দ্য গ্রেট বিউটি (২০১৩)

ইতালির রোমের জাঁকালো জীবন এবং সম্পদের পাহাড়, এই দুইয়ের মধ্যে থেকে বেঁচেথাকার সৌন্দর্য ও অর্থ খুঁজে বেড়ান ৬৫ বছর সদ্যপেরোনো এক আর্টিস্ট জেপ গানবারদেল্লা। এ জীবনে উনি একটাই বই লিখেছেন, দ্য হিউমান অ্যাপারেটাস, তাও ৪০ বছর হয়ে গেল, সেই বইটাই তাঁকে এখনো রোমের সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়ে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে। সিনেমায় যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের প্রায় সবাইই বেশ ধনী, এবং আমোদপ্রমোদের মধ্য দিয়েই তাঁদের জীবন কাটে। ওদের সবচাইতে বড় পরিচয়: ওরা ধনী। পার্টি, ক্লাব, ফুর্তি, ইন্দ্রিয়সুখ এবং স্পষ্টতই যন্ত্রণা—এ নিয়েই তাঁদের দিনযাপন। গল্পটি মূলত অবক্ষয়ের এবং উপলব্ধির। সিনেমায় দৃশ্য ও সুরের মিশেল নিখুঁত, এর সাথে বৃদ্ধ আর্টিস্টের মনস্তত্ত্বের সমান্তরাল পরিভ্রমণ লক্ষণীয়। রাতের রোমের সকল সৌন্দর্য ও বিষাদ এ সিনেমার মূল উপজীব্য। জেপকে মুভিতে এক অসহায় লেখকের মতো দেখায়, যিনি অনেক বছর ধরেই লেখালেখি থেকে বাইরে আছেন এবং লেখক পরিচয়ের বাইরে থেকে জীবন ও জগত কেমন, সে অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবনের শেষ সময়টাকে ঋদ্ধ করছেন। আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যুর মাঝের সময়টা কাটে কিছু সত্য, অর্ধসত্য ও মিথ্যার মায়ায়। মুভিতে সময়ের সে যাপনকে দেখানো হয়েছে মৃত্যু, ভালোবাসা, সৌন্দর্য এবং আর্টের রমণীয় বিষাদের পরিপূর্ণ দলিল হিসেবে। আধুনিক রোম ও সমসাময়িক সমাজের ক্ষয়িষ্ণু এলিট সম্প্রদায়ের প্রতিভূ যাঁরা, তাঁদের জীবনকে মুভির প্রোটাগনিস্টের হাত ধরে ক্যামেরার লেন্সে তুলে এনেছেন পরিচালক পাওলো সরেন্টিনো। ‘দ্য গ্রেট বিউটি (২০১৩)’ মানবিক সম্পর্কের অন্ধকার ও আলোকিত আখ্যান, একইসাথে দর্শকের চোখ, কান ও আত্মার এক মহাভোজের আয়োজন। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, মুভমেন্ট, রঙ ও সুরের নিপুণ ব্যবহার, আবহ-তৈরির কারিশমা সে ভোজের রসদ যুগিয়েছে।

জেপ এখন একটি পত্রিকায় কাজ করেন। আর্টের বিভিন্ন ফর্মের প্রদর্শনীতে তাঁর নিয়মিত আসাযাওয়া, আর্টিস্টদের সাথে যোগাযোগ, বিভিন্ন মডেলের সাথে বিশেষ সখ্যতা, ইন্দ্রিয়নির্ভর ঠাট্টাফুর্তিতে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখা, এ সবই প্রকৃতপক্ষে হিডোনিস্ট সোসাইটিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার মাধ্যমে জীবনের অপ্রাপ্তি, হতাশা ও শূন্যতাকে ভুলেথাকার কৌশলমাত্র। তাঁর বন্ধুর মেয়ে রামোনার সাথে অন্তরঙ্গতা তাঁকে অতীত ও ভবিষ্যতকে ভুলে বর্তমানকে ভালোবাসতে শেখায়। তাঁর কৈশোরের প্রেমিকা এলিজার মৃত্যু তাঁকে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করে। এলিজার ডায়রিতে জেপের কথাই ঘুরেফিরে এসেছে বারবার, সেখানে তাঁর স্বামী, যাঁর সাথে তাঁর ৩৫ বছরের সংসার, তাঁর কথা এসেছে মাত্র দুইবার, তাও স্বামীকে এলিজা উল্লেখ করেছেন কেবল একজন সঙ্গী হিসেবে। এলিজা জেপকে বিয়ে করতে পারেননি, কিন্তু পুরো বিবাহিত জীবনটাই কাটিয়েছেন জেপের ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে। জেপ দেখা পান একজন ১০৪ বছর বয়সী বৃদ্ধার, যাঁকে সবাই সন্ন্যাসিনী বলে মানে। তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন আফ্রিকার দরিদ্র মানুষের সাথে এবং প্রতিদিন মাত্র ৪০ গ্রাম গাছের শেকড় খেয়ে বেঁচে আছেন। জীবনের এমন সারল্য ও বিস্ময় জেপকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায় এবং যে সৌন্দর্যের খোঁজ তিনি করে চলেছেন বহুদিন ধরেই, সে সৌন্দর্যের পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা পান।

মুভিতে জেপ বারবার মনে করিয়ে দেয় প্রুস্ত একটা বই লিখতে চেয়েছিলেন, যে বইয়ের বিষয়বস্তু হবে ‘নাথিং’। পরিচালকও এখানে তা-ই করেছেন। মুভির প্রধান চরিত্র তাঁর নিজের জীবন নিয়ে যা করেছেন, তাকে বলা চলে ‘নাথিং’, সে হিসেবে এ সিনেমা ‘নাথিং’ নিয়েই কথা বলে। তবে হ্যাঁ, জেপ কেমন করে তাঁর জীবনটা কাটাচ্ছে, তাঁর চারপাশের মানুষ ও পৃথিবীর সাথে তাঁর সম্পর্ক কী, এসব মুভিকে টেনে নিয়ে গেছে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও অপূর্ব সব ভিজ্যুয়ালের মধ্য দিয়ে। জেপ তাঁর ভাবনা ও কাজে সৎ, তিনি জীবনটাকে তেমন সিরিয়াসলি নেন না, এবং তিনি একটা বিশেষ কিছু, এটা নিজেকে কিংবা কাউকে তাঁর কাজেকর্মে আর কথাবার্তায় বোঝান না। তিনি কাউকে পরোয়া করেন, যা করতে ভাল লাগে, করে ফেলেন, জীবনের কোনো দুশ্চিন্তা তাঁকে স্পর্শ করে না। তিনি একজন সুখী মানুষ। ‘সেপ্টেম্বরের প্ল্যান করে গ্রীষ্মটাকে’ মাটি করে দেয়ার মানুষ জেপ নন। বরং তাঁর চারপাশে যা কিছু সুন্দর—চিত্রকর্ম, খাবার, পাখি, গির্জা, গাছ, সমুদ্র, এবং অবশ্যই নারী—-তা নিয়েই তাঁর সময়টা দিব্যি কেটে যায়। বর্তমান নিয়েই তাঁর দিনযাপন, দেখতে ভালই লাগে। তবে তাঁর জীবনে দুইটি দিক অনুপস্থিত। স্বপ্ন পূরণ করার আনন্দ, পাশেথাকার কাউকে পাওয়ার সার্থকতা। জেপ তাঁর সময়টাকে উপভোগ করছেন, এটা ঠিক, তবে যে মহত্তম সৌন্দর্যের দেখাই তিনি কখনোই পাননি, তা হল ভালোবাসা। পার্টি, ফুর্তি, মদ, মেয়ে, বিত্ত, খ্যাতি, সম্মান, সবকিছু নিয়েই তিনি বেশ আছেন, তবে কেউ তাঁকে ভালোবাসে না, তাঁর জীবনে এমন কোনো মানুষ নেই, যিনি তাঁকে সত্যিই ভালোবাসেন।

মুভিতে সবাই এমন একটা এন্ডলেস লুপে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখান থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। তাদের আশেপাশে যারা আছে, তারাও তাদের মতোই—জীবন নিয়ে হতাশ, উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ। রোমের জমকালো রাতগুলি তারা কাটিয়ে দেয় একঘেয়েমিতে। সেখানে সৌন্দর্য নেই, ভালোবাসা নেই। বিত্ত আছে, চিত্ত নেই। তাদের জীবনে এমন কোনো অর্জন নেই, যা মনেরাখার মতো, যা তাকে সম্মান এনে দিতে পারে। মুভিতে অসাধারণ কিছু ডায়লগের মাধ্যমে রোমের এই আপার-ক্লাস হিডোনিস্ট সম্প্রদায়ের জীবনের শূন্যতা ও ধূসরতাকে অপূর্ব ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ সিনেমা এমনই এক সিনেমা, যার শুরু নেই, শেষ নেই। সিনেমার শুরু, ব্যাপ্তি ও শেষ—এ তিনের দিকে তাকালে যা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে প্রকৃত সুন্দরকে ছুঁতে না পারার দুঃখবোধ। তবে সিনেমাটির যে থিম, তা অভিনব কিছু নয়, এবং সিনেমা দেখে মনে হয়েছে, ৪০-৪৫ মিনিটের মুভিকে ২ ঘণ্টা ২১ মিনিটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নগ্নতাকে ধরেবেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে বারবারই। এমন অপ্রাসঙ্গিক ও বাড়তি আয়োজনে বিরক্তি ধরে যায়। ক্লান্ত মন নিয়ে এ মুভি দেখতে বসলে নির্ঘাত আরও ক্লান্তি এসে ভর করবে। পরিচালক মুভির দৃশ্যায়নে ও গল্পবলার ধরনে ফেলিনিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন, যা প্রকটভাবেই চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে বলেই পরিচালকের দর্শন আরোপিত মনে হয়, ছদ্মবেশী বিবেচনায় সেটিকে গ্রহণ করতে ঠিক ইচ্ছে করে না। মুভি দেখার সময় প্রায়ই মাথায় আসে, এখনো শেষ হয় না কেন?