কিংবা সে মানুষটার কোন চিন্তাভাবনা নিজের সাথে না মিললে, মানুষটাকে গালাগালি করতে ছাড়ি না, রাস্তায় টেনে শুয়োর-কুকুরদের কাতারে নামাই। ওর কাছ থেকে আগে যা কিছুই পেয়েছি, সেসব কিছু ভুলে যাই মুহূর্তের মধ্যেই। এটা মাথায় থাকে না যে, ওই মানুষটি আরেকজনের জন্য ভালকিছু করার দিব্যি নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি, সেও আমার মতোই স্বার্থপরভাবে খেয়ে-বসে-শুয়ে ‘ইট, ড্রিংক অ্যান্ড বি মেরি’ জীবনাদর্শে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারত। ওর কাছে যাই, নিজের কাজে লাগবে এমনকিছু যদি পাওয়া যায়, এই লোভে। সে মানুষটা বেঁচে আছে কীভাবে এতকিছু করেও, সে খবর রাখার সময়ই নেই আমাদের। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, নিজের স্বার্থ হাসিল করা। আর হাসিল হলেই সে মানুষটাকে ইউজড টিস্যুপেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিই। দীর্ঘদিন ধরে যে গরুর দুধ খেয়ে বেঁচে আছি, সে গরুটি হঠাৎ একদিন একটু ক্ষেপে শিংটা উঁচালো, আর অমনিই ওকে জবাই করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এটা কী ধরনের মানসিকতা? এরকম জঘন্য মানসিকতা নিয়ে কখনওই বড় হওয়া সম্ভব নয়। এমনকিছু করা সম্ভব নয়, যেটার মাধ্যমে লক্ষজনের মধ্যে আলাদা করে লোকে আমাকে মনে রাখে।

শুরু করেছিলাম, দুইজন সচিব মহোদয়ের কথা দিয়ে। এরকমকিছু হামবড় অন্তঃসারশূন্য মানুষের জন্য জাতি হিসেবে আমাদের পদে-পদে লজ্জিত হতে হয়। উনারা জানেন না, উনারা নিজেরা আসলে কী। উনারা বড় মানুষকে সম্মান দিতেও জানেন না। এমন মানুষকে আসলে কেউ মন থেকে সম্মান করে না; লোকে উনাদের সামনে গিয়ে যে মাথা নত করে, সে নত হওয়াটা উনাদের চেয়ারের সামনে, উনাদের ব্যক্তিত্বের সামনে নয়। উনি আমার চাইতে বড় —– এ ভাবটাই জীবনে বড় হওয়ার প্রথম ধাপ। যাদের মধ্যে এটি কাজ করে না, তারা কখনওই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে না। একজন বড় মানুষের চাইতে আমি ছোট, এটা বুঝতে না পারলে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান নিয়েই আত্মতৃপ্তি কাজ করে। আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার কালের কণ্ঠ পত্রিকার সাহিত্য ম্যাগাজিন শিলালিপি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আত্মতৃপ্তি মৃত্যুর সমান।” উনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নিজের বিশালায়তন সৃষ্টি নিয়ে উনার নিজের মধ্যে এমন তৃপ্তি কাজ করে কি না যে, আমার তো সব কাজই শেষ!

সুখের কথা, আমাদের আমলাতন্ত্রে এবং এর বাইরে দায়িত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি, যাঁদের মধ্যে ওরকম নির্বোধ অহমিকা কাজ করে না। উনারা দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করে যান, এবং এতে করে আপনাআপনিই দেশ উপকৃত হয়। বুদ্ধিমান মানুষমাত্রই নিজের এবং অন্যের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন। যে ভাবে, তার পথ চলা শেষ, সে আর বেশিদূর যাবেই বা কীভাবে? যে ভাবে, আমি পথের একটা অংশ অতিক্রম করেছিমাত্র, সে-ই শুধু এগিয়ে যেতে পারে। একটা মানুষের মধ্যে কখন আত্ম-অহংকার জন্ম নেয়? যখন তার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, তার পুরোটুকুই সে করে ফেলতে পারে। এ ধরনের মানুষের সামর্থ্য সাধারণত কম হয়। ওদের শক্তিতে এর চাইতে বেশিদূর যাওয়া কিংবা এর চাইতে বেশিকিছু করা সম্ভব নয়। ওরা হল দুর্বল মানুষ। কারণ, একই অবস্থানের আরেকজন মানুষকে দেখা যায় নিরহংকার। কারণ, সে তার সামর্থ্যের উপর আস্থা রাখে। সে তার সক্ষমতায় যতদূর যেতে পারবে বলে বিশ্বাস করে, তার শেষ বিন্দুতে এখনও পৌঁছে যায়নি। সে আরও দূর পাড়ি দেবে বলেই গন্তব্যে-পৌঁছার মিথ্যে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে না। একই অবস্থানের একজন অহংকারী মানুষের জন্য যে বিন্দুটি পথের সমাপ্তিবিন্দু, নিরহংকার মানুষের জন্য সেই একই বিন্দুটিই পুরো পথের এক-চতুর্থাংশমাত্র!