ছায়ার শহরে

 
আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন,
এই বিকৃত, অর্ধ-অন্ধ আয়নার মধ্য দিয়ে আপনি কী দেখেন?
আমি মুখ বন্ধ রেখে হাসিমুখে শুনব, এবং তবুও,
আমার পরবর্তী ভ্রমণের সময়, ওটার দিকেই তাকাব।
এক অনড় আত্মবিশ্বাস বুকে রেখে আমি ক্রমাগত হোঁচট খাচ্ছি,
ভাল করে আমাকে দেখুন, আপনাকে খুঁজে পাবেন।


দেখুন, আমি চাঁদের পাহাড় মাপি।
আমি জানি, সে পাহাড়, আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে অনেক দূরে।
আপনি বরং সেটির ছায়া মাপুন। ছায়া তো অনেকদূরই আসে!
এইভাবেই আমি আপনাকে
পৃথিবীর বাইরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা পৃথিবীর সমস্ত কিছুর ছায়ার খোঁজ দেবো:
পাহাড়ের ছায়া,
বাড়ির ছায়া,
নগরগুলির ছায়া,
এমন-কী, নিজের ছায়ারও।


কখনো আপনি স্বর্গবিতাড়িত হয়ে পড়লে
বিশ্বস্ত ঝোপের মধ্যেও আগুন খুঁজে পাবেন।
মন জানতে চাইছে, কেন? শুনুন তবে……
যেহেতু আপনার পাশেই আমি অচেনা সব কাঁপুনির মধ্যে বসবাস করছি অনেকদিন ধরেই,
সেহেতু আমার গন্তব্য এখনও গোপনীয়তাই। আমি মৃত্যুকে ভয় পেতে শিখে গেছি।
সে কবে থেকেই আমি পৃথিবীর মাঠের প্রান্তে ছড়িয়েপড়া মৃতদেহগুলির উপর দিয়ে হাঁটছি অবলীলায়
এবং ভয়ে কাঁপতেকাঁপতে যখন
কোনো এক রাতে অসহায় আমি পথের আশায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি খুলেছিলাম,
দেখলাম, সেখানে সবাই সুখী---আমরা, ওরা।
আমি যথাযোগ্য পবিত্রতায় যথাস্থানে যথাসময়ে সেটি রেখে দিয়েছিলাম।


শহরজুড়ে অন্ধকার মূর্তির বেসাতি,
অভ্যস্ত হাওয়া মুক্তো ফোটাতে গিয়ে ভেঙে যায়
এবং মাতাল হয়ে লোকেরা আবারও হাসে।
অন্ধকার ভাস্কর্যটির কথা কেউ ভাবে না, ওটা কেউ কখনও দেখেইনি।
শহরে হঠাৎ শরৎ আসে, এসে পড়ে আলোর ঝলকানি, বুড়োদের বকবকানি,
ঘরগুলির মধ্যে ইন্সট্রুমেন্টালের গর্জন,
ঝাঁঝিয়ে বাজানো ড্রামের ছড়াছড়ি---
দুঃসময়ে দৈত্যকে কেউ সালাম দেয় না।
প্রেমের দম্পতিরা এইসব গায়ে না মেখে কেবলই হেসে চলে, আর
ওদের পায়ের কাছে সময়ের শিশু হামাগুড়ি দেয়।


......তবে,
যতবারই সূর্য ডুবে যায়, কিংবা কখনওকখনও দেখাই যায় না, অদৃশ্য হয়ে থাকে,
বিশালাকার এক মূর্তির শীতল ছায়া
বোবা শহরজুড়ে থেকে যায়,
এবং যখন প্রদীপশিখা ফোটে,
ফিসফিস করে গল্প করে দেখতে বড়ো ঘোড়সওয়ারের ছায়াগুলি,
ঘরের মাঝে চুপচাপ হেঁটে বেড়ায় কিছু নিঃশব্দ কান্না,
এবং খুনির দয়ালু মনে প্রতিটি দশম খুনের বেলায় একটি করে আফসোসের জন্ম হয়।


আজ এখানে মানুষের কাফেলা চলছে।
কখনো কল্পিত রাস্তাগুলির মধ্য দিয়ে,
রাতের রহস্যময় ঝড়ের মধ্য দিয়ে, তবে
ভয় ও বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে নয়।
তাদের সবারই একটি স্বপ্ন মনে……
তারা অন্ধকার রাতে ছদ্মবেশী বিবেকের মনের কথাটি শুনবে।


বজ্রপাতের রেখা জ্বলে উঠলে তবেই সন্ত্রাস কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে,
ভালই লাগে কিন্তু দেখতে!
তবু এর আগে এত চমৎকার দৃশ্য আমি কখনও পছন্দ করিনি।
তাদের মায়েদের অশ্রু দিয়ে যে নকশিকাঁথা সেলাই হচ্ছে,
সেটির অদৃশ্য কোণে রয়ে যায় একটি অপরিমেয় ফাঁক।
মানুষের কান্নায়ও আজকাল ফাটল থাকে,
সেখান দিয়ে পর্বতও অনায়াসেই লাফিয়ে গলে যায়!


মারাত্মক, হিমশীতল ভয়াবহতার কাছে
কেবলই অবিশ্বাস্য রকমের জন্মান্ধ ক্লিকের শব্দ শোনা যায়,
আমরা কিছুই দেখি না, কেউ দেখে ফেললে দুম করে ওকে বলে দিই,
মশাই, আপনি পাগল!


চোখ অবশ্য খুলি কখনওকখনও।
দেখি, লোকেরা
কসাইখানাটিতে একটি নিষ্পাপ ছোট বাছুরকে নিয়ে আসে।
জ্বলন্ত কয়লাকে এবং আগের হরিণটিকে তারা গড় হয়ে প্রণাম করে।
এইসব প্রস্তুতি দেখে লোকেরা একঢোঁক তৃপ্তির হাসি হেসে নেয়,
এবং যারা তাদের ভাই বলে ডাকে, তারা
সুবিন্যস্ত কিছু খাঁজ খনন করে।
লোকেরা তাদের ভোগ্যগুলিতে নরকের শব্দে পাথর ছুঁড়ে মারে,
সৎ কবিদের শেষ কুঁড়েঘরটিও ভেঙে দেয়। আমি কাকে ভালোবাসি, সে
সম্পর্কেও লোকেরা খারাপ কথা বলে।


ঘড়ি এখন আর ঘণ্টা বাজায় না,
ঘণ্টাই এখন ঘড়ি বাজায়---
ঘণ্টা কখন বাজবে কি বাজবে না, সেটা বুঝেই ঘড়ি ঘোরে।
ফলে, কিছু মানুষ আমার হৃদয়ের ঘণ্টা নিয়ে
দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে।
ঘড়ি সম্পর্কে, বিশেষত কীভাবে ঘড়ি ব্যবহার করতে হয়,
তেমন কিছু জ্ঞান দিতে থাকে, যদিও তারা জানতো না
শব্দ কখন চিৎকার হয়ে ওঠে, এবং সেটিকে আর থামানো যায় না।