তবুও অপেক্ষা/ দুই

 
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। সোয়াতিনটা নাগাদ মা চলে গেলেন। মা বেঁচে থাকতে বুঝিনি, তিনি আমার কী ছিলেন। মাকে আমার বন্ধু বললেও কম বলা হবে। এতটা ফ্রি ছিলাম আমরা মা-মেয়ে যে ভাবাই যায় না। প্রতিদিনই গল্পের আড্ডা বসত আমাদের। আহা, মা এত চমৎকার করে গল্প বলতেন আর আমাকে হাসাতেন! আমি সবকিছুই মায়ের সাথে শেয়ার করতাম। তখন টিভিতে একটা সিরিয়াল চলত। ইস পেয়ার কো কেয়া নাম দু? আমরা দুজন মিলে দেখতাম। আমি হিন্দি বুঝতাম না। মা অনুবাদ করে দিত। আমার আর তাঁর ক্রাশ ছিল সিরিয়ালের নায়কটা। একসাথে বসে ‘টাইটানিক’ দেখেছি, তাঁর প্রিয় ছবি ‘রোমান হলিডে’ দেখেছি। শেষ ছবি দেখলাম ‘বজরঙ্গি ভাইজান’। মা মারা যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি আর কোনও মুভি দেখিনি, গল্পের বইও পড়িনি। মা ছিলেন জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সবকিছুতেই সিদ্ধহস্ত। টিভির রিমোর্ট নষ্ট? নো টেনশন, মা আছেন! বাড়ির কারেন্টের লাইনে গন্ডগোল? ব্যাপার না, মা নিজেই ইলেকট্রিকমিস্ত্রি বনে যেতেন! বাড়ির এটা ওটা খুঁটিনাটি সব নিজেই সারাতেন। আমার জন্য সব সুন্দর সুন্দর জামা বানিয়ে দিতেন। বন্ধুরা আমাকে হিংসা করত। আমার জামাকাপড় গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে খাতাবাঁধাই, সবই মা করে দিতেন। আমি এতটাই নির্ভরশীল ছিলাম তাঁর উপর! আমাদের দুজনের মিল ছিল, আমরা দুজনেই এসথেটিক্সে আগ্রহী। সুন্দর করে ঘর-সাজানো, হস্তশিল্প, ওয়ালম্যাট, ছবিআঁকা…এগুলি করতাম আমরা। মা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমিও আঁকতাম, তবে তাঁর মতো সুন্দর করে কখনওই পারতাম না। তাঁর আর আমার জন্ম একই মাসে। মায়ের জন্মও চট্টগ্রামে। নানাভাইয়ের রেলওয়ের চাকরির সুবাদে পলোগ্রাউন্ডে কাটে মায়ের শৈশব। মা ছিলেন প্রচণ্ড পাখিপ্রেমিক, ভালো শিল্পী। তবে খাঁচায় পাখিপোষা পছন্দ করতেন না। এজন্য আমার পাখি ভালো লাগলেও কোনও দিন পোষা হয়নি, এক কবুতর ছাড়া।


তো আমার সেই মা অকস্মাৎ চলে গেলেন। অথচ ঠিকসময়ে চিকিৎসা হলে মা বাঁচতেন। প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। মানুষ অল্প শোকে কাতর হয়। হ্যাঁ, এটা অল্প শোক…! আমি প্রচণ্ড কাতর হয়ে গেলাম! আত্মীয়স্বজন এল। যে যত উচ্চস্বরে কাঁদতে পারে, কাঁদল! রীতিমতো কাঁদার প্রতিযোগিতা! আমি তেমন কাঁদলাম না। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। যখন আত্মীয়স্বজন চলে গেল, তখন নিজেরা কাঁদলাম হু হু করে। কী একটা ঘোর, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মা একটা গল্প প্রায়ই বলতেন। ‘ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে যখন প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন, তখন ইন্দিরা সবাইকে সান্ত্বনা দিলেন। সবাই চলে যাবার পর ছেলের চিতার সামনে বসে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেললেন।’ আমার শুধু সে গল্পটাই মনে আসছিল। মা ৩৬তম বিসিএস-এর তিন মাস আগে মারা গেলেন। মারা যাবার আগে প্রায় দিনই আমাকে পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ে শোনাতেন প্রিপারেশনের জন্য। মায়ের ছোটবেলায় বড়ো মামা পত্রিকা পড়ার আগ্রহ দেখে মায়ের নামে নাকি প্রতি মাসে ছয় ছয়টা পত্রিকা ইস্যু করতেন। আসলে আমার নানাবাড়িটাই ছিল সাহিত্যিক-পরিবেশের। নানা প্রচুর বই পড়তেন। কোরআন মহাভারত রামায়ণ বাইবেল সবই পড়তেন। তিনি আলহাজ্বও ছিলেন, অর্থশালী মানুষ ছিলেন, সাথে ছিল পড়ার প্রতি অনেক আগ্রহ। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বাড়িতে প্রচুর বই ছিল।


আমাদের বাসায় যত অভাবই ছিল না কেন, কখনও পত্রিকা বন্ধ হয়নি। তাই ছোটবেলা থেকে আমারও পত্রিকাপড়ার অভ্যাস। বাবা খুব খুঁটিয়ে পেপার পড়েন। তিনি অবশ্য গল্পের বই পড়েন না। তাঁর আলমারি ভর্তি হাদিস-তাফসির, নানান ধর্মীয় বই। মা মারা যাবার পর বাবা খুব একা হয়ে যান। রাতে শুয়ে শুয়ে মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করেন। ‘কবর’ আর ‘দুই বিঘা জমি’ এ দুটো ছাড়া আর পারেন না। যদি জিজ্ঞেস করি, এত রাতে আবৃত্তি করছেন কেন? বলেন, ঘুম আসে না! বাবা আমার খুবই কাঠখোট্টা টাইপ গুরুগম্ভীর লোক। তবে বাবা কড়া না, খুবই নরম প্রকৃতির মানুষ। গল্প করতে পারেন না। তবে সূক্ষ্ম রসবোধ আছে। মা খুব আড্ডাবাজ হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই বাবার সাথে একটা দূরত্ব ছিল। আমি বাবার তেমন সেবাও করি না। তবে বাবা তাঁর ছোট কন্যা হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন এবং বাসার অন্যদের চেয়ে আমিই তাঁর সাথে বেশি ফ্রি।


তো যা-ই হোক, মা মারা যাবার পর আবার এক সপ্তাহের মধ্যে উঠে দাঁড়ালাম। কোচিং-এ গেলাম। মেজো বোন একদিন বলল, তুমি যদি এই সম্পর্ক রাখো তো এই বাড়িতে আমার মরামুখও দেখতে আসবে না। নানান মানুষের নানান কথায় আমার মাথাই গরম হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলাম, একটা ইন্টার-পাস ছেলেকে কী করে আমার পরিবারের সামনে এনে দাঁড় করাব? ওর সাথে দেখা করলাম। আমার একটা স্বভাবের কথা বলি। আমি জোডিয়াকে বিশ্বাসী। একসময় অ্যাস্ট্রোলজির চর্চা করতাম। মকররাশির জাতকরা যখন তখন মাথা গরম করে উলটাপালটা বকে। এরা কী বলে রাগের সময়, নিজেও বুঝে না। তবে এদের রাগ বেশিদিন থাকে না। ভুলে যায় তাড়াতাড়ি সব। তবে এবার আর ভুললাম না পরিস্থিতির কারণে। রাগের মাথায় ওকে অনেক কটুকথা বললাম। আর আল্টিমেটাম দিলাম, উন্মুক্ততে আবার নতুন করে পড়াশোনা করে আমার যোগ্য হয়ে আসতে। সাথে একটা চাকরির জন্য যেন চেষ্টাও করে। সে একটা কথাও বলল না, শুধু শুনল।


এরপর এক মাস দুই মাস তিন মাস চার মাস চলে গেল সে আর কোনও যোগাযোগ করল না। অথচ ওই সময় সদ্য মাকে হারিয়ে আমার মানসিক অবস্থা ছিল চরম বেহাল। এসময় কাছের মানুষের সাপোর্ট দরকার ছিল। পেলাম না। চার মাস নামাজ পড়ে অনেক কান্নাকাটি করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, যে ছেলে আমার সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তে আমার পাশে ছিল না, তার জন্য কেন আমি আমার পরিবার ছাড়ব? অতএব, ব্রেকআপের সিদ্ধান্ত নিলাম। চার মাস পর যখন ও আবার যোগাযোগ করল, তখন আমি সরাসরিই ব্রেকআপ করতে চাইলাম মিউচুয়ালি। ও অনেক কাঁদল। মানতে কষ্ট হলো ওর। আমি ডেসপারেট, এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসব। এতদিনে আমার বোধোদয় হলো, এ সম্পর্কে আমরা কেউই সুখী হতাম না। জেনারেশন-গ্যাপ, সাথে যোগ্যতার প্রশ্ন। মেয়েরা সব সময়ই তার থেকে বেশি যোগ্য ছেলে ডিজার্ভ করে, এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে সংসার সুখের হবে না। ছেলেটা এক বছর কান্নাকাটি করল। মেসেজ দিত, রিপ্লাই দিতাম না। এক বছর পর ও বিয়ে করে ফেলে। দেখে আমি খুশি হই।


ব্রেকআপের পর ওর প্রতি আমার কোনও অনুভূতিই ছিল না বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, সম্মান ছাড়া। ২০০৫ থেকে ২০১৫, টানা দশ বছর লাগে আমার একটা ইল্যুশন থেকে বের হতে। ওর প্রতি আমার এ কারণেই শ্রদ্ধাসম্মান বেশি ছিল যে আমরা বিবাহবহির্ভূত কোনও সম্পর্কে জড়াইনি। আমি এ বিষয়ে খুব স্ট্রং ছিলাম। মানুষ যা দুমাসের মাথায় করতে পারে, আমরা দশ বছরেও তা করিনি। বিলিভ ইট অর নট! ধর্মীয় নৈতিকতার কিছু বেড়াজাল তো ছিলই, সাথে একটা ব্যাপার কাজ করত---সবকিছু বিয়ের আগেই কেন শেষ হবে! বিয়েটা আমার কাছে রহস্য হয়েই থাক না। বিয়ের আগে সেই রহস্যউন্মোচনের ইচ্ছে আমার নেই। সে-ও আমাকে কখনওই এই ব্যাপারে জোর করেনি। এখানেই সে আমার অন্যান্য বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডদের চাইতে ব্যতিক্রম। এজন্যই ওর প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা।


আমাদের বন্ধুত্বটা এখনও আছে। তার প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ, ভালোবাসা কোনওটাই নেই, শুধুই শ্রদ্ধা আছে। মাঝেমাঝে সে ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নেয়। মা মারা যাবার তিন বছর পর একবার আমার সাথে দেখা করে। তাকে এতগুলি দিন অপেক্ষা করানোর জন্য আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। সে বলেছে, ‘তুমি তো আমার সাথে কোনও প্রতারণা করোনি, ক্ষমা চাইবার প্রশ্নই উঠে না। যদি কিছু গোপন করি, আমি করেছি। তোমার সাথে মিথ্যা বলেছি দিনের পর দিন। তোমার তো কোনও দোষ নেই এখানে। আমি সব সময় তোমার জন্য দোয়া করি। একটা সময় যখন আমার খারাপ অবস্থা ছিল, তখন তুমি পাশে ছিলে। আজ আমার অবস্থা ভালো, কিন্তু তুমি পাশে নাই।’


আসলে আমি সব সময়ই একটা ক্লিন-ইমেজ নিয়ে চলেছি। নেক-নিয়ত সব সময় মনে রেখেছি। কাউকে ঠকানোর নিয়ত আমার ছিল না, নেইও। আমরা এই সম্পর্কে কেউই সুখী হতাম না, সেটা অনেক পরে বুঝেছি। সম্পর্কে সামাজিক অবস্থানের একটা সামঞ্জস্য দরকার। যা-ই হোক, এই প্রেমোপাখ্যান এখানেই শেষ। এরপর আমার জীবনে আসে এক অন্যরকম সংগ্রাম! সংসারে মা নেই। বাবা একেবারেই সংসারী নন। সিঙ্গেল-মাদারের ভূমিকায় আমাকে অবতীর্ণ হতে হয়। আগেও ছিল, এখন একটু বেশি। আমি আর মেজো বোন পালাক্রমে দুজন এই সিঙ্গেল-মাদারের ভূমিকা পালন করতাম। আর বাচ্চাটা যে, সে আমাদের বড়ো বোন। আমাদের দুই বোনদের বড়ো আদরের বড়ো বোন। সেই গল্পই নিয়ে আসছি।


আমার বড়ো বোনের নাম শাহানা। শাহানা অর্থ রাজকুমারী। নানাভাই ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ থেকে মিলিয়ে এই নাম রেখেছেন। ও সত্যিই রাজকুমারী আমাদের পরিবারের। আমি সবার ছোট হওয়া সত্ত্বেও আদরের ভাগটা সে-ই বেশি পাবে, এমনকি শাসনের ভাগটাও! এতে অবশ্য আমার দুঃখ নেই। বরং সবার সাথে আমিও সামিল হয়ে আরও বেশি আদর-শাসন করি ওকে! সে লম্বা, শ্যামবর্ণের। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। চুলগুলি ববকাট। কখনও, বয়কাটও করে রাখা। আমিই ওর চুল কেটে ছোট করে রাখি। সে হাসলে সাদা ঝকঝকে কী সুন্দর দাঁতগুলি দেখা যায়! ওর মতো মিষ্টি সুন্দরী বোধকরি আমাদের বাসায় আর কেউই না। ওর গালে একটা পোড়াদাগ আছে। আমি সেখানে চকাস করে চুমু খাই। সারাক্ষণই খিলখিল করে হেসে টইটই করে হেঁটে বেড়ায়, আর রাগ উঠলে ভীষণ রেগে যায়, যাকে সামনে পাবে, তাকেই খামচি দিবে, চুল টান দিবে! মাঝেমধ্যে আমি বা অন্যরা রেগে গেলে ওকে হালকা মারি। ও ভীষণ ভয় পায়, চোখ বন্ধ করে রাখে। আমি ওকে ডাকি শাহানাবুড়ি, চাঁদের কণা, কাচকিপোনা, জাদুসোনা, লক্ষ্মীপক্ষি, কালোপরী আরও কত্ত আদুরে নামে!


ওর ফিজিক্যাল গ্রোথ স্বাভাবিক, কিন্তু মেন্টাল গ্রোথ দুবছরের বাচ্চার ব্রেইনের সমান। আপু ব্রেইন-প্যারালাইজড বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কিছুই বলতে পারে না। কিছুই বুঝে না। তাই বলে সে বোবা নয়। আবোলতাবোল হাবিজাবি কথার ফুলঝুড়ি-বুড়ি! শুধু এই নামগুলি বলতে পারে---কাকা, আম্মা। বাবাকে ডাকে পাপা। আর আমার নামটা ছোট মেয়ে হিসেবে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বলে নামের কাছাকাছি কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ‘আন্নি’। আর চা-কে বলে কা। ও অটিস্টিক চাইল্ড। যখন ঢাকায় ছিলাম, ইস্কাটনে ওদের একটা প্রতিষ্ঠানে ওকে নিয়ে যাওয়া হতো প্রতিদিন। সেখানে ওদের গান-নাচ শেখানো হতো। কিন্তু পরে ঢাকা থেকে চলে আসায় আর নিয়ে যাওয়া হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। ও জন্ম থেকেই অ্যাবনর্মাল, তবে শারীরিকভাবে নয়। জন্মের সময় ওর অক্সিজেনের অভাব ছিল, বাঁচারই কথা ছিল না। বেঁচেছে, তবে ব্রেইনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ও কিছুই বুঝে না, কিছুই করতে পারে না। দেখা গেল, খুব কাঁদছে। পেটব্যথা মনে করে ওষুধ খাইয়ে দিই। পরে দেখি, না, ওর পেটে ব্যথা নেই। ওর বোধ আছে, বুদ্ধি নাই। না আগুন, না শীত, না গরম। গায়ে ব্যথা হলে বলতে পারে না। কোনও দিনই, ওর যে কোথায় ব্যথা, আমরা কেউ জানতে পারি না। বাথরুমের কথাও বলতে পারে না। আমরা সময় করে করে ওকে বাথরুমে নিয়ে বসাই। ঠিক সময়ে না বসালে ও কাপড় নষ্ট করে দেয়। আমরাই পরিষ্কার করি। খাইয়ে দিই। কাপড় পরিয়ে দিই। সব করি। একজন মা তার শিশুকে যেভাবে যত্ন করে বড়ো করে, ঠিক সেভাবেই করি সবকিছু।


এ ধরনের বাচ্চারা খুব চঞ্চল প্রকৃতির। ওদের সামলানো মুশকিল। সারাক্ষণই চোখে চোখে রাখতে হয়। কখন কী মুখে দিয়ে গলায় ঠেকে মরে, কখন মেইনগেটের দরোজা খুলে রাস্তায় গাড়ির নিচে মরে! হাজার হাজার টেনশন। রান্নাঘরে একবার নিচে শুয়ে চুলার উপর পা তুলে দিল। পায়ের পাতা থেকে ঊরু পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে। ড্রেসিং করেছি। সেই পা নিয়েই সারাঘর দৌড়ে বেড়ায়। নতুন বাসায় রান্নাঘরে মা দরোজা দিয়েছে। যতবার কিচেনে ঢুকি, দরোজা আটকাই। যতবার বের হই, ততবার দরোজা আটকাই। একবার যদি ভুল হয়, দেখব, সমস্ত তেল নুন আটা চারিদিকে ফেলে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে। একবার মরিচের গুঁড়া খেয়ে সারাশরীরে মাখল। তখন রাত বারোটা। ওর মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছে। সাথে সাথে সাবান ডলে ডলে ওকে গোসল করালাম। খাটের প্রতিটি পায়া কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছি। কোনায় যাতে পা লেগে ব্যথা না পায়। তারপরও কোথায় কোথায় ব্যথা পেয়ে পায়ের আঙুলগুলি ভেঙে ফেলেছে। এই ভাঙা পা নিয়ে সে দৌড়ে বেড়ায়। শীতের রাতে বিছানায় ওয়ালক্লথ বিছানো হয়। তাতে প্রস্রাব করে সারারাত ভিজার মধ্যে শুয়ে থাকে। মেহমানের রুমে ওকে ঢুকতে দিই না। কাচের জিনিসপত্র ভেঙে তাতে গড়াগড়ি খাবে। মুড়ির পটটা খাটের নিচে লুকিয়ে রাখি। পেলে খুলে সারাঘর ছড়িয়ে ফেলবে।


বাথরুমের দরোজাটা সব সময় বন্ধ রাখি। একটু ভুল হলেই ভিতরে ঢুকে সাবান, পেস্ট খেয়ে ফেলে। পড়ার টেবিলে কোনও বই-খাতা রাখতে পারি না। বই-খাতা সামনে পেলে ছিঁড়ে ফেলে। ওগুলি লুকিয়ে রাখি। এমনই হাজার হাজার উৎপাত। বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। পুরো ঘরটাই ওর উপযোগী করে সাজানো। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই জীবনে। জীবনে কোনও দিন পুরো ফ্যামিলি মিলে কোথাও যেতে পারি না। ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় না। নেওয়া সম্ভবও না। এরকম একটা অটিস্টিক মানুষ, একেবারেই কিছু না-বোঝা বয়স্ক বাচ্চামেয়ে যে ফ্যামিলিতে আছে, তারাই শুধু সার্ভাইভ করতে পারে সে মানুষটাকে নিয়ে। কতটা যে ভুক্তভোগী তারা, সেটা আর কেউ বুঝবে না। আমরা কারও সাথে মিশি না, কারও বাসায় যাই না। বাসায় কেউ এলে সবার আগে ওকে গিয়ে ধরি, কাপড় ঠিক আছে কি না, বাইরের মানুষকে যেন না ধরে, এইসব খেয়াল রাখি। আমি আর মেজো বোন, দুজন ওর ডানহাত বামহাত। বেশিরভাগ কাজ দুজনেই করি। আমরা প্রচণ্ড ভালোবাসি ওকে! এমন ভালোবাসা বাবা-মাকে দূরে থাক, নিজের সন্তানকে বাসতে পারব কি না, জানি না। সমস্ত ভাবনা ওকে ঘিরেই আমাদের।


মা মারা যাবার পরে দায়িত্বটা আরও বেড়ে গেল। আগে তো ওকে মা খাওয়াতেন, এখন সেই দায়িত্বটা আমার উপর। মেজো বোন এলাকার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে জব করে। আর বাবা এসব কিছুই বুঝেন না। রাতে তিন বোন একসাথে ঘুমাই। সকালে বোন স্কুলে যায়। আমি বড়ো বোনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। যতক্ষণ ও না উঠে, আমিও উঠতে পারি না। ও উঠলেই, রান্নাঘরে খাবার রেডি করা থাকে, একদৌড়ে নিয়ে আসি। খাওয়ানো শেষ হলে এরপর ওকে পাহারা দেবার কাজ। কিছু মুখে দিল কি না, কোথাও আছাড় খেয়ে ব্যথা পেল কি না। দরোজা খুলে বাইরে চলে গেল কি না। প্রচণ্ড টেনশন। মেজো বোন স্কুল থেকে এলে আমার দায়িত্ব শেষ। বই-খাতা গুছিয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি যাই বন্ধুদের সাথে বিসিএস-পড়াশোনা করতে। ফিরি বিকালে। বাসায় কলিংবেলের শব্দ পেলে বড়ো আপু যেখানেই থাকুক, দৌড়ে ছুটে আসে দরোজার সামনে। আমাকে দেখে আন্নি আন্নি করে খুশিতে চেঁচায়। দেখে, হাতে কিছু নিয়ে এসেছি কি না। যখন চুপিচুপি আমার ঘরে নিয়ে চকলেটটা খাওয়াই, পরম তৃপ্তিতে চাখুম চাখুম করে খায়। রাতে পড়তে বসলে আমার বইটা টেনে নিবে। কলমটা কেড়ে হাতে ফুল এঁকে দেবার জন্য হাতটা পেতে দিবে।


আমাদের বাড়িটা আগে একতলা ছিল। আস্তে আস্তে আশেপাশে বিল্ডিং-এ ভরে যায়। ও সারাদিন হাঁটত, আর জানালার পাশে বসে বসে বাইরে দেখত। আশেপাশে বাড়িঘর হয়ে গেলে ও আর কিছুই দেখতে পারে না। আমাদের বাড়িটাও কেমন জানি অন্ধকার হয়ে গেল। বুবু সারাদিন অন্ধকার-ঘরে হাঁটাহাটি করে। জানালার পাশে বসে উঁকিঝুঁকি করে, কিন্তু কিছুই দেখতে পারে না। বাইরে যেতে ওর খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আমরা যেতে দিই না। আশেপাশের লোক হাঁ করে দেখবে। হয়তো ছোট বাচ্চারা দ্যাখ দ্যাখ পাগল বলে দু-চারটা ঢিল মারবে। ওসব দেখে আমাদের খারাপ লাগবে। আমরা যখন বাইরে থেকে কাজ সেরে আসি, ও একদৌড়ে এসে খুশিতে আমাদের জাপটে ধরে। তখন আমাদের মনে হয়, জীবনটা সুন্দর। ভালোবাসা পেলে পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষটিও হাসিমুখে বেঁচে থাকতে পারে।


বাবার কাছে অনেক কেঁদেকেটে দোতলা করার জন্য আবদার করি। শুধুই ওর জন্য। বাইরের কিছুটা আলো-বাতাস তাহলে সে দেখতে পাবে। বাবা কিছুতেই রাজি না। শেষে আমার অনেক চাপাচাপিতে দেশের বাড়ির জমিজমা বিক্রি করে দোতলা বাড়িটা করলেন। তখন বুবুর খুশি দেখে কে! নতুনবাড়িতে যেদিন ওকে ওঠালাম, সেদিন ওর পায়ে ফুল ছিটাতে ছিটাতে ওকে সেখানে নিয়ে গেলাম। বুবু সে কী খুশি! সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় শুধু হাততালি দিচ্ছিল! তবে নতুন পরিবেশ পেয়ে প্রথমে সে খুব ভয় পেল। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই পুরো বাড়িতে ফুরফুর করে দাপিয়ে বেড়ায় সে। বড়ো বড়ো রুমের বড়ো বড়ো জানালা। একবার এই ঘরে তো আর-একবার অন্য ঘরে। সে প্রথম প্রথম দিকটিক ঠাওরাতে পারত না। ঘুরেফিরে একই ঘরে বারবার যেত। রুমের পাশে জানালার কাছে বসে বাইরে দেখত। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত। জানালায় ওইটুকু দেখাই ওর একটুকরো পৃথিবী। বুবুর চোখে রাজ্যের ভাষারা খেলত। সেখানে আনন্দ ছিল, বিষাদও ছিল। আমরা বুঝতে পারতাম। বাইরের লোকজন অবশ্য বুবুকে দেখলে বিরক্তই হতো। এটাই স্বাভাবিক। বুবু ওদের কে? কেউ তো না! বুবুর এমন অস্বাভাবিক আচরণ বাইরের কেউ সহ্য করবে কেন? কিন্তু আমাদের জন্য বুবু ছিল বড়ো আদরের ধন!


মা দেখে বলতেন, সুকান্তের সেই কবিতাটার মতো…এক মোরগ প্রাসাদের বাইরে থেকে প্রতিদিন প্রাসাদ দেখত, আর দেখে দেখে তার খুব প্রাসাদের ভেতর যেতে ইচ্ছে করত। একদিন মোরগটা গেল প্রাসাদের ভিতর, তবে খাবার হয়ে।…ঠিক তেমনিই ওর খুব বাইরে যেতে ইচ্ছে। একদিন সে ঠিকই বের হবে এই বাড়ি থেকে, তবে লাশ হয়ে। মায়ের কথা শুনে আমাদের কেমন জানি লাগত, তবু কিছু বলতাম না।…আমাদের দোতলা করার পর সুখ একটু একটু করে আসছিল। কিন্তু মায়ের সুখ আমাদের বেশিদিন সইল না। সারাজীবন টানাটানি করে হিসেব করে চলা মহিলাটি দোতলার সুখ নেবার কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন। এখন আমাদের যত আনন্দ বেদনা, সব শাহানাকে ঘিরেই। ও আমাদের জীবন্ত খেলনা। আমি আর কোনও বাচ্চাকে আদর করতে পারি না, কোলে নিতে পারি না…শুধু ওর জন্য।


এর মধ্যেই কোনওমতে পড়াশোনা চালিয়ে যাই। লাইব্রেরিতে ম্যাথের বন্ধুদের সাথে বেশি মিশি। পিএসসি’র অন্য পরীক্ষাগুলি তেমন দিতাম না। অন্যদের মতো বিসিএস নামক ক্রেজে আমিও গা ভাসিয়ে শুধুই বিসিএস পরীক্ষা দিই। ৩৭তম দিলাম। হলো না। বিসিএস প্রিপারেশন নিতে গিয়ে দেখলাম, আসলে অ্যাকাডেমিক পড়া আর চাকরির পড়া দুটো একদমই ভিন্ন। অ্যাকাডেমিক পড়ার তেমন কিছুই চাকরির পরীক্ষায় কাজে লাগে না। খেয়াল করলাম, চাকরির পড়া পড়তে গিয়ে অ্যাকাডেমিক পড়া যা পড়েছি, তার সবই সব ভুলে যাচ্ছি। অথচ কত যত্ন করে, নোট করে অ্যাকাডেমিক পড়া তৈরি করেছি একসময়! ক্লাসে এত ভালো ভালো রেজাল্ট করলাম, সেগুলির দামটা আর কই থাকল এখন? আমার কাছে চাকরির চেয়ে বোনটার যত্নআত্তি আগে। সে-ই আমার কাছে বড়ো, প্রয়োজনে চাকরিই করব না। প্রয়োজনে বিয়েও করব না। তার উপর মা না থাকাতে ওর দায়িত্বটা এখন আমাদের উপর আরও বেশি। ওর শরীরে আগে থেকেই নানা সমস্যা। ওকে তো আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারি না। আমাদের বাসার পাশে একজন মহিলা-ডাক্তার আছেন। বয়স্ক, কিন্তু উনি মাকে খালাম্মা ডাকতেন। তাই আমরা ওঁকে হেমা আপু বলেই ডাকতাম। উনিই মাঝে মাঝে বাসায় এসে শাহানাকে দেখেন।


শাহানা নিজের যত্ন নিতে পারত না বলে ওর দাঁতগুলি নষ্ট হয়ে পড়ে যেতে থাকে। আমরা যতটুকু পারি, করি। ওর কিডনিতেও সমস্যা। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে পেট ফুলে থাকে। কিন্তু প্রস্রাব হয় না। প্রচণ্ড অস্থির হয়ে সেসময় সে দৌড়াদৌড়ি করে। আমাদেরও টেনশনে নাভিশ্বাস অবস্থা। একসময় সে হাসে, তখন ওকে বাথরুমে নিই। সে প্রস্রাব করে। আমাদের যে কী আনন্দ হয় তখন! ব্লাডটেস্ট করাতে গিয়ে ধরা পড়ে, ওর ক্রিয়েটেনিন অনেক কম। এ অবস্থায় ওর চিকিৎসা করাব কীভাবে? ডাক্তারের কাছে তো নিতে পারব না। নেট ঘেঁটে কী কী পথ্য খেতে হয় কিডনিরোগে, দেখা শুরু করি। এ ছাড়া তো আর কোনও টেস্ট করানো সম্ভব না। অবস্থা খারাপ হলে মাঝে মাঝে ডাক্তার এসে দেখে যায়। একটা সময় ওকে ক্যাথেটার দিয়ে প্রস্রাব করানো শুরু করা হয়। এই কাজটা আমার মেজো বোন ভালো পারে। এতকিছুর পরও, শত কষ্টেও আমার বোনটা সব সময় হাসে। খাটে যদি বসা থাকি, ও কোথা থেকে উড়ে এসে অমনিই ধপ্‌ করে আদুরে বেড়ালের মতো আমার কোলে পিঠ এলিয়ে শোবে।


২০১৭ সাল। আমি অন্যঘরে, পড়ার টেবিলে। শোবার ঘরে খাটে উঠে চিত হয়ে কারও কোল মনে করে হেলান দিতে গিয়েই খাট থেকে পড়ে গেল সে। এরপর থেকেই প্রচণ্ড অস্বাভাবিক আচরণ। আর উঠতে পারল না। আর কোনও কথাও বলতে পারল না। ব্যথায় সমস্ত মুখ নীল হয়ে গেল। ওকে আমরা বিছানায় শুইয়ে দিলাম, আর সেখানে সে অস্থির হয়ে প্রচণ্ড ছটফট করতে লাগল। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার তেমন কিছুই করতে পারলেন না। আমরা চারপাশে বসে সারারাত ওর হাত পা মালিশ করলাম। বাবা শিয়রে বসে সুরা পড়লেন। ভোরবেলায় অনেক কষ্টে কোনওমতে কোলে করে ট্যাক্সিতে ওকে সিএমএইচ নিয়ে গেলাম। একরাত বেডে ছিল। ক্যাথেটার দিয়ে প্রস্রাব বের করতে গেলে খালি রক্ত বেরোয়! ইনার-ব্লিডিং। হেমাচুরিয়া। কোনও লাভ হলো না। ওখান থেকে উন্নত হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হলো। তারা ওর কিডনির টেস্ট করে বলল, কিডনিতে পানি এসেছে। রাত দুইটায় ওখান থেকে পাঠিয়ে দিল। শেষচেষ্টা হিসেবে অনেক কষ্টে ওকে আর-একটা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার কিছুই বললেন না। কিছু ওষুধ দিলেন, এই যা! এরপর সে প্রায় তেরো-চৌদ্দদিন বিছানায় পড়া। নিথর দেহ। নড়াচড়া নাই, কোনও কথা নাই। কী যে কষ্ট, কী যে চাহনি ওই করুণ দুইচোখে। শুধু চামচে করে পানি, স্যালাইন, ফলের রস খেত। বিছানার সাথে লেপটে গেছে শরীর। আমদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল আমাদের টুনটুনিপাখিটা।


৪ জুন ২০১৭। অষ্টম রোজা, আমার ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ঠিক ছয় মাস আগে। সকালবেলা ওর পাশে বসে আছি। আমার হাতে কলম। ও হাত পেতে দিল কলম দিয়ে এঁকে দেবার জন্য। আঁকলাম। হাতটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না। হাতটা পরে গেল। আবার অনেক কষ্টে হাতটা মুখের কাছে এনে চেষ্টা করল, কী এঁকেছি দেখতে। বেশিক্ষণ পারল না। পড়ে গেল। দুপুরে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিল। তারপর আবারও। আমি আব্বুকে ডাক দিলাম। মেজো বোন আমার পাশেই ছিল। আব্বু বড়ো আপুকে উত্তরদিকে মাথা দিয়ে শুইয়ে সুরা-ইয়াসিন পড়া শুরু করলেন। বাবাকে খুব ভালোবাসত সে। দুইবার বাবার কোলে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। সে হয়তো বুঝে গিয়েছিল, এটাই ওর বাবাকে শেষ ধরা। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় হঠাৎ করে একবার ঈশানকোণে চেয়ে একটুখানি হাসল। কাকে দেখেছিল সে? আম্মুকে? এরপর জিভটা বের করল, আমি তাতে চামচে করে পানি ঢেলে দিলাম। পুরো ঠোঁটটা নীল। নিঃশ্বাস নেবার ব্যর্থচেষ্টা করেই যাচ্ছে। চোখগুলি স্থির। পলক ফেলছে না। দুনিয়াকে দেখার জন্য শেষবারের মতো আপ্রাণ চেষ্টা। আমি ওর চোখ বন্ধ করে দিলাম। আপু তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমরা নিশ্চিত না কখন শেষনিঃশ্বাস ছাড়বে বা আদৌ ছেড়েছে কি না। বাবা তুলা নিয়ে নাকের কাছে রাখলেন। তুলা বাতাসে নড়ল না। আমরা নিশ্চিত হলাম।


আমাদের চোখের সামনে আমাদের প্রাণভোমরা জানপাখিটা চলে গেল! শাহানা নামের একটা অধ্যায় সমাপ্ত হলো। আমি একটুও কাঁদলাম না। একটা নিষ্পাপ শিশুর নরক থেকে স্বর্গে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া দেখলাম। ওর মুক্তি আমাকে পুলকিত করল। বেঁচে থাকলে শুধু যন্ত্রণাই পেতো বেচারি। এখন ওর অফুরান সুখ। মিলটনের প্যারাডাইজ লস্ট-এর লাইন মনে এল--- Death is the golden key that opens the palace of eternity. সেদিন অলক্ষে ঈশ্বর হেসে বলেছিলেন কি না জানি না---আভি তো পিকচার বাকি হ্যায়!


বড়ো বোন মারা যাবার এক সপ্তাহ পর আবার উঠে দাঁড়ালাম। একটা চাকরির পরীক্ষা দিলাম। কী একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছি। না ভালোলাগা, না খারাপলাগা, না আনন্দ না বিষাদ---এমন একটা বিবশ অনুভূতি গাঢ় থেকে আরও গাঢ়তর হতে আরও কিছুদিন সময় নেয়।


মেজো বোনের সাথে ছোটবেলা থেকেই আমার খুব একটা বনিবনা ছিল না। টানা বারো বছর আমরা কথা বলতাম না। মা মারা যাবার পর আমরা দুবোন আবার কথাবলা শুরু করি। এই মেজো বোন আমার বারো/তেরো বছরের বড়ো। তখনও বিয়ে করেনি। ও দেখতে অতিসুন্দরী। জীবনে বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছে। বিয়ে করার প্রতি ওর তেমন আগ্রহ নেই। বাসায় প্রচুর প্রস্তাব আসত। যখন মা ছিলেন, মা খুব বাছতেন, সহজে পাত্র পছন্দ হতো না। মা চাইতেন বাবার মতো লম্বা সুপুরুষ পাত্র। মোটামুটি শিক্ষিত, চাকরিজীবী হলেই হলো। আর বাবা চান নামাজি পাত্র। খুব বেশি টাকা পয়সা চাই না আমরা। তবে বাছাবাছির পর্যায়টা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। যেমন আমেরিকার নাসায় চাকরি-করা ছেলেটা যেমন কালো তেমন বিশালদেহী বলে ছেলেটাকে না করা হলো। ম্যাজিস্ট্রেট পাত্র দাড়ি রেখেছে বলে বোন রাজি না! পেট্রোলপাম্পের ব্যবসায়ী বিশাল বড়োলোক ছেলেটার কপালটা একটু বেশিই বড়ো! ট্যাক্সের সরকারি চাকুরে ছেলেটার অনেক জমি! সরকারি চাকরি করে এত জমি! নিশ্চয়ই ঘুষ খায়! অতএব, বাদ! কারও বাড়ি নোয়াখালী, কারও বরিশাল! এহেন হেন তেন কারণে পাত্র অপছন্দ!


অবশ্য, আমাদেরও যে অপছন্দ করত না, তা না। বেশিরভাগই অপছন্দ করত বড়ো বোন অ্যাবনর্মাল দেখে। তো এভাবে বাছতে বাছতে ওর বিয়ে হচ্ছিল না। এর মধ্যে আমার জন্যও হাতেগোনা কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে। যেহেতু আমার মেজো বোনই এখনও বিয়ে করেনি, তাই আমি ছোট বলে আমার জন্যও তেমন সম্বন্ধ আসত না। আর মেজো বোনের জন্য এই যে এত বাছাবাছি, হয়তো বাবা-মায়ের পরিবারের বড়ো বোনটা বাদে ও-ই বিবাহউপযুক্ত প্রথম, এজন্যই এত বাছবিচার, এত আশা। আর সে দেখতেও সুন্দরী, তার সাথে যোগ্যও। একইসাথে যোগ্য ও সুন্দরী মেয়েদের এত সহজে বিয়ে হয় নাকি?


তো এর মধ্যে একদিন ছোট মামি আমার জন্য পাত্র নিয়ে হাজির। কোন এক ডিসির পুত্র। বিশাল বড়োলোক। ছেলের মা ব্যাংকার। ছেলে লন্ডনে পড়াশোনা করে। দেখতে ভোম্বলদাস টাইপ। যেমন কালো, তেমন মোটা। একটা কথাও কয় না। যে কয়টা কয়, তা-ও কয় বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে লন্ডনের অঞ্চলভিত্তিক স্ট্রিট-ল্যাঙ্গুয়েজের প্রনানসিয়েশনে। অনেকটা র‍্যাপ হিপহপ টাইপ ছেলে। আমার একটুও পছন্দ হয় নাই। আমাকে ছেলের মা জিজ্ঞেস করলেন, রান্না জানো? বললাম, না। কোরান পড়তে জানো? বললাম, না। এরপর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করে বললেন, মাস্টার্স শেষ করেছ কবে? এখনও চাকরি পাওনি! বললাম, চেষ্টা করছি। (মনে মনে বললাম, চাকরি যে পাইনি, তা তো জানেনই। জেনেই এখানে এসেছেন। তারপরও এতটা অবাক হয়ে এটা মুখে বলার কী মানে? না কি কাউকে অপমান করার সুযোগ পেলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না? আমার বয়সে আপনি নিজে কী করতে পেরেছিলেন আপনার জীবনে?)


তো আর কী! পরবর্তীতে বাবাকে বললাম, আমার ছেলে পছন্দ হয় নাই। আরও বললাম, আমি এখন বিয়ে করব না। আগে চাকরি করে এস্টাবলিশ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। তা ছাড়া বুড়োবাপকে একা রেখে আমি শ্বশুরবাড়ি থাকব কেমন করে? জীবনে কোনও দিন নিজের বাসা ছাড়া কোথাও থাকিনি। বাবা সব মেনে নিলেন। ইন ফ্যাক্ট, বাবা আমার খুবই নরম প্রকৃতির মানুষ, তিনি আমার সব ইচ্ছেই মেনে নেন। কক্ষনো আমার বিরুদ্ধে জোর করেন না। বাবা ছোট মামির আনা পাত্রের ঘটককে না করে দিলেন। আসলে ওই ছেলেকে বাবারও তেমন পছন্দ হয়নি। আর আমি তো প্রবাসীছেলে বিয়ে করব না বলে ঠিক করে রেখেছি। বিদেশ হলো ফ্রি-সেক্স-এর জায়গা। ওসব জায়গায় ছেলে-মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা। নিজেও বিদেশ যেতে চাইনি কখনও মা-বাবা বড়ো বোনকে ছেড়ে। তা না হলে আইইএলটিএস পড়তাম, স্কলারশিপের খোঁজখবর নিতে শুরু করতাম সে কবেই। আমি মানা করায় মামি ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।


(চলবে…)