ঘুমের কুহক ঠেলে

 
আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে!
আমি যা বলছি, শোনো, বোঝো। না বুঝলেও শোনো।
আমার জীবনটাকে তুমি শেষ করে দিচ্ছ যেমনি করে ভূমিকম্প শেষ করে দেয় শহরের পর শহর...
বজ্রপাত যেমনি করে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় আকাশটাকে,
তেমনি, ঠিক তেমনি তুমি আমার জীবনটাকে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে হেসে চলেছ অবিরাম।
শুধু তোমার জন্যই আমার মেরুদণ্ড কিংবা পাঁজরে আর কোনও জোর অবশিষ্ট নেই।
আমার পাপের ফল আমার চামড়ামাংস ফুঁড়ে অস্থিতে গিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে অবিরাম--তোমার জন্যই আমার যত পাপ!
 
আমি এমন কোনও উপত্যকা নই, যাকে চাইলেই বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেয়া যায় খুব সহজেই।
আমি এমন কোনও গিরিখাতও নই, চাইলেই কেউ ডুব মেরে হারিয়ে যাবে অনায়াসেই।
আমি তোমার নদীগুলিকে ঝকঝকে ওই সাগরপানে ছুটিয়ে নেবো, সে দায় আমার নেই।
আমি নই এমন কোনও দৃশ্যকল্প, যাকে চাইলেই তুমি সাজিয়ে নেবে ইচ্ছেমত,
তোমার পাপের গুহায় হেঁয়ালি ছন্দে নাচব এমন পুতুলও নই আমি, জেনে রেখো।
আমি এমন কোনও সুবিস্তৃত অরণ্য নই, চাইলেই যাকে কেটে ফেলা যায়, যায় পুড়িয়ে দেয়া এক পলকেই!
আমি নই সেই দৃঢ় বৃক্ষ, যা বদলে তৈরি হয়ে যায় আসবাব কিংবা ঘর--এক-এক করে।
আমার পাতা কিংবা প্রাণরস শুষে, শরীরের ছাল-শাখা উপড়ে, লাভ কী, বলো?
আমায় নগ্ন করে রক্ত চুষে খুব আরামে ক্লান্তি সরাবে--ভেবো না ভুলেও!
 
আমার কঠিন চামড়া থেকে আঙুল তোমার সরাও।
আমি কোনও পর্বত নই যে আমায় জয় করতেই হবে,
আমার চূড়ায় উঠে ডিগবাজি খেয়ে বিজয় নিশানা আঁকতেই হবে--এমন তো নয়!
আমার শরীরে আয়েশ করে গর্ত খুঁড়ো না, সে গর্ত ফুঁড়ে খেলবে হাওয়া--অমন কোনও বাতায়ন এ শরীর নয়।
যতটুকু বুঝ আমায় নিয়ে, শুধু ওইটুকু ধরে থেকো না, আমার অন্য দিকেও খেয়াল করো!
 
আমার স্তব্ধ সৈকতে তোমার জাহাজ ফেলে রেখো না,
আমি এমন কোনও মহাদেশ নই, যাকে আবিষ্কার করতেই হবে,
আমি তোমার মানচিত্রে নই তো কোনও শূন্য, যা করতেই হবে পূর্ণ!
আমি নিশ্চিন্ত কোনও অঞ্চল নই, যেখানে তুমি গড়বে বসতি ইচ্ছেমত,
আমি আশ্রয় নই এমন কোনও যেখানে পালিয়ে লুকিয়ে স্বস্তি কুড়োবে।
 
আমি ছায়াপথ, আমি পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরি অবিরাম,
এ শরীরে আমার আশ্রয় নেয় কত উল্কা-গ্রহ, নক্ষত্র আর তারার নদী,
আমায় বোঝার চেষ্টা করো না, মেলতে চেয়ো না রহস্য আমার--ব্যর্থ হবে, নিরাশ হবে।
তোমার সকল অক্ষর আর সংখ্যা মিলেও পারবে নাকো জানতে আমায়--শত জন্মেও!
 
বরং বিস্ময় নিয়ে তাকাও এ চোখে, আমায় তুমি পাবে সূর্যাস্তে,
আমার গোলাপি হলুদ আভাটুকু দেখো সাগরে ছড়াবে কেমন করে,
ওই চোখজোড়ায় ক্লান্তি এলে, দুঃখটুকু ক্ষয়ে-ক্ষয়ে এলে,
আমার দিগন্ত ভরবে তোমায় কী তৃপ্তিতে...
আমায় যখনই পাবে না খুঁজে, অস্তিত্বের খোঁজ করো নাগো, পাবে না কিছুতে।
 
আমার দিকে চেয়ে দেখো! আমি আকাশের সব তারা।
আমি শূন্যতায় যত ফুলকি ছড়াই, সেই প্রভাস্রোতে থেকো, নিয়ো পূর্ণতা দুহাত ভরে।
যদিও তুমি চাইবে নুড়ি, তোমায় হেলায় ফিরিয়ে দেবো,
মুক্তো দেবো দুহাত ভরে, যখন কিছুই চাইবে না তুমি।
আমি শান্ত মরুতে খসেপড়া এক ক্ষয়েযাওয়া চাঁদ,
ওই দুটি চোখ বন্ধ করে নরম সুরেতে আমায় খুঁজো,
আমি তোমার স্বপ্নঘুমের কুহক হয়ে আদর করে তোমায় ছোঁবো,
গোধূলি যেখানে রঙটা ছড়ায়, যত্নে তোমায় সেখানে নেবো।
তোমার ছায়ায় আমার আলো নাচবে কেমন, অনুভবে দেখে নিয়ো।
 
আমি মহাসমুদ্র। আমি প্রকাণ্ড, আমি বন্য, আমি মুক্ত।
আমার কাছে ঘন হয়ে এসো, আমার ঝড়ে কাঁপতে দারুণ তৈরি থেকো,
উত্তাল সাগরে যত বিস্ময় আর উদ্বেগ কত লুকিয়ে বেড়ায়, সে খোঁজ বলো, কে-ই বা জানে!
কত অমৃত আর গরল গিলে সাগর চলে অচিন বাঁকে, কে খোঁজ রাখে!
আমার ঢেউয়ে পাল তুলে দাও, আমি তোমায় ভাসিয়ে নেবো খুব আদরে!
 
এই ভেতরে আসো, হাঁটতে থাকো ঠিকানা ছাড়াই।
আমি এক অজেয় স্বপ্ন--জয় করে নাও!
আমি ভয় দেখাব, বাঁচতে শেখাব।
আমি আলো, আমিই ধোঁয়াশা।
তোমার তুমি’কে আমার আমি’তে দাও মিশিয়ে,
আনন্দ আর সুখ নিয়ে দেখো উঠবে জেগে আমার অসীমে!
 
 
যদি শুনে থাকো, শুধু জেনে রেখো;
শুনেছ যা কিছু, গ্রহণ করো। যেটুক পাবে, পরের কয়েক জন্মেও হয়তো পাবে না।
স্বীকারোক্তি আর শপথের ভিড়ে হারিয়ে যেয়ো না,
স্থির থেকো, নিজেকে রেখো ধরে শক্ত করে--এই এখানটাতেই!
অনন্তকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই কখন হারিয়ে গেছ! ভেবেছিলে আর কখনও?
তোমার আমার হৃদয় খুলে তাকিয়ে দেখো--সেখানটাতে অনন্ত কেমন ঘুমিয়ে আছে!
ওকে ডাকো, ওকে ডাকো! ডেকে নিয়ে সাথে সামলে চলো, সামনে চলো!
হৃদয়ের ঘুম ভাঙলে পরে পৃথিবী জাগে! ওকে জাগিয়ে তোলো--থাকতে বেঁচে আর কী লাগে?