এয়ারপোর্ট কড়চা

অপারেশন ডেটলাইন ২৩ জুলাই

……………………………………………………….

২৩-০৭-২০১৩। মঙ্গলবার। সকাল ৯.৩০ টা। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইট। প্লেনটা চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়েতে। মাস্কট থেকে এসেছে। লাস্ট ডেস্টিনেশন ঢাকা। চট্টগ্রামে যারা নামার কথা তারা নেমে গেছে একে-একে। শাহনেওয়াজ নামেনি। ওর নামার কথাও না। এই সুদর্শন যুবক (সত্যিই সুদর্শন) হয়তো ভাবছে, মডেলিং-এ না গিয়ে স্মাগলিং-এ তো এসে মনে হয় খুব একটা ভুল করিনি। এইতো আর ১ ঘন্টা মাত্র। ঢাকায় নামবো। এইসব স্বর্ণের বার আর গয়না বুঝিয়ে দিতে পারলেই তো কেল্লা ফতে! জীবনটা কতো সুন্দর! একটু হুইস্কি হয়ে যাক! খাও-দাও ফূর্তি করো, দুনিয়াটা মস্তো বড়ো! আহ্!

কিন্তু হায়! Smugglers propose, customs officers dispose. গোপন সংবাদ পেলাম। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো! আমি আর আমার ২জন কর্মকর্তা দৌড়ালাম। এয়ারপোর্ট অফিস পেরিয়ে রানওয়ে। ওইতো ইউনাইটেড! আবার দৌড় (আক্ষরিক অর্থেই দৌড়)! গেলাম। প্লেনে উঠলাম। তাও দৌড়ে। খুব কুল-কুল টাইপের লুক নিয়ে নায়ক সাহেব তাকালেন আমাদের দিকে। মনে হলো একটু অসংলগ্ন। কোনও মদ্যপন্থী বাঙালিই মদ্যপানের সময় বিরক্ত করা পছন্দ করে না। তবুও কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সাথে অবৈধ কিছু আছে কি না। হ্যাঁ বলবে, এটা আশা করিনি, সে আমাদের নিরাশ করেওনি। তাকে চ্যালেঞ্জ করলাম, ব্যাগ সার্চ করলাম। আমি পাইলাম, আমি উহাকে পাইলাম! কালো রঙের প্যাকেটে লুকানো অনেক ভারি কিছু। অনেকটা জাপটে ধরে ব্যাটাকে প্লেন থেকে নামালাম। সে নির্বিকারভাবে আমাদের সাথে হাঁটছে। কোনও ভয়ের ছাপই নেই ওর চোখেমুখে। হয়তো বা ভয়ে ভয় পেতেই ভুলে গেছে। আমার অফিসরুমে এনে আটকে রাখলাম। আমার অনুমতি নিয়ে আমার একজন অফিসার শাহনেওয়াজকে একটু আড়ালে নিয়ে দেহতল্লাশি করলো। নাহ্, তেমন কিছু নেই। ততক্ষণে লোক জমে গেছে আশেপাশে। সরকারি সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা। সঅঅ-বব্। প্রেস মিডিয়া এসে গেছে। ক্লিক্! ক্লিক্!! কালো প্যাকেটটা খুললাম। খয়েরি রঙের বড়োসড়ো একটা খাম। সেটাও খুললাম। লম্বাটে ৪টা কাপড়ের ফিতা আকৃতির ব্যাগ। ৩টা খয়েরি, ১টা কালো। ব্যাগগুলো থেকে বের হলো খয়েরি রঙের প্লাস্টিকের টেপে শক্ত করে মোড়ানো পাশাপাশি লম্বাভাবে সাজিয়ে রাখা সারি-সারি স্বর্ণের বার। গুনলাম। মোট ১৪৬টা। ১০ ভরি করে। মোট ১৪৬০ ভরি। ওজন নিলাম। প্রায় ১৭.০২ কেজি। ক্লিক্! ক্লিক্!! চলছেই। ওর সাথের ব্যাগটা আরো তল্লাশি করলাম। আরেকটা প্যাকেট! খুললাম। কয়েকটি লকেট, চুড়ি, কানের দুল, আংটি। স্বর্ণের, দামি পাথরখচিত। ওজন নিলাম। ৪০০ গ্রাম। এরপর শুরু হলো প্রেস ব্রিফিং। লাইট, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন। কতো প্রশ্ন করে রে!! (ইস্! আগে জানলে একটু সাজুগুজু করে আসতাম। বেকুব-বেকুব টাইপ চেহারা এসেছে পেপারে, টিভিতে। হাহাহাহাহা)

পতেঙ্গা থানাকে খবর দিলাম। পুলিশ এলো, এজাহার হলো, FIR হলো, আরো কত্তো কী-সব। এরপর আসামিকে পুলিশ প্রহরায় দিলাম। ওরা হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ওকে গাড়িতে তুললো। আটক-করা প্রায় ১৭.৫ কেজি স্বর্ণ অন্য একটা পুলিশের গাড়িতে। সেই গাড়িতে আমি, আমার অফিসাররা। প্রায় ৮ কোটি টাকা সমমূল্যের মালামাল নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কাস্টোডিয়ান শাখায় জমা দিতে যাচ্ছি। সামনে, পিছনে পুলিশের গাড়ি। এই পুরো দলের নেতা আমি। সে কী ভাব আমার! শাহনেওয়াজকে পতেঙ্গা থানায় সোপর্দ করে আবার চললাম কাস্টম হাউসের উদ্দেশ্যে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় জ্যাম। ইফতারের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এভাবে একসময় কাস্টম হাউসে পৌঁছলাম। ইফতারের সময় হয়ে গেছে। ওখানেই ইফতার সারলাম। স্বর্ণগুলো জমা দিলাম। স্তব্ধ বেশকিছু সময়ের পর আযান শুনলে খুব ভালো লাগে। আহ্, কী শান্তি!

খুব সংক্ষেপে সেদিনের পুরো ঘটনাটা লিখলাম। অনেক কিছু বাদ গেলো। ওই স্মাগলারের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। গল্প করেছি, এটাও বলা যায়। ধরা-পড়ে-যাওয়া অপরাধীর সাইকোলজি অদ্ভুত! তাকে ঘিরে-থাকা লোকজনের সাইকোলজি আরো অদ্ভুত!

অপারেশন ডেটলাইন ৪ আগস্ট

………………………………………………

সারিতে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সহজ নয়৷ আই কনট্যাক্ট ঠিক রাখার ব্যাপারটা আমার কাছে কখনোই স্বস্তিকর বলে মনে হয়নি৷ (হলে অনেক কিছুই অন্যরকম হতে পারতো। সেকথা আজ থাক!) চোখ দেখবো, না লোকটাকে দেখবো, নাকি কী দেখা উচিত সেটা ভাববো, এটাই একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ! অথচ এই কাজটাই করতে হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। স্মাগলিং-এর গোপন সংবাদ পৌঁছেছে আমাদের কাছে। শুধু এই চেকিং-ই না, আরো কিছু আছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রতিদিন ফ্লাইট নামে। মাঝেমাঝে হুট করেই আমার টিম নিয়ে চলে যাই প্লেনের ভেতরে। ইচ্ছেমতো তন্নতন্ন করি। কাস্টমসে এই খোঁজার পোশাকি নাম রামিজিং। পুলিশ একে বলে রেইড দেয়া। কাজটা খুব মজার। একেবারে নিরীহ লোকজনও কেমন যেনো ভয়ভয় চেহারায় তাকিয়ে থাকে ওইসময়৷ এই ভয় বোধ হয় অপরাধী না হওয়ার ভয়৷ সব খোঁজা হয়। পুরো প্লেনের যেখানে খুশি খোঁজো৷ প্রয়োজনে প্লেনের বডিপার্টস খুলে। এ-ই হচ্ছিল।

এভাবেই চলছিল৷ তেমন কিছুই পাচ্ছিলাম না। যা পাচ্ছিলাম তা হলো, শুধু ফোনে বসদের তাড়া; মাঝেমাঝে ঝাড়ি। বি ভেরি অ্যালার্ট, এয়ারপোর্ট কাস্টমস! কোনও কাজ একবার ঠিকভাবে করার বিপদ আছে৷ পরের বারও বস পারফেকশন আশা করেন। এই এক্সপেক্টেশনই রিলাইয়েবিলিটি৷

০৪-০৮-২০১৩। রোববার৷ খবর এলো, যা খুঁজছি তা আসবে। ছুটলাম এয়ারপোর্টে। ৮:০০টা। এয়ারপোর্ট কাস্টমস হলে আমি আর আমার টিম। প্রফেশনাল ব্যাপারে আমি বরাবরই স্কেপটিক। আজকে আরো বেশি। যা কিছু বিশ্বাস করলে কারও কোনও ক্ষতি হয় না, আমি শুধু সেসব ব্যাপারে অবিশ্বাস করার কষ্টটা ছাড় দিই। সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছি; হাঁটছি দ্রুত লয়ে। এদিক-ওদিক৷ তাকাচ্ছি, দেখছি৷ আমার অফিসাররা আরো বেশি তৎপর। ওরা সবাই ধর্-তক্তা-মার্-পেরেক টাইপের। তবে, বুঝে-শুনে৷ এইরকম না হলে এয়ারপোর্টে কাজ করা সহজ নয়। ফ্লাই দুবাই ফ্লাইট। নামার কথা ১০:০৫টায়। দুবাই থেকে। আমার এআরও (অ্যাসিসট্যান্ট রেভিনিউ অফিসার) প্যাসেঞ্জার মেনিফেস্ট নিয়ে এসেছে। আমি গোপন তথ্যের সাথে যাত্রীদের নাম মিলাচ্ছি। ৪জন ইকবালকে পেলাম। মহাকবিকে ৪জনের কারওই বাবা-মা ছাড়েননি। ওদের ছেলেদের আমরাও ছাড়িনি। একে-একে ইকবাল মহোদয়দের আমার রুমে নিয়ে গেলাম। সবাইকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম সাথে লুকানো কিছু আছে কি না। তাদের কেউ-ই আমাদের নিরাশ করেনি; মানে, ‘নেই’ বলেছে। এদের মধ্যে একজনের আচরণ মনে হলো কেমন যেনো৷ একজন এআরও আমার অনুমতি নিয়ে ওর দেহ তল্লাশি করলো। এই দৃশ্যটা মোটেই সুখকর নয়। পেশার খাতিরে অন্যের অপমান দেখার অস্বস্তি পর্যন্ত হজম করতে হয়। দৃশ্যপট বদলালো দ্রুতই। জিন্সের প্যান্টের বেল্টের ভেতর অন্তর্বাসের ঠিক নীচেই খয়েরি রঙের স্কচ টেপে মোড়ানো কোমরে খুব সাবধানে বাঁধা কিছু গোল্ডবার। লম্বাটে রকমের সাজানো। হায়! এই ইকবাল মহাকবি হয়নি, মহাবদমাশ হয়েছে।

ওকে রুমে আটকে রেখে আবার ছুটলাম কাস্টমস হলের দিকে। ফ্লাই দুবাই-এর প্যাসেঞ্জারদের কাস্টমস চেকিং চলছে। যেখানটায় ব্যাগেজ স্ক্যানিং হয়, সেখানটার আশেপাশে গেলাম। আমার অফিসাররা খুব সতর্ক। দেখলাম এক লোক কেমন যেনো তাড়া নিয়ে কাস্টমস এরিয়া ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একজন এআরও’কে ইশারায় দেখিয়ে দিলাম। সাথে কী আছে জিজ্ঞেস করায় লোকটা দুর্ব্যবহার করলো। আমার এআরও আরো এক কাঠি বেশি সরেস৷ ঠাণ্ডা মাথায় ওকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো৷ কিছু-কিছু মানুষের সিক্সথ্ সেন্স খুব প্রখর হয় অথবা পরিস্থিতি বুঝে প্রখরভাবে কাজ করে। আমার এই এআরও কিছুটা এরকম৷ ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই কী মনে করে যেনো ওর কোমরে হাত দিয়ে দিলো। এরপর ওকে জাপটে ধরে আমার রুমে নিয়ে গেলো৷ সাথে গেলাম। ঠিক আগের মতোই ওর শরীরে লুকানো গোল্ডবারগুলো বের হলো। ও রাশেদুল। রাশেদুল কাঁদতে লাগলো৷ অস্বস্তিকর দৃশ্য৷

এরপর ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো অনেকটাই গত ২৩-০৭-২০১৩ তারিখে প্রায় ১৭.৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনার আংশিক পুনরাবৃত্তি। তাই লেখার এই জায়গাটায় অভিনবত্ব কম। ভিন্নতা ছিল ঘটনার শুরুটাতে, স্বর্ণের পরিমাণে। আরো কিছু জায়গায়৷

ততক্ষণে লোক জমে গেছে আশেপাশে। সরকারি সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা। সঅঅ-বব্। প্রেস মিডিয়া এসে গেছে। ক্লিক্! ক্লিক্!! আগের মতোই৷ খয়েরি রঙের প্লাস্টিকের টেপে শক্ত করে মোড়ানো পাশাপাশি লম্বাভাবে সাজিয়ে রাখা সারি-সারি স্বর্ণের বারগুলো টেপ কেটে বের করলাম। টেবিলে রেখে গুনলাম। মোট ৫৩টা। ইকবালের কাছে ছিল ২৮টা, বাকিগুলো রাশেদুলের৷ ১০ ভরি করে। ৫৩০ ভরি। ওজন নিলাম। প্রায় ৬.১৮ কেজি। ক্লিক্! ক্লিক্!! চলছেই। অবিরাম৷ ওদের সাথের ব্যাগগুলো তল্লাশি করলাম। নাহ্! ওরকম কিছু নেই৷ পারসোনাল ইফেক্টস্ সব৷ এরপর শুরু হলো প্রেস ব্রিফিং। লাইট, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন। কতো প্রশ্ন করে রে!! রিপোর্টারদের ধৈর্য্য ও প্রশ্নের ভাণ্ডার দুই-ই অপরিসীম৷ (আগেরবারের মতোই আমার বেকুব-বেকুব টাইপ চেহারা এসেছে পেপারে, টিভিতে। হয়তো ঠিকই এসেছে৷ ইসস্! আরেকটু ইশমার্ট হইতে মুঞ্চায়!)

যথারীতি পতেঙ্গা থানাকে খবর দিলাম। পুলিশ এলো, এজাহার হলো, FIR হলো, আরো কত্তো কী-সব। এরপর আসামিকে পুলিশ প্রহরায় দিলাম। ওরা হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ওকে গাড়িতে তুললো। আটক-করা প্রায় ৬.১৮ কেজি স্বর্ণ অন্য একটা পুলিশের গাড়িতে। সেই গাড়িতে আমি, আমার অফিসাররা। গতবারের মতোই৷ প্রায় আড়াই কোটি টাকা সমমূল্যের মালামাল নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কাস্টোডিয়ান শাখায় জমা দিতে যাচ্ছি। সামনে, পিছনে পুলিশের গাড়ি। এই পুরো দলের নেতা আমি। ভাব-টাব আগেরবারের চেয়ে একটু কমে গেছে, তবে আছে! ছোটোলোক(মানুষ) ছোটো কাজেও ভাব নেয়৷ আমি ওরকম৷ সেদিন রাস্তায় জ্যাম ছিল না। ইফতারের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এভাবে একসময় কাস্টম হাউসে পৌঁছলাম। আযান দিচ্ছে৷ প্রতীক্ষার সুমধুর আযান৷ সবাই মিলে ওখানেই ইফতার সারলাম। স্বর্ণগুলো জমা দিলাম। রাষ্ট্রীয় আমানত হস্তান্তর করার শান্তি অন্যরকমের৷ ওই ২জনকে সাথে নিয়ে পুলিশ চলে গেলো পতেঙ্গা থানার উদ্দেশ্যে৷

এই পুরো ব্যাপারটায় বরবরের মতোই সব ধরনের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সিনিয়র স্যারদের কাছ থেকে৷ এখানে উনাদের কৃতিত্ব বরং বেশি৷ হাত কী করবে, কী করবে না, মাথা-ই ঠিক করে দেয়৷ বসদের সাপোর্ট পেলে ভাল কিছু করা সহজ হয়৷ স্যারদের ধন্যবাদ৷