‘ছোটোলোক’-এর বড়ো জয়

আপনার অফিসে যে লোকটি ঝাড়ু দেন, যাকে দেখলেই আপনার মনে হতে থাকে, ওকে এমনিতেই একটা বকা দিয়ে দিলেও কী-ইবা হবে, নিজের বাসার কোনও রাগ কিংবা ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝাড়ার সবচাইতে নিরাপদ স্থানটি ভেবে মুখে যা-ই আসে, তা-ই বলে ফেলা যায় ভাবেন যাকে, কখনও কখনও গায়ে হাত তুলতে ইচ্ছে করলে যার গায়ে হাত তোলাটা নিজের অধিকারের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যার বাবা-মা তুলে গালাগালি করে নিজের অসুস্থ মানসিকতাটা সামনে নিয়ে এলেও কিচ্ছুটি হয় না, যিনি আপনার সব অন্যায় কথা শোনাকে ওঁর চাকরির একটা অংশ মনে করেন, যাকে তুইতোকারি করা যায় বিনা অস্বস্তিতেই, নিজের জুতোজোড়াও সরিয়ে রাখতে যাকে হাঁক দিয়ে বলেন বেশ জোরেই, যার অসহায়ত্ব দেখলে আপনার কদর্য পৌরুষ সুড়সুড়ি পেয়ে নাচতে থাকে—উনিও কিন্তু একটা পরিবারের সর্বময় কর্তা। আপনি স্রেফ একটা তুড়িতেই ওঁর চাকরিটা ‘খেয়ে ফেলতে’ পারেন বলে উনি আপনার সামনে নত হয়ে সব অবিচারও সহ্য করে। কণ্ঠস্বরটাও যথাসম্ভব নামিয়ে কথা বলেন, কারণ স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরকে বেয়াদবি ভেবে বসে আপনি চাইলেই ‘সব কিছু’ করতে পারেন। সে ভয়ে উনি হাসিমুখে বিনা বাক্যব্যয়ে আপনি যা-ই বলেন না কেন, মেনে নেন, এমনভাবেই, যেন মন থেকেই নিয়েছেন! এটা শ্রদ্ধা নয়, ভালোবাসা নয়, এটা স্রেফ ভয়। চুপ করে থাকা মানেই কিন্তু মন থেকে গ্রহণ করা নয়। প্রতিবাদের অনুপস্থিতি মানেই ন্যায্যতা নয়। শরীরের শক্তির নির্লজ্জ প্রকাশে মনের নাজুকতাই ফুটে ওঠে। এই পৃথিবীতে সবচাইতে দুর্বল চিত্তের মানুষগুলোকেই অন্যের গায়ে হাত তুলতে হয়। মানুষ যখন তার নিজের অবস্থানের অযোগ্য হয়, তখনই নিজের অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করে অন্যকে আঘাত করে। বড়ো অবস্থানের ছোটোলোক মাত্রই ভয়ংকর!

আপনার অফিসের সেই ঝাড়ুদারের কথায় ফিরে যাই। সেই উনি যখন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন একটা সস্তা লজেন্স হাতে নিয়ে, ওঁর পুতুলের মতন আদুরে ছোট্ট মেয়েটি তখন খুশিতে ওঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর ওঁর চুলগুলি সরিয়ে দেয়, কপালে, চোখে, গালে চুমু খায়, আর লজেন্সটা চুষতে চুষতে বলতে থাকে, “আব্বু, তুমি অনেক ভালো!” বাবার সেই মুহূর্তে মনে হতে থাকে, এর চাইতে দামি সার্টিফিকেট পৃথিবীর সেরা ভার্সিটিতেও মেলে না। সারাদিনে কী কী হলো, ওকে কে কী কী বলেছে, বন্ধুদের সাথে কী কী খেলল, আম্মু কখন কখন বকা দিয়েছে, একে একে সব বলতে থাকে। ওঁর স্ত্রী তখন একটু দূর থেকে বাপ-বেটির এসব খুনসুটি দেখতে থাকেন আর মুচকি হেসে ভাবেন, “এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য কে কবে কোথায় দেখেছে?” সবচাইতে দরিদ্র অবহেলিত মানুষটিও কোনও এক নারীর চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ, কোনও একটি শিশুর বিশ্বাসে পৃথিবীর সেরা পিতা। সেই পুরুষটি এরপর স্ত্রীর খোঁপায় হয়তো পরিয়ে দেন দিনের শেষে সস্তায় বিক্রি-হওয়া একটা ফিকে-হয়ে-ওঠা গোলাপ। স্ত্রীর মুগ্ধতার কাছে ওটাই পৃথিবীর সবচাইতে দামি উপহার! সেইদিন স্বামীর ঘামে-ভেজা চপচপে শার্টটির গন্ধ সেই গোলাপটির সুবাসের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে মুহূর্তেই। লাজুক চাহনিতে সেই প্রথম দিনের মতো করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতমুখ ধোয়ার জলটাও এগিয়ে দেয় স্বামীর সেবায়। ধুয়ে মুছে তিনজন একসাথে বাসার বাইরে একচিলতে উঠোনে বসে সর্ষের তেল, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচে মাখা মুড়ি খেতে খেতে চাঁদের আলোয় স্নান সেরে নেয়।

মেয়েটি দুইজনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে লাফাতে থাকে, কী কী সব ছড়া কাটতে কাটতে খিলখিল শব্দে হাসতে থাকে, খেলতে থাকে। সে দৃশ্য দেখে বউ যখন হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে, তখন হঠাৎই খেয়াল করে ওর চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বামী হাসছেন মিটিমিটি, এ দেখে এই এতদিন পরও বউটি ভীষণ লজ্জা পেয়ে আঁচলে মুখ ঢাকে। “কী করেন? মেয়ে দেখছে তো!” হাহাহোহো করে হেসে বউয়ের আরও পাশ ঘেঁষে বসে স্বামীটি কর্কশ ধেড়ে গলায় একটা গান ধরে। সে গানটিকে ওই সময়ে মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মোহনীয় সংগীত। সেই আশ্চর্য সংগীতের মূর্ছনা চারপাশকে ছাপিয়ে যায়। মেয়েকে বাবা যে ছবির বইটি কিনে দিয়েছেন, সেটা থেকে কী কী সব ছবি এঁকে বাবাকে দেখায়, আর বাবা বলে, “বাব্বাহ্! অনেক সুন্দর হয়েছে তো!” স্ত্রী ভাবেন, মেয়েকে দেওয়া ওইটুকু বাব্বাহ্! শোনার জন্যও বেঁচে থাকা যায়। একদিন আমার মেয়েও বড়োঘরের মানুষের মেয়েদের মতন বড়ো হবে। রাজ্যের স্বপ্ন এসে নামে চোখের পাতায়। একটা সময় গল্পে, গানে, ঝিঁঝিঁর ডাকে আর জোনাকিদের আলোয় প্রাচীন রাতের নৈঃশব্দ্য এসে ভর করে সেই উঠোনে।

উনি যখন খেতে বসেন, তখন স্ত্রী পাশে বসে তরকারি বেড়ে দেন, সম্মুখভাগের গেলাপহীন টেবিল ফ্যানটা স্বামীর কাছাকাছি রাখেন। মেয়েটি সারাদিন অপেক্ষা করে ছিল কখন বাবা আসবে, বাবা কোলে বসিয়ে চারটে ভাত খাইয়ে দেবে, মজার মজার গল্প শোনাবে। সেদিন পাতে একটু শাক, ডাল আর সবজি ছাড়া হয়তো আর কিছুই জোটেনি, কিন্তু ওটা নিয়েই ওদের ছোট্ট স্বর্গের রাজভোজ চলে। স্ত্রীকে যখন একলোকমা তুলে খাইয়ে দেন, তখন ছোট্ট পরীটিও গোলগোল নাদুসনুদুস হাতদুটো মুখের দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে! স্ত্রীকে খাইয়ে দিয়ে তার সে কী সুখ! এক লোকমা মুখে তুলে দেওয়ার পর ঠোঁটের নিচে যে দুএকটি ভাত আটকে থাকে, সেটিও পরম যত্নে আস্তে আস্তে হাত দিয়ে সরিয়ে নেন। পরের লোকমা মুখে তুলে দেওয়ার সময় থুতনির নিচে বাম হাতটা রাখেন, যাতে ভাত বাইরে না পড়ে। মেয়ে সামনে আছে, তাই স্ত্রীকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু সমস্ত অনুভূতি আর আদর দিয়ে মাথায় হাতটা বোলাতে বোলাতে পরম তৃপ্তিতে স্ত্রীকে খাইয়ে দেন। ভালোবাসার মানুষটি আদর করে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিলে ওতে মেয়েরা যতটা খুশি হয়, আর কোনও কিছুতেই এর কণামাত্রও খুশি হয় না। এই শিল্পের কাছে পৃথিবীর সবচাইতে দামি উপহারটিও হার মানে। স্ত্রী ভাবে, শুধু এই ক্ষণটার জন্যও তো সারাজীবন ধরে প্রতীক্ষা করে থাকা যায়! ছোটো ছোটো সুখগুলিতেই জীবনের সমস্ত অর্থ লুকিয়ে আছে। এসব সুখের জন্যই স্বামীর ঘরে ফেরার মুহূর্তটি সব মেয়ের কাছেই দিনের সবচাইতে দামি মুহূর্ত।

মেয়েটি কখনও তুলতুলে নরোম হাতে কয়েকটি ভাত এলোমেলো করে তুলে নিয়ে বাবার মুখের কাছে ধরে, মায়ের মুখের কাছে ধরে। ওইটুকুন খাবারের স্বাদের কাছে বিশ্বের সেরা রাঁধুনির হাতের রান্নাও হার মানতে বাধ্য! সারাদিনের খাটুনি, ক্লান্তি, অথচ স্ত্রী আর কন্যাকে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছেন হাসিমুখে, ওতে ক্লান্তির ছাপটুকুও নেই। ওদের চোখে উনি পৃথিবীর সবচাইতে সম্মানিত মানুষ। স্ত্রী ওঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবেন, “মানুষ এত সুন্দরও হয়! জীবনে এত রং কেন?” ছোট্ট মেয়েটি বাবার দিকে মোলায়েম চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, “আমার কোনও বন্ধুর এত ভালো বাবা নেই।” প্রত্যেকটি মেয়েরই একজন সেরা বাবা থাকেন। সেই ঝাড়ুদারটি ভাবেন, “এর চাইতেও বেশি সুখ হয়?” যার কোথাও কোনও সম্মান নেই, তিনিও কোনও-না-কোনও জায়গায় অনেক সম্মানিত একজন মানুষ।

যাঁরা আপনার অধীনে একেবারেই ছোটো চাকরি করেন, তাঁদের দিকে কখনও ভালোবাসার চোখে তাকিয়ে দেখেছেন, কেমন দারুণ লাগে? কখনও নিয়ে দেখেছেন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সুস্থতার খোঁজ? ওঁর কেন মনখারাপ, এ কথা জিজ্ঞেস করেছেন কখনও? কখনও ওঁর ছোটো ছেলে কিংবা মেয়েটির জন্য একটা ক্যাডবেরি কিনে দিয়ে দেখেছেন কতটা কৃতজ্ঞতাভরে উনি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকেন? আর কিছু নয়, কাজের ব্যস্ততার একফাঁকে আপনার রুমে ডেকে একটু হাসিমুখে গল্প করুন না ৫ মিনিট! ছোটো অবস্থানের মানুষের সাথে গল্প করলে জাত যায় না। দেখবেন, ওঁর চোখজোড়া চকচক করছে! বাসায় ফিরে স্ত্রীকে, ছেলেমেয়েকে আপনার গল্প করবে। অনেক অনেক প্রার্থনা করবে আপনার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, বড়োলোকদের দোয়া কাজে লাগুক আর না লাগুক, গরীবদের দোয়া কাজে লাগে। সত্যিই খুব কাজে লাগে। অবস্থানের সুবিধা নিয়ে কারও সাথে অন্যায় করলে সে অন্যায়ের শাস্তি অনিবার্য। নিচু অবস্থানের কারও সাথে ভালো ব্যবহার করলে, ওঁর কাজের মূল্যায়ন করলে, ওঁর কাজের যে পরিধি, সেটির মধ্যে ওঁর প্রাপ্য ক্ষমতাটুকু দিলে তিনি অনেক সন্তুষ্টিতে থাকেন। ওঁরা তো খুব অল্পতেই ভীষণ খুশি হয়ে ওঠেন। আপনাকে মন থেকেই ভালোবাসবেন, শ্রদ্ধা করবেন, এমনকি নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকবেন। আপনার সম্পর্কে কে কী ভাবে, বলাবলি করে, ওঁদের কাছ থেকে জেনে যাবেন, নিজেকে শুধরে নিতে পারবেন। আপনার খোঁজখবর রাখবেন চাকরির অংশ হিসেবে নয়, একেবারে মন থেকেই।

যিনি আপনার অফিসে প্রতিদিন রান্না করে দেন, তাঁকে কখনও রুমে ডেকে একটা ধন্যবাদ দিয়েছেন? একদিন দিয়েই দেখুন না, পরের দিনের রান্নাটা আরও ভালো হবে। ভাবতে পারেন, এতে যদি ওঁরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন? কাজে ফাঁকি দেন? আমি দেখেছি, হন না, দেন না। ওঁরা কাজ করেন ভালোবাসা থেকে, খুশিমনে, ভয়ে নয়। ভালোবাসার শাসনের চাইতে ভয়াবহ শাসন আর হয় না। যদি একবার হৃদয় দিয়ে ওটা করতে পারেন, তবে আপনার কাজের টেনশন অনেকটাই কমে যাবে। ওঁদের দায়বদ্ধতার জায়গাটিতে আঘাত করুন ভালোবাসা দিয়ে, হৃদয়ের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে, আইনবিধি দিয়ে নয়। দেখবেন, ওঁরা সংকোচে আর লজ্জায় ফাঁকি দেবেন না। আপনার সম্মানের দিকটা মাথায় রেখে নিজেরা এমন কিছু করবেন না যেটাতে আপনি অসম্মানিত হন।

জীবনে সফল হওয়ার চাইতে অনেক বেশি প্রয়োজন শান্তিতে থাকা। একজন সফল মানুষের চাইতে একজন ভালো মানুষ অনেকবেশি শান্তিতে থাকতে পারে। আপনি যদি আপনার অফিসে যাঁরা ছোটো কাজ করেন, তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, তবে এর শাস্তি পাবেন বিধাতার কাছ থেকেই। প্রকৃতিতে এসব ক্ষেত্রে ন্যাচারাল জাস্টিস কাজ করে। আপনি দেখবেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখশান্তির দিক দিয়ে ওঁদেরকে বিধাতা পুরস্কৃত করছেন। দিনের সাফল্যের চাইতে রাতের শান্তির দাম অনেক বেশি। যে মানুষ জেগে থাকতে অন্যদের ঘুম হারাম করে দেয়, সে মানুষ ঘুমানোর সময় স্বস্তিতে ঘুমাতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। একজন সফল মানুষ নিশ্চয়ই একজন সফল পিতা, সফল স্বামী। যে বাবা তাঁর সন্তানের শৈশবের সাথী হন না, তিনি প্রতি মুহূর্তেই তাঁর নিজের বাবার শিক্ষাকে অসম্মান করেন। যে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু থেকে বঞ্চিত করেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর মায়ের অবস্থানকে ছোটো করে ফেলেন। অর্থ ও অবস্থানের বিচারে সাফল্য মাপা যেতে পারে, সার্থকতা নয়। একজন্মের সার্থকতা একশো জন্মের সাফল্যের চাইতেও অনেক বড়ো।

পুনশ্চ। ইয়ে মানে, এই লেখায় যে ব্যক্তির কথা বলেছি, ওঁর মাথায় চুল না থাকলে ওঁর চকচকে টাকে ওঁর ছোট্ট মেয়েটি চুমু খায় ধরে নিতে হবে!