তোমরা যারা এপ্লাস পাওনি

তোমরা যারা এপ্লাস পাওনি, তারা মন খারাপ কোরো না।


কেন করবে মন খারাপ? তোমরা কি সত্যিই জানতে না যে এপ্লাসটা পাবে না? আরাম করে ফাঁকিটা যখন দিচ্ছিলে, তখন কি মাথায় ছিল না যে আজকে এভাবে কাঁদতে হবে? নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখো তো সত্যিই কি পড়াশোনাটা করেছিলে ঠিকমতো? হ্যাঁ, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের সামনে কান্নাকাটি করছ তো করো! ওটা একটা ভদ্রতা। রেজাল্ট ভালো হয়নি, একটু কান্নাকাটি না করলে কেমন জানি খারাপ দেখায়! কিন্তু তার সাথে নিজের বিবেককে পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করে দেখো, সত্যিই কি তুমি পড়ায় ফাঁকি দাওনি? বিবেককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও, তুমি এখন আর ছোট্টটি নেই। আজকে থেকে পৃথিবী তোমাকে আর ক্ষমা করবে না। সামনের দিনগুলিতে আরও টের পাবে---একেবারে হাড়ে হাড়ে, মাংসে মাংসে, রক্তে রক্তে! পৃথিবী জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না!


হ্যাঁ, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছ, যারা এপ্লাস পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাওনি। মানে কিছু 'ভালো স্টুডেন্ট' এপ্লাস মিস করে ফেলেছ। জেনে রেখো, এই পৃথিবীতে 'পাওয়ার কথা ছিল' বলে কিছু নেই। 'কী পেলে, কী পেলে না', সেটাই একমাত্র কিংবা শেষ কথা। তোমাদের জন্য সুখবর হলো, যদি পড়াশোনাটা সত্যিই করে থাকো, যদি বেসিকটা সত্যি সত্যি স্ট্রং হয়, তবে এর সুফল তোমরা পাবেই পাবে! অপেক্ষা করো। অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ইজ অ্যা ভেরি পুওর ইনডিকেটর ফর জাজিং সামওয়ানস ফিউচার।


কেউ কেউ এপ্লাসটা কেন যে পেয়ে গেছ, তা তোমরা নিজেরাও জানো না। হয়তো কাউকে মুখে কিছু বলছ না, 'পাওয়ার কথা ছিল, পেয়েছি!' এই জাতীয় ভাবও নিয়ে ফেলছ, তা-ও...মন তো জানে, মনের কী কথা! ব্যাপার নাহ্‌, এরকম হয়! আমি বুঝি বুঝি! আমরা আমরাই তো! তোমাদের দেখে, যারা এপ্লাস পাবে ভেবেছিল, কিন্তু পায়নি, ওরা খুব দুঃখ পাচ্ছে। খুশি হচ্ছ, খুশি হও। শুধু মাথায় রেখে দিয়ো, এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টটা দিয়ে আসলেই তেমন কিছুই এসে যায় না। সত্যিই যায় না, জেনে-বুঝেই বলছি। সামনে যেন কখনও এমন একটা দিন না আসে, যেদিন তোমরা জীবনের কাছ থেকে কখন যে লাথিটা খেয়ে ফেলেছ, তা নিজেরাও বুঝতে পারবে না! সাবধান হও। খুব সাবধানে পা ফেলো। নিজেকে তৈরি করতে থাকো। নিজেকে যন্ত্রণা দাও, নিজেকে খাটিয়ে নাও। জীবন মানেই এপ্লাস নয়। জীবন মানে---কে কতটুকু নিজেকে তৈরি করল আর ভাগ্যটাও তার পাশে কতটুকু থাকল...শেষঅবধি।


তোমাদের বেশিরভাগই এপ্লাস পেয়েছ ঠিকভাবে পড়াশোনা করেছ বলেই। তোমরা যে আনন্দটা পাচ্ছ, সেটা তোমাদের প্রাপ্য ছিল। প্রার্থনা রইল, আরও এগিয়ে যাও সামনের দিকে। সাথে এটা মাথায় রেখো, যারা এপ্লাস পায়নি, ওদের চাইতে তোমরা বেশিদূর এগিয়ে যাবেই, এমন কিছু কোনও অবস্থাতেই হবে না। সময় কথা বলবে, মিলিয়ে নিয়ো। মাথাটা নিচু করে অপেক্ষা করো। আজকে লাফাচ্ছ, বড়ো ভালো লাগছে দেখতে। সাথে পা দুটোর যত্ন নিয়ো, যাতে সেগুলি মজবুত থেকে যায়...ভবিষ্যতেও লাফানোর জন্য। আজ লাফালে, কাল থেকে আবার খুঁড়িয়ে চললে! এরকম হলে হবে? তখন তো সবাই হাসাহাসি করবে তোমাদের দেখে। তার চাইতে বড়ো কথা, নিজের কাছেই নিজে হেরে যাবে। পৃথিবীতে সবচাইতে বড়ো পরাজয় হচ্ছে, নিজের বিবেকের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ব্যর্থ হওয়া।


এপ্লাস না পেয়ে মন খারাপ করে আছ যারা, তোমাদের দেখে হাসি পাচ্ছে। কেন, জানো? দুটো কারণে।


এক। এপ্লাস পাওয়াটা কি সত্যিই বেশ বড়ো একটা ব্যাপার? একজন মানুষের যোগ্যতা যদি তার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট দিয়েই নির্ধারিত হতো, তবে পৃথিবীর ইতিহাসটা আজকে অন্যরকম হতো। জানি, এসব বলে লাভ নেই, সবাই রেজাল্টটাকেই দেখে দিনের শেষে। সাথে এ-ও জানি, দিনের শেষে আরও দিন থেকেই যায়। বাকিদের চোখ থাকলে থাকুক আজকের দিনের শেষটায়, তোমাদের চোখ রেখে দাও সামনের দিনগুলির শেষটায়। তোমাদের রেজাল্ট কী হলো বা হলো না, এবং তোমরা জীবনে কী হবে না হবে না,---এই দুইয়ের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই কোনও সম্পর্ক নেই কোনও সম্পর্ক নেই! একটা সহজ সূত্র মাথায় রেখে দাও: ক একজন ভালো স্টুডেন্ট। ক জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। অতএব, ক একজন ব্যর্থ ভালো স্টুডেন্ট। আসুন, আমরা দেখি, ক তার অতীতজীবনের গল্প করে করে কেমন এক আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে! এবং দেখা শেষ হলে, আসুন, এবার একটু হেসে নেওয়া যাক। হা হা হা...(কিছু মনে কোরো না, পৃথিবীটা মোটামুটি এরকমই!)


দুই। আমাদের সময়ে স্ট্যান্ড-করা বলে একটা ব্যাপার ছিল। একটা শিক্ষাবোর্ডে মেধাতালিকায় (মানে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে) মাত্র প্রথম ২০জন স্ট্যান্ড করত। ওদের সাক্ষাৎকার পেপারে ছাপা হতো। ওদের কে কত সময় ধরে টয়লেট করত, তা-ও দেশবাসী জেনে যেত পেপারের কল্যাণে। আমরা যারা স্ট্যান্ড করতে পারিনি, তারা ওদের দেখে এলিয়েন ভাবতাম। বাবা-মা ওদের পাধোয়া জলকে কোক-পেপসি-ফান্টা-মিরিন্ডা-স্প্রাইট ভাবতেন আর আমাদের খেতে বলতেন। আমরাও মনে মনে খেতাম বা খেতে বাধ্য হতাম। আজ বুঝি, ওদের পাধোয়া জল খাওয়ার কিছু নেই, কেননা পা আমারটা ধুলেও কিছু জল পাওয়া যায়, যা বাবা-মা তখন বোঝেননি। সত্যি বলছি, তখন কেউ 'মনের ভুলে' স্ট্যান্ড করে ফেলতে পারত না, যেমন করে তোমরা এখন অনেকেই 'মনের ভুলে' এপ্লাস পেয়ে যাও। হ্যাঁ, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই স্ট্যান্ডটা করতে হতো। একটা বোর্ডে প্রথম বিশ জনের মধ্যে থাকা! অত সহজ ছিল না 'ভালো নম্বর' পাওয়ার ব্যাপারটা! অঙ্কে ৯৯ পাওয়া আর ৮০ পাওয়া একই কথা ছিল না সেসময়। ৯৯ মানেই ছিল ৮০'র চাইতে ১৯ নম্বর বেশি! আজকের দিনে তোমরা অনেকেই ভাবতেও পারবে না, কতটা সম্মানের ছিল সেই স্ট্যান্ড করতে পারাটা! জীবনের বৃহৎ প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, সেটারই যদি কিছু সাময়িক আত্মতৃপ্তি বাদে আর তেমন কোনও মূল্য না থাকে, তবে তোমাদের এই এপ্লাস পাওয়া না-পাওয়া তোমাদের স্বর্গে নিয়ে গেছে বা যাবে কিংবা স্বর্গচ্যুত করেছে বা করবে---এমন আজব ভাবনা তোমার মাথায় আসছে কেন?


রেজাল্ট যা-ই হোক, শুধু মাথায় রেখো, পথ এখনও অনেক বাকি। সামনের দিনগুলি তোমায় কোথায় নিয়ে যাবে, তার কিছুই আজ বলা যাবে না। আজকে থেকে শুরু করে অন্তত ১০-১২ বছর পর তুমি নিজেকে কোথায় দেখছ কিংবা অন্যরা তোমাকে কোথায় দেখছে, সেটিই বলে দেবে, আজকের এই সুখ কিংবা দুঃখ কতটা অর্থপূর্ণ কিংবা অর্থহীন।...কাঁদো কাঁদো কাঁদো! সামনে হাসতে হবে। হাসো হাসো হাসো! সামনে কাঁদতে হবে।---নাহ্‌, এটা কোনও থাম্বরুল নয়! আমি এমন হতে অনেক দেখেছি বলেই বললাম। আবার এমন মানুষও দেখেছি, যারা আগেও হেসেছে, এখনও হাসছে। হায়, এমনও দেখেছি, কিছু মানুষ সারাজীবনই কাঁদে, কাঁদতেই বুঝি ওদের জন্ম!


যারা ভি-চিহ্ন দেখাচ্ছ, তাদের অভিনন্দন জানাই।
যারা ভি-চিহ্ন দেখাতে পারছ না, তাদের একটা টেকনিক শিখিয়ে দিই: তোমার হাতের তর্জনী ও মধ্যমা, এই দুই আঙুলকে ভি-আকৃতিতে ফাঁক করো, একইসাথে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাকি দুই আঙুলকে ভাঁজকরা অবস্থায় চেপে ধরো---ভি হয়ে গেল! ব্যস্‌!


মনে রেখো,
এপ্লাস একটি গ্রেডমাত্র, যোগ্যতা বা অযোগ্যতা নয়।
ভি একটা চিহ্নমাত্র, সাফল্য বা ব্যর্থতা নয়।
অপেক্ষা করো, যদি কখনও জীবন নিজেই তোমাকে ভি দেখায়, তবে সেদিনই বুঝবে,---হ্যাঁ, এর নামই জয়!