জলের মধ্যে বালির দাগ

 
মোমেন ভাই। তিনি আমার চাচাত ভাই হন। ওঁরা চার ভাই, তিন বোন। মোমেন ভাই সবার ছোট। পরিবারের ছোটরা কখনও বড় হয় না, বয়স যতই বাড়ুক, ওরা আজীবন ছোটই, ওরা বৃদ্ধবয়সেও ছোট।


মোমেন ভাইদের পরিবার গ্রামের নামকরা পরিবার। জমিজমা, পুকুর, বড় উঠোনের সেমিপাকা ঘর। এককথায়, অঢেল সম্পত্তি ওঁদের।


এনামুল ভাই মোমেন ভাইয়ের বড় ভাই। তাঁর ছোট তিন বোন, তার পর দুই ভাই, সবার শেষজন হচ্ছেন মোমেন ভাই। এনামুল ভাই শিক্ষিত মানুষ। সবাই ওঁকে সম্মান করে। গ্রামে শিক্ষিতের সংখ্যা কম থাকায় এনামুল ভাইয়ের বেশ কদর। তবে তাঁর পরের ভাই-বোনেরা তেমন পড়াশুনা করেননি। বোনদের বিয়ে, ভাইদের কুয়েতে পাঠানো হয়েছিল জমিজমা বিক্রি করে করে। তৎকালীন সময়ে জমির তেমন একটা দাম ছিল না। অনেক জমি বিক্রি করে তুলনামূলক বিচারে খুব সামান্যই টাকা পাওয়া যেত। এভাবে জমি বিক্রি করে করে একজন একজন করে বিদেশ পাঠানো হচ্ছিল। বোনদের ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হয়।


এনামুল ভাই দেশে থেকে গেছেন। তিনি একটা ডিসপেনসারির দোকান চালান। পাশাপাশি হালচাষের আয় তো আছেই। বিদেশ থেকে অন্য ভাইয়েরা প্রতি মাসে টাকা পাঠান। সেই টাকা দিয়ে বিক্রি-করে-দেওয়া জমি আবার কেনা হচ্ছিল। কোনও অভাব নেই ঘরে।


মোমেন ভাই বড় হচ্ছেন। পৃথিবীর যে কয়েকটা কাজ তিনি মন থেকে অপছন্দ করতেন, সেগুলির মধ্যে পড়ালেখা অন্যতম, এমনকি পড়ালেখা থেকে মুক্তি পাওয়ার শর্তে অন্যান্য অপছন্দের কাজগুলিকেও পছন্দের কাজ করে নিতে তাঁর বিন্দুমাত্রও আপত্তি ছিল না। সেই ছেলে দরকার হলে হালের চাষ করবে, গরু চড়াবে, রাজমিস্ত্রির কাজ করবে, মাটি কাটবে, ধান কাটবে, তবুও পড়ালেখা করবে না। এ-পাড়া ও-পাড়া দৌড়ে বেড়ানো, এ-ঘর ও-ঘর দাপিয়ে বেড়ানো, তাসখেলা, দলবেঁধে ক্রিকেট ও ডাংগুলি খেলা, রিকশার টায়ারকে লম্বা একটা কাঠি দিয়ে চালানো, বড় পুকুরপাড়টায় থাকা ভূরি ভূরি কাঁঠালগাছের মুচি চুরি করে বন্ধুরা মিলে লবণ আর গুঁড়ামরিচ মিশিয়ে হইচই করে খাওয়া, পরে আবার দৌড়ানি খাওয়া, এসব ছিল মোমেন ভাইয়ের নিত্যকাজ।


প্রতিদিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে নানা অভিযোগ আসে। আজ মুচি-চুরির অভিযোগ তো কাল বরই-চুরির অভিযোগ। আজ এ-বাড়ির টিনের চালে ঢিল মারে তো কাল ও-বাড়ির নারকেল চুরি করে। প্রতিদিন প্রতিদিন এই অভিযোগ, ওই অভিযোগ আসতেই থাকে।


মোমেন ভাইয়ের মা আমাদের চাচি হন। সন্ধ্যা গড়ানোর পর সমস্ত দুষ্টুমির শাস্তিস্বরূপ চাচি মোমেন ভাইকে প্রায় প্রতিদিনই পেটান। পেটাতে পেটাতে কানে ধরে শপথ করান, সে এমন চুরিচামারি, বদমায়েশি আর কখনও করবে না। মোমেন ভাইও কাঁদতে কাঁদতে কানে ধরে উঠবস করতে করতে শপথ করেন যে কাল থেকে এসব মোটেও করবেন না। ও-বাড়িতে ঢিল ছুড়বেন না, অমুকদের গাছের নারকেল চুরি করবেন না, বরইগাছে ঢিল মারবেন না, আমচুরি তো দূরে থাক, আমবাগানের পাশ দিয়েও হাঁটবেন না আর কোনও দিনই।


তার পর চাচি মোমেন ভাইয়ের পিঠের ক্ষতে তেল মালিশ করতে করতে চোখের জল লুকাতে চাইতেন। শাসন না করলে তো ছেলে উচ্ছন্নে যাবে। কিন্তু ছেলে কিছুতেই শুধরায় না। রাতে শপথ করে, পিটুনি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে-পড়া মোমেন ভাই সকাল হতেই হয়ে উঠেন চিরাচরিত সেই পুরান মোমেন ভাই। যেন রাতে কিছুই ঘটেনি, কোনও শপথ হয়নি। যেন আবার এ-বাগানে ও-বাগানে চুরি, এ-বাড়ি ও-বাড়ির চালে ঢিলছোড়া, এ-পাড়া ও-পাড়া দাপানো, ওই লোকের চাষের বীজ মাড়িয়ে দেওয়া তো অমুক লোকের ফুলের গাছ ছিঁড়ে দেওয়া। একে মেরে রক্তাক্ত করা, ওকে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া…এসবই মোমেন ভাইয়ের শিরোধার্য কাজ।


ছেলের এমন দুরন্তপনায় চাচি অতিষ্ঠ। চাচি কখনও কখনও মোমেন ভাইকে পেটাতে পেটাতে নিজেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতেন আর রাগে-দুঃখে বলতেন, “তোর মতো বদমায়েশ ছেলের মরে যাওয়াই ভালো, তোকে আজকে মেরেই ফেলব, তুই মরলে পুরা পাড়ার শান্তি হবে।” বলেই পেটাতে পেটাতে চাচি নিজেই ক্লান্ত হয়ে যেতেন, কিন্তু ওরকম পিটুনি খেতেও মোমেন ভাইয়ের যেন কোনও ক্লান্তি বা অপরাধবোধ নেই। প্রচণ্ড মার দিয়ে চাচি আবার আদর করে খাইয়ে দিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। কখনও কখনও ঘুমন্ত মোমেন ভাইয়ের কপালে চুমু মেখে দিয়ে ভাবতেন, ছেলে আমার একদিন বড় হবে, দুরন্ত মোমেন একদিন ভারি সংসারী হয়ে উঠবে, তারও ঘর-সংসার হবে, অবুঝ মোমেনও একদিন বাবা হয়ে উঠবে। ভাবতে ভাবতে সকাল হতো, মোমেন ভাইয়ের দুষ্টুমি সকালের সাথে আবার শুরু হতো। সেই অশান্ত মোমেন যেন কিছুতেই শান্ত হয় না।


দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। মোমেন ভাইয়ের দুরন্তপনা দিনদিন বাড়তে থাকে। সকালে চাচি পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত তো সন্ধ্যায় এনামুল ভাই পেটায়। দুপুরে বড় বোন পেটায় তো বিকেলে মেজো বোন পেটায়। সবাই পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও মোমেন ভাইয়ের কিন্তু পিটুনি খেতে কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অনুতাপ নেই। এখন মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল ঝরছে তো খানিক বাদেই ফিক করে হেসে দিল। এক দোষের দায়ে মার খেয়ে আর এক দোষ করার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নেয় দুরন্ত মোমেন।


সবাই মোমেন ভাইয়ের এমন চঞ্চল স্বভাবে হতাশ। বড্ড হতাশ। ছোট মোমেনের বয়স বাড়ছে, কিন্তু সে ঠিক বড় হয়ে উঠছে না, কেবল বয়সই বাড়ছে। ওদিকে পড়াশোনার ব্যাপারে প্রতি বছরই অবধারিত ফেলই মোমেনের ভাগ্যে লেখা। একই ক্লাসে দুই বছর, পরের বছরে শিক্ষকরা বিরক্ত হয়ে বা দয়া করে পরের ক্লাসে তুলে দিতেন। এভাবে বেশি দূর যাওয়া যায়নি, ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠতেই পড়াশোনার গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়ে দুষ্টের মহারাজ হয়ে উঠল ছোট মোমেন।


সবারই মোমেন ভাইকে নিয়ে ভারি দুশ্চিন্তা, কেবল মোমেন ভাইয়েরই যেন কোনও চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট, তাপ-অনুতাপ নেই। দুশ্চিন্তায় পরিবারের সবাই উৎকণ্ঠিত হলেও মোমেন ভাইয়ের কপালে কখনও কোনও দিনও কোনও কিছু নিয়েই উৎকণ্ঠার বলিরেখা নেই। দুনিয়া উল্টে যায় তো যাক। অবধারিত নিয়মানুযায়ী মোমেন ভাইয়ের কোনও পরিবর্তন নেই। দিন গড়াচ্ছে, মোমেন ভাই বড় হচ্ছে, পরিবারের সকল সদস্যের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।


হাসি-তামাশার ছলে মোমেন ভাইকে পাড়া-প্রতিবেশিরা জিজ্ঞেস করে, “কী রে মোমেন, কাজকাম পড়াশুনা নাই, সারাদিন টো টো করে ঘুর, এমন করলে তো কেউ বউও দিবে না।” শুনে মোমেন ভাই দাঁতের ফাঁক থেকে খিলান দিয়ে ময়লা বের করতে করতে উদাস ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করে উত্তর দিতেন, “আরে ধুউর! দুনিয়ার এককোনায় বউ পড়ে আছে, একদিন গিয়ে ঠিকই তুলে নিয়ে আসব শালীরে।” এমন উত্তরে হাসাহাসির রোল পড়ে যেত।


যেকোনও আড্ডাতেই মোমেন ভাই মধ্যমণি। আড্ডায় মোমেন ভাই থাকা মানেই হাসতে হাসতে সবার পেট ব্যথা হয়ে যাওয়া। যতসব আজগুবি কথাবার্তা আর সত্য-মিথ্যাকে একসাথে জোড়াতালি দিয়ে যেকোনও ঘটনাকেই মোমেন ভাই বেশ রসিয়ে রসিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। ঘরের লোকজনকে যন্ত্রণায় রাখলেও বাইরের লোকেদের কাছে মোমেন ভাই বেশ পছন্দের একজন ভালোমানুষ। মোমেন ভাইকে ঘিরে রসের আড্ডা জমে উঠে। সে আড্ডায় থাকা মানে এমন---যেন পৃথিবীতে কোনও দুঃখ-কষ্ট নেই। খাও-দাও, দুরন্তপনা করো, মার খেয়ে চিত হয়ে থাকো, চিত থেকে উঠে আবার আগের কাজগুলো করো। এসব চক্রাকারে চলতেই থাকে। এ যেন এক দুষ্টুমির দুষ্টচক্র!


মোমেন ভাই এখন আর আগের মতো মার খান না, তিনি এখন আর ছোট্টটি নেই, বড় হয়ে গেছেন গায়েগতরে। তবে মার খেতে তাঁর তেমন কোনও আপত্তি নেই, ভালোই অভ্যস্ত তিনি। কেউ মার দিতে চাইলেই গায়ের গেঞ্জি খুলে পিঠটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, “এই নাও, মেরে নাও!” যত আপত্তি ওই মারদাতাদের। এত বড় দামড়া ছেলেকে মারতে এখন ওদের লজ্জা লাগে।


পরিবারের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। দুরন্ত মোমেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। এবার ভাইয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, মোমেন ভাইকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সবাই রাজি, কিন্তু মোমেন ভাইয়ের মন ভারী হয়ে আছে। বিদেশটা কেমন হবে? ভালো লাগবে তো? মানাতে পারবে ওখানে? ওদেশের লোকগুলো ভালোবাসতে জানে? সারাদিন মারধোর খেলেও তো কাছের মানুষগুলোকে পাশে পাওয়া যায়, একবার দেখতে পাওয়া যায়। ওরা যে তাকে ভালোবাসে! ওখানে তো আপন কেউ নেই।


না, মোমেন ভাই বিদেশে যাবেন না। এদেশেই থাকবেন, মার খেয়ে থাকবেন, গালাগালি লাত্থিগুঁতা যে যা মারে তো মারুক, ওদের ছেড়ে ওই দূর দেশে থাকতে কিছুতেই পারবেন না তিনি। কিন্তু বড় ভাইদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দেশে থেকে সবাইকে জ্বালানোর চেয়ে বরং বিদেশে গিয়ে শান্ত হোক।


যথারীতি বিদেশযাত্রার দিন-তারিখ ঠিক হলো। গন্তব্য কুয়েত। মোমেন ভাইয়ের মুখে এবারও হাসি লেগে আছে। সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিতে নিতে হাসতে হাসতে পিঠ এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “তোমাদের কারও মারতে ইচ্ছা হলে মেরে নাও বাপু, অনেক অনেকদিন মারতে পারবে না তো!” এ-কথা শুনে চাচি মোমেন ভাইকে বুকে টেনে ধরে জড়িয়ে কপালে মুখে চুমু খেতে খেতে ধরাগলায় বললেন, “বাবা আমার, তোকে যত মারি তার চেয়ে শতগুণ বেশি কষ্ট আমরা পাই।” এই প্রথম মোমেন ভাই দ্রুত মাকে ছাড়িয়ে মুখ লুকাতে চাইছেন---ঠিক মুখ নয়, চোখ।


সদা-হাস্যোজ্জ্বল মোমেন ভাই এবার কাঁদছেন। কিন্তু কিছুতেই চোখের জল কাউকে দেখাবেন না। দ্রুত মাকে ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। চাচি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। ভাবছেন, ছেলে আমার এবার বড় হয়ে গেছে, চোখের জল লুকাতে শিখে গেছে। কাঁদতে শিখে গেছে।


কাঁদতে-শিখে-যাওয়া মোমেন ভাই কুয়েত চলে গেলেন।


একদিন একদিন করে প্রতিদিন পৃথিবীর বয়স বাড়ছে, আর একদিন একদিন করে পৃথিবীর বুকে আমাদের সময় কমছে।


এখন মোমেন ভাই নেই ঘরে। সারাবাড়িই কেমন জানি মরুভূমি হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো অভিযোগ আসে না, কারও গাছের ফলও চুরি হয় না, কারও ঘরের চালে ঢিলও পড়ে না।


যারা সারাক্ষণই হই-হুল্লোড় করে ঘর মাতিয়ে রাখে, তারা দূরে চলে গেলে তাদের জন্য মন খুব বেশি কাঁদে, তাদের জন্য শুন্যতার গভীরতা বাড়তে থাকে। সারাবাড়িতে সুনসান নীরবতা, যেন মোমেন ভাই ছাড়া বাড়িটা একটা ছোটখাট মরুভূমি।


এভাবে সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। তার পর অনেকগুলো বছর কেটে গেল। প্রায় সাত বছর।


তখন এখনকার মতো যোগাযোগ-মাধ্যম এত উন্নত ছিল না। চিঠির মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান চলত। ধীরে ধীরে মোবাইল ফোন এল। নোকিয়া এগারোশ’। কারও কাছে তেমন ফোন থাকত না। এক মিনিট কথা বলতে সাত-আট টাকা লাগে। এভাবে যে যত মিনিট কথা বলবে, তত গুণ সাত-আট টাকা বিল উঠবে। তখনকার সময়ে দশ টাকাও অনেক টাকা। মাসে একবার বা দুবার চাচির সাথে মোমেন ভাইয়ের কথা হতো ফোনে। কখনও কখনও হতোই না।


এর মধ্যে পরিবারের সবার বিয়েপর্ব শেষ। এবার মোমেন ভাইয়ের পালা। এবার চাচির শখ হলো, দুরন্ত মোমেনকে বিয়ে করাবেন, সংসারী করাবেন। সদা-হাস্যোজ্জ্বল মোমেনের জন্য একটা ঘরোয়া বউ চাই। শুনে মোমেন ভাইও লাজুক-সম্মতি দিলেন। তিনি দেশে আসবেন, বউ আসবে ঘরে।


মোমেন ভাই বিদেশ থেকে অনেক টাকা পাঠান। তাঁর ইনকাম বেশ ভালো। ঘরে মোবাইল ফোন কেনা হয়েছে। বড় করে দালান-বাড়ি বানানো হয়েছে। মোমেন ভাই যেহেতু ছোট, সেহেতু মাকে নিয়ে থাকবে বলে নিজে একাই একটা বাড়ি করেছে চাররুমের। সেখানে থাকবেন মা, বউ আর মোমেন ভাই। বিয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবই চলছিল। এদিক ওদিক মেয়ে দেখা হচ্ছে।


ততদিনে মোবাইলের প্রচলন বেশ হয়ে গিয়েছে। প্রায় কয়েক ঘর পরপরই মোবাইল ফোন। প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে। চাচি প্রতিদিনই মেয়ে দেখে যাচ্ছেন। ছেলে দেশে আসবে। আসার আগেই মেয়ে ঠিক করে রাখার পরিকল্পনা চলছে।


ওখান থেকে কেউ দেশে এলে সচরাচর ছয় মাসের ছুটি পায়, এর বেশি না। চাচির এক মেয়ে পছন্দ হয়েছে। চাচির দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে। বেশ সুন্দরী, ঘরোয়া। মেয়েপক্ষও রাজি। মেয়েপক্ষ ছেলেকে আগে দেখেছে। দুই পরিবারের মধ্যে চেনা-জানা আছে। কথা পাকাপাকি হলো। সামনের মাসেই দেশে ফিরবেন মোমেন ভাই। সাত বছর পর। গোটা গোটা সাতটা বছর চলে গেছে এর মধ্যে। এই সাত বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।


সবাই উৎফুল্ল, দেশে ফিরবেন মোমেন ভাই। সেই মোমেন---দুরন্ত, মারখোর, দুষ্টু, সদা-হাস্যোজ্জ্বল মোমেন ভাই দেশে ফিরবেন।


সবাই ভাবছে, সেই ছোট্ট মোমেন কেমন হয়েছে দেখতে? আগের মতো চুরি করে এখনও? একে ওকে মারে ইচ্ছে হলেই? এই চালে ওই চালে ঢিলছুড়ার অভ্যাসটা আছে এখনও? এখনও কি কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলে? কারণে অকারণে হাসে আগের মতোই? বড় হয়ে গেছে? না কি আগের মতো ছোটই আছে? আছে এখনও আগের মতোই বেপরোয়া? না কি এখন সে ভীষণ শান্ত?


আহা, কত কত প্রশ্নের উত্তর মিলবে পরের মাসে। মোমেন ভাই দেশে ফিরবেন। সাত বছর, গোটা সাতটা বছর পর! সবার আদরের মোমেন ভাই দেশে ফিরবেন। সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরলেই তার পরের সপ্তাহেই বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। সময়টা ২০০৮। মোমেন ভাই ফিরবেন জুলাইয়ের একুশ তারিখ। বিয়ে হবে আটাশ তারিখ।


এদিকে বিয়ের পাত্র পাত্রী দুজনেই এখন সারাদিন ফোনে কথা বলে। সংসারটা কীভাবে গোছানো হবে, জীবনটা কীভাবে কাটানো হবে, ঝগড়া রাগ অভিমান হলে কীভাবে সামাল দিবে, কে আগে সরি বলবে, কার কী পছন্দ অপছন্দ, বাচ্চা-কাচ্চার কী কী নাম রাখা হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো রসালাপ।


কনের জন্য স্বর্ণের গয়না বানিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোরকা পাঠানো হয়েছে। সাথে যাবতীয় প্রসাধনী। দেশে ফিরেই যাতে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রোগ্রাম নামানো যায়, তাই আগে থেকেই দরকারি জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কনের যা যা পছন্দ ও দরকার, তার সবই দেওয়া হয়েছে, কিছুই বাদ নেই। মা, বোন, ভাইয়াদের যা যা দরকার, সবই পাঠানো শেষ। মোমেন ভাই আগেই সব খরচের টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবাই খুশি। খুব আনন্দিত। দেশে ফিরবেন মোমেন ভাই। মাত্র তিন দিন বাদে একুশ তারিখ দেশে ফিরবেন, আটাশ তারিখ বিয়ে। মোমেন ভাইয়ের বাড়ির সবাই মজা করে শপিং করছে। চারিদিকে উৎসবের আমেজ।


ওদিকে মোমেন ভাই ভাবলেন, নিজের জন্য তেমন কিছুই কেনা হয়নি। এবার নিজের জন্য কেনাকাটার পালা। মায়ের জন্য নামাজের তসবি, নামাজ-পড়ার জায়নামাজ, আতর, যাবতীয় প্রসাধনসামগ্রী ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে মোমেন ভাই শপিং থেকে বের হলেন। কেনাকাটা শেষ। মনে মনে হাসছেন তিনি। ভাবছেন, আহা, কত শত যুগ পর দেখা মিলবে প্রিয়জনদের সাথে। আচ্ছা, প্রথম দেখাতেই মা কি জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদবেন? চোখে মুখে বারবার অস্থির হয়ে চুমু খাবেন? কত দিন মায়ের আদর খাওয়া হয়নি, কত যুগ মায়ের হাতের মার খাওয়া হয়নি। মোমেন ভাই ভাবছেন প্রথম দেখাতেই মাকে বলবেন, “মা, এই নাও পিঠ, একবার মেরে হাতটা শানিয়ে নাও তো, কত বছর যে না মেরে না মেরে হাতটা ভোঁতা করে রেখেছ!”


হয়তো মোমেন ভাই এইসবই ভাবছেন আর মনে মনে হাসছেন। বোনেরা কি খুব আদরে জড়িয়ে ধরবে? হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে? ওরা এখন দেখতে কেমন হয়েছে? হবু-বউ কি খুব লজ্জায় মুখ লুকাবে প্রথম দেখায়? প্রথমে কী বলে কথা শুরু করবে? আগে ও কথা বলবে, না কি আমি বলব? ওর চোখ দুটো দেখতে কেমন? চোখে কাজল পড়ে? হাসতে গিয়ে টোল পড়ে? লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে কখনও কখনও?


আরও ভাবছেন মোমেন ভাই, আহা! কত রঙিন দুষ্টুমিমাখা সময় ছিল! যে বাড়িগুলোর ছাদে ঢিল ছুড়তাম, ওরা কি এখন আমাকে দেখে চিনতে পারবে? ও-পাড়ার বরইগাছগুলো কি আছে, না কি কেটে ফেলেছে ওরা? পারুদের আমবাগানে এখন কেউ চুরি করে? নারকেলের গাছগুলোতে কি এখনও আগের মতো ডাব হয়? গ্রামে ডাব-চুরি হয় আজও? এবার গেলে কাদের বাগানে চুরি করলে ধরাপড়ার আশংকা কম? আগের বন্ধুদের সাথে কি দেখা হবে? না কি ওরাও জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়ে গেছে ভীষণ?


মোমেন ভাইয়ের মাথায় বারবার দেশই ঘুরছে, সাত বছর পর দেশে ফেরার আনন্দ চোখের কোণে নাচছে। এ আনন্দের কোনও প্রকাশভাষা নেই। এসব ভাবতে ভাবতে, মুচকি হাসতে হাসতে মোমেন ভাই রাস্তা পার হচ্ছেন, যখনই রাস্তার ঠিক মাঝখান বরাবর গেলেন, ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে বড় একটা লরিগাড়ি দ্রুত চলতে গিয়ে মোমেন ভাইকে পিষে দিল। মোমেন ভাইয়ের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে চাকার তলে তেলাপোকার মতো ছ্যাৎ করে পিষে গেল। একটা তাজাপ্রাণ, একটা মানুষ, একজন মোমেন ভাই নিমিষেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন।


মরার আগে মোমেন ভাই শেষ একবার ‘ও মা, মা রে…’ বলে চিৎকার করেছিলেন।


ঘটনাস্থলেই মোমেন ভাইয়ের সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। শরীরের এক একটা অঙ্গ অন্যটা থেকে আলাদা হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ল। ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারায় রাস্তার চারপাশ বয়ে যাচ্ছিল। মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে, তা পিচের গায়ে লেপটে থ্যাকথ্যাক করছে। গলগল করে বের-হওয়া রক্তের স্রোতধারা একজন জলজ্যান্ত মানুষের অনেকগুলো স্বপ্নকে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দিল।


মোমেন ভাই মারা গেলেন। দুর্ঘটনার সাথে সাথেই মারা গেলেন। চোখের পলক ফেলারও সময় পাননি। মা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শব্দ উচ্চারণের সময় ও সুযোগ কোনওটাই পাননি মোমেন ভাই।


নিথর, নিস্তেজ মোমেন ভাইয়ের শরীর গলে-লেপটে পড়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। কারও জানা হয়নি, শেষবার মোমেন ভাই কাকে দেখতে চেয়েছিলেন, শেষ কোন কথাটি বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণ বের হয়ে যেতে যেতে তাঁর মনের কোন কষ্টটি দ্বিগুন হয়ে উঠেছিল! কেমন যন্ত্রণাবোধ হয়েছিল মোমেন ভাইয়ের? বুকের উপর দিয়ে যখন অমন ভারী ভারী চাকা পিষে যাচ্ছিল, মোমেন ভাই কি তখন নিঃশ্বাস নিতে চাইছিলেন? বাঁচার জন্য তীব্র আকুতি ফুটে ওঠেনি তাঁর চোখে-মুখে? চোয়ালে মুখে লাগা ধাক্কায় যখন দাঁতগুলি খুলে পড়ছিল, যখন চোখের ভেতর অসংখ্য ভাঙাকাচ ঢুকে পড়ছিল, তখন কেমন লেগেছিল মোমেন ভাইয়ের? এসবের উত্তর জানা হবে না কোনও দিনই।


কয়েকজন লোক দৌড়ে এসে ভাইয়ার ছেঁড়া ছেঁড়া শরীরগুলোকে এক করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। টুকরো টুকরো শরীরের সব রক্তে রক্তিম আভায় ভরে উঠেছে পিচঢালা রাস্তা। অথচ আর কিছু দিন পরেই মোমেন ভাইয়ের রক্তিম-ফুলেল রঙের বাসর হবার কথা ছিল। পুরনো সেই কথার ঝুলি নিয়ে দেশে ফিরবেন বলে যে মোমেন ভাই হাজারো কথা জমিয়ে রেখেছিলেন, সে মোমেন ভাইয়ের মুখের সবগুলো দাঁতই রাস্তায় ছিটকে ছিটকে ধুলোয় মিশে আছে।


যে হাতে হবু নতুন বউয়ের হাত রাখার কথা ছিল, সে হাতের হাড়গুলো ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। যে বুকে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার কথা ছিল, সে বুকের হাড়গুলো ভেঙে ভেঙে শরীরের ভেতরের মাংসপিণ্ডগুলো দলা দলা হয়ে বেরিয়ে এসেছে। যে পায়ে দৌড়াদৌড়ি, দাপাদাপি করার দায়ে প্রতিদিনই মা আর বড় ভাইদের পিটুনি খেতে হতো, সে পা-দুটোর একটা শরীর থেকে ছিটকে রাস্তায় দূরে পড়ে আছে। এই দুই-পায়ে আর দাপাদাপি হবে না। ভাইয়া এখন নিথর, নিষ্প্রাণ, নির্জীব। নিষ্পলক চোখ, থেঁৎলে-যাওয়া ছিন্নভিন্ন শরীর।


কদিন বাদেই তো তাঁর বর সাজার কথা হচ্ছিল, অথচ আজ পুরোদস্তুর লাশ হয়ে গেছে হবু বরটি। কত কল্পনা, কত জল্পনা, কত ইচ্ছা, কত শখ, কত আহ্লাদ…নিমিষেই সব শেষ! সবই একটা শরীরের সাথে সমাপ্তি-জেরে মিলিয়ে গেল।


মোমেন ভাই মারা গেছেন। দেশে খবর এল। সবাইকে সত্য ঘটনা জানানো হলো। একমাত্র চাচিকে জানানো হলো, মোমেন ভাইয়ের গাড়ির সাথে হালকা ধাক্কা লেগেছে, তবে তিনি সুস্থ আছেন। তবু চাচির উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল।


বাড়ির অন্যরা কেমন জানি মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ বড় বোন সশব্দে কেঁদে ওঠায় চাচির মনে সন্দেহ ঘন হতে লাগল, তিনি তড়পড়াতে লাগলেন। চাচি বারবারই কথা বলতে চাইছেন মোমেন ভাইয়ের সাথে। কেমন আছে মোমেন এখন? বেশি ব্যথা পেয়েছে? খুব লেগেছে? কোথায় ব্যথা পেয়েছে? কিছু খেতে পারছে তো? কথা বলতে কি খুব কষ্ট হচ্ছে? সারাদিন তো একটাবারও ফোন করল না…কেন করল না? এমন তো ছেলেটা কখনও করে না! কষ্ট করে হলেও ওকে আমার সাথে একটু কথা বলতে বলো, আমার কেমন জানি করছে কলিজায়! একটু কথা বলিয়ে দাও, ছেলেটার আমার না জানি কোথায় কোথায় চোট লেগেছে!


…এসব বলে চাচি কেঁদে উঠলেন। এবার মোমেন ভাইয়ের বড় ভাই মনকে শক্ত করে ধরাগলায় একনিঃশ্বাসে বলেই ফেললেন, “মা, মোমেন তো বেঁচে নেই, অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, হওয়ার সাথে সাথেই মারা গেছে।” কথাটা শেষ হতে না হতেই চাচি দাঁড়ানো থেকে ধপাস্‌ করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।


ধীরে ধীরে মোমেন ভাইয়ের বাড়িতে সবাই জড়ো হতে লাগল। পুরো বাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়ল। যেদিন মোমেন ভাই দেশে ফিরবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, সেদিনই মোমেন ভাই দেশে ফিরেছেন। তবে জ্যান্ত অবস্থায় নয়, ছিন্নভিন্ন কাটাছেঁড়া জোড়াতালি-দেওয়া শরীর নিয়ে। অ্যাকসিডেন্টের দুদিন বাদে পোস্টমর্টেম-শেষে ফ্রোজেন করে-রাখা মোমেন ভাইকে দেশে পাঠানো হলো।


চারদিক থেকে শত শত মানুষ জড়ো হতে লাগল। শেষবার মোমেন ভাইকে দেখার জন্য উৎসুক জনতার ভিড় আরও বাড়তে লাগল। গাড়ি এসে পৌঁছাল। মোমেন ভাইয়ের কফিন উঠোনে রাখা হলো। বাক্সের মুখ খুলে রেখে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হলো। ভিড়ের মধ্যে মোমেন ভাইকে একবার দেখার জন্য ধুম পড়ে গেছে। মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী দৃশ্য বরাবরই একটি সরব দৃশ্য।


বারবার জ্ঞান-হারানো চাচিকে এবার কয়েকজন মিলে ধরে ধরে মোমেন ভাইয়ের কফিনের সামনে আনলেন। সাত বছর! আস্ত সাতটা বছর পর মা ছেলের দেখা হয়েছে আজ। দুজন মুখোমুখি। ছোটবেলার সেই মোমেন ফিরে এসেছে। সেই দুরন্ত, দুষ্টু, অস্থির মোমেন আজ নিথর, নিশ্চুপ, নিঃস্পৃহ, স্তব্ধ, শান্ত। অথচ কথা ছিল, দেখা হলে অনেক কথাই হবে। সেই আগের মতো মোমেন ভাই মাকে দেখে এখন আর হাসতে হাসতে গেঞ্জি খুলে পিঠ বাড়িয়ে দিয়ে বলছেন না…”মা, দেখি, মারো তো, কত মারতে পারো!” সদা-হাস্যোজ্জ্বল মোমেন ভাই আজ একটুও হাসছেন না, একটুও কথা বলছেন না, রসের কথা বলে বলে সবাইকে হাসাচ্ছেন না।


মোমেন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন চাচি, অথচ মোমেন ভাইয়ের কোনও সাড়াশব্দ, অনুভূতি নেই। এই প্রথম মোমেন ভাই কোনও দুরন্তপনা দুষ্টুমি করছেন না। অথচ একদিন শান্ত-শিষ্ট-স্থির হবার জন্য মোমেন ভাইকে প্রতিদিনই পেটাতে হতো। সেই মোমেন ভাই আজ শান্ত। তাঁর এই শান্ত হয়ে-থাকাই অশান্ত করে তুলছে মায়ের বুক, চোখ, কলিজা। চাচি বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির অশান্ত হয়ে মোমেন ভাইয়ের চোখে মুখে হাত বুলাচ্ছেন আর সারামুখে বারবার চুমু খাচ্ছেন।


মুখ ছাড়া মোমেন ভাইয়ের আর কিছুই দেখানো হচ্ছে না। মুখে থাকা কয়েকটা কাটা-দাগ দেখে বুক ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে চাচি ওই দাগগুলোতে বারবার চুমু খেতে খেতে বলছেন, “বাছাধন আমার, বাপজান আমার, আমার সোনাজাদুর সুন্দর মুখে কাটা-দাগ লেগেছে, জাদু আমার ব্যথা পেয়েছে!”


চাচি বারবার বুকের ক্ষতগুলো দেখতে চাইছেন। কিন্তু ক্ষতবিক্ষত শরীরটা চাচিকে দেখাতে চাইছে না কফিনধারীরা।…বিলাপ করতে করতে এবার চাচি জোর করছেন ছেলের বুক দেখবেন বলে। জোর করে সাদাকাপড়ের গিঁট খুলে ফেলতে চাইছেন। বাধ্য হয়ে চাচিকে সাদাকাপড়ের কিছু অংশ খুলে বুকের অংশটা দেখানো হলো। সে ভয়ংকর দৃশ্য দেখে চাচির ঠিক কেমন লেগেছিল জানি না। কোনও শব্দ, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি নেই। নেই কোনও নড়াচড়াও। চাচি মুহূর্তের মধ্যেই ধপাস্‌ করে মাটিতে পড়ে গেলেন।


আজ, যে বুকে বুক লাগিয়ে কয়েক ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে রাখার কথা ছিল, সেই বুকটা কিনা ছিন্নভিন্ন, কাটাছেঁড়ার দাগে দাগে জর্জরিত! এই দাগের ক্ষত চাচির বুকে কত যুগ ধরে থেকে যাবে, তা আমাদের কারও জানা নেই। কখনও জানাও হবে না। চাচির হয়তো মনে পড়ছে কত বেলা-অবেলায় অস্থির মোমেনকে স্থির করতে বেদম পেটানো হয়েছে, কোনও কাজই হয়নি তাতে, অথচ আজ…মোমেন যেন সেই আগের প্রতিশোধটাই নিয়ে নিল চিরতরে শান্ত হয়ে গিয়ে।


মোমেন ভাইয়ের সব ভাই-বোন কাঁদছে, বুক ফাটিয়ে ফাটিয়ে কাঁদছে। আজ, এইদিনে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যাবার কথা ছিল সবার। কিন্তু তার বদলে পুরো পৃথিবীকে একপাশে করে দিয়ে অশান্ত মোমেন শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। শরীরভর্তি অগুনতি কাটাছেঁড়া, ভাঙা ভাঙা দাগের সারি। একবুক ভালোবাসা নিয়ে দেশে ফিরতে আসা মোমেন ভাইয়ের বুক ভেঙে চুরমার হয়ে আছে। বেলা ফুরাবার আগেই মোমেন ভাই অবেলায় ডুবে গেলেন।


কফিন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, ক্রমেই তা বাড়ছে। দ্রুত দাফন করতে হবে।


মোমেন ভাইয়ের হবু-বউকে আনা হয়েছে। ওদের দেখা হবে আজই। এ-দেখা প্রথম ও শেষ দেখা। হবু-বউ মুখচেপে নিঃশব্দে কাঁদছে আর দেখছে। হয়তো ভাবছে, না-হয়ে-ওঠা একটা সংসার খাটিয়ায় শুয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, এই না-হয়ে-ওঠা সংসারে আমার কত না গল্প ঝুলে আছে! কত সুখ, কত স্বপ্ন, কত আহ্লাদ, কত আনন্দ, কত মায়া-হাসি এই পোস্টমর্টেম-করা শরীরটার সাথে গাঁথা হবার কথা ছিল। কথা ছিল কত কথা হবার, কিন্তু আর কথা হলো না, আর কখনও হবেও না। এই ছিন্নভিন্ন শরীরের সাথে দাফন হয়ে যাবে দুটি মানুষের অপূর্ণদৈর্ঘ্য ঘরসংসার, স্বপ্নবসতি। প্রথম দেখা, প্রথম মুখোমুখি, প্রথম স্পর্শ করতে না পারার বেদনা…অধিকারের আগেই উপস্থিত এ কী অনধিকার! তার পর…সব প্রথমেরই শেষ। আহহ্‌…জীবন!


মোমেন ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর আসল ঠিকানায়। ছোটবেলায় মোমেন ভাই যখন হাঁটতে জানতেন না, তখন বড় ভাই তাঁকে কাঁধে তুলে এ-ঘর ও-ঘর, এ-উঠোন ও-উঠোনে নিয়ে যেতেন। মোমেন ভাই সে সময় কখনও কখনও খিলখিল করে হেসে উঠতেন, কখনও কখনও আরও আবদার জুড়ে দিতেন হয়তো। আজও সেই বড় ভাই-ই মোমেন ভাইকে কাঁধে তুলেছেন তাঁকে তাঁর স্থায়ীঘরে পৌঁছে দেবেন বলে। তবে এবার মোমেন ভাইয়ের মুখে খিলখিল হাসির শব্দ নেই। কণ্ঠে আরও একটু কাঁধে রাখার আবদারটুকু নেই। সবার চোখের সামনে নীরব, নিথর, নিশ্চল, নির্জীব, নিস্তেজ, নিস্পৃহ একজন মোমেন ভাই।


বাগানে সবার শেষে ফোটা সবচেয়ে উজ্জ্বল, রক্তিম ফুলটি সবার আগেই ঝরে গেল। দপদপ করে জ্বলা প্রদীপটি সবার আগেই হঠাৎ নিভে গেল। আজ, ঘরের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপটিকে অন্ধকার কবরে নামিয়ে দেওয়া হবে।


খাটিয়া কাঁধে তোলা হচ্ছে। কান্নার রোল বাড়তে লাগল। জ্ঞান ফিরে চাচি বিলাপ করতে করতে দৌড়ে এসে খাটিয়াধারী একজনের পা সজোরে ধরে আটকে রেখে মোমেন ভাইকে শেষ একবার দেখতে চাইছেন। দুই-চার জন মহিলা চাচিকে খাটিয়া ছাড়িয়ে আটকে রেখেছেন। খাটিয়া যত দূরে সরে যাচ্ছে, চাচির বিলাপ তত বাড়ছে। মোমেন ভাইকে যতই দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, চাচির নিজেকে ওঁদের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা ততই বাড়ছে। হঠাৎ বিলাপ থেমে গেল।


মোমেন ভাই বড় ভাইয়ের কাঁধে চড়ে গোরস্তানে যাচ্ছেন। পেছনে রেখে যাচ্ছেন একটি অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি। সাথে আর একটি মৃত্যু। সমবেত শোকার্ত মানুষের কাজ আরও একটু বেড়ে গেল। একটি তাজা শোকের প্রলেপ না শুকাতেই চোখের সামনে আর একটি সদ্যোজাত শোক। জগতের গভীরতম সত্যের যুগপৎ মঞ্চায়ন। মোমেন ভাই তাঁর মাকে সকল কান্না, যন্ত্রণা, কষ্ট থেকে চিরমুক্তি দিয়ে দিলেন। পুরাতন বন্ধনের পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে গল্পের আপাতসমাপ্তি আরও একটু দীর্ঘ হলো।


কিছু কথা লিখতে ইচ্ছে করছে। কথাগুলি লেখার আগে বলে নিই, আমার ভেতর কণামাত্রও কোনও প্রতিশোধ-প্রবণতা নেই। লোকের কাছে করার মতো অনেক গল্প আমার আছে, কারও উপর প্রতিশোধ নেবার গল্প করে আমাকে বাঁচতে হয় না।


এই মোমেন ভাইয়ের মা একদিন আমার বাবাকে তাঁদের জায়গাজমি-সংক্রান্ত ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা গ্রাম্য সালিশ-দরবার করতেন, সবার উপকার করতেন, সবাই মানত বাবাকে। জোর করে মোমেন ভাইদের জায়গা দখল করে নিয়েছিল অন্য আর একটা দল। এঁদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই বাবা খুন হয়, যদিও সেখানে বাবার কোনও সম্পৃক্ততা বা লাভ ছিল না। বাবা শুধু তাঁদের জন্য কথা বলতে গিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর সালিশে সিদ্ধান্ত হয়, মোমেন ভাইদের পরিবার আমাদের পরিবারকে দেখাশুনা করবে। আমাদের ভাইয়েরা বড় না হওয়া পর্যন্ত ওদের সামান্য কিছু জমি আমাদের পরিবারকে চাষ করার জন্য শালিসে দেওয়া হয়েছিল। বাবা মারা যাবার ছয় মাস পর ওরা ওই সামান্য জমিটুকুও কেড়ে নেয়। ওরা আমাদের পরিবারকে কোনও প্রকারের তেমন সাহায্যও করেনি, অথচ আমার বাবাকে ওদের জন্যই মরতে হয়েছিল। অনেক জমি ছিলো ওদের, তবুও ওরা আমাদের চাষ করতে পর্যন্ত দেয়নি। এখন মোমেন ভাইদের পরিবারটা আগের মতো আর নেই। ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে।


মোমেন ভাইয়া বিদেশে যাবার আগে আমার বড় ভাইয়ের সাথে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আগে কে ব্যাটিং করবে, এটা নিয়ে ঝগড়া করে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে ভাইয়ার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। তার পর থেকে ভাইয়া অনেক বছর অ্যাবনরমাল ছিল। এখনও ওই আঘাতের প্রভাব থেকে গেছে ভাইয়ার ব্রেইনে।


মোমেন ভাই মারা গেছেন, তাতে আমারও সামান্য কষ্ট হয়েছিল। মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। মৃত্যুকে কখনও প্রতিশোধের চোখে দেখতে নেই। মোমেন ভাইয়ের খাটিয়াধারীদের মধ্যে আমার বড় ভাইও ছিল। বড় ভাই সেদিন চিৎকার করে করে কাঁদছিল, আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। ওরা দুজন বন্ধু ছিল, প্রায় সমবয়সী ছিল। মোমেন ভাই ভাইয়ার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন।


মোমেন ভাইয়ের মায়েরা ভীষণ কৃপণ ছিলেন, তবে কখনও কারও সাথে দুর্ব্যবহার করতেন না। ওদের সহায়সম্পত্তি, অর্থবিত্ত, প্রভাবপ্রতিপত্তি সবই ছিল, কেবল বিবেকটা ছিল না। সেই মানুষগুলির মনে অন্যদের জন্য দয়া ছিল না। ওঁরা ধনে ধনী হলেও মনে ধনী ছিলেন না। জগতের সবাই তো আর ধনী হতে পারে না, কেউ কেউ তো পয়সাওয়ালা গরীবও হয়, ওঁরা অনেকটা ওরকমই ছিল।


আমার মায়ের সাথে কাউকেই কখনও দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। মায়ের আত্মসম্মানবোধ আমার চেয়ে দশগুণ বেশি। এ জগতে যাঁরা আত্মসম্মান নিয়ে চলেন, অন্যরা ওঁদের অসম্মান করার সুযোগ বা ইস্যু কোনওটাই কখনও পায় না। বাবা ছিল না বলে মাকে কম খেয়ে, কম রেঁধে, খুব সাধারণ হয়ে চলতে হয়েছে ঠিকই, তবে আমাদের মাকে কখনওই কারও কাছে হাত পাততে দেখিনি। সেলাইমেশিন চালিয়ে মা সংসার চালাতেন। মোমেন ভাইদের পরিবার পয়সাওয়ালা গরীব ছিলেন, আর আমার মা পয়সাহীন ধনী ছিল। ওঁদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা এখানেই। ওঁদের জায়গায় আমার মা থাকলে ওই পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব থাকত আমার মায়ের। নিজের মা বলে বলছি না, মায়ের হৃদয়টা আকাশের চেয়েও বড়। অমন অভাবের ভেতরেও মা অন্যদের সাহায্য করত, আশ্রয় দিত। তখন গ্রামে অনেক দারিদ্র্য ছিল, এখন তো মানুষের অত অভাব নেই। এমন ঘটনা ঘটতে একদিনও দেখিনি যে আমাদের বাসায় কোনও অভুক্ত গরীবমানুষ এসেছেন আর তাঁকে না খেয়ে বিদায় নিতে হয়েছে।


আর একটা কথা। সেদিন আমি নিজে তেমন কাঁদিনি, আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছিল না। ওই পরিবারের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকে বিতৃষ্ণা ছিল। আমার পরিবারের অন্যরা ওঁদের সাথে মিশলেও আমি নিজে তেমন একটা মিশতাম না। মন থেকে সায় আসত না। এখনও মিশি না। তবে ওঁরা এখনও আমাদের পরিবারে আসেন। বিশেষ করে আমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে আসেন। আমাকে বারবার যেতে বলেন ওঁদের বাড়িতে। বেশ সম্মান করে কথা বলেন। কেন, আমি জানি না। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার ভেতরে বিতৃষ্ণা একবার জমাট বেঁধে গেলে সেটা আর কখনওই গলে না।


আমাদের পরিবারে বাবা ছিল না, তার উপর আমরা ছিলাম গরীব। এরকম একটা পরিবারের মাকে যা খুশি বলা যায়। তবে আমার মাকে যা খুশি কখনওই বলা যেত না, এখনও যায় না। কারও বিরুদ্ধেই আমাদের মায়ের কোনও অভিযোগ নেই। মা ধার্মিক মানুষ, ধার্মিক মানুষের কোনও ব্যাপারেই কোনও অভিযোগ থাকতে নেই।