নস্টালজিয়া (১৯৮৩)

——————————————

মানুষ মূলত একা। আশেপাশে অনেকেই থাকতে পারে, অনেকেই সময় দিতে পারে, কিন্তু মানুষ যখন নিজের মনের কিংবা মস্তিষ্কের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়, তখন অতীত, এমন-কী ভবিষ্যৎ কোনো অস্তিত্ব কি অনস্তিত্বের সাম্রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময়টাতে পাশে কাউকেই পাওয়া যায় না। এ এক শীতল একাকী যাত্রা। ধরে চলার মতো কোনো হাত পাওয়া যাবে না জেনেও নিজের সাথে পথচলা, তাও এমন এক পথে, যে পথ খুব-চেনা হওয়া সত্ত্বেও কখনো হাঁটা হয়নি। এ যেন ধূসরিত ধুলো-বাস্তবের কণা হাতড়ে কল্পনার রাজ্যে ঘোরা। যে মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে, সে যদি বলে বসে, স্বপ্নের চাইতে বাস্তব বড়ো, তবে সে ভাষণ দিনযাপনের সাথেই বেমানান ও বিরোধী অবস্থানে চলে যায়। চোখ খোলা, তবু কী এক স্বপ্নের ঘুম, শৈশব কি বার্ধক্য, দুইই নানান মন্তাজে সামনে এসে কী মোলায়েম ঢঙে নেচে ওঠে ক্ষণেক্ষণেই, তখন সমস্ত সত্তা দ্রোহ করে বসে, আর চিৎকার করে নিজের আর চারপাশের অন্তর্জগৎ নিয়ে নানান সংশয় জানান দেয়। সেটাকে অস্বীকার করা যায় না, আবার মেনে নিতেও যন্ত্রণা হয়।

কেউ যখন অন্য কারো মানস-জগত খুঁজতে গিয়ে নিজের অসীম-শূন্যতা কিংবা আপাত-পরিপূর্ণতা কিংবা দুইকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে, আর স্মৃতি কি বিস্মৃতি, যা সে নিজেই বোঝে না স্পষ্ট করে, সব একেএকে সামনে আসতে থাকে, যেমনি করে এক পর্দা সরে আরেক পর্দা আসে, তখন সে আত্ম-অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। সে পথ অজানা, অচেনা, তবু তার মায়া অপ্রতিরোধ্য। জীবন আর জগত যেন ফেলেআসা সব মুহূর্তকে পাশাপাশি এনে দাঁড় করায়, সেগুলির কোনটাতে টুক করে ঢুকে পড়লে বর্তমানটা স্পষ্ট হয়ে যায়, তা ভেবেভেবে অতীত আর ভবিষ্যৎ একাকার করে ফেলার মধ্যেই সে সুখ, নিদেনপক্ষে স্বস্তি খুঁজে ফেরে। অপ্রাপ্তি আর একাকিত্বের সেতু রচনা করে দীর্ঘশ্বাসের ধ্যানে সে দেখতে পায়, ছায়া সরিয়ে বৃষ্টি আসে, নতুন ভেঙে প্রাচীন ফেরে, আলো ফুরিয়ে আঁধার জাগে। জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃতের কোলাহল বাজতে থাকে যেন, সেখানে সময়কে চ্যালেঞ্জ করে কুয়াশা কাঁপে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, কত যে স্মৃতি ভেসে ওঠে……….সবকটাই নির্জন, ফাঁকা। এমন নিদারুণ, মলিনবিধুর অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্তি কি কখনোই মেলে না?

মন আর মগজ কেমন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেলে সুন্দরকে অসহ্য মনে হয়, সঙ্গী, পরিবার, দেশ, এমন-কী নিজেকেও দূরে সরিয়ে রাখতে আপাত-স্বস্তি লাগে, দুঃখ কি দ্বেষের সকল সীমানা এক ফুঁৎকারেই উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে, সবার ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে করে চিৎকার করে……..যার মধ্যে বিশ্বাস আছে, তাকে আর যা-ই ভাবো, পাগল ভেবো না!…….তা বুঝতে হলে তারকোভস্কির নস্টালজিয়া-য় আক্রান্ত হতে হয়; অমন মন-থেকে-মনে তীর্থযাত্রা কিংবা জীবন আর জীবনী খুঁড়ে জ্যান্ত শবের মিছিলে নিজেকে হাঁটিয়ে তৃপ্ত হওয়া……….আমাদের ঘরছাড়া করে দেয়। বোহেমিয়ান আমরা আলোহাতে পার হতে চাই আলোরই নদী, তবু হাতের আলোটুকু কিছুতেই নিভতে দেয়া যাবে না, ওটা নিভে গেলে আলোর নদীর সমস্ত আলোও নিভে যাবে, সে অন্ধকারের অতলে সামনে এগুনো যায় না, আবার ফিরে যেতেও আফসোস হয়। বর্ণকে পেছন ফেলে বিবর্ণের দিকে যাত্রা, মনকে সরিয়ে অন্যমনকে আলিঙ্গন, নিরাপদ পরিচিতকে ভুল মেরে বসে অপরিচিতের অনুসন্ধান……..এমন কিছু ফ্যাকাশে দৃশ্যপটের নকশিকাঁথা তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’।

তারকোভস্কির একটা কথা আমার খুব প্রিয়: একটা বই হাজার লোকের পাঠে হাজারটা বই হয়ে যায়।

‘নস্টালজিয়া’ এমন একটা সিনেমা যা হাজার লোকের চোখে হাজারটা সিনেমা হয়ে যায়। মুভিটা দেখুন, আপনার সিনেমাচোখে হয়তো আমার ব্যাখ্যাত অনুভব-সাক্ষ্যের অনেককিছুই খুঁজে পাবেন না।