দ্য ফেস অব অ্যানাদার (১৯৬৬)

এ জীবনে যে কয়েকটি অসামান্য ফিল্ম দেখে মুগ্ধ হয়েছি, সেগুলির মধ্যে একটি ‘দ্য ফেস অব অ্যানাদার (১৯৬৬)’। গল্প কোবো আবের, নির্মাণ হিরোশি তেশিগাহারার।

ওকুইয়ামা একজন ব্যবসায়ী। কোনো এক দুর্ঘটনায় তাঁর মুখমণ্ডল পুড়ে চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। এতটাই বিকৃত, তাঁর নির্দিষ্ট কোনো চেহারাই ছিল না। সাইক্রিয়াটিস্ট তাঁকে একটা অবয়ব পরিয়ে দেন। অবয়বটি অন্য এক ব্যক্তির, ফলে তাঁর আসল চেহারা বদলে গেল। সে অবয়ব ক্রমেই তাঁকে ভিন্ন এক ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই রূপান্তরযাত্রায় তাঁর সাথে তাঁর নিজের ও চারপাশের পৃথিবীর যে সম্পর্ক, তা নিয়েই এ মুভি।

লোকে মদ কেন খায়? মাতাল হতে। মাতাল হয়ে কী লাভ? মাতাল হলে লোকে অন্য এক মানুষে পরিণত হয়। যা কিছু সে স্বাভাবিক অবস্থায় করতে পারে না, কিন্তু অবচেতন মনে করতে চায়, মাতাল অবস্থায় তা কিছুই অবলীলায় করে ফেলা যায়। তাই লোকে মাতাল হতে চায়। মানুষ তার অস্তিত্বের উপর বিরক্ত। সে অন্য অস্তিত্বে থাকার ফ্যান্টাসিতে ভোগে, সুযোগ পেলেই সে অস্তিত্বে নিজেকে নিয়ে যেতে চায়। ঘর ভুলতে লোকে অন্যঘরে আশ্রয় নেয়। মদের চাইতে নিরাপদ আশ্রয় আর কী-ইবা আছে?

আমরা যখন বাসায় থাকি, তখন এক পোশাক, বাইরে যখন যাই, তখন আরেক পোশাক। অফিসে গেলে যা পরে যাই, বেড়াতে গেলে তা পরে যাই না। ঘরের মানুষ, অফিসের মানুষ ভিন্ন চেহারার দুই মানুষ। একই মানুষ ভিন্ন অফিসে ভিন্ন চেহারায় থাকে। বেড়াতে গেলে আরেক মানুষ। কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে তার বাহ্যিক অবয়বটা কেমন হবে। লোকে প্রয়োজন আর পরিস্থিতি বুঝে মুখোশ পরে। আর মুখোশই তার আচরণ ও বাহ্যিক সাজ ঠিক করে দেয়।

বাবা-মায়ের মেয়ে যখন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এল, তখন ধীরেধীরে সে হয়ে উঠল শ্বশুরশাশুড়ির বউমা, স্বামীর স্ত্রী, সন্তানের মা। বিয়ের আগে তার আচরণ ও ভূমিকা পরিস্থিতি ও পরিবেশ বুঝে বদলে গেল। তাই দেখা যায়, বিয়ের আগের প্রেমিকা, আর বিয়ের পরের স্ত্রী, একই নারী হলেও অবস্থার পরিবর্তনের কারণে সেই দুই চেহারা এক নয়, ভিন্ন। আবার সে একই নারী যখন মা হয়, তখন তার চেহারা আরেক রকম। আমার প্রেমিকা, আমার স্ত্রী, আমার বাবা-মায়ের পুত্রবধূ, আমার সন্তানের মা—একই শরীরে সম্পূর্ণ ভিন্ন চারটি সত্তা, ভিন্ন চারটি চেহারা। প্রয়োজন মানুষকে মুখোশ পরিয়ে দেয়। কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে, মানুষ নতুন মুখোশ পরে নতুন মানুষ হয়ে যায়।

আরও মজা আছে। ধরুন, আপনি ফেসবুকে বিপরীত লিঙ্গের অপরিচিত কারো সাথে গল্প করছেন। উনার প্রোফাইলে উনার নিজের ছবি দেয়া নেই। যার সাথে কথা বলছেন, তার চেহারাটা দেখবেন ভেবে উনার ছবি দেখতে চাইলেন। উনি যে ছবিটা পাঠাবেন, সে ছবি আপনার কথা বলার ধরন ঠিক করে দেবে। উনার চেহারা আপনার পছন্দ হলে আপনি যেভাবে কথা বলবেন, পছন্দ না হলে সেভাবে কথা বলবেন না। এমন-কী উনার ছবি দেখে উনার ব্যক্তিত্ব কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কেও কিছু ধারণা আপনার মাথায় চলে আসবে। এখানে দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে। যে ছবিটা উনি আপনাকে পাঠালেন, সে ছবি উনার নিজের ছবি না। ফলে, ছবি দেখার পর আপনার ভাবনা ও আচরণ যে পথে গেল, সে পথটা ভুল পথ। আবার এমনও হতে পারে, উনি নিজের ছবিই আপনাকে দিলেন, কিন্তু ছবি দেখে উনার সম্পর্কে আপনার যা যা ধারণা হয়েছে, উনি আদতে ওরকম নন। তাহলে কী দাঁড়াল? মানুষের মুখ কিংবা চেহারা মানুষকে ঠিকঠাক চেনায় না। আবার প্রাথমিকভাবে মানুষকে চিনতে আমরা তার চেহারার উপরই নির্ভর করি। কোন চেহারাটা সে আমাদের দেখাচ্ছে, কিংবা তার কোন চেহারাটা দেখছি বলে আমরা ধরে নিচ্ছি, তার উপরই নির্ভর করে সে কেমন মানুষ বলে আমরা ভাবছি, আদতে সে যেমন মানুষই হোক না কেন!

আচ্ছা, আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যারা দেখতে কুৎসিত, কিংবা কোনো দুর্ঘটনার ফলে যাদের চেহারা কুৎসিত হয়ে গেছে, তারা অন্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন কেন? এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। হয়তো তারা দেখতে যেমন, তেমন করে নিজেকে দেখতে তাদের ভাল লাগে না। দুর্ব্যবহার করার মাধ্যমে তারা নিজেদের এই সান্ত্বনা দেন যে, আমার চাইতে সুন্দর লোকটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে আমি মাটির উপরে দিব্যি আছি! এমনও হতে পারে, আশেপাশে যারা দেখতে তাদের চাইতে ভাল, তাদের দেখলে ওদের সহ্য হয় না। স্বাভাবিক! ক্লাসের যে ছেলেটি কখনোই ফার্স্ট হতে পারেনি, ফার্স্টবয়কে ঈর্ষা, এমন-কী ঘৃণা করার অধিকার সে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলেই ধরে নেয়। কিংবা, তারা হয়তো এটা মাথায় রেখে বসে আছেন, যারা দেখতে কুৎসিত নন, তারা ওদের কাছ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইছেন। মানুষ অবহেলা সহ্য করতে পারে না, আর যখন সে ধরে নেয়, কেউ তাকে অবহেলা করছে, তখন সে রীতিমতো ক্রুদ্ধ ও অমানুষ হয়ে ওঠে, যদিও এই অবহেলিত হওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরিই তার ধারণাপ্রসূত।………লোকে অযৌক্তিকভাবে দুর্ব্যবহার করে কিছু না কিছু ঢাকতে।

ধরুন, আপনি পৃথিবীতে এসেছেন কোনো নির্দিষ্ট চেহারা না নিয়ে। তখন কী হবে? কেউ আপনাকে নির্দিষ্ট কেউ হিসেবে চিনবে না। না চিনলে কী হবে? সেক্ষেত্রে আপনি নির্দিষ্ট কেউ নন। আপনি নিজেকে যে কেউ ভাবতে পারেন, অন্যদের সামনে নিজেকে যেকোনো অবয়বেই উপস্থাপন করতে পারেন। আপনার পায়ে পরিচয়ের শেকল পরানো নেই। আপনাকে নির্দিষ্ট কোনো অস্তিত্ব কিংবা চেহারা নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে না। লোকের জাজমেন্টের ভার বহন করে চলতে হচ্ছে না। কারো চোখে আপনি যে অবয়বে খারাপ, আপনি সহজেই সে অবয়ব বদলে অন্য অবয়বে চলে যেতে পারেন। কোনো ফ্রেমই আপনাকে বাঁধতে পারবে না। আপনি একজন মুক্ত মানুষ। মুক্ত মানুষ মাত্রই একাকী। একাকী, তবে মুক্ত—সান্ত্বনা ওইটুকুই।

একজন মানুষের দিকে তাকানো যাক। মানুষ হিসেবে খুবই চমৎকার। কিন্তু উনি দেখতে কুৎসিত—জন্মগতভাবে কিংবা দুর্ঘটনাবশত। এখন কথা হল, অন্যরা তাঁকে কীভাবে নেয়? ভেতরের সৌন্দর্যই আসল, বাইরের চেহারায় কিচ্ছু এসে যায় না, এইসব পুঁথিগত কথাবার্তা আমাদের সুন্দর করে ভাবতে ও বলতে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু সেই মানুষটিকে আর দশটা মানুষের মতো করে বাঁচতে সাহায্য করে কতটা? আরও হতাশার ব্যাপার, তার কুৎসিত চেহারাকে যে মেনে নেয়, তাকে সে গ্রহণ করতে পারে না নানান নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। তখন তাঁর পক্ষে চমৎকার হয়েই বাঁচা কতটা সম্ভব? কতদিন সম্ভব? একসময় দেখা যায়, তিনি বেঁচে আছেন তাঁর চারপাশের মানুষের অবহেলা নিয়ে, নিজের প্রতি নিজের অসীম ঘৃণা নিয়ে। তাঁর আত্মসম্মানবোধ কমে যেতে থাকে, অন্যদের সাথে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, ক্রমেই তিনি নিজেকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন। তখন তিনি হয় একাকীত্ব নিয়ে বাঁচেন, নতুবা নিজেকে শেষ করে দেন।

আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কেমন আচরণ করি? আমরা আদতে যেরকম, সেরকম আচরণ করলে অনেকসময়ই বাড়তি কিছু ঝামেলা এসে উপস্থিত হয়। তখন আবার সে ঝামেলাগুলি মেটাতে আমাদের বাড়তি সময় দিতে হয়, মন ও মস্তিষ্কের উপরও চাপ পড়ে। কী দরকার? তার চেয়ে বরং আমরা সেভাবেই চলি, যেভাবে চললে ঝামেলা এড়ানো যায়। যার সাথে যেভাবে চললে সে পছন্দ করে, তার সাথে সেভাবেই চলি। আমার যে চেহারাটা যার পছন্দ, তার সামনে সে চেহারাটাই প্রকাশ করি। স্ত্রীর সাথে যেভাবে কথা বলি, হাসি, আচরণ করি, তার কোনোটাই সত্যিকারের ‘আমি’ কিংবা সেই মুহূর্তের ‘আমি’ নই। সে আমাকে আমার মতো করে গ্রহণ করতে পারে না, এ দুঃখ করা ঠিক নয়, কারণ আমি নিজেও তাকে তার মতো করে গ্রহণ করতে পারি না। এই যে মুখোশ পরে বাঁচা ও বাঁচতে দেয়া, এর নামই জীবন।

সবাইই মুখোশ পরে থাকে। কিছু মুখোশ খুলে যায়, কিছু মুখোশ যায় না। আসলে মানুষের আইডেন্টিটি কী? কীভাবে এটি প্রতিষ্ঠা পায়? বাহ্যিক চেহারা, ব্যক্তিত্ব এবং আইডেন্টিটি, এই তিনের মধ্যে সম্পর্ক কী? আমাদের চেহারা আমাদের ব্যক্তিত্ব ঠিক করে দেয়? নাকি আমাদের ব্যক্তিত্ব আমাদের চেহারা ঠিক করে দেয়? ‘দ্য ফেস অব অ্যানাদার’ এ চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক নির্মোহ ও আন্তরিক অনুসন্ধান।