তবুও অপেক্ষা/ চার

 
এরপর আরও বহুদিন চলে গেল। শেষপর্যন্ত, হয়তো ছেলের চাপে, ওর বাবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হলেন। আসলে আমাদের পরিবার যেমন একটার পর একটা শর্তের কারণে রাজি ছিল না, তেমনি ওর বাবাও হয়তো রাজি না অনেক কারণে। হতে পারে, আমি মাতৃ-পিতৃহীন কন্যা, জলেভাসা মানুষ, আমার কোনও দাম নেই। অতএব, জামাই, শ্বশুর-শাশুড়ির আদর-যত্ন আমি পাব না। আমাদের অত টাকাপয়সা নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাব, তা-ও কারও কাছে ছোট হতে পারব না। তারপর একদিন ওদের বাসায় আমাদের পরিবারের যাবার তারিখ ঠিক হলো। দুই পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হলো। প্রথম যেদিন ছেলেটা আমাদের বাসায় এল, তখন থেকে ওই পর্যন্ত আসতে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে এক বছর হয়ে গেল। এই এক বছরে ওই ছেলে আমার সাথে খুবই মার্জিতভাবে শিষ্টাচারের সাথে কথা বলত। আমাদের কথা হতো সাহিত্য, সাধারণজ্ঞান, ভূগোল এসব বিষয়ে। আমরা একে অপরকে আপনি আপনি করে বলতাম। সে আমাকে মাঝে মাঝে অতিভদ্রতায় জ্বি মহামান্যা, জ্বি মহাশয়া এসব সম্বোধন করত। শুনে আমি খুব মজা পেতাম।


তো যেদিন বিয়ের ডেট ঠিক করতে আমার পরিবার ওর পরিবারে গেল, সেদিন সারাদিনই ওর সাথে আমার ইনবক্সে আপডেট আদানপ্রদান হচ্ছিল। কিন্তু বিয়ের ডেট কবে ঠিক হয়েছে, সে কিছুতেই লজ্জায় বলতে পারছে না। শেষে ডেট শোনার জন্য আমার বোনের বাসায় ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। রাত এগারোটায় ওরা ফিরলে জানতে পারলাম বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে ১ নভেম্বর ২০১৯। বোন আর দুলাভাইকে খুব চিন্তিত দেখাল। কারণ তারা এখন অনুষ্ঠান করবে না। কিন্তু কনেপক্ষের অনুষ্ঠানে ৩০০ বরযাত্রী নিয়ে আসবে। এর একজনও কমানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। আমার মামা-মামিরা অনেক অনুরোধ করলেন, কিন্তু তারা মানলেনই না। পরদিন ছেলেকে ফোন করে বললাম, আপনি আমার সবকিছু তো জানেনই, আমার বোন আর দুলাভাইয়ের উপর এত চাপ দিতে আমি চাই না, আপনি যদি আপনার বাবাকে বলে বরযাত্রী কমাতে পারতেন, খুবই ভালো হতো।


এটা শুনে হঠাৎ সে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। আমাকে অনেক কথা শোনাল। এ-ও বলল, তার পক্ষে এটা তার বাবাকে বলা সম্ভব না। আমি যেন আমার মুরুব্বি দিয়ে বলাই। আমি তাকে বললাম, আমার মুরুব্বিরা তো বাধ্য হয়ে মেনেই এসেছে, এখন তাদের দিয়ে কীভাবে বলাই? এই নিয়ে আমাদের অনেকক্ষণ ধরে বাকবিতণ্ডা চলল। আমিও প্রচণ্ড রেগে গেলাম। রাগ করে তাকে ফেইসবুকে ব্লক করে দিলাম। আবার রাগ কমলে একদিন পর ব্লক খুলেও দিলাম। সামনে ছিল কুরবানির ঈদ। ঈদের দিন ওদের বাড়ি থেকে কেউ ফোন দিল না, ছেলেও না। আমার তো আর নিকট গার্ডিয়ানই নেই ফোন দেবার। সারাদিন কাঁদলাম। এরপর আর ওর পরিবার থেকেও কেউ যোগাযোগ করল না, আমার পরিবার থেকেও না।


আবার প্রচণ্ড হতাশ হয়ে গেলাম। নিজের দুঃখ ভোলার জন্য সম্পর্কে জড়ালাম, আরও দ্বিগুণ দুঃখ পেয়ে ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এলাম। একদিকে চাকরি নাই, অন্যদিকে সান্ত্বনা পাবার জন্য বাবা, মা কারও সাপোর্ট নেই। আমার একজীবনে শুধু যদি আমার মা-টা পাশে থাকত, তবে আর কিছুই চাইতাম না জীবনে। শুধু মায়ের সাথে থেকে জীবনের সমস্ত অর্জন আর ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে আমৃত্যু কাটিয়ে দিতে পারতাম। তখন এত কিছুতে এত কষ্ট পেতাম না, এত ভালোবাসা কুড়াতেও যেতাম না কোথাও।…সে সম্বন্ধটা ভেস্তে যাবার পর প্রতিদিন নামাজ পড়ে, নফল নামাজ পড়ে স্রষ্টার কাছে কান্নাকাটি করতাম। এমন একটা দিন নাই, যে দিন আমি কাঁদিনি, এবং এখনও অনেক কাঁদি। আত্মহত্যা মহাপাপ, সেই দুঃসাহসও নেই আমার। তাই নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহ্‌র কাছে মৃত্যু চেয়েছি বহু বহুবার। রাস্তাঘাটে এলোপাথাড়ি চলতাম, যাতে অ্যাক্সিডেন্টে মরি। এমনই হতভাগ্য আমি, মরিও না রাস্তাঘাটে! কিছু মানুষ এতটাই দুর্ভাগা যে মৃত্যুও ওদের উপেক্ষা করে।


এতবার বিসিএস দিচ্ছি, তা-ও হচ্ছে না। আসলে আমার তেমন মেধা নেই। এই বিষয়টা আমার মানতে খুব কষ্ট হয়। পরীক্ষার আগে দিয়ে এক-দেড় মাস গাধার মতো সারাদিন পড়তে পারি। আমার পড়াশোনা ওই গরু-গাধার মতোই, গায়ে গতরে। সিংহের মতো কৌশলী না আমি। একসময় কত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে ছিলাম আমি, অথচ আজ? নিজেকে খুব হীন মনে হয় বন্ধুদের কাছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত আমার ডিপার্টমেন্টের, আমাদের ব্যাচ থেকে একজনও বিসিএস ক্যাডার হতে পারেনি। আমার ব্যাচের ব্যাকবেঞ্চাররা বেশিরভাগই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকার। আমি ম্যাথে দুর্বল বলে ব্যাংকে পরীক্ষাই দিই না ভয়ে। আর যারা আমার মতো ফার্স্টবেঞ্চার, তারা অনেকেই প্রাইমারি স্কুলে জব করে। আমাদের দুজন ফার্স্টগার্লই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, অথচ ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া ডিজার্ভ করে। অবশ্য আমাদের ডিপার্টমেন্টে আমাদের ব্যাচের আগের পরের ব্যাচের অনেকেই বিসিএস ক্যাডার, নামি ক্রিকেটার, ফিফার রেফারি বাংলাদেশের প্রথম নারী, ফোবর্স ম্যাগাজিনে শীর্ষ তিরিশ যুবকের মধ্যে বাংলাদেশি যুবক---গর্ব করার মতো এরকম সবই আছে। ওদের কথা বলে কী লাভ? আমার নিজের যে বলার মতো কিছুই নেই! সেরা ভার্সিটির, সেরা ডিপার্টমেন্টের ব্যর্থ স্টুডেন্ট হওয়ার চাইতে, নিকৃষ্ট ভার্সিটির, নিকৃষ্ট ডিপার্টমেন্টের সফল স্টুডেন্ট হওয়া অনেক ভালো। ভার্সিটি আর ডিপার্টমেন্ট ধুয়ে পানি খাওয়ার মতো সময় তো সেদিনই শেষ হয়ে গেছে, যেদিন আমার অনার্স শেষ হয়ে গেছে। ভার্সিটির নাম বেচে-খাওয়া অনেক পাবলিকই এখন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়।


আসলে ব্যর্থতার ইতিহাস তার থাকাই মানায়, যে সফল হতে পারে। সফল হতে না পারলে এইসব যন্ত্রণা-ব্যর্থতার কোনও দামই নেই। যে আমি প্রাইমারি স্কুলের চাকরিকে মূল্যায়নই করতাম না বা কেউ সম্মান দেয় না বলে ওখানে কোনও দিন পরীক্ষাই দিইনি, সেই আমি এবারই প্রথম প্রাইমারিতে পরীক্ষা দিলাম। হতাশা কাটানোর জন্য জিমে ভর্তি হলাম। তখন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল! হঠাৎ আমার একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করল। অন্যকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন অন্যকে ভুলে নিজেকে ভালোবাসতে চাই। আমি আবিষ্কার করলাম, আমি সুন্দর! আমি সুখী। আমি সবল। আমি মুক্ত। আমার কোনও জরা নাই, দুঃখ নাই, শ্লাঘা নাই, কষ্ট নাই! পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে যাচ্ছি! আমি জিমে যাওয়ার আগে এইসব কখনওই বুঝিনি, নিজেকে নিয়ে এরকম করে কোনও দিনই ভাবিনি। নিজেকে আরও সুন্দর করে তোলার প্রতি আমার মনোযোগ বাড়ল। মনে হতে লাগল, আমি দিনদিন সুন্দর হচ্ছি, আমার মধ্যে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস এসে ভর করল। আমি এখন একতুড়িতেই বিশ্বজয় করে ফেলতে পারি!


২৪ ডিসেম্বর ২০১৯। আমার জীবনের এক বিশেষ দিন। আমার জন্মদিন। আমার সরকারি চাকরির বয়সের শেষদিন। যেদিন আমার সরকারি চাকরির বয়সের শেষদিন, সেদিন আমি জীবনে প্রথম সরকারি চাকরি পেলাম! আল্লাহ্‌ আমাকে জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি দিলেন। একটা চাকরি, একটা অবলম্বন, একটা আত্মপরিচয়। কোনওমতে জীবনটা ব্যস্ততায় কাটিয়ে দেবার একটা অনুষঙ্গ। অনেক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মানুষ যেমন লাল গোলাপটা ছিঁড়ে আনে, আমিও পারলাম! হয়তো তা গোলাপ না, একটা টগরমাত্র, তা-ও তো পেলাম! আমি ওতেই অনেক খুশি। প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকের একটা জব আমার হলো। মানুষ যেমন অনেক কষ্টের পর সামান্য কিছু পেয়ে আনন্দে হুড়মুড় করে কেঁদে ফেলে, আমিও তেমন হু হু করে বাচ্চাদের মতন আনন্দে কেঁদে ফেললাম। এরকম আনন্দ মানুষ তার কাছের মানুষদের সাথে শেয়ার করতে চায় সবার আগে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন আমার মেজো বোন তার শ্বশুরবাড়ি ছিল। আমি প্রথম ফোনটা তাকেই দিলাম। অনেকক্ষণ ঝরঝর করে কাঁদলাম। এরপর স্কুলজীবন থেকে শুরু এখন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে কাছের দুই ফ্রেন্ডকে ফোন করে কাঁদলাম। অনেক না-পাওয়ার মধ্যে এই একটুখানি পেয়েও নির্মল আনন্দের কান্নাটি প্রাণ খুলে কাঁদলাম সেদিন।


আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম এটা ভেবে, যে আমি এতদিন বিসিএস-এর জন্য কত ঝড়ঝাপটাতেও, প্রিলিতে পর্যন্ত না টিকেও ওটার পেছনে লেগেছিলাম, প্রতিবার অকৃতকার্য হয়েও ধৈর্য ধরে নতুম উদ্যমে আবার পড়াশোনা শুরু করেছি, সে-ই আমি এই সামান্য চাকরিটা পেয়েই আনন্দে শিশুর মতো কাঁদলাম! আসলে মানুষ অনেক অনেক না পাবার মাঝে, ক্রমাগত চেষ্টাতেও তার লক্ষ্যের কাছে পৌঁছতে যখন সে পারেই না, তখন অল্প কিছু পেলেই সে অনেক সন্তুষ্ট হয়, এটা সেদিন প্রথম বুঝলাম!


মানুষ হিসেবে আমি বেশ সহজপাঠ্য। সহজেই আমাকে পড়া যায়। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। অনেক বেলা করে উঠি। কাল রাতেও ডুকরে ডুকরে অনেক কেঁদেছি। ইদানীং খুব ব্যস্ততার মধ্যে সময় যাচ্ছে। এদিকে আবার নেক্সট বিসিএস-এর জন্য টুকটাক পড়ছি। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিশেষ সংখ্যাটা ধরেছি, আর-একটা বিষয় শেষ হলেই শান্তি। তার উপর কাল হঠাৎ এক বন্ধুর অনুরোধে জীবনে প্রথম ভাবানুবাদ করার দুঃসাহসটা দেখিয়ে ফেললাম! এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং-এর ‘How Do I Love Thee’ কবিতাটা। রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপ’-এর আধুনিক সংস্করণ লেখারও ভূত চেপেছে মাথায়।


অতীতের কত কী যে এসে মনে ভিড় করে! আমার চোখে এই মুহূর্তে পানি চলে আসছে! বড়ো অপরিণত মেয়ে আমি। বড়ো অবিবেচক আবেগ-অনুভূতি আমার! আমি জানি, সবার জীবনেই অল্প-বিস্তর দুঃখ আছে। সেগুলির মধ্যে বড়ো বড়ো দুঃখ যেগুলি, তা সব প্রায় একই, শুধু আকার আর রঙ বদলায় ওদের। আজ চৈত্রসংক্রান্তি। মনে পড়ছে, কোনও এক চৈত্রসংক্রান্তিতে আমি, বাবা আর বোন মিলে একটা আয়োজন করেছিলাম। বাঁশফুল চালের ভাত, হরেক রকম ভর্তা আর আমাদের মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী চালকুমড়া পাতার বড়া দিয়ে। একটু খাওয়াদাওয়া, আনন্দ। এর দামই লক্ষ টাকা!


আজকে যে ড্রেসটা পরেছি, সেটা কোনও এক বৈশাখে মা ডিজাইন করে দিয়েছিলেন। আমার একটা ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ আছে, ওটাও অনেক কষ্টে বানিয়ে দিয়েছিল মা। এটাই ছিল মায়ের পরানো শেষশাড়ি। বাবার কথাও মনে পড়ছে, আমার বড়ো বোনের মুখটা চোখের সামনে বারবার চলে আসছে। আমার বাবা অত গোঁড়া ছিলেন না। কাটখোট্টা টাইপ মানুষ ছিলেন তিনি, অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের রসকষহীন ক্যাটক্যাটে বুড়োর মতন। তবে তাঁর সূক্ষ্ম সেন্স অব হিউমার ছিল! আমি বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়াতে যেমন আদর পেতাম, তেমন শাসন। এখন অবশ্য কোনওটাই না! তো বাবা যখন চিৎকার করে করে আরবি পড়াতেন, আমিই বাবাকে ধমক দিতাম! মা-ও বকা দিতেন। বলতেন, এত জোরে পড়ালে আশেপাশের সবাই বিরক্ত হবে তো! তবে আমি বাবার সাথে খুবই ফ্রি ছিলাম। সবচেয়ে বেশি আমিই বাবাকে বকতাম। বাবা অবশ্য আমার বকাতে মাইন্ড করতেন না। হা হা হা…বাবা অন্য ধর্মকে সম্মান করতেন। অন্য ধর্মকে সম্মান না করলে কেউ আসলে নিজের ধর্মকে সম্মান করতে পারে না। অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল না হয়ে নিজের ধর্মকে যথাযথভাবে পালন করা যায় না। এ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট ধর্ম বলে কিছু নেই। যার যার ধর্ম, তার তার কাছে বড়ো। এটা যে যত দ্রুত মেনে নিতে পারে, সে তত দ্রুত ধর্মের পথে এগিয়ে যেতে পারে।


পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টি করে। আগের যুগের মোল্লামৌলবিরা অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে মিলে মিশে চলত। আর এখন শুধুই বিদ্বেষ ছড়ায়। সবচেয়ে রাগ হয় কিছু জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের দেখলে। ওদের দেখলে মনে হয় যেন নিজের ধর্মকে হেয় করাটা মস্ত একটা আর্ট! আহমদ ছফার একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে। খুব ভালো লেগেছিল। আসলে এখনকার কিছু বুদ্ধিজীবী বেশ হীনমন্যতায় ভোগে। ইদানীং বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক মুসলিমসমাজ আত্মমর্যাদাহীনতায় ভোগে। ওরা মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে যে-কোনও অনুষ্ঠানের শুভসূচনা করে, অথচ বিসমিল্লাহ্‌ বলে অনুষ্ঠান শুরু করতে কার্পণ্য করে। মিলাদমাহফিলে যেতেও ওদের কেমন একটা কুণ্ঠা! এটা এক ধরনের দ্বিচারিতা আরকি! এটাই আমাদের জাতিগত সংকট।


আমি সব সময় লজিক দিয়ে ধর্মকে বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু বিশ্বাস আর লজিক তো এক জিনিস না! আমার সমস্যা হলো, যা-কিছুতে কোনও লজিক খুঁজে পাই না, সেসব আচার পালন করতে ইচ্ছে হয় না। মন ঠিক সায় দেয় না। সংশয় হয়। একবার অকপটে আমার মাকে বলেছিলাম, ‘পৃথিবীতে এত এত ধর্ম, কোন ধর্ম সত্য? তার নির্ভরযোগ্যতাই-বা কী?’ উত্তরে মা বলেছিলেন, ‘তুমি কোরান, বাইবেল, গীতা সব পড়ে বিবেচনা করো।’ কোনওটাই ঠিকমতো পড়া হয়নি। তবে একটা ব্যাপার মনে হয়েছে, মুসলমান, ইহুদি আর খৃষ্টান এই তিন ধর্মের মধ্যে অনেক সাযুজ্য আছে। একবার জাকির নায়েকের লেকচারের একটা কথা খুব ভালো লেগেছিল, যদিও তাঁর লেকচার তেমন শোনা হয় না। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা-মায়ের ধর্মবিশ্বাসের কারণে জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম অন্ধভাবে গ্রহণ করার চেয়ে বুদ্ধিবিবেচনা করে নাস্তিক হওয়াও ভালো।’ আবার এ-ও না যে আমি অনেক বড়ো বুদ্ধিজীবী নাস্তিক হতে চাই। আমি খুবই টিপিক্যাল মুসলিম। নিজের সন্দেহগুলি দূর করে বিশ্বাসটা আরও পোক্ত করতে চাই।


আমার ধারণা, আমরা বাংলাদেশিরা বেশিরভাগই রেসিস্ট। যেমন, ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে বেশিরভাগ গোঁড়া মুসলিম পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে, আবার অনেকে রেসিজমের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতকে সাপোর্ট করে। আবার আজ পর্যন্ত এমন কোনও সনাতনধর্মের লোক দেখিনি, যারা ভারত-পাকিস্তান খেলায় পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছে। আবার অনেক সনাতনধর্মের লোক দেখেছি, ধর্মীয় ট্যাবু ভেঙে বিফ খায়। ওদিকে খুব কম মডারেট মুসলিমই পোর্ক খাবার দুঃসাহস দেখায়। এগুলি হচ্ছে আমার উর্বরমস্তিষ্কের ভাবনা, যার কোনও অর্থ নাই। অর্থ থাকলেও দাম নাই। সারাজীবনই এসব নিয়ে কথা বললেও শেষ হবে না। যে জিনিস শেষ করা যায় না, তা শুরু করাটা নিছকই মূল্যহীন। তাই ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক সকল ধরনের আলাপআলোচনা থেকে নিজেকে সাধারণত দূরে রাখি।


বাদ দিই এত ভাবনা। আমার হাতে কিছু কাজের লিস্ট করা আছে। কাজগুলি রোজার আগেই গুছিয়ে নিতে চাই। তার উপর বোন আবার একটা বই দিয়েছে পড়তে---মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’। সব কাজ শেষ না করা পর্যন্ত একটু অস্থির আছি। তা ছাড়া এখন মাঝে মাঝে নিজেকে শয়তানের উপাসক মনে হয়! রোজা শুরু হলে ইনশাআল্লাহ্‌ শৃঙ্খলের মধ্যে আসতে চাই। শুধুই পড়াশোনা আর ধর্মচর্চা করব! আমি আমার আবেগ লুকাতে পারি না। অকপটে আবেগ প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করি, এতে আমার বেদনার উপশম হয়। তাই আমি বাধ্য হয়েই লিখি, আমাকে লিখতে হয়। লিখতে না পারলে আমি মরেই যাব! আমি কলেজ থেকেই অনেক কবিতা লিখতাম। ইংরেজি কবিতাও লিখেছি ৩/৪টা। সব ধরনের লেখার উপর (গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা আর হরর গল্প) একবার করে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। ইচ্ছে আছে, ভবিষ্যতে ওগুলোকে বই আকারে ছাপাব।


এখন আর কবিতা লিখতে পারি না। অনেক কঠিন একটা কাজ এই কবিতা-লেখা। কবিতা লিখতে মনে প্রেম থাকা চাই। ফেসবুকে লেখার ফলে এখানে সরাসরি মানুষের প্রতিক্রিয়া পাই, আমার ভালো লাগে। চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব ছোট করে সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে। এখনকার ব্যস্ত মানুষেরা বড় লেখা দেখে বিরক্ত হয়। আমি দুঃখের লেখা লিখতে চাই না। মজা করে রস দিয়ে লেখার চেষ্টা করি। মা মারা যাবার পর এটাই আমার জগত। যখনই কোনও লেখা মাথায় আসে, খাতায় লিখি। বারবার পড়তে আমার ভালো লাগে। তারপর ওয়ালে পোস্ট করি। টাইপিং পারি না। একটা ডেস্কটপ পিসি ছিল, কোনও কাজে লাগে না দেখে হার্ডডিস্কটা রেখে ভাঙারির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। এই পুরান মোবাইলে টাইপ করে করে লিখি। আমার একটুও কষ্ট হয় না।


আমি জীবনে খুব কম গল্পের বই পড়েছি। মা বলত, এত বই পড়ে কী হবে? আমারও কিছু হয় নাই! বই না পড়ার খেসারত এখন আমাকে দিতে হচ্ছে! মায়ের গাইডলাইন ছাড়া জীবনে চলতে চলতে ঠেকছি, ঠকছি! জীবনের জটিলতা কিছুই বুঝি না। এর চেয়ে মরণ অনেক ভালো! না গুছিয়ে কিছু বলতে পারি, না মানুষের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারি। একটাই কাজ পারি---যে-কোনও লেখা কোনওমতে গুছিয়ে মনের ভাবটা প্রকাশ করা। হয়তো শিব গড়তে চেয়েছি, হয়েছে বাঁদর, তবু কিছু একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারি। বইপড়া ও লেখালেখির মধ্যে সম্পর্ক খুব সরলরৈখিক বা অবিচ্ছেদ্য কিছু নয়। বই পড়েন প্রচুর, কিন্তু লিখতে পারেন না, এমন অনেক মানুষকে আমি চিনি। আবার বই পড়েন না, কিন্তু ভালো লিখতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যেমন আমি নিজে। তবে হ্যাঁ, লিখতে গেলে নিজের ভেতরের মানুষটাকে জাগাতে হয়, আর তা করতে গেলে অন্তত কিছু বই পড়া থাকতে হয়। লেখালেখির প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে দুঃখ। যার জীবনে কোনও দুঃখ নেই, তার পক্ষে লেখালেখি করা সম্ভব নয়। লেখালেখি নয় শুধু, তার পক্ষে কোনও কিছুই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাই আমার মনে হয়, যার কোনও দুঃখ নেই, সে-ই সবচাইতে দুঃখী মানুষ। যা-ই হোক, আমার মতো ব্যর্থ যন্ত্রণাকাতর মানুষ ভালো লিখতে পারলেও কী, না পারলেও কী! আমি চেষ্টা করছি---জীবনের সব কষ্টকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার চেষ্টা!


আমার লেখার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আমি কোনও রাখঢাক পছন্দ করি না। এখানে যা যা বলছি, সব সত্য বই-কি মিথ্যা নয়। আপনাদের কাছে একটুও বাড়িয়ে বলিনি কোনও কিছুই। কোনও কিছু লুকাইওনি। একদম ফ্রাঙ্কলি সব বলার চেষ্টা করেছি কোনও জড়তা ছাড়াই। আমি নিজেকে আপনাদের সামনে পূর্ণভাবে মেলে ধরতে চেয়েছি যাতে আমাকে বুঝতে আপনাদের সুবিধা হয়। আমার অনুভূতিগুলিকে জ্যান্ত করে অনুভব করানোর ক্ষেত্রে আমি পুরো গল্পেই আন্তরিক থেকেছি। আমার মা একটা কথা সব সময় বলতেন---আছি সত্য, নাই বিনাশ। আমি আমার জীবনদর্শনে কখনও এর ব্যত্যয় করিনি, আমৃত্যু করবও না। মায়ের আর-একটা কথা আমার মাথায় রাখি---কেউ ধর্মচর্চা করলেই সে ধার্মিক হয়ে যায় না। যার জীবাত্মা পরিশুদ্ধ, তার পরমাত্মাও পবিত্র!


আমার শেষগল্পটা শুরু করব। কোথা থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারছি না!


গত কুরবানির ঈদের সময় ভার্চুয়াল-জগতের সেই ডাক্তারবন্ধু প্রায়ই আমাকে ট্যাগ করে পচাত, বিভিন্ন ভিডিও-ছবি দিয়ে। যেমন একটা পেত্নিমার্কা সিনেমার চরিত্রকে সে ট্যাগ করে বলত, এই যে আমাদের অন্তঃপুরবাসিনী আপা মডেল! আর নিজের পোস্টে সব সময় বাংলা সিনেমা অথবা বিতর্কিত কোনও হুজুরের ছবি দিয়ে পোস্ট দিবে---ইনি আমার ছোটবেলার হুজুর, কেউ তাঁকে নিয়ে কোনও কটুকথা বললে ব্লক খাবেন। তারপর সে নারীদের নিয়ে নানা পোস্ট দিবে। তার বউ কথা না শুনলে, ভাত রেঁধে না দিলে সে বউকে পিটাবে। রান্নাঘরে আর দরোজার সামনে লাঠি ঝুলিয়ে রাখবে। এইসব উলটাপালটা পোস্ট দিতেই থাকে! মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কি না, আমি জানি না! সবাই তো ভালো সেজে আকৃষ্ট করতে চায়, আর সে অবলম্বন করল ভিন্ন পন্থা। তার মাথায় যখন যে বিষয়ে ভূত চাপে, সে বিষয়ে তখন খুব পোস্ট করতে থাকে। ওই সময় রিহানা নামের এক কাল্পনিক মেয়েকে নিয়ে পোস্ট দিত। যেমন, ‘বাড়িওয়ালার মেয়ে রিহানা, আকাশে মেঘ করেছে, আমার কাপড়গুলি বাসায় নিয়ে আসো।’ ‘বাড়িওয়ালার মেয়ে রিহানা, আমার জন্য চা বানাও।’ ‘বাড়িওয়ালার মেয়ে রিহানা, আমার ছাগলটাকে ঘাস খাওয়াও।’ এইসব টাইপ পোস্ট।


তো কুরবানি ঈদের দিন সে আমাকে নক করল। আমি তখন কবরস্থানে জিয়ারত করতে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। বলল, তার এক বড়ো ভাই আমাকে রিকোয়েস্ট দিয়েছেন। তিনি হার্টের বিশেষজ্ঞ। খুব মজার মানুষ। আমার লেখাগুলি পড়তে চান, আমি যেন রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করি। সে, মানে সেই ডাক্তার রুমি তার ওই বড়ো ভাইয়ের কাছে আমার কথা বলেছে, আমি নাকি ব্লগার! তো যা-ই হোক, রাতে সেই ভাইয়ের রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করি। ওঁর নাম জামান। তো জামান ভাই আমাকে সাথে সাথে নক করে বললেন, তুমিই কি রুমির সেই রিহানা? প্রত্যুত্তরে বললাম, অমন বদ্ধপাগল ডাক্তারকে আমাদের বাসায় ভাড়া দিতে বয়েই গেছে! তো তিনি বললেন, এ কী, তুমি রুমিকে পাগল বললে? জানো, ও তোমার কত প্রশংসা করে! তোমার নাকি মা নাই, আর তুমি নাকি ভালো একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছ। আল্লাহ্‌র কাছে মন দিয়ে চাও, আর চেষ্টা করতে থাকো, আল্লাহ্‌ ফিরাবেন না। তো সেই জামান ভাই আমাকে প্রায়ই নক করে কথা বলতেন।


এখানে একটা কথা বলে রাখি। আমি ফেইসবুকে খুবই রাফ অ্যান্ড টাফ। অচেনা কেউ ইনবক্সে নক করলেই আনফ্রেন্ড/ব্লক করি, যদি বুঝি, সে আমার সাথে টাইমপাস বা অন্য মতলবে কথা বলতে চাইছে। নিজের দুর্বলতা বা সিকিউরিটির জন্য নিজেকে অনেক শক্তভাবে ফেইসবুকে উপস্থাপন করি, যাতে কেউ কিছু বলার সাহস না পায়। তা ছাড়া কখনওই সরাসরি ব্যক্তিগত কিছু, বিশেষ করে, বাবার মৃত্যুর কথা কিছুদিন আগ পর্যন্তও লিখতাম না। ফলে অনেক দীর্ঘদিনের বন্ধুর কাছেও এটা অজানা। বাপ-মা, গার্ডিয়ান নাই, এ সমাজে এরকম একটা আনম্যারিড মেয়েকে মানুষ ডিস্টার্ব করতেই পারে। এ কারণে ইনসিকিউরড ফিল করে ফেইসবুকে বেশি উচ্চবাচ্য করি ও নিজেকে অনেক সাহসী হিসেবে দেখাই। এরপরও সরাসরি অনেকেই অ্যাপ্রোচ করত। মাউন্ট এলিজাবেথের এক ব্রেস্টসার্জন ডাক্তার (প্রথমে ভেবেছি ফেইক! এত বড়ো ডাক্তার আমাকে রিকোয়েস্ট দিবে কেন!) রিকোয়েস্ট দিয়ে আমার সাথে হাই/হ্যালো করে নক দিত। আমি তাকে রিয়েল না ফেইক আইডি, জিজ্ঞেস করলে সে তার হসপিটালের আইডি কার্ড দেখায়। তো সে মাঝে মাঝেই নক করে। আমি কখনওই কাউকে আগ বাড়িয়ে নক করি না। একদিন হুট করে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়! আমি ভয় পেয়ে যাই। আমার সন্দেহ হয়, এই লোকের নিশ্চয়ই চরিত্র খারাপ! এটা ওটা বলে কাটাতে চাই। হুট করে অনুমতি ছাড়াই অডিওকল দেয়। আমি ধরি না। ইন ফ্যাক্ট, অচেনা কারও সাথেই এভাবে কথা বলি না। অস্বস্তি হয়। ফোন না ধরাতে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। বলে, চাই না এমন ইগোওয়ালা অহংকারী মেয়েকে! এই বলেই ব্লক! জীবনে প্রথম কেউ আমাকে ব্লক দিল। এর আগ পর্যন্ত আমিই দিয়ে এসেছি! আসলে লাইফে সব কিছুরই একটা ফার্স্টটাইম বলে ব্যাপার থাকে। ওটা হচ্ছে আমার ফার্স্টটাইম কারও কাছ থেকে ব্লকখাওয়া!


যা-ই হোক, সেই জামান ভাই শুরু থেকেই আমাকে ছোটবোন বলে সম্বোধন করতেন। আমিও সেজন্য ফ্রি হয়ে তাকে বড়ো ভাইয়া বলে সম্বোধন করেছি। খুবই মেধাবী আর ভালো মানুষ। চট্টগ্রামের রাউজানে বাড়ি। এদিকে এর মধ্যে আমাদের পড়শি ডাক্তার হেমা আপা, উনি সরকারি অনেক বড়ো পদে আছেন। বয়স ষাটের আশেপাশে। আমি আপাই ডাকি, কারণ আমার মাকে উনি খালাম্মা ডাকতেন। তাঁকে দেখলাম, রুমির সাথে মিউচুয়াল। এই হেমা আপা খুবই ঠোঁটকাটা টাইপ মানুষ। মুখে কিছুই বাধে না। খুবই রসিক। আর এদিকে আমি কখনওই অসুন্দর শব্দ মুখে উচ্চারণ করি না। হেমা আপু ফেইসবুকে খুব ফ্রি। সব ধরনের লেখা, গালিগালাজ পোস্ট করতে দ্বিধা করতেন না। আমার সাথে মাঝে মাঝে ইনবক্সে কথা হতো। জিজ্ঞেস করলাম, রুমি ভাইকে কীভাবে চিনেন? বললেন, ওঁরা ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড। একদিন ডায়বেটিসের জন্য চিনির বদলে কী খাওয়া যায়, সেটা জানতে হেমা আপু রুমি ভাইকে নক করেছিলেন। এরপর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেন। আমি রুমি ভাইকে মনে মনে খুব পছন্দ করতাম। আর এই হেমা আপুর সাথে এদিকে রুমি ভাইয়ের খুব খাতির হয়ে যায়।


ততদিনে রুমি ভাই আর আমার মধ্যে অনেক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড হয়ে যায়। হেমা আপুকে আমাদের মিউচুয়াল অনেকের কথাই জিজ্ঞেস করতাম। রুমি ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘রুমি ভালো ছেলে।’ কথায় কথায় জামান ভাইয়ের প্রশংসা করলাম উনার কাছে। হেমা আপু বললেন, ‘ও তো একটা লুচ্চা! তুমি তো জানো, আমি ফেসবুকে অনেক সময় গালিগালাজ করে পোস্ট দিই, আমি তো ঠোঁটকাটা মানুষ। তো জামান একদিন আমাকে বলে, ম্যাডাম, আমার সাথে কি সেক্সচ্যাট করবেন? সাথে সাথেই আমি ওকে ব্লক করে দিই। কেমন শুয়োর, দেখো! আমার বয়স ওর মায়ের বয়সের কাছাকাছি, আর আমাকেই কিনা সে…! হারামজাদা পারভার্ট!’ হেমা আপুর কথা শুনে আমি বেকুব হয়ে গেলাম! জামান ভাইয়ের পক্ষে এই কথাও বলা সম্ভব! কীভাবে কী! কিছুই তো মিলাতে পারছি না! বুঝলাম, সত্যিই মানুষ সবচেয়ে জটিল প্রাণী। মানুষের মন সবচেয়ে দুর্বোধ্য! কাকে কী ভাবতাম, আর কে কী! আসলে ঠিকমতো না জেনে কাউকেই জাজকরা ঠিক না! আমার নিজেকে বোকা বোকা লাগল।


রুমি ভাই এর মধ্যে তার আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখে। প্রায় তিন মাস। আমি অস্থির হয়ে যাই। ওকে খুব মিস করতে থাকি! মনে হয়, কী জানি হারিয়েছি! আর যদি না পাই! এত বছরে আমরা একে অপরকে শুধু পচিয়েছি আর ঝগড়া করেছি! কিন্তু এত বছরের ফেইসবুক বন্ধু সে আমার, তাকে খুব আপন, খুব কাছের মনে হয়। ভালোবাসার চেয়েও আমার মধ্য বেশি কাজ করে তার প্রতি নির্ভরশীলতা, আস্থাভাজনতা। আমি হেমা আপুকে প্রায়ই নক করে বিরক্ত করি রুমি ভাইয়ের কোনও খবর জানেন কি না, জানতে। উনি তেমন কিছু বলতে পারেন না। এদিকে বাসায় আমার জন্য বিয়ের প্রপোজাল আসতে থাকে। আমার খুব অসহায় লাগে। মনে হয়, একমাত্র রুমিকে পেলেই আমি স্বস্তি পাব। তাকে আমার খুব আপন আর চেনা মানুষ মনে হয়। বোনের কাছে একটা প্রস্তাব আসে। ছেলে বুয়েট থেকে পাস করে সরকারি চাকরি করে। আমার কিছুই করার নেই! ছেলেটা ইমেইলে তার বায়োডাটা আর ফেইসবুক আইডি লিংক দিল। আমাকে দেখতে বলল বোন। ফেইসবুক লিংক দেখে আমার একটুও পছন্দ হলো না। দেখতে বয়স্ক! আমি নিজে বয়স্কা হলেও বয়স্ক ছেলে বিয়ে করব না! হা হা হা।


তার উপর সবচেয়ে যেটা খারাপ লেগেছে যেটা, সেটা হলো, একজায়গায় সে পোস্টে ক্যাপশন দিয়েছে… Shamsed vaier sathe dekha. যে ছেলে এভাবে বাংলিশ লিখে, সে ছেলে বুয়েট কেন, হাভার্ডের হলেও আমি বিয়ে করব না! লিখতে পারত, শামসেদ ভাইয়ের সাথে দেখা! অথবা Meeting with Shamsed bhai. অথচ সে কী লিখল? না বাংলা, না ইংরেজি! পুরাই খ্যাত্‌মার্কা! আগের দিন রাতে দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, বোনকে মানা করে দেব। সকালে তা-ই বললাম। বোন তো আমার উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা! ঝগড়াও করল। আমি কাঁদলাম। তিন দিন আমার সাথে কথা বলল না। দুলাভাইও আমার উপর খুব বিরক্ত। তিনি যে আমার জন্য দয়া করে এ বাসায় থাকেন, সেটা পই পই করে বোঝাতে ছাড়েন না। তিন দিন আমিও কাঁদলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। আজ যদি বাবা-মা অথবা বাবা কিংবা মা বেঁচে থাকতেন, আমার উপর হয়তো তাঁরা কোনও কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইতেন না! একটা মেন্টাল সাপোর্ট অন্তত পেতাম। নিজেকে ভেসেআসা খড়কুটোর মতো লাগে। একটু যদি কোথাও আশ্রয় পেতাম! একটু নির্ভরতা! কারও বুকে পরম ভালোবাসায় মাথা রাখতে পারা! আমার যদি মন না সায় দেয়, আমি কীভাবে বিয়ে করব? জোর করে পছন্দ করানো যায় না, জোর করে বিয়ে হয়তো হতে পারে, কিন্তু সেই বিয়ে কখনওই একটা মনের সাথে নিজের মনের হয় না। নিজেকে এই বোন-দুলাভাইয়ের সংসারে ভারী ভারী মনে হলো! নিজের বাড়িতেই নিজেকে আশ্রিতা ভাবতে ইচ্ছে করল।


নিঃসন্দেহে সেই বুয়েটপাস ইঞ্জিনিয়ারের যোগ্য আমি নই। কাজেই তাকে রিফিউজ করার যোগ্যতাই আমার নেই! অযোগ্য হয়েও কেন তাকে রিফিউজ করব? কেন করব? এটাই ওদের কথা। ওদের আমি কী করে বুঝাই যে, আসলে কারও প্রতি ভালোলাগাটা মন থেকে আসতে হবে, সে যতই যোগ্য হোক না কেন! আমার যাকে পছন্দ হবে, তার একটা মিনিমাম যোগ্যতাই কেবল দেখব, আর কিছু দেখব না। শুধু ভালোলাগাকেই গুরুত্ব দিব। আমি জানি, সেই ছেলে আমার চাইতে অনেক যোগ্য মেয়ে ডিজার্ভ করে বা বিয়ে করতে পারবে। আসলে যোগ্যতা ব্যাপারটা আপেক্ষিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ্যাঁকা-খাওয়া স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ‘মেয়েরা প্রেম করে কবির সাথে, বিয়ে করে ব্যবসায়ীকে। হা হা হা!’ আমি ব্যবসায়ী বিয়ে করতে রাজি আছি, যদি তার মধ্যে একটা কবিমন পেতাম। অবশ্য অভিজ্ঞতা বলে, কবি আর হুজুর, এরা যেমন ভালোও হয়, তেমনি খারাপও হয়। যোগ্য বা ওভারকোয়ালিফায়েড হলেও ওভারঅল ভালোলাগার একটা ব্যাপার আছে। সমাজের বিচারে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, এই অজুহাতে কি দুম্‌ করে যার-তার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাব নাকি? আশ্চর্য!


(চলবে…)