জীবনের চারটি খসড়া

 
স্বপ্ন

------------------
তখনও ভার্সিটিতে ভর্তি হইনি। আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি যে পরিসংখ্যানে পড়ব। ইচ্ছে ছিল, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার। কিন্তু চান্স তো পেলাম না। তো ক্লাসশুরুর আগে একটা স্বপ্ন দেখলাম। অদ্ভুত স্বপ্ন। দেখলাম, মৌর্যবংশের শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজকার্য চলছে। রাজকার্যে নবরত্ন উপস্থিত থাকেন। এখানে একটু বলে রাখি, রাজার সভাসদে ‘নবরত্ন’ মানে নয়জন সদস্য, যাঁদের বিভিন্ন দিকে জ্ঞান, প্রতিভা, পাণ্ডিত্য আছে। কেউ ভাঁড়, কেউ কবি, কেউ সংগীতস্রষ্টা, কেউ জ্যোতিষী, এরকম। আমি দেখলাম, সেই নবরত্নের এক রত্ন হলেন জীবনানন্দ দাশ! বেশ মজা পেয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখে। প্রাচীন রাজার সভাসদে এই আধুনিক কবি! ভার্সিটিতে পড়ার সময় দেখলাম আর-এক আজব স্বপ্ন! দেখলাম, একদিন সুকুমার রায়ের কাছে আমি গিয়েছি। তিনি আমাকে কোকাকোলা বানাবার সিরাপ বোতলে ঢেলে দিচ্ছেন। কী অদ্ভুত স্বপ্ন!


ভাবছেন, আপনাকে কত সহজেই স্বপ্নের কথা বানিয়ে বলে বলে বোকা বানাচ্ছি, তাই না? আমার গায়ে বিশেষ কোনও সাইনবোর্ড থাকলে এমন কথা বলবার সাহসটাও কি হতো আপনার? কত আজেবাজে স্বপ্নই তো কত সহজে চেটেপুটে খেয়ে হজম করে নিলেন এই জীবনে! আহা, আজ আমি সাইনবোর্ডবিহীন বলে…


আচ্ছা, বাদ দিই ওসব। এবার একটা সত্যিকারের স্বপ্নের কথা বলি। কীরকম? আরে, শুনুন না আগে! ওটা হচ্ছে আমার জীবনে দেখা প্রথম এবং বোধকরি শেষস্বপ্ন! তখন আমি ক্লাস-থ্রি’তে পড়ি। জীবনে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পেলাম। ছেলেটা ক্লাস-ফোরে পড়ে! সে সরাসরি প্রস্তাব দেয়নি, বন্ধু মারফত দিয়েছে। এবং, আমার সাথে কখনও সরাসরি কথা হয়নি তার। বেচারা আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করত! তখন আমাকে আর পায় কে! ভাবখানা এমন ছিল, যেন আমি সুপারমডেল নওমি ক্যাম্পবেল! পাত্তাই দিতাম না ব্যাটাকে! তো ছেলেটা অনেকভাবে আমাকে বলার চেষ্টা করত। আর আমি ওকে সামনে ঘেঁষারই সুযোগ দিতাম না! একবার তো বড়ো বোনকে দিয়ে ঝাড়িই দিয়েছিলাম! তবে ছেলেটা স্কুলে খুব পরিচিত ছিল টিচারদের কাছে। ভালো গান গাইত। ওর ক্লাসের মেয়েদের কাছে ও ছিল ক্রাশ!


তো ওই সময় বাংলা সিনেমার মতো আমার কিছু সখি জুটে যায়। এই সখিদের কাজই ছিল, ওই ছেলে আর ছেলের বন্ধুদের দেখে মুখ টিপে হাসাহাসি করা, আর আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতো দেওয়া! আমি খুব বিরক্ত হতাম! দেখা গেল, বাংলা ছবির সাইড-নায়িকাদের মতো এরা ওই ছেলে আর তার সখাদের প্রেমে পড়ে গেল! একবার হল কী, স্কুলের সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় ছেলেটার সাথে বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো ধাক্কা খেলাম! ব্যস্‌, পুরো ক্লাসে রটে গেল, আমি নাকি ইচ্ছে করে ধাক্কা খেয়েছি!


সে যাকগে, মূলপ্রসঙ্গে আসি। একদিন ভোরবেলা। আজান দিয়েছে কি দেয়নি। স্বপ্নে দেখলাম, আমাদের বাসার সামনে একটা ট্রাক না পিকাপ, তাতে সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ। লম্বা-চওড়া এক মহিলার লাশ। দেখলাম, ওই ছেলেটা লাশের উপর পড়ে কাঁদছে। লাশটা সম্ভবত ওর মায়ের। ঘুম ভেঙে গেল। আমি ঘামছিলাম। কী বিশ্রী স্বপ্ন!


সকালে স্কুলে গেলাম। প্রথম ক্লাস হুজুর স্যারের। প্রথম ক্লাসেই ওই ছেলেটার এক বন্ধু আমাদের ক্লাসে এসে স্যারকে কী যেন বলল। পরে জানতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগে ছেলেটার মা মারা গেছে! ছেলেটা এসেছে ক্লাসটিচারের কাছ থেকে ছুটি নেবার জন্য। শুনেছিলাম, আমার সাথেও নাকি সে কথা বলতে চেয়েছিল। এ জীবনে আর কখনও আমাদের কথা হয়নি। ছেলেটার নাম নোবেল। শুনেছি, পরে সে নাকি মডেল হয়েছে।


এই স্বপ্নটা আমার জীবনে দেখা মনেরাখার মতো একটা সত্যস্বপ্ন ছিল। অনেকদিন পর জানতে পেরেছি, ছেলেটার মা দেখতে লম্বা-চওড়া ছিলেন, ঠিক যেমনটা আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। তিনি মারা গিয়েছিলেন হার্টঅ্যাটাক করে। সবচেয়ে দুঃখজনক, মায়ের মৃত্যুর আগের দিন নাকি ছেলেটা আমার কথা ওর মাকে বলেছিল।


আমি সেই ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানতাম না স্বপ্নটা দেখার আগে। তাহলে কীভাবে এতকিছু মিলে গেল? আমি এই স্বপ্নের কোনও ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাইনি!


পাত্র
-------------------
গত বছর কোনও একদিন বিকেলে হুট করে বোনের স্কুলের প্রিন্সিপাল তাঁর দুজন কলিগসহ আমাকে আর বোনকে তাঁর প্রাইভেট কারে তুলে নিলেন। গন্তব্য গুলশান। যাচ্ছেন তাঁর ভাইয়ের বাসায়। কিন্তু আমাদের কেন নিয়ে যাচ্ছেন, সে উদ্দেশ্যটা আমাদের কাছে পরিষ্কার না। একটা অজানা অচেনা গন্তব্যে আমরা ছুটে চলেছি! গেলাম সেখানে। আলিশান বাড়ির বিলাসবহুল বৈঠকখানায় বসে আছি। বৈঠকখানার প্রতিটি আসবাবে, শোপিসে আভিজাত্যের সুস্পষ্ট ছাপ। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হতে আরও ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হল। প্রিন্সিপাল ম্যামের ভাইয়ের শালার জন্য আমাকে আনা হয়েছে! কিছুক্ষণের মধ্যেই পাত্র আর তার মা আসবেন মেয়ের বাসায়। ওরাও থাকে গুলশানে।


পাত্রের বাবা বিশাল ব্যবসায়ী। এই শহরের শীর্ষ দশ ধনীর একজন। সাধারণত এই পরিচয় থাকতে পাত্রের আর কোনও পরিচয়ের দরকার থাকে না। সমাজে পুরুষের যোগ্যতার মাপকাঠি একটাই! এই সমাজে অর্থের দাঁড়িপাল্লায় পুরুষকে পণ্যের মতো বসিয়ে মাপা হয়। সে বিচারে পিতার ব্যবসায়ে অধীনস্থ এই আলালের ঘরের দুলাল, পাত্রীর পরিবারে চকচকে লোভনীয় অতিউপাদেয় পণ্য।


আমার সামনে সোফায় বসা পাত্র। সে নর্থ-সাউথে পড়েছে। ইংরেজি ছাড়া বাংলায় কথা বলে না! পাত্রকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল! লজ্জায় তাকাতে পারলাম না! এই লজ্জা আমার জন্য না, তার জন্য! বিশাল হস্তিকায় পাত্রের উপচে-পড়া থলথল ভুঁড়ির ভারে প্যান্টটা কোনওমতে প্রান্তসীমায় ঠেকে শেষলজ্জাটুকু নিবারণের অহেতুক চেষ্টা করছে মাত্র! এই বিশালদেহীকে বিবাহ করে বহন করা দূরে থাক, এখনই তো সহনই করতে পারছি না!


পাত্রের মা অতিশয় আধুনিকা, মিশুক। আমার জন্য নিজহাতে কাচ্চি বিরিয়ানি, জাফরানি সেমাই আর পুডিং রেঁধে এনেছেন! আসলে বড়োলোকের কারবারই আলাদা! একটা সময় পাত্রের সাথে আলাদা করে কথা বলিয়ে দেবার জন্য আমাকে আলাদারুমে পাঠানো হলো! পাত্র বড়োলোকের হাবাগোবা আলাভোলা অতিশয় আদুরে পুত্র! যা-ই প্রশ্ন করে, বেশ ভাবটাব নিয়ে উত্তর দেই! আগ বাড়িয়ে বললাম, আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশও যাব! এ কথা শুনে যদি সে পাত্র পিছায়, সে আশায়! বরং হিতে বিপরীত হলো যেন! উলটা পাত্র আরও সনির্বন্ধ দৃষ্টি মেলে আমায় দেখল! আমি এখন কী করি, কী করি!


খানিক পরে বেশ ভাব নিয়ে বললাম, আমার ফেসবুক আইডির নাম নিশিগন্ধাবীথিকা! বেচারা দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে চারগুণ ত্বরিতগতিতে মোবাইলটি নাভির নিম্নদেশে কোনওমতে অবহেলায় আটকে-থাকা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে সার্চ দেওয়া শুরু করল! কিন্তু বিধাতা মাঝে মাঝে বড়ো বেরসিক আচরণ করেন! আমার বাংলা আইডির ওই ভজঘট লেখা পড়বার জন্য বাংলা নাম লিখে সার্চ দেবার সামর্থ্যই তার নেই!


এখানেই বড়োলোক নীরব! এখানেই বড়োলোকি, জারিজুরি শেষ! কারণ ইংরেজি গানের রিংটোন-বাজা তার দামি মোবাইলটিতে বাংলা নামক অচ্ছুৎভাষার কোনও অ্যাপই নামানো নেই! শত চেষ্টাচরিত্রের পর ব্যর্থ হয়ে আমাকেই অনুনয় করল, আমিই যেন তাকে রিকোয়েস্ট দেই! আমি হুঁ হ্যাঁ হুম করে সেদিন রাত্তিরে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।


পাত্র রাজি! অতএব পাত্রের মাতাও রাজি! অতঃপর মাতা যেখানে রাজি, সেখানে পিতা রাজি না হয়ে কেন হবেন পাজি? এদিকে পাত্রীও রাজি! তবু বিয়েটা পড়ালেন না কাজি! কেননা পাত্রী তো সবই পছন্দ করেছে। বিশেষ করে, হবু শাশুড়িআম্মাকে আর পাত্রের বোন হবু ননাসকে তার যারপরনাই পছন্দ হয়েছে! শুধু পাত্রটাই পছন্দের বাকি ছিল!


পুনশ্চ। আজ সকালে প্রিন্সিপাল ম্যাম ফোন করেছিলেন দিয়েছিলেন আমার বোনকে। গতকাল রাতে স্ট্রোক করে মারা গেছে সাকা নামের বিশাল ঢাউস অবয়বের সেই ছেলেটা!


চরিত্র
----------------------
মানুষের চরিত্রের সাথে পেশার কোনও সংযোগ নেই। কেউ বলে শিক্ষকের চরিত্র খারাপ, কেউ বলে ডাক্তারের, কেউ বলে পুলিশের, কেউবা অন্য কিছুও বলে। আমি এসবে বিশ্বাসী না। সব পেশার লোকই ভালো, আবার সব পেশাতেই খারাপ লোক থাকতে পারে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে অনেক হাই-প্রোফাইলের লোক আছে। ইনবক্সে অনেকেই ডিস্টার্ব করে, ব্লক করে দিই। এর মধ্যে তিনটা কেইস নিয়ে বলি।


১। এক ডাক্তার ছেলে চীনে থাকে। চীনে ডাক্তারির উপর ডিগ্রি নিয়েছে। তো ইনবক্সে আমাকে প্রায়ই ডিস্টার্ব করত। বলে, সে এই সে সেই। সে কার কার যেন ভাগনে, কে কে যেন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়, তার বাড়ির লোকজন অনেক পাওয়ারফুল, এই জাতীয় নানা হেন তেন। তার সাথে যোগাযোগ রাখলে আমার অনেক লাভ হবে নাকি! আমি রিপ্লাই না দেওয়াতে সে আপত্তিকর ভিডিও পাঠায়। ব্লক করে দিই।
২। এই লোক একটা পাবলিক ভার্সিটির টিচার। অনেক নামকরা মানুষ। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার-এর মতো পেপারে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন চ্যানেলে তাঁকে দেখা যায় টক-শো’তে। ভীষণ ভীষণ সুন্দর করে কথা বলেন, কথা শুনলে মুগ্ধ হতে হয়। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। স্ত্রী নেই, কিংবা কয়েকজন ছিলেন, এখন নেই। খুব চমৎকার কথাবার্তা লিখেন ফেসবুকে, কয়েকটা বইও লিখেছেন। অসংখ্য নারী গুণগ্রাহী তাঁর, এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, এমন একজন মানুষও আমাকে সময় দেন! এবং, খুবই আন্তরিকতা দিয়ে। আমার প্রতি একটু বেশিই আন্তরিক তিনি! এতটা বেশি যে, এটাকে ঠিক আন্তরিকতা মনে হয় না, বিরক্তি মনে হয়। শুধুই দেখা করতে বলেন, বিদেশি গিফট দিতে চান, বিকাশে টাকা পাঠানোর কথা বলেন। সংকোচে ব্লকও করতে পারি না, এত বড়ো একজন মানুষ!
৩। একজন ফেসবুক সেলিব্রিটি। তাঁর আইডিও ভেরিফাইড। দেশ, সমাজ, সমসাময়িক নানান বিষয়, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি নিয়ে তাঁর উদ্‌বেগ নেটিজেনদের কাছে সুবিদিত। তিনি আমাকে মাঝেমধ্যে ইনবক্সে নক দেন। কখন দেন? বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে। হয়তো তখন তাঁর একা একা লাগছে, হয়তো তখন তাঁর একজন নারীকে শাড়ি-পরা অবস্থায় দেখতে ইচ্ছে করছে, হয়তো তখন তিনি মদ্যপান করছেন বলে কাউকে একান্তে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েদের বিরক্ত করাটাকে তিনি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন!
…আরও অনেকে আছেন। কাউকে কাউকে ব্লক করে দিই, কাউকে কাউকে করি না। কেন করি না? মানবচরিত্রকে বিশ্লেষণ করতে ভালো লাগে। মানুষের মুখ ও মুখোশের দূরত্বটা খুব কাছ থেকে বুঝতে ভালো লাগে। এত বড়ো বড়ো মানুষকে একটা মেয়ের কাছে এসে অসহায় হয়ে যেতে, নতিস্বীকার করতে…দেখতে ভালো লাগে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি একটা বদ মেয়ে। এবং আপনারা পুরুষরা এক-একটা বদনা!


হিমু
---------------
আমার জীবনে এ পর্যন্ত তিনজন ‘হিমু’র সাথে পরিচয় হয়। তবে এক-এক চরিত্র আমার কাছে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়।


আজ থেকে পনেরো বছর আগে প্রথম হিমু, মানে আমার প্রাক্তনের সাথে পরিচয় হয়। সে ছিল আমার দেখা সবচেয়ে নিরীহ চরিত্রবান পুরুষ। ছাপোষা এবং ধার্মিক। কিন্তু আমাদের দুজনেরই কমন একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। আমরা দুজনই ছিলাম প্রচণ্ড জেদি। জেদের কারণেই আমি তাকে হারিয়েছি। ব্রেকআপ করে দিয়েছিলাম জেদ থেকেই। ছেলেটা ছিল এতিম, নিঃস্ব, সংগ্রামী। ব্রেকআপের পর এক বছর কান্নাকাটি করে অবশেষে বিয়ে করে গৃহস্থ হয়।


কামিনী রায়ের কবিতায় পড়েছিলাম, না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নর---বিধাতা মানুষের কান্নাকে অবহেলা করেন না। আমার মনে হয়, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যে কষ্ট দিয়েছিলাম, তার প্রায়শ্চিত্ত আজও করে বেড়াচ্ছি। তবে এটাও ঠিক, আমাদের বিয়েটা সুখের হতো না। কারণ সে ছিল সামাজিক মাপকাঠিতে আমার অযোগ্য। এ সমাজে সুখপরিমাপের দণ্ড হলো---কেবলই সংখ্যা আর অবকাঠামো। সে বিচারে সমাজকে উপেক্ষা করে আমার চেয়ে অনেক অনেক কম শিক্ষিত আর্থিক দৈন্যগ্রস্ত একটা ছেলেকে ভালোবেসে স্রোতের বিপরীতে হাঁটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। সমাজ আমাকে কিছুতেই সুখী হতে দিত না।


এত বছর পর এখনও সে আমাকে ভুলতে পারেনি। এখনও মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়। আমার মা-ভাইয়া দুজনের জানাজাই পড়েছে। প্রতিদিন তাঁদের জন্য সে দোয়া করে। এখন আর আমার তার প্রতি প্রেম বা ভালোবাসার অ্যাফেকশনটা নেই। যেটা আছে, সেটা হলো বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা। ভেবে রেখেছিলাম, আমার যদি কখনও বিয়ে হয়, তখন তাকে দাওয়াত দিব। সত্যি বলতে কী, জীবনের এই অর্ধেক সময়টাই আমি খামখেয়ালিপনা, একগুঁয়েমি, স্বেচ্ছাচারিতা করে কাটিয়ে দিয়েছি। প্রচণ্ড আবেগি একটা মেয়ে আমি। সব সময়ই লজিক না বুঝে অ্যান্টিলজিকে চলা মানুষ আমি। কতবার যে কতভাবে বিপদে পড়তে গেছি! প্রতিবারই কীভাবে যেন কোনও এক মহাশক্তি আমাকে উদ্ধার করেছে।


এরপরও আমি সৃষ্টিকর্তার উপর খুব একটা কৃতজ্ঞ না। জীবনে এত এত পোড় খেয়ে এসে ঠিক এই মুহূর্তে আমি সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি অবস্থায় আছি। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না, আবার অবিশ্বাসেরও কারণ দেখি না। সবকিছুতে অ্যান্টিলজিক-মানা আমি শুধু থিওলজিতে লজিক খোঁজার চেষ্টা করি। ধর্মের অনেক কিছুতেই আমি লজিক খুঁজে পাই না। আর যা-কিছুতে আমি কোনও লজিক পাই না, তা-কিছু আমি মন থেকে পালন করতে পারি না। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে ঈশ্বরের সমীপে নৈবেদ্য হিসেবে দান করেছিলাম। ধ্যান করে আর নামাজ পড়ে ঈশ্বরের সাথে আমার একধরনের যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছিল। না বাস্তব না পরাবাস্তব, এমন এক অদ্ভুত জগতে চলে গিয়েছিলাম। ঈশ্বরের সাথে এই যোগাযোগস্থাপনে নিজেকে অসম্ভব শক্তিধর মানবী বা সুপারপাওয়ার ওমেন ঠাওরেছিলাম। আমি আবারও নিজেকে ঈশ্বরসমীপে সমর্পণ করতে চাই। আবারও যোগাযোগস্থাপন করতে চাই। আমার মানসিক পরিত্রাণ আর প্রশান্তি দরকার। আমার আরোগ্য দরকার।


এখন আমি আলাপ করব আমার জীবনে-আসা দ্বিতীয় ‘হিমু’ নিয়ে। এই মানুষটা হয় দেবতা, নয় দানব। এই জীবনে তাঁর চাইতে ব্যাখ্যাতীত মানুষ আমি কখনও দেখিনি।


গত বছর শেষের দিকে। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। সুইসাইড করার সাহস নাই অথবা কিছুটা হলেও পরকালের ভয় আছে। কী করব? কিছুই করার নাই এভাবে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা ছাড়া! শেষে টানা নামাজ পড়ে গেলাম। প্রতি ওয়াক্তে দুই রাকাত করে নফলনামাজ পড়ি, আল্লাহ্‌র কাছে মৃত্যুর পরোয়ানার জন্য কান্নাকাটি করি। রাস্তাঘাটে ইচ্ছে করে এলোমেলো হাঁটি, যাতে অ্যাক্সিডেন্ট হয়।


একদিন থানাস্ট্যান্ডে ট্রাকের সামনে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটা ট্রাক আসি আসি করছে। পাশে দাঁড়ানো রাস্তা পার-হওয়া মহিলা আমাকে ঝাড়ি দিলেন, ‘আপনি যে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, ট্রাক ধাক্কা দিলে?’ আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, ‘মরলে মরব!’ তখন উনি বললেন, ‘মরবেন তো না, পঙ্গু হয়ে যাবেন।’ ওঁর কথা শুনে ভয়ে পেছনে সরে এলাম। আমি মরতে রাজি, কিন্তু পঙ্গু হতে রাজি না।


এমনই এক সময় একদিন ইনবক্সে এক অচেনা বন্ধুর মেসেজ। এখানে বলে রাখি, আমি সবার রিকু নিই না। যাঁরা লেখালেখি করেন, ছবি আঁকেন, গান গাইতে পারেন, কিংবা কোনও না কোনও সৃজনশীল কাজের সাথে জড়িত, তাঁদের অ্যাড করি। কেউ যদি সমাজের অনেক উঁচু অবস্থানেরও হন, কিন্তু সৃষ্টিশীল না হন, তবে এমন কাউকে কখনও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে রাখি না। যাঁর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা নেই, সেই গতানুগতিক মানুষের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ কাজ করে না। আবার আমার একটা মানসিক সমস্যাও আছে। ইনবক্সে কেউ আমাকে নর্মাল একটা হাই-হ্যালো বললেও তাকে আনফ্রেন্ড করে দেই! হাই-হ্যালো বাদে অন্য যে-কোনও লেখা পাঠালে বা প্রশ্ন করলে আমি এই কাজটা করি না।


তো ইনবক্সে সেই আগন্তুক যা লিখলেন, তা অনেকটা এরকম-আমি শখের বশে দর্শন পড়াই। আমার পড়ানোর টেকনিকের উপর একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই। আপনি যদি আগ্রহী থাকেন, তবে আমি আপনাকে পড়াতে চাই। আবার এমনও হতে পারে আপনি নিজেই দর্শনের শিক্ষক!


কেউ স্বেচ্ছায় পড়াতে চায় একালে, এমন অদ্ভুত মেসেজ দেখে আমার ভ্রূকুটি হলো, এবং প্রথমেই স্বার্থপর বাঙালির যে চিন্তা মাথায় এল---পড়ানোর জন্য ফি নিবে? না ফ্রি পড়াবে?...আহা, বিদ্যা এমনই সস্তা আমাদের কাছে যে এটা আমরা ফ্রিতে নিতে চাই! টাকা দিয়ে নেবার মতো এতটা মূল্যবান জিনিস বিদ্যা নয়, অন্তত বাঙালির কাছে নয়! তো রিপ্লাই দিলাম ওঁকে। কেন পড়াতে চায়, কী উদ্দেশ্য, কোনও টাকা নিবে কি না, এসব জিজ্ঞেস করে টেক্সট পাঠালাম।


উত্তরে উনি কী লিখলেন, তা লেখার প্রয়োজন মনে করছি না। সামনের বিবরণেই তা বোঝা যাবে!


পাঠদান শুরু হল। ভার্চুয়াল-প্লাটফরমে সে ভাইয়ার অনেক স্টুডেন্ট। এর মধ্যে ৬০-৬৫ বছর বয়সের মানুষও আছেন। সেখানে আমিও নতুন বিদ্যার্থী হিসেবে যোগ দিলাম। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি একটু ভিন্ন। শুরুতে ছবি পাঠাতে হবে, নিজের ছবি নয়, নিজের পছন্দের কোনও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের ছবি! সাথে নিজের সম্পর্কে এমন কিছু লিখে দিতে হবে, যা আমি কখনও কাউকে বলিনি। আরও লিখতে হবে, আমার চোখে আমার সবচাইতে কাছের মানুষটির জীবন নিয়ে কিছু ভাবনা, যা আমি ওই মানুষটিকে বলার সাহস কখনওই করতাম না। আরও অদ্ভুত কত কী!


ওটা ছিল আমাদের ইন্টারঅ্যাকশনের আইসব্রেকিং সেশন! এরপর শুরু হলো ‘ভাবনা-প্রক্ষেপণ’। এটা হচ্ছে আমি নিজের ও নিজের আশেপাশের জগত সম্পর্কে কী জানি না, কিন্তু জানতে চাই, এমন কিছু ব্যাপার ওঁকে জানানো। শর্ত হলো, কোনও দার্শনিকের তত্ত্ব ধার করে নয়, নিজের মতো করেই সব লিখতে হবে। এরপর হচ্ছে লেখালেখির কাজ। উনি বিভিন্ন টপিক নিয়ে লিখতে বলতেন। কোনও রেফারেন্স দেখে নয়, কারও কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নয়, নিজের মাথায় যা আসে, তা-ই লিখতে হবে। মাথায় কিছু না এলে জোর করে এনে হলেও লিখতে হবে। কিছু আর্টিকেলের লিংক দিতেন, সেগুলি নিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে লিখতে হবে, আর্টিকেল থেকে কিছুই কপি করা যাবে না। লেখায় ভুল হলেও কোনও সমস্যা নেই। উনি সাথে সাথেই ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে সেটা কেন ভুল, কীভাবে লিখলে ঠিক হতো, এসব খাতায় লিখে মোবাইলে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতেন।


ও আচ্ছা, ওঁর চারটা শর্তের কথা বলি, যেগুলি আমাদের পালন করতে হয়। এক, কখনওই ওঁর মোবাইল নম্বর চাওয়া যাবে না, তবে ওঁকে যখন তখন মেসেঞ্জারে কল করা যাবে। দুই, কখনওই ওঁর সাথে দেখা করতে চাওয়া যাবে না। (উল্লেখ্য, ভাইয়া কখনওই নিজের কোনও ছবি ফেসবুকে দেন না।) তিন, ওঁর সাথে ইনবক্সে বা ভয়েসকলে কী কথা হলো, তা এই পৃথিবীতে উনি আর আমি বাদে আর কেউ যেন কখনওই জানতে না পারে। চার, যদি কখনও কোনও না কোনও কারণে ওঁর সাথে আমাদের কারও দেখা হয়ও, সেটা নিয়ে কাউকে কিছুই বলা যাবে না।


রহস্য রহস্য লাগছে না? ধৈর্য ধরে পড়ুন, এই রহস্যমানবকে কিছুটা বুঝবেন সামনে।


একদিন তাঁকে ইনবক্সে বললাম, ভাইয়া, আমার ইংরেজিতে অনেক সমস্যা! উনি আমার জন্য ইংরেজির বিভিন্ন বেসিক নিয়ম ও অনুশীলনের স্যাম্পল পাঠিয়ে দিলেন। ওঁর লাইব্রেরিতে অনেক বই। সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে, কী কী পড়লে আমি ইংরেজির খুঁটিনাটি সহজে শিখে ফেলতে পারব, তা তা পাঠিয়ে দিলেন। এরপর থেকে উনি নিজেই আমাকে ইংরেজি শেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলেন! শুধু তা-ই নয়, উনি আমাকে যেভাবে যেভাবে পড়তে বলছেন, আমি সেভাবে সেভাবে আদৌ পড়ছি কি না, তা পরীক্ষা করতে উনি নিজেই কিছু এক্সারসাইজ তৈরি করে পাঠিয়ে দিতেন। কিছু টপিক দিয়ে বলতেন, সেগুলির উপর ইংরেজিতে লিখে ওঁকে পাঠাতে। আমি কোথাও কোনও ভুল করলে উনি অনেক ধৈর্য নিয়ে সেগুলি ঠিক করে দিতেন। কোনটা কেন ভুল, তা বুঝিয়ে দিতেন উদাহরণসহ।


তিনি মাঝেমধ্যে আমাদের জীবনের নানান কষ্টের কথাও শোনেন। কারও কোনও আর্থিক সমস্যা আছে কি না, ব্যক্তিগত জীবনে কোনও যন্ত্রণার মধ্যে আছে কি না, কিংবা অন্য যে-কোনও ব্যাপারে হেল্প লাগবে কি না, সব ধরনের খোঁজখবর নিতেন। এবং, অবাক-করা ব্যাপার হলো, উনি সত্যি সত্যিই সবার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়ে দিতেন কিংবা কোনও কাজে নিজেকে ইনভলভড করতে হলে তা-ই করতেন। কেউ খুব বেশি সমস্যায় পড়লে তাকে মেসেঞ্জারে কল করে তার সাথে কথা বলে সেই সমস্যার একটা না একটা সুরাহা করে দিতেন। কারও কারও কাছে ভাইয়ার মোবাইল নম্বরটি ছিল, তবে ওদের কেউ প্রাণ গেলে সেটি অন্যকে দিত না। হয়তো ওদেরই কোনও একটা কাজে ভাইয়া তাঁর নম্বরটি ওদের দিয়েছেন, ব্যাপারটা এমন। আমাদের উনি রীতিমতো সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। ওঁকে ব্যাখ্যা করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। উনি ছিলেন অনেকটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের হোসেন মিয়া ক্যারেকটারটির মতো।


ফেসবুকে তাঁর একটা গ্রুপ আছে। নাম, দর্শনের ক্লাস। আগে উনি নিজের বাসাতেই স্টুডেন্টদের পড়াতেন। এখন স্টুডেন্ট বেড়ে যাওয়ায় বাসায় আর জায়গা হয় না। তা ছাড়া সবার পক্ষে নির্দিষ্ট একটা সময়ে ওঁর বাসায় যাওয়াও একটা ঝামেলার ব্যাপার। তাই উনি ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছেন পড়ানোর সুবিধার্থে। এখন তাকে সব সময়ই এখানে পাওয়া যায়। আমাদের সব ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট গ্রুপের ওয়ালেই দিয়ে দেন। সেগুলি রেডি করে ওঁকে ইনবক্সে পাঠাতে হয়। উনি প্রতিটি আলাদা আলাদা করে পড়েন, এবং প্রতিটির ব্যাপারেই প্রতিজনের সাথে ইনবক্সে কথা বলেন। দরকার হলে ফোনও করেন, মেসেঞ্জারে।


উনি কিন্তু বেকার নন, ভালো একটা চাকরি করেন। নয়টা-পাঁচটা তাঁর অফিস। কিন্তু ওঁকে সব সময়ই পাওয়া যায় যে-কোনও প্রয়োজনে। একদম সব সময়ই! তাঁর পড়ানোর নিয়ম হলো, জীবন ও জগত সম্পর্কে নানান কিছু নিয়ে ভাবতে উনি আমাদের বাধ্য করবেন। কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নানান জটিলতা নিয়েও তাঁর সাথে কথাবলা যায়। এবং সেটা অবশ্যই ভেরি কনফিডেনশিয়ালি। একজনের কথা অন্যজন ভুলেও জানতে পারবে না, এমন। এমন ঘটনা ঘটে, হয়তো উনি আমাকে, কোনও একটা ব্যাপারে, যে ব্যাপারটা আমার নিজের স্বার্থেই দরকার, একটা কাজ করতে দিলেন। সাথে বেঁধে দিলেন একটা ডেডলাইন। আমি হয়তো নিজেই কাজটা করতে ভুলে গেলাম বা মনে থাকলেও ফাঁকিবাজি করে কাজটা করলাম না। কিন্তু ওঁর হাত থেকে আমার রেহাই নেই। আমাকে অনলাইনে দেখলেই উনি নক করে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কাজটা করেছিলাম কি না, আমার সমস্যাটার সমাধান হয়েছিল কি না, আমার আরও কোনও হেল্প লাগবে কি না। মাঝেমাঝে ওঁর এরকম স্নেহের ভয়ে আমি ফেসবুকেই আসি না দিনের পর দিন।


কোনও একটা বিষয় নিয়ে একবার লাগলে সেটা শেষ না করা পর্যন্ত উনি ছাড়েন না। কেউ অসুস্থ, ভাইয়া ঠিকই চলে যাবেন তাঁকে দেখতে, এবং সেটা অবশ্যই আমাদের কাউকে জানতে না দিয়ে। যদি দরকার হয়, সেই মানুষটির সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেবেন। (আমার বড়ো ভাইয়া যখন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন, যখন আমার তথাকথিত আত্মীয়স্বজনদের পাশে পাচ্ছিলাম না, তখন এই রহস্যমানব ভাইয়াই পাশে ছিলেন---একেবারে বড়ো ভাইয়ার জানাজা পড়ানো পর্যন্ত।) দেখা গেল, আমার কোনও বান্ধবীর বাবা কোনও একটা সমস্যায় পড়েছেন। ওঁকে বললাম। এরপর উনি সেটার পেছনে লেগে থাকবেন এবং কাজটা করেই ছাড়বেন।


এই মানুষটার উপর আমি যে কী পরিমাণ নির্ভরশীল হয়েছি, বলে বোঝাতে পারব না! রাতে ভয় পেয়েছি, ওঁকে ফোন করেছি। কারও সাথে ঝগড়া হয়েছে, ওঁকে বলেছি। বাসায় বকা খেয়েছি, ওঁর কাছে সমস্ত অভিযোগ জমা করেছি। একেবারেই ব্যক্তিগত কোনও ইস্যু, যা আমি হয়তো আমার বন্ধুকেও বলতে পারছি না, তা-ও ভাইয়াকে বলেছি। সব সব সব কথকতা এই ভাইটির কাছে জমা করি। আমার সকল ধরনের ডিপ্রেশন দূর করে দেওয়ার এক আশ্চর্য জাদুকর এই ভাইয়াটি!


ওঁর সাথে মিশে মিশে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও ঠেকে গেলে এই মানুষটার কাছে আশ্রয় খুঁজেছি। আমার সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেছে! হুমায়ূন আহমেদের গল্পে কিছু মানুষ থাকে, যাদের মানুষকে সম্মোহন করার অদ্ভুত শক্তি থাকে। ভাইয়াটি তেমনই। যেদিন আমার আইডিটা ডিজঅ্যাবলড হয়ে গেল, সাথে সাথে ওঁকে ফোন করি। আমার পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিই। আমার আইডি ফেরত পাব কি পাব না, এটা নিয়ে কোনও কিছুই না ভেবে, এমনকি নিজে কোনও চেষ্টা না করে সমস্ত কিছুই ওঁর উপর ছেড়ে দিয়ে আমি নির্ভার হয়ে আছি। ভালো কথা, ভাইয়া লেখালেখিও করেন। বাংলাদেশে যে দুই-একজন মানুষ অ্যাক্রোস্টিক ধারায় কবিতা লেখেন, তিনি তাঁদের একজন।


প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো ভাবছেন, লোকটার কোনও বদমতলব আছে। কিংবা আমার সাথে প্রেমের সম্পর্ক হতে যাচ্ছে তাঁর! না, এই পৃথিবীতে বফ - গফ সম্পর্কই শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক না। এর বাইরেও অনেক বিশ্বাসযোগ্য আস্থাভাজন সম্পর্ক আছে। এই মানুষটা আমার কাছে তেমনই। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় নিঃস্বার্থ বড়ো ভাই। তাঁর সম্পর্কে শুরুতে বলেছিলাম, তিনি হয় দেবতা, নয় দানব। এর মাঝামাঝি কিছু নন একদমই! হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে পেয়েছি, অতিমহাপুরুষ আড়ালে আড়ালে গডফাদারও হয়েছে। তেমনটা হলেও আমার কোনও সমস্যা নাই! কোথায় যেন পড়েছিলাম, সবাইকে বিশ্বাস করা বিপজ্জনক, আর কাউকেই বিশ্বাস না করা আরও বিপজ্জনক!


আমি আজ পর্যন্ত কখনও জানতে পারিনি এই ভাইয়াটির মনে কোনও কষ্ট আছে কি না। উনি একদিনও নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেন না কাউকে। তিনি বিবাহিত, দুই সন্তানের পিতা। পারিবারিকভাবে তিনি নিজেকে অসম্ভব সুখী মনে করেন। গত ১৪ বছর ধরে উনি মানুষের কষ্ট ও হতাশা নিজের বুকে ধারণ করে বেড়ান। কাকতালীয়ভাবে ওঁর সাথে সব হতাশাগ্রস্ত মানুষের পরিচয় হয়। এইসব মানুষ ওঁকে পরম আপন ভেবে সমস্ত কষ্ট ওঁকে দিয়ে দেন। আর উনি কষ্টগুলি নিয়ে এই শহরের হিমু হয়ে ঘুরে বেড়ান। আমার চাকরি হওয়ার পর প্রথম ফোনটা দিই বাবাকে। এরপরের ফোনটা এই ভাইয়াকে। তাঁকে বললাম, ভাইয়া, আমি কাঁদছি! উনি বললেন, কাঁদেন।


ভাইয়ার চোখেও পানি, তিনিও কাঁদছেন। কেন, জানি না।


পুনশ্চ। ভাইয়া আমাকে ফেসবুকে নক দিলেন কেন, তা বলা হয়নি। আমাকে উনি চিনলেনই-বা কীভাবে? আমি আগেই বলেছি, ভাইয়ার সাথে পরিচয় হওয়ার সময়ে আমি কিছু ব্যাপার নিয়ে চরম ডিপ্রেশনে ছিলাম। তো আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমার ব্যাপারটা ওর বড়ো ভাইয়ার সাথে আলাপ করেছিল। সেই রাগিব ভাইয়া ছিলেন ‘দর্শনের ক্লাস’ গ্রুপের সদস্য। তিনিই রহস্যমানবকে ভাইয়াকে আমার ব্যাপারে বলেছিলেন। তো পরবর্তীতে বান্ধবীর কাছ থেকে এটা জানতে পারি এবং রাগিব ভাইয়ার সাথে আমার যোগাযোগ হয়। একসময় আমাদের প্রতিদিনই ফোনে কথা হতো। যেদিন আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল, সেদিন আমার সাথে দেখা করতে আসার পথে রোড অ্যাক্সিডেন্টে রাগিব ভাইয়া মারা যান।


আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে মানুষটি আমাকে বাঁচার একটা রাস্তা খুঁজে দিলেন, বাকি জীবনটা আমি শুধুই সেই মানুষটির স্মৃতিকে বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেবো। আর কোনও হিমুকে আমার লাগবে না।