কৈফিয়ত

২৬ মে ২০১৫

একটা ইনবক্স মেসেজ কিছুটা পরিশীলিতভাবে শেয়ার করছি:

ভাই, প্লিজ আপনার এসব ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ করেন। আর ভাল লাগে না এসব শুনতে। আপনি আপনার জীবনের বেশিরভাগ সময় নষ্ট করেছেন বাজে কাজ করার পেছনে। আপনি যেটাতে ভাল করতে পারতেন, সেটাতে কিছু করেননি। এটা কার দোষ? আপনি পড়াশোনা করেননি কেন? কেউ আপনাকে পড়াশোনা করতে নিষেধ করেছিলো? আমি মনে করি, কেউ আপনাকে দেখে বিসিএস ক্যাডার হতে উৎসাহিত হলে সে একটা মহাবেকুব! আপনি জীবনে কিছু করতে পারেননি বলে এখানে এসেছেন। জীবনের সব জায়গাতেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে হয়ে এই পথে এসেছেন। আপনার মতো সবাই কি জীবনের কাছে হেরে যাবে নাকি? ঈশ্বর আপনাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন। এতে আপনার কী কৃতিত্ব? আমি মনে করি, যারা আপনার বক্তৃতা শুনে ওরা জীবনে কিছু করতে পারবে না। প্রতিটি মানুষই জানে তাকে কী করতে হবে। আপনি এটা ঠিক করে দেয়ার কে? কিছু মনে করবেন না, সস্তা ফেসবুক সেলিব্রিটি হওয়ার অন্ধ মোহে আপনি দিন দিন বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছেন। আপনার বেশিরভাগ কাজই আমার কাছে দেখানেপনা বলে মনে হয়। আপনি যে চাকরিটা করছেন, সেটা কি খুব বড় কিছু? এত ভাব কীসের তবে? আর আপনি স্টুডেন্টদেরকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন না কেন? সবাই কি আপনার মতন কূপমণ্ডূক হয়ে দেশে বসে বসে চাকরি করবে? আর আপনি এমবিএ করলেন কেন? আইবিএ’য়ের একটা সিট নষ্ট করলেন কেন?

আমার কৈফিয়ত:

আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ কাজই করেছি, ‘দেখি, কাজটা করলে কী হয়’ এই নীতিতে। আমি প্রতি মুহূর্তের দুনিয়ায় বেঁচে-থাকা মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, যেটা করতে ভাল লাগে, সেটা সবচাইতে ভালভাবে করার চেষ্টা করি। জীবনটা আর কোন ইউজার-ম্যানুয়াল নিয়ে আমার কাছে আসেনি, তাই নিজে ভুল করে করে কিংবা অন্যের ভুল দেখে দেখে শেখাটা আমার কাছে সবসময়ই জন্ম-অধিকার বলে মনে হয়েছে। জীবনে সব কাজ ঠিক করতেই হবে কেন? এতটা নিখুঁত হওয়ার কীসের অতো দায়? আমি বাজে কাজ করার পেছনে সময় নষ্ট করেছি? আরে ভাই, সময় নষ্ট করবো না তো কী নষ্ট করবো? সময় তো নষ্ট করার জন্যই, বস! আমি কীসে ভাল করতে পারতাম, সেটা আমার নিজের কাছেই এক মহাবিস্ময়! আমি চুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। কিন্তু আমি যে এর কিছুই পারি না, তাই করি না! তবে কেন সরকারের এত টাকার শ্রাদ্ধ করলাম? এইতো আপনার দুঃখ? যে টাকাটা সরকারের পকেট থেকে চলেই গেছে, সেটা তো চলেই গেছে। সেটা তো আর ফিরে আসবে না। এখন যদি আমি এমন কিছু একটাতে আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, যেটাতে আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ কিংবা ভালোবাসা নেই, তবে আমি কি আদৌ কিছু ফেরত দিতে পারতাম সরকারকে? বরং এই ছোটোখাটো চাকরিটাকরি করে মাঝে মাঝে সরকারের পকেটে নগদে কয়েক কোটি টাকাও ঢুকিয়ে দিই। এ-ই কি ভাল নয়, ভাই? বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করছি, আপনি সরকারকে কতোটুকু ফেরত দিতে পেরেছেন এ পর্যন্ত, একটু শুনি? আমারটা শুনবেন? কমপক্ষে কয়েকশো কোটি। আমি গর্ববোধ করি এই ভেবে যে সরকার আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষগুলোকে কয়েকশো কোটি টাকার বিশ্বাস করে। সবচাইতে বড় কথা, আর যা-ই হোক, আমাকে দেখিয়ে কেউ এটা বলছে না, “দেখো দেখো! চুয়েটের প্রোডাক্ট কী পরিমাণ বাজে হয়। কিচ্ছু পারে না!” বরং অনেকেই বলে, “সুশান্তদাও কিন্তু চুয়েটের স্টুডেন্ট!” আমি আমার ভার্সিটি নিয়ে অহংকার করি। হোক সেটা বুয়েটের নিচে, পৃথিবীর বুকে কুলগোত্রহীন, আমার ভার্সিটি তো! আমি আমার গ্র্যাজুয়েশনের সাবজেক্টের সাথে মিলিয়ে চাকরি করলে সেটাই সবাই বলতো। তখন কেমন লাগতো সেটা ভাবলেও তো আমার ভয় হয়! আমাকে যা ইচ্ছে বলুক, কিন্তু আমার জন্য আমার মা কেন গালি খাবেন? আমি যে মায়ের স্তন্যেই মানুষ।

আমি পড়াশোনা করিনি কেন? সিম্পল! আমার ইচ্ছে হয়নি, তাই করিনি। এটাই সত্যি কথা। কেন ইচ্ছে হয়নি? ইচ্ছে হতেই হবে কেন? আমার ইচ্ছেটাকে তো আর কেউ পাত্তা দেয়নি। এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া নিয়ে আমার অনেক অভিমান আছে। কীরকম? একটু পেছন থেকে বলি, কেমন? এইচএসসি পর্যন্ত আমি আমার জীবনে যা পড়াশোনা করার করে ফেলেছি। এরপর যা পড়েছি, সেটা বেশিরভাগ সময়ই আড্ডায় চাপাবাজি চালিয়ে যেতে যতটুকু লাগে ততটুকুই। এই যেমন, জীবনেও কোনোদিন দেরিদা পড়িনি, কিন্তু দেরিদাকে নিয়ে পড়েছি। উমবার্তো ইকোর লেখা পড়ার মতো জ্ঞান কিংবা বুদ্ধি, এর কোনটাই আমার নেই, কিন্তু ইকোর সৃষ্টি নিয়ে পড়েছি অনেকটুকু। নোয়াম চমস্কিতে ডুবে থাকার মতো ধৈর্য আমার নেই কিন্তু উনার লেখার নানা মাত্রা নিয়ে কথা বলতে পারি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইংরেজি সাহিত্যের ‘কমলকুমার মজুমদার’ আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ পড়া শুরু করেছিলাম। উনি আমার দৃষ্টিতে ইংরেজি সাহিত্যের দুর্বোধ্যতম লেখক। উনার লেখা পড়তে বসলেই কেমন জানি মাথা ঘুরতে থাকে, বারবার ছোট বাথরুম পায়, পেটে একটু পর পর মোচড় দিতে থাকে। ওই বই পড়ার চাইতে না-পড়াটা ঢের সোজা! অর্ধেক পড়ার পর আমি উপলব্ধি করলাম, আমি গল্পের প্লট ভুলে গেছি, কোন চরিত্র কোনদিকে যাচ্ছে, তার কিছুই বুঝতে পারছি না। তাঁর ‘ফিনেগানস ওয়েক’ পৃথিবীর সবচাইতে অহেতুক কঠিন বইগুলোর একটি। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি, আমিও কোন একদিন জয়েস পড়তে পারব যেভাবে করে আমি এক বসাতেই মুরাকামি পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু পড়তে না পারলে কী হবে? আমি কিন্তু জয়েসকে নিয়ে বলতে পারি বিস্তর! আপনি কিছুতেই বুঝতে পারবেন না, উনার লেখা আমি অতটা পড়িনি। এই বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী ভাবটা নিতে না পারলে যে প্রেস্টিজ থাকে না! এই যে বই কিনিটিনি, এ অভ্যেস কিন্তু সেই ক্লাস সেভেন থেকে। আমার বইয়ের সংগ্রহ একদিনে ৫৬০০ ছাড়ায়নি। এই সাহিত্যই ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। কিন্তু দেখুন তো, কী হতে কী হয়ে গেল! সেই আমি কিনা পড়েছি কাটখোট্টা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে! সত্যি বলছি, আমার একটুও ইচ্ছে ছিল না এতে পড়ার। আমি আর্টস ভালবাসি, সায়েন্স না। ওই দুএকটা উভচর মানুষটানুষ ছাড়া ভয়ে সায়েন্স ফিকশন পড়তাম না, যদি ভুলেও ভাল লেগে যায়! আমি শব্দ আর ভাষা নিয়ে খেলতে ভালবাসতাম; তাই, পারতামও। এর পেছনে সময় আর প্রচণ্ড শ্রম দিয়েছি দিনের পর দিন। আমার চাইতে বেশি ভোকাবুলারি চিটাগাং কলেজে আমাদের ব্যাচে আর কারোর ছিলো বলে তো মনে পড়ে না। বাংলা সাহিত্য আর ইংরেজি সাহিত্য আমার চাইতে ভালভাবে খুব কম ছেলেমেয়েই ওই বয়সে পড়েছে, এইটুকু দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। আমি চাইবো-ই সাহিত্য নিয়ে পড়তে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? চেয়েছিলামও। বাসা থেকে পড়তে দেয়নি। চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ২য় হয়েছিলাম, ওরকম ২য় হলে নাকি চুয়েটে পড়তে হয়, সবাই এটাই বলেছিল। হায়, আমি তো এই নিয়মটা আগে জানতাম না। জানলে কি আর ভর্তি পরীক্ষায় সব অংক করে আসতাম ঠিকমতো? এইচএসসি পাসকরা একটা ছেলে কতোটুকুই বা বোঝে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়লে কী পাপ হয়? ওর বলার মতো অবস্থানই বা কতোটুকু? কে শুনবে ওর কথা? সায়েন্সে পড়লে যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটাই নিয়ম! আমি ভীষণ রাগ করেছিলাম, অনেক কান্নাকাটিও করেছিলাম। কেন? এর চেয়ে বেশিকিছু যে করার ছিলো না আমার। তবে আমিও শোধ নিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি; হইওনি! সেই প্রথম দিন থেকে শেষ দিনটা পর্যন্ত সব কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কপি-পেস্ট করে চালিয়ে দিয়েছি। এই ইঞ্জিনারিংয়ের সাথে ঘর করার সময় আমার বরাবরই মনে হয়েছে পরস্ত্রীর সাথে একই ছাদের নিচে আমাকে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি কোনদিনও ওই পরস্ত্রীকে ভালবাসতে পারিনি। হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি, নইলে যে সার্টিফিকেট মেলে না; কিন্তু কোনদিনও মন থেকে নিতে পারিনি। সত্যি বলছি, এত কষ্ট হয়েছে পাস করতে! অন্যেরা যেখানে এ-গ্রেড পাওয়ার পর এ+ না পাওয়ার অসীম দুঃখে দুদিন কিছুই খায় না, সেখানে আমি ডি-গ্রেড পেলেও বন্ধুদেরকে পার্টি দেই! কী পাইনি, সেটা নিয়ে ভাবতাম না। বরং ভাবতাম, ভাগ্যিস! ডি পেয়ে পার হয়ে গেছি! আরেকটু হলে তো ফেল করতাম! একদিনের ঘটনা শেয়ার করছি। সিপিআই নামে একটা কঠিন সাবজেক্টে ডি-গ্রেড পেয়ে খুশিতে স্যারের সাথে দেখা করতে গেছি। চুয়েটের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাজ করতাম আর লেখালেখি করতাম বিধায় স্যার আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। আমাকে দেখে আমি কিছু বলার আগেই স্যার খুব কাঁচুমাচু করে সংকোচে বলে উঠলেন, “সুশান্ত, আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন এসেছ। কিন্তু ভাই, বিশ্বাস কর, তুমি পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছ, তোমাকে এই ডি দিয়ে পাস করাতেই আমার ঘাম বের হয়ে গেছে।” আমি সাথে খুব কৃতজ্ঞতার সাথে বিনীতভাবে বললাম, “না না স্যার! প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি শিওর ছিলাম, আমি সিপিআইয়ে পাস করব না। আমি জানি, আপনি আমাকে দয়া করে পাস করিয়ে দিয়েছেন। আমি তাই খুশি হয়ে দেখা করতে এসেছি।” স্যার খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “ভাই, আমি অভিভূত! পোলাপান এ+ পেয়েও কেউ আমার সাথে দেখা করতে আসেনি! তুমি একটু পড়াশোনা করতে পার না?” আমি হলাম চুয়েটের সেইরকমের ছাত্র। এমন ছাত্র পড়াশোনা করবে কোন দুঃখে? কত কত যে ফেল করতাম! আপনিই বলেন, কেউ কি সুখে ফেল করে? আমি ভাবতাম, দেখি না, কত ফেল করতে পারি! একসময় না একসময় তো স্যাররা পাস করিয়ে দেবেন। পরেরদিন অ্যালগরিদম পরীক্ষা, আর আমি আগের রাতে বাসায় বসে বসে পড়ছি জিআরই বিগ বুক, ফাওলারের মডার্ন ইংলিশ ইউসেজ। এরকম অনেকদিন হয়েছে। প্রয়োজনে নয়, ল্যাংগুয়েজের প্রতি ভালোবাসা থেকে। এর ফলও হাতেনাতে পেয়েছি। আমার চুয়েট থেকে পাস করে বের হতে লেগেছে আমার বন্ধুদের চাইতে প্রায় আড়াই বছর বেশি। আর কিছুদিন গেলে তো আমার ছাত্রত্বই বাতিল হয়ে যেত!

আমি জীবনে কিছু করতে পারিনি বলে এখানে এসেছি? সত্যিই তো তা-ই! ‘জীবনে কিছু করা’ কাকে বলে, এটা বুঝতেই তো অর্ধেক জীবন চলে গেল। এই ভুলে-ভরা জীবনটাতে যে উপহাস আর তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছুই পাইনি অতো। কতো কী যে করে সময় নষ্ট করেছি! কোচিং ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, গিফটশপের ব্যবসা, সাপ্লাইয়ের ব্যবসা, উল্টো-জীবনের স্বপ্নবাজি, এমন আরও কত কী! ‘জীবনে কিছু করা’ মানে তো আর দশজন আমাকে দিয়ে যা করাতে চাচ্ছে, সেটাই করা। কিন্তু কী করবো, বলুন! আমার যে অন্য কারোর খুশিমতো জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে না। অন্য কারোর জীবনে বেঁচে থেকে কী লাভ? একদিন ধুম করে মরে যাবো তো! যে কোনোদিন নিজের জীবনে বাঁচেইনি, সে আবার মরে কীভাবে? সে বড়জোর, পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আমি অন্তত মরার সময় হলেও শান্তি চেয়েছি। তাইতো, জীবনে ওরকম করে ‘কিছু করতে’ চাইনি। সবাইকেই কিছু করতেই হবে কেন? আমি না হয়, অন্য-কিছু করে বেঁচে আছি। আমার যা ছিল, এর চাইতে ভালকিছু যে কিছুতেই করতে পারতাম না। আমার জীবিকাভিত্তিক পড়াশোনা অল্প, জানাশোনা আরও অল্প, আমি কোন সাহসে জীবনে কিছু করতে চাইবো? আর যা যা করবো বলে শুরু করেছিলাম, সেসব করতে করতে একটাসময়ে অনুভব করতে শুরু করলাম, আমি যা করছি, তা করে অনেক ধনী হয়তো হয়ে যেতে পারব, তবে জীবনটাকে আমি যেভাবে কাটাবো বলে স্বপ্ন দেখি, সেভাবে করে কাটাতে পারব না। দেরি হওয়ার আগেই তাই সরে গেছি। আমার জীবন থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা, অনেকটুকু সময় হারিয়ে গেছে, এটা ঠিক। আমি তো আর হারাইনি। যদি এসব অর্থের মোহে আমিই হারিয়ে যাই, তবে কী হবে? আমি তো ভাল করেই জানি, হারিয়ে যেতে কী যে কষ্ট হয়! তাই আমার যোগ্যতায় যতটুকু কুলায়, ততটুকু দিয়ে চেষ্টা করে সবচাইতে ভালটাই করেছি। যদি কোনোদিন মনে হয়, আমার পক্ষে আরও বেশিকিছু করা সম্ভব, তবে এ চাকরিটা ছেড়ে সেটাই করতে শুরু করবো। ঈশ্বর আমাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন? সেতো বটেই! তাঁর অনুগ্রহ তো সবারই লাগে, না? আমার যে হারিয়ে যাওয়ারই কথা ছিল। হারাইনি তো! আপনি ঠিকই বলেছেন, এতে আমার কোন কৃতিত্বই নেই। তবে, আমি অসফল হলে, আপনি নিশ্চয়ই এটা বলতেন না যে ঈশ্বর অনুগ্রহ করেননি বলে হয়নি? বরং বলতেন, আমার যোগ্যতা নেই, তাই হয়নি। আহা মানুষের নিষ্ঠুর ভাবনা! ভাবছি, পৃথিবীটা আরও একটু সহজ হলে এমন কী ক্ষতি হয়ে যেত?

আমাকে দেখে কেন কেউ বিসিএস ক্যাডার হতে উৎসাহিত হবে? সবাই তো ভাবে, একটু ভাল থাকবে। এই ভালথাকার ম্যাজিকটাও সবাই-ই কমবেশি জানে, বোঝে। তবুও আরেকজনের মুখ থেকে শুনলে সেটা কেমন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। এইতো! আমি কি কখনো কাউকে বলেছি, বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাও? কই, মনে পড়ে নাতো! আমি যে সবাইকে শুধু ভাল থাকতে বলি। সবাই-ই ভাল থাকুক, এইটুকুই আমার ইচ্ছে। সে যে কাজ করেই হোক না কেন! কারোর চাকরি ‘বড় কিছু’ হয় কীকরে? চাকরি মানেই তো স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার চুক্তি! এও আবার ভাল হয় নাকি? আমার কবি জীবনানন্দের কথাতেই বলি, “পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি।” আমি সাহিত্যের ছাত্র হলে মার্কস-পাওয়ার-পরীক্ষায় অক্সিমোরোনের উদাহরণ দিতাম, ‘ভাল চাকরি’। সত্যিই দিতাম। দিক পরীক্ষার খাতায় শুন্য, তবুও। জীবনের গল্প লিখে শুন্য পেলে কিছু হয় না। চাকরির সাথে কতটা বোঝাপড়া করে জীবনটা কাটাবো, এটাই ঠিক করে দেয় কোন চাকরিটা আমার জন্য। চাকরি মানেই অন্যের ইচ্ছেমাফিক জীবনটাকে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়া। তবে কেন চাকরি করছি? কী করবো? আর অন্যকিছু করতে পারি না যে! চাকরি তো করতেই হয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে প্রাণ বড়, না চাকরি বড়, এ দ্বন্দ্ব তো বহু পুরনো। চাকরি যার নেই, তার প্রাণটাই বা কী কাজে লাগে? আরে বাবা, ‘চাকরির নিকুচি করি’ বলতেও তো একটা চাকরি থাকা লাগে! আমিও যে মধ্যবিত্ত! বাবার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা থাকলে কি আর চাকরি করতাম? (ভাগিস নেই!) আমি ভেবেটেবে দেখলাম, এই চাকরিটা করলে হয়তো বা অতটা খারাপ লাগবে না। আর অন্যকিছু করার সামর্থ্য থাকলে তো করতামই!

হ্যাঁ, প্রত্যেকটা মানুষই জানে ওর জীবনে কী করতে হবে। এটা ঠিক করে দেয়ার আমি সত্যিই কেউ নই। কই, কোনোদিন কাউকে আমার ক্যারিয়ার আড্ডায় আসার জন্য ওকে ধরেবেঁধে নিয়ে আসতে ওর বাসায় পুলিশ পাঠিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না! বরং প্রচণ্ড ভিড় দেখে সবাইকে আড্ডায় হাতজোড় করে বলেছি, আজকে নয়, অন্য একটা আড্ডায় আসুন। আহা! সবাই এত কম বোঝে কেন? দুএকজন মানুষ ভুল করতে পারে, তাই বলে এত হাজার হাজার মানুষ ঠিক একই সময়ে একই ভুলটাই করছে? সবাই-ই ভুল, শুধু আপনি-ই ঠিক? ওরা জীবনে কিছু করতে পারবে না? একেকজনের ‘জীবনে কিছু করা’র অর্থ একেকরকম। আরেজনের ‘কিছু করা’র অর্থ ঠিক করে দেয়ার আপনি কে? আপনার প্রতি বিনীতভাবে প্রশ্ন করে গেলাম।

আচ্ছা ভাই, দামি সেলিব্রিটি কাকে বলে? যাকে কেউই চেনে না, তাকে? যে কারোরই কাজে লাগে না, তাকে? যে শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের আর নিজের ফ্যামিলির সুখের কথা ভাবে, তাকে? যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না, তাকে? বেশিরভাগ ‘ফেসবুক সেলিব্রিটি’র ফেসবুকের বাইরের পরিচয়টা ঘটা করে দেয়ার মতো কিছু না। খুব বিনয়ের সাথে বলছি, এই ফেসবুকের বাইরে আমার পরিচয়টা একেবারে নগণ্য নয়। লিখতে ভাল লাগে, বন্ধুরা ভাল বলে, কিছু লাইক পাই, তাই লিখি, ফেসবুকে আসি। না এলে কী হবে? লেখালেখি করতে পারব না? কেউ চিনবে না? কজন বিখ্যাত মানুষের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিলো, বলবেন? ফেসবুকের বাইরেও আমার মাথা উঁচু করে চলার মতো পরিচয় আছে। দয়া করে, যা বলার বুঝেশুনে বলবেন। আমি বিরক্তিকর হচ্ছি, এটা বলছেন কেন? আমি তো আমার ওয়ালেই লিখি। আপনার ওয়ালে পোস্ট করি না, আপানাকে ট্যাগ করি না। আপনি যা পড়ছেন নিজ দায়িত্বে, বিরক্ত হচ্ছেনও নিজ দায়িত্বে। আমি অহেতুক আপনার নিউজ ফিডে চলে আসি? কেন থাকছেন আমার আশেপাশে? এ থেকে মুক্তি পেতে নিষেধ করেছেটা কে আপনাকে? দেখানেপনা? জ্বি ভাই, আমি ভালোরকমেরই নার্সিসিস্ট। নার্সিসিস্ট না হলে কি আর সামান্য কটা লাইকের মোহে এমন বিশাল বিশাল লেখা লিখতে লিখতে সময় আর শ্রম দিতাম? কিংবা বিভিন্নরকম রঙঢঙ করে পোজ মেরে মেরে ছবি তুলে পোস্ট করতাম? পোষায় কিনা দেখেন তো? না পোষালে অনেক দূরে গিয়ে স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে শব্দ না করে মুড়ি খেতে থাকেন।

স্টুডেন্টদেরকে বিদেশে যেতে পরামর্শ দেয়ার আমি কোথাকার কে? আপনার কি মনে হয়, ওই সুযোগ কিংবা ইচ্ছে থাকলে কেউ সাধ করে ক্যারিয়ার আড্ডায় আসে? আর আমি কূপমণ্ডূক? লাফাতে হলে আগে শক্ত মাটিতে দাঁড়াতে হয়। এটা জানেন না? বিদেশে তো যাবই! পিএইচডি করতে হবে না? তবে পিএইচডি করতে বিদেশে যাবো না। বিয়ের পর বউকে নিয়ে ঘুরতে বিদেশে যাবো। সাথে পিএইচডিটাও করে ফেলব। ঘোরাঘুরির পাশপাশি পড়াশোনা। প্ল্যানটা ভাল না? পড়াশোনা কেন? আরে বাবা, পিএইচডি করবো বললে তো সরকার অনেকদিনের জন্য ছুটি দেবে। বিদেশ ঘুরতে যাবো বললে কি এতদিনের ছুটি মিলবে? ঘুরে বেড়াব, সাথে নামের আগে ড-বিসর্গ বসানোর ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। কী বুঝলেন? না বুঝলে, ধান আর চাল একসাথে মিশিয়ে আলাদা করতে থাকেন। ওটা করতে করতে একটাসময়ে ঠিক বুঝে যাবেন।

এমবিএ করলাম কেন? একটাই উত্তরঃ আইবিএতে চান্স পেয়েছি বলে। চান্স না পেলে তো আর আইবিএ থেকে মাস্টার্স করতে পারতাম না, বড়জোর কাউকে এরকম একটা ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক টেক্সট পাঠাতে পারতাম। একটা সিট নষ্ট করলাম কেন? আপনি কি শিওর আমি ওই সিটটাতে ভর্তি না হলে যিনি ভর্তি হতেন, উনি শেষ পর্যন্ত ড্রপআউট না হয়ে ডিগ্রিটা কমপ্লিট করতে পারতেন? কিংবা, অন্য বড় সুযোগ পেয়ে এমবিএ করা ছেড়ে দিতেন না? এই যেমন আমি এমডিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও সেটি কমপ্লিট করতে পারিনি। সব পড়াশোনাই কি কেবল চাকরির জন্য? আইবিএ আমাকে যা শিখিয়েছে, সেটার সবচাইতে ছোট অংশটা হল, বুকিশ নলেজ, মানে পড়াশোনা। আইবিএতে পড়ার সুযোগ না পেলে জীবনের অনেক পাঠই আমার বাকি থেকে যেত।

শেষকথা: আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি টেক্সটটা না পাঠালে এই লেখাটা লিখতাম না।