দেখবে, একদিন তুমিও

এক। জেমসের গান শুনে বাসায় ফিরছি। চেঁচিয়েছি ইচ্ছেমতো, লাফিয়েছি ইচ্ছেমতো, হাত-পা ছুঁড়েছি ইচ্ছেমতো। গলা ভেঙে গেছে, শরীর ব্যথা করছে, তাও খুব খুশি! আশেপাশে ছিল বন্ধুরা, সুপারকুউল জুনিয়র ভাইবোনরা। ওদের ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেছি। আমার ধারণা ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যারা পড়ে, ওরা আমাকে তেমন একটা পাত্তাটাত্তা দেয় না। ভুল জানতাম। আমার ভার্সিটিতে আমি এখন আর অপাঙ্ক্তেয় ন‌ই।

And, our day ended with James!

কিছু অবজারভেশন বলি।

একজন জেমস গান, গাওয়ান; নাচেন, নাচান। কাজটা সহজ নয়। অনেক দিনের সাধনায় একজন জেমস হ‌ওয়া যায়। উনি যখন গানের লাইন কিছু অংশ গাইলেন, আমরা চেঁচিয়ে বাকিটুকু গাইলাম। এসব গান রক্তে মিশে গেছে, চেঁচিয়ে না-গাইলে শান্তি লাগে না। রক্তে এমনিএমনিই মিশে না, এর জন্য আগে নিজের রক্ত ঝরাতে হয়।

ফ্যান যে কতটা ক্রেজি হতে পারে, এইসব আর্টিস্টকে কাছ থেকে (‘স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে’ অর্থে) না-দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। উনি যদি গিটার হাতে দাঁড়িয়েও থাকেন, কিংবা মুখে উয়া ওয়া রেপাপ্পা রেরেপাপ্পা জাতীয় শব্দও করতে থাকেন, তাও আমাদের ভালো লাগে, আমরা গানটা চেঁচিয়ে করতে থাকি। কার‌ও কার‌ও উপস্থিতিই যথেষ্ট। একজন জেমস আমাদের সামনে আছেন, এইটুকু অনুভূতিও আমাদের আনন্দ দেয়।

হি ইজ প্রফেশনাল। হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফেশনাল। উনি জানেন কী করতে হবে, উনি জানেন কী করতে হবে না। কখন শুরু করতে হবে, কখন থামতে হবে, উনি খুব ভালো করে বোঝেন। কী বলতে হয়, কতটুকু বলতে হয়, কখন বলতে হয়, উনার করায়ত্তে। উনি জানেন, আমরা উনাকে ভালোবাসি। উনি বোঝেন, একটা গোটা জেনারেশন উনার গান শুনে বড় হয়েছে, আর একটা জেনারেশন বড় হচ্ছে। সামনের কথা সামনের সময় বলে দেবে। যা-ই কিছু ঘটুক, উনার কিছু গান শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। যাবেই! সম্ভবত এটা উনি নিজেও জানেন।

এমন গ্রেটনেস আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। আমাদের ভাবতে ভালো লাগে, আমরা জেমসের সময়ে জন্মেছি, বড় হয়েছি। একজন জেমস স্টেজে উঠবেন জানলে আমরা শুধুই তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারি। কল্পনাতীত শ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া একজন জেমস তৈরি হয় না। সাথে কিছু মানুষের উপেক্ষা, মন্দকথা, কটূক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখানোর অভ্যাস। সে-দলে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের কথা আমরা মানি, কিন্তু যাঁদের কথা মানার সত্যিই কিছু নেই। ওঁরা কারা, ভাবুন, পেয়ে যাবেন, বুঝে যাবেন। মানার কিছু আছে কি নেই, সময়‌ই বলে দেবে।

জুনিয়রদের বলছি, যারা গাইতে পার, ছবি তুলতে পার, আঁকতে পার, লিখতে পার, কিংবা অন্য যা-ই কিছু পার, যা তোমার বন্ধুরা পারে না, সত্যি বলছি, এর চাইতে বড় রত্ন, বড় সুযোগ আর হয় না। It’s a gift from God. Honour it! চর্চা করো, করেই যাও, যত কষ্টই হোক, সে-উপহার কখনোই ছেড়ো না। দেখবে, একদিন তুমিও….

বিশ্বাস হলো না তো? খোঁজ নিয়ে দেখো, জেমসের জীবনে আজকের দিনটা আসবে, হয়তো এটা তাঁর নিজের‌ই একসময় মনে হয়নি। তুমি একজন জেমস না-ই বা হলে, তাও তো এমন কেউ হয়ে উঠতে পার, যাকে দেখিয়ে অনেকেই বলবে, আহা, ওরকম হতে পারতাম! কোন‌ও এক বাবা তাঁর সন্তানটিকে বলবেন, দ্যাখ্, ওঁর মতো হতে হবে।

পড়াশোনা করছ, করো; পৃথিবীতে কিছু ঝামেলা এড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য একটা সার্টিফিকেট লাগে। তবে বেঁচে-থাকার সময়টাতে অন্তত কিছু মানুষের চোখে আলাদা হয়ে থাকার জন্য আরও বাড়তি কিছু লাগে, যা তোমাকে পৃথিবীর কোনও ভার্সিটি দিতে পারবে না, নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে…নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ক্রমাগত আঘাত সহ্য করে, নিজের প্যাশনের প্রেমে পড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

এত কথা কেন বললাম, জানো? যে মানুষ তাঁর ভালোবাসার কাজটিকে ততটাই ভালোভাবে করতে পারেন, যতটা অন্য কেউ পারে না, আমি সে মানুষটিকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। এমন মানুষকে আমি আর্টিস্টের আসনে বসাই। আর্টিস্ট হয়ে ওঠো…পারবে। শুধুই ভালো রেজাল্ট করতে আমরা পৃথিবীতে আসিনি।

দুই। আন্টি, আপনার তো অনেক বয়স হয়েছে, এখনও রান্না করে যাচ্ছেন, সবাইকে শেখাচ্ছেন। এবার একটু বিশ্রাম নেন। অনেক দিন করলেন তো! আর কত?
: না, বাবা…যতদিন পর্যন্ত এ এলাকায় আমার চেয়ে ভালো রান্না করে এমন কাউকে না পাচ্ছি, ততদিন পর্যন্ত আমাকে রান্না করে যেতেই হবে। ওরকম কাউকে পেলে তবেই তোমার আন্টির ছুটি!

২০০৪ সালের কথা। আমি সে-সময় পৃথিবীসুদ্ধ লোকের পোলাপানকে পড়িয়ে শিক্ষিত করে ফেলার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত! চট্টগ্রামের জিইসি’র মোড়ের ওদিকটায় এক স্টুডেন্টকে পড়াতাম। ওর নাম হৃদয়। ওর মা অসাধারণ রান্না করতেন। এ জীবনে আমি যত হাতের রান্না খেয়েছি, সেগুলির মধ্যে আন্টির হাতটাই সেরা। রান্নাকরার কাজটাকে উনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। হৃদয়ের বাসা ছিল একমাত্র বাসা, যেখানে আমি, যা নাস্তা দিত, তার পুরোটাই নির্লজ্জভাবে চেটেপুটে খেয়ে ফেলতাম। অনেক দিনই পড়ানো শেষ করে ডিনার করে এসেছি। (এ জীবনে বিনা দাওয়াতে যে দুইএকটি বাসায় খেয়েছি, হৃদয়ের বাসা সেগুলির একটি।) আন্টি নাস্তায় মামুলি বেগুনি ভেজে দিলেও খেয়ে মনে হত, এর চাইতে ভালো বেগুনি বানানো সম্ভব নয়।

আন্টির বয়স হয়ে গিয়েছিল, অসুস্থ ছিলেন, শরীরও ছিল দুর্বল। ওই ভাঙাচোরা শরীর নিয়েই ঘরের সব রান্না নিজেই করতেন, কখনও নিজের হাতে করতে না-পারলেও রান্নাঘরে একটা মোড়ায় বসে হৃদয়ের ভাবিদের রান্নায় নানান নির্দেশনা দিতেন। এলাকায় কারও বাসায় কোনও অনুষ্ঠান নামলে সে-রান্নাঘরে আন্টির উপস্থিতি ছিল অনেকটাই অপরিহার্য! কেউ রান্না শিখতে চাইলে অনেক আগ্রহ নিয়ে রান্না শেখাতেন। আন্টি এসব করতেন মনের দাবিতে, কোনও অর্থের বিনিময়ে নয়। (ওই এলাকায় হৃদয়রা ছিল সম্ভবত সবচাইতে ধনী।) আন্টি আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন, এতটাই স্নেহ করতেন যে বাসায় ভালো কিছু রান্না করলে সেদিন আমার পড়ানোর দিন না-থাকলেও ফোন করে আসতে বলতেন। আমিও যেতাম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ডাক উপেক্ষা করার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই।

আন্টি ছিলেন নিরক্ষর। কখনও স্কুলেই যাননি। তারপরও, আমার চোখে, আজও তিনি একজন মহান শিল্পী, সব সময়ই এমনই শ্রদ্ধেয় থেকে যাবেন। তিনি রান্না করতে ও অন্যকে তাঁর রান্না খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন। রান্না করতে-করতে কখনও ক্লান্ত হতেন না; ভালোবাসার কাজে মানুষের ক্লান্তি আসে না। তিনি যতটা ভালো রাঁধতে জানতেন, যতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে রান্না করতেন, যতটা তৃপ্তি নিয়ে অন্যকে রান্না শেখাতেন, ততটা করতে গেলে নিছকই শেফ নয়, আর্টিস্ট হতে হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর্টগুলির একটি হলো রান্নাকরা। যাঁদের হাতের রান্না ভালো, আমি তাঁদের ভালোবাসি, সম্মান করি।

ভেবে দেখুন, একজন মানুষ তাঁর কাজটি কতটা ভালোভাবে করতে পারলে বলে ফেলতে পারেন, আমার চেয়ে ভালোভাবে কাজটা আর কেউ করতে পারে না! একজন চিত্রকর যে-মুহূর্তে আঁকেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো আঁকতে আর কেউ পারে না। একজন ফটোগ্রাফার যে-মুহূর্তে ক্যামেরায় ক্লিক করেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো ছবি আর কেউ তুলতে পারে না। একজন কবি যে-মুহূর্তে একটি কবিতা লিখছেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীর সেরা কবিতাটি আমি এখন লিখছি। একজন গায়ক যে-মুহূর্তে গান গাইছেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো আর্টিস্টের জন্ম এখনও হয়নি।…এর নাম নিজেকেই বেঁধেফেলা, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েদেওয়া—নিজেকে সেরা করে উপস্থাপন করার, নিজের কাজটা নিখুঁত করে তোলার, নিন্দুকের চোখেও অনিন্দ্য হয়ে থাকার।

…এমন কিছু ভাবনা এবং তার নিরলস চর্চা, হোক না তা এক খ্যাপাটে লোকের পাগলামিই, মানুষকে অন্য মানুষ করে তোলে। এতটাই অন্য যে, সবাই তাঁকে দেখে সমীহ করে, তাঁকে মুখে অপছন্দ করলেও মনে-মনে মেনে নিতে বাধ্য হয়: হি ইজ অ্যা জিনিয়াস! যাঁরা ওরকমই আর্টিস্ট, মনের অবচেতনেই তাঁরা কিছু কোড ফলো করেন। আপাতত একটা বলছি। অনেক বছর ধরে তাঁরা প্রতিদিনই, ভালোবাসার কাজটি আগের দিনের চেয়ে একটু হলেও ভালোভাবে করেন। যে-করেই হোক, করেনই! হয়তো পাঁচ মিনিট বেশি সময় দেন, হয়তো আরও একটু বেশি মনোযোগ দেন, হয়তো নিজেকে আগের দিনের চেয়ে একটু হলেও বেশি কষ্ট দেন। প্রতিদিনই এটা হতে থাকে। প্রতিদিনই…আরও একটু বেশি!

এ প্রসঙ্গে চুয়েটের এক স্যারের কথা মনে পড়ছে। সিএসই ডিপার্টমেন্টের আশফাক স্যার। উনি যখন ক্লাসে পড়াতেন, তখন এতটাই আত্মবিশ্বাস আর সে-বিষয়ে দখল নিয়ে পড়াতেন যে, ক্লাস করতে ভালো লাগত। আমরা বুঝতে পারতাম, স্যার যা পড়াচ্ছেন, তা তাঁর চাইতে ভালোভাবে পড়াতে পারবেন, এমন কেউ হয়তোবা আছেন, তবে আমাদের এমন একটি চাওয়াও নেই, যা পূরণ করাটা স্যারের আয়ত্তের বাইরে। ক্লাসে এক মিনিটও দেরি করে আসতেন না, খুবই সহজ ও সাবলীলভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতেন। উনার পড়ানোর স্টাইল, কথাবলার ও তাকানোর ধরন, ব্যক্তিত্ব, মার্জিত আচরণ দেখলে মুগ্ধ হতে হতো। যা পড়াচ্ছেন, তার পুরো কনসেপ্টটা উনার মাথায় আছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই। ক্যুইজ, ক্লাস-টেস্ট, ফাইনাল একজামের প্রশ্ন করতেন সহজ, খাতায় মার্কসও দিতেন অকৃপণভাবে। অসাধারণ শিক্ষক যাঁরা, তাঁদেরকে, প্রশ্ন কঠিন করে, স্টুডেন্টদের মার্কস কম দিয়ে অসাধারণ হয়ে থাকতে হয় না। পড়ানোর বাইরেও অনেক কিছু থাকে, যা শিক্ষকদের স্মরণীয় করে রাখে। স্যার ছিলেন দেখতেও খুব সুদর্শন, অনেক মেয়েরই ক্রাশ। স্যারকে ঈর্ষা করতাম না, ভালোবাসতাম। যাঁরা গ্রেট, তাঁদের আমি ঈর্ষা করতে পারি না, ভালোবেসে ফেলি! আমি স্যারের নাম দিয়েছিলাম: মিস্টার নেভার-বিহাইন্ড!…আর একজন স্যারের কথা বলে ফেলি: সাইফ স্যার। মাত্র কিছু দিন পেয়েছিলাম স্যারকে, তবু তাঁর কথা আমাদের মনে আছে। উনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর ক্লাস করে আমাদের মনে হয়েছিল, আমরাও পারব! (বাকি স্যারদের কথা অন্য কোনও লেখায় লিখব।)

যা-ই হোক, উপরের অনুচ্ছেদের আগের অনুচ্ছেদে ফিরে আসি।…ক্রমাগত এমন চর্চায়, একসময় তাঁরা হয়ে ওঠেন অনন্য। এতটাই অনন্য যে, ওঁরা বলে ফেলতে পারেন…আমি জানি, আপনি আমার চেয়ে ভালোভাবে এটা করতে পারবেন না। আপনি আমাকে ঘৃণা করতে পারবেন, ঈর্ষা করতে পারবেন, হয়তো আমার ঘাড় থেকে পিতৃদত্ত মাথাটাও একপলকেই নামিয়ে দিতে পারবেন, কিন্তু আপনি কখনওই ‘আমি’ হতে পারবেন না।
তাঁরা—
শাহরুখ খানের মতো করে বলতে পারেন: আই অ্যাম দ্য বেস্ট!
মোহাম্মদ আলীর মতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেন: আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট!
রোনালদোর মতো পরোয়া না-করেই নিজেকে বলে দেন: ইয়োর লাভ মেকস মি স্ট্রং, ইয়োর হেট মেকস মি আনস্টপেবল!

ভাবছেন, এইসব দম্ভ? অহংকার? মনেমনে বলেছেন, অহংকার পতনের মূল…ব্লা ব্লা ব্লা! নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, একজন বিরাট কোহলি যেমন করে ড্যাম কেয়ার ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন, আপনি কি পারবেন অমন করে কথা বলতে? কী আছে আপনার অমন করে কথা বলার জন্য? ইউ ডিজার্ভ নট টু বি অ্যারোগ্যান্ট! বোঝার সুবিধে হবার জন্য বলছি: ওঁদের ওই দিকটা অহংকার নয়, আত্মবিশ্বাস কিংবা সত্যউপলব্ধি! আপনার আমার ওরকম কিছুর সাথে কখনও পরিচয় ঘটেনি বলেই আমাদের কাছে তা অহংকারের মতো শোনায়। যাঁকে অহংকার মানায়, তাঁকে পতিত হতে হয় না। অহংকার নয়, বরং অনর্জিত অহংকারই পতনের মূল! তিনি জানেন, কী করে নিজেকে ওই বেস্ট জায়গায় রেখে দিতে হয় দিনের পর দিন।

বলি কী, স্রোতের বিপরীতে চলা বলে আসলে কিছু নেই। একেক নদীর স্রোত একেক দিকে। একেকটা মানুষ একেকটা নদী। ফলে এক নদীর স্রোতের দিকের সাথে আর এক নদীর স্রোত মিলবে না, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? আপনি স্রোতের বিপরীতে চলছেন না, আপনি আসলে আপনার নিজস্ব স্রোতের দিকেই চলছেন। সে-স্রোতটা ওঁদের কাছে অচেনা বলেই ওঁরা ওটাকে ‘স্রোতের বিপরীতে’ নাম দিয়ে নিজের মস্তিষ্ককে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। চলুন না একটু সেই স্রোতেই! বড় নদীর নিজস্ব স্রোত থাকে, ছোট নদীর কাছে তা বরাবরই অভিনব, ভীতিকর…কখনওবা, পরিত্যাজ্য। সেখানেই মজাটা! যে-রাস্তায় লোকের হাঁটাচলা কম, সে-রাস্তায় দৌড়েও আরাম। যে-রাস্তায় লোকের হাঁটাচলা বেশি, সে-রাস্তায় তো হেঁটেও আরাম নেই!

গুরু শাহরুখ খানের আর একটা কথা দিয়ে শেষ করছি:
Love me or hate me………..but you cannot ignore me.

(আমি নিজেও কিন্তু সত্যিসত্যি জানি, যাঁরা আমাকে অপছন্দ করেন, মুখেমুখে পাত্তা দেন না, সুশান্তস-হেটার্স-ক্লাব-এর সম্মানিত সিনিয়র সভ্য, তাঁরাও লুকিয়েটুকিয়ে আমার অন্তত কিছু লেখা পড়েন, কিছু কথা শোনেন…আমার ওয়ালে আসেন। আমি তাঁদের প্রতি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব। তাঁরা না-থাকলে আমি নিজেকে প্রতিদিন পোড়াতে পারতাম না। আমি পারফেকশনের দিকে ঝুঁকতে ভালোবাসি যতটা পারফেকশন পছন্দ করার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমার সম্মানিত হেটারদের জন্য কিছু অসুবিধে তৈরি করে দিতে—তাঁরা আমাকে নিয়ে যা-ই বলুন না কেন, আমার কাজের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। (আমাকে নিয়ে বাজে কথা তো উনারা বলবেনই, নাহয় যে চাকরি থাকবে না!)

একটা কথা বলি, ভাই! ওরা আপনাকে সহ্য করতে পারে না কেন, জানেন? কারণ ওরা আপনার মতো হতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। একটু মানিয়ে নিন, বস! লাথিটা ওদের নয়, নিজেকেই মারুন, আর এগিয়ে যান—প্রতিদিনই, একটু-একটু করে। ওরা পারবে না, ওই জায়গাতেই থেকে যাবে…এ বিষয়ে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন!)

তিন। সেলুনে গেলে চুলকাটা শেষ হবার পর মাথার পেছনে আয়না ধরে জিজ্ঞেস করে, স্যার, দেখেন তো পেছনে কাটা ঠিক আছে কি না!

আমি কখনোই এ ব্যাপারে কোনো মতামত দিই না। সব সময়ই বলি, আপনি নিজে একবার চেক করে নেন। আমি দেখে বুঝব না। আপনি খুশি হলে আমিও খুশি।

কেন ওরকম বলি?

আমার দেখা চমৎকার একটি মুভি ‘শব্দ’। মুভির প্রধান চরিত্রের নাম তারক। তারক একজন সাউন্ড আর্টিস্ট। তাঁর কাজ সিনেমার জন্য নানান ধরনের শব্দ তৈরি করা। তিনি তাঁর কাজের প্রতি ভীষণ নিবেদিতপ্রাণ। সারাক্ষণ‌ই তাঁর মাথায় শব্দ সৃষ্টির আইডিয়া গিজগিজ করছে। কোনো নতুন শব্দ, যা হয়তো আশেপাশের কেউ খেয়াল করেনি, তারকের কান এড়াতে পারে না। কখনোই পারে না। প্রতিটি শব্দ‌ই তারকের কাছে একেকটি রত্নের মতো। টাকাপয়সার ব্যাপারে তারক বরাবরই নিস্পৃহ। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শব্দতৈরির ক্ষেত্রে তারকের সমতুল্য আর কেউ নেই। জাগতিক অনেক বিষয়ের প্রতি নির্মোহ তারক কিছুটা খ্যাপাটে—অনেক জিনিয়াস‌ই এমন হয়ে থাকেন।

একদিন। অর্ধেক শেষ-হ‌ওয়া চায়ের কাপটি টেবিলে রাখতে গিয়ে তারক চমকে ওঠে! এ কী হলো! আধখাওয়া চায়ের কাপ টেবিলে রাখার শব্দ এরকম হয়! এমন একটা ভুল হয়ে গেছে! হায় হায়! এখন?

হ্যাঁ, কিছু দিন আগে একটা মুভির জন্য তারক শব্দ তৈরি করে দিয়েছে। মুভিটা ফাইনাল এডিটিংয়েও চলে গেছে। সে মুভির একটা দৃশ্যে টেবিলে চায়ের কাপটি রাখার শব্দ তৈরি করার সময় তারক শব্দটি তৈরি করেছে চায়ের খালি কাপ দিয়ে। অথচ সেই দৃশ্যে চা-খাওয়া তখন‌ও শেষ হয়নি। চায়ের খালি কাপ এবং আধখাওয়া কাপ টেবিলে রাখার শব্দ ভিন্ন রকমের।

তারক দৌড়ে গেল ডিরেক্টরের কাছে। একটা ভুল হয়ে গেছে। আমার বানানো শব্দটা ঠিক হয়নি। দৃশ্যটা আধখাওয়া চায়ের কাপের, কিন্তু আমি সেখানে দিয়েছি খালি চায়ের কাপের শব্দ। আমি ওই শব্দটা আবার তৈরি করে দিতে চাই।

খেপেছ, তারক? মুভির সব কাজ প্রায় শেষ! এখন আবার নতুন করে ওই শব্দটা ঢোকানো সম্ভব নয়। বাদ দাও! যা হয়েছে, তা-ই! আর তা ছাড়া ওইটুকু কেউ ধরতেই পারবে না! কেউ কখনো ভেবেছে নাকি এত সূক্ষ্মভাবে? খালি আর আধখাওয়া কাপের শব্দ যে দুরকম, এটাই তো কেউ জানে না! কিচ্ছু হবে না। বদলানোর দরকার নেই। ওই শব্দেই হয়ে যাবে!

ঠিক আছে, মানলাম। হয়তো কেউ বুঝতেই পারবে না। কিন্তু আমি তো বুঝেছি, জানি, ওখানে একটা ভুল আছে। তারক কেন এ ভুলটা করবে?

…তারক কেন এ ভুলটা করবে?—আমার শোনা সেরা ডায়লগগুলির একটি। একজন মানুষ কোন লেভেলের কনফিডেন্ট এবং ডেডিকেটেড হলে এমন কথা বলে ফেলতে পারে! তারক নিজেও জানেন, এমন অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য কার‌ও মাথায়ই আসবে না। তিনি এও জানেন, সব কিছুর পরও এটা ভুল, এবং এ ভুলটা অন্য দশজন সাউন্ড আর্টিস্ট করলেও তারক এটা করতে পারে না। সবাই তারক হয় না বলেই তারক তারক হতে পেরেছে। নিজেকে এমন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, নিজেকে পারফেকশনের দায়ে বেঁধে ফেলা, নিজের কাজটি সবার আগে নিজের চোখে নিখুঁত করে তোলা, সেরা জিনিসটা চিনতে পারা—অনেক বড় কিছু। সবাই তা পারে না, অনেক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস লাগে। সেখানে পৌঁছতে হলে অসীম সাধনার দরকার।

চুলকাটার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চুলকাটায় কোনো খুঁত আছে কি নেই, তা যিনি কেটেছেন, তিনি যতটা বুঝতে পারবেন, আমি তার সিকিভাগও বুঝতে পারব না। তাই কাজটা তাঁর নিজের মনের মতো হয়েছে কি না, সেটা জরুরি। যদি তা হয়ে থাকে, তবে সেখানে আমার দেখার কিছু নেই। সূক্ষ্ম কোনো ভুল আমি ধরতেই পারব না। আর যদি এমন হয়, তিনি কোনো খুঁত আছে বুঝেও আমি ধরতে পারব না জেনে আমাকে খুশি করে দিয়ে নিজেও খুশি হয়ে গেছেন, তবে থাকুক না ওরকমই! নিজেকে ফাঁকি দিয়েই যদি কেউ জীবন কাটিয়ে দিতে চায় তো দিক না! সবাই তো আর গ্রেটনেসের মজা বুঝবে না। এমন‌ও হয়, চুলটা যেভাবে কাটা হলো, সেটা হয়তো আমার ভালো লাগল না, তবে তার চাইতে ভালোভাবে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তাকে কিছু না-বলে পরেরবার অন্য সেলুনে যাওয়াটাই বেটার। মিডিওকারদের মনে কষ্ট দিতে হয় না।