খসড়া আলোর জীবন

 
এক।

অন্যরা যা শুনতে পায় না, আমি তা শুনি,
কেউ খালিপায়ে নিঃশব্দে হাঁটলেও সে শব্দ আমার কান এড়ায় না।
প্রত্যেকটি নিস্তব্ধতার এক ধরনের আওয়াজ থাকে, শুনতে হয়।
প্রেমিকার চিঠিতে সিলের নিচে দীর্ঘশ্বাস লেপটে থাকে,
সেখানে এক বিষণ্ণ গিটার কাঁদে, শুনতে পাই।
লোকেরা যা আবছা দেখেই পালায়, কিংবা কখনো
দেখেইনি বলেই পালায়, আমি তা স্পষ্টই দেখেছি বহুবার।
তোমরা তো দেখো কিছু হাসি সাজানো আছে, ঠোঁটের
আর চোখের দোরগোড়ায় প্রেম লুকিয়ে আছে, খেয়ালই কর না।
ঝোপের অভ্যন্তরভাগে নীলরঙের একটি ফুল ফোটে, সে খোঁজও রাখি।


এ ঠোঁট প্রথম যেদিন চুমু খেলো, সেদিন আমি
সুবিশ্বস্ত প্রেমকেও দূরে চলে যেতে দেখেছি।
জেনে নাও, ঠোঁটে কক্ষনো স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে না।
সবচেয়ে সুস্থ পাগলটিও রায় দেবে না, ভালোবেসে যদি কেউ সুন্দরতম
কোমরবন্ধটিও তোমাকে উপহার দেয়, সেটি তুমি চেষ্টা করলেও হাঁটুর নিচে পরতে পারবে!
দুই।
যে বেঁচে নেই, তার প্রেম কি এখনো বৈধ?
হ্যাঁ, সে ভালোবেসে নিজেকে খুন করেছে, এরপর
ভালোবাসতে ভুলে গেছে। আচ্ছা, সে যদি নিজেকে মেরেই ফেলল,
তবে কীভাবে আবার ভুলে যাবে? হয়তো কেউ মারা গেছে, তবে
সে মারা যায়নি। তার লাশটি যেপেয়েছে, দোহাই তোমার, আগে
তাকেই দাফন করো! আরেকটা বছর আসছে, আগের কবিতা দিয়েই
সে বছর চালিয়ে নেয়া যাবে, সেখানে পৃথিবী এখনো সুন্দর আছে,
প্রেমও তাজাই আছে। নতুন করে কিছুই আর লাগবে না। তবু মনে আসে,
সে যদি বেঁচেই না থাকে, তবে সে প্রেমের বৈধতা কীসের?
ঠাট্টা বন্ধ করো, অন্য সময় পুষিয়ে নিয়ো, আবারও বলছি,
মৃতকে খুঁজে যে পেয়েছে, যাও, এখুনিই তাকে কবর দাও!
তিন।
শুনে রাখুন, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি,
মানে, খুব বাসতাম আরকি!
যে আমি সবকিছুকে মেনে নিয়ে আপনাকে ভালোবাসা দিয়েছিলাম,
যেখানে বিশ্বাস ছিল আর বেশিটুকই ছিল শ্রদ্ধা,
সে আমি কখনোই কিছু আশা করে বাঁচতে শিখিনি, অতএব
আপনার চোখের আনন্দটুকুকে আমার অশ্রুর কথা ভেবে
ম্লান করে দেবেন না, বরং মেকি আবেগটুকুকে পকেটে ঢুকিয়ে
প্রতিদিনের মতো চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন। তন্দ্রাই তো নিরাপদ!
ভালোবেসে যে মরে যায়, সে ফুল হয়ে বেঁচে থাকে,
একদিন ঠিকই টের পাবেন।
চার।
আমার হৃদয়ে বসন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল ছুরির ফলার মতো, সেই
গভীর ক্ষতচিহ্ন বয়ে আজও বেঁচে আছি ভোরের ক্ষয়েযাওয়া প্রেম হয়ে।
স্বপ্ন ভেঙে চৌচির হয়ে যে ঘুমটা ভাঙে, সে ঘুম বিপথগামী বুলেটের মতোই---
বিদ্ধ করে আর অসীম ক্লান্তি ছড়িয়ে দিয়ে বলে, এইবার তবে সহজ পথে বাঁচো!
তখন প্রেম---পাতার আড়ালে চোখেপড়া পুরনো ঝর্ণার মতো বয়ে চলে কিংবা ধর্মগ্রন্থের
কালো অক্ষরের কালির মতো বিশ্বস্ত নক্ষত্রের গায়ে ভালোবাসার সুসমাচার লিখে চলে।
এরপরও যদি তারার শিখাগুলি নিভে যেতে শুরু করে, তবে সহজেই বুঝে নিই,
নতুন এ প্রেমের জন্মদাত্রী ভালোবাসাটা কিন্তু অনেক দিনের পুরনো ও অকৃত্রিম!
পাঁচ।
আবারও ঘনপাতায় গা-এলানো গোছা আঙুরের উত্থান ঘটে,
গ্রীষ্মের উত্তাপ শস্যের গর্ভে লুকিয়ে থাকে। ওহ্‌, আপনি হয়তো
ভুলেই গেছেন, সময় বাকি থাকতেই তোরণের ওপারে ছায়া খুঁজে নিতে হয়!
শরতের সুর আর রঙতুলি মৌমাছির গুঞ্জরে, পাখিদের নিঃশব্দ অভিমানে যখন
লাজুক পায়চারিতে কনুই বাঁচিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যায়, তখন গোটা পৃথিবীই
তাকিয়ে থাকে এক টুকরো মেঘের দিকে, সে মেঘ আবার গাছের ডালে অবেলায়
ঘুমিয়েপড়া একটি শুঁয়োপোকার জেগে ওঠার জন্য প্রতীক্ষা করে। বিশ্বাস হয়?
এখনো পৃথিবীতে অন্তত একজন মানুষ মৃত্যুর আগে কিংবা মাথা নত করার আগে
চিৎকার করে, আনন্দ করে, বাসনা করে, শোক করে, বেঁচে থাকে।
এবং বেঁচে থাকে বলেই মরে যায়।
ছয়।
প্রেম, ভালোবাসা নয়।
শরীর, বিশ্বাস নয়।
নির্যাতন, স্তুতি নয়।
রক্ত, স্বপ্ন নয়।
খুন, মৃত্যু নয়।


একটি স্যাঁতসেঁতে কাঁচা জলের ডোবা থেকে জল চেয়ে,
মাঘের জটাধারী কোনো সন্ন্যাসীর কাছ থেকে ফাগুন চেয়ে
যারা জীবনের অজস্র নড়বড়ে মুহূর্তের কিছু নষ্ট করে দেয় হাসিমুখে,
ওদের কাউকে যদি দেখতে ইচ্ছে করে, তবে আমাকে প্রাণভরে দেখে নিন।
এই ঠুনকো জীবনটা, নিরর্থক প্রেমের মিছিলে হাঁটুগেড়ে হাঁটতেহাঁটতে,
অগুনতি কবরে জ্যান্ত থেকে কাটিয়ে দিলাম কেবলই শরীর টিকিয়ে রেখে……


প্রজ্বলিত মোমবাতির খসড়া আলোয় বোকা জীবনটা মৃত্যুর নিবিড় চুম্বনে
জ্বলে নিভেও গেছে ঠিক কতবার, তার খোঁজ রাখিনি। আপনারা যেটাকে
প্রেম বলেন, সেটাকে আমার কোনো নামেই ডাকতে ইচ্ছে করে না আর।
বেশি বাঁচতে চাইল বলে কত মানুষ ঠিকমতো মরতেও পারেনি, সে পরিসংখ্যান
গভর্নমেন্টের কোনো দফতরে কিংবা গোরস্থানের নেমপ্লেটগুলিতে পাবেন না।
ভালোবাসা কিছু আত্মতৃপ্ত মূর্খকে গলাটিপে হত্যা করেছে, যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, এমন-কী পরেও, নিজেদের জ্ঞানী বলেই জেনেছে।