নামরাখা

লোকজনকে ‘না’ বলতে না পারার কারণে আমাকে যে কয়েকটা মধুর যন্ত্রণা হাসিমুখে নিতে হয়, তার মধ্যে একটা হল, নাম রাখা। “ভাই, আমার অমুকের জন্যে কাইন্ডলি একটা নাম সাজেস্ট করবেন?” এই ধরনের রিকোয়েস্ট আমি প্রায়ই পাই। অনেকেই আমার রাখা নাম নিয়ে বড় হচ্ছে, এটা আমি ভাললাগা নিয়ে বলতে পারি। আমার দিদা (দিদিমা/ নানি) যে কয়েকটা ভাল কাজ করতেন, তার মধ্যে এই ভাল কাজটা আমি করি কিংবা আমাকে করতে হয়। (আমার ‘সুশান্ত’ নামটা দিদার রাখা। আমার ছোটো ভাইয়ের ‘প্রশান্ত’ নামটা আমার বড় মামার রাখা। তাঁরা কেউই আজ পৃথিবীতে নেই। তাঁদের দেয়া নাম নিয়ে আমরা এখনও আছি। আমার ডাক নাম বাপ্পী, আমার ছোটো ভাইয়ের পাপ্পু। এই দুইটা নাম বাবা-মা’র দেয়া।) মাঝেমাঝে মনমেজাজ ঠিক থাকে না। এটা আবার কাউকে বলতেও ইচ্ছে করে না। নিজেরটা নিজের মধ্যেই রাখি। মান্না দে’র একটা গান অনেকদিন পর শুনে আজ সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল। এই সময়ে একটা টেক্সট।

: সুশান্ত, জানিস, আমার একটা ভাই হইসে!

: বাহ! বেশ ভাল। এই বয়সেও? আঙ্কেলআন্টি’র সাহস আছে। গুড! ভেরি গুড! উনাদেরকে আমার পক্ষ থেকে কনগ্রাচুলেট করে দিস।

: চুপ থাক, ফাজিল! আমার কাজিন হইসে। বুঝসিস? ও না দেখতে তোর মতো। তবে ও আবার একটু পরপর চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেসি না। আপাতত তোর মতো লাগতেসে। এই দেখ, ছবি পাঠাচ্ছি।

ও ছবি পাঠাল। দেখলাম। আমি কখনওই পৃথিবীর কোনও শিশুর সাথে আমার চেহারার মিল পাই না। যথারীতি আজকেও পেলাম না। শিশুরা হয় ফুলের মতো সুন্দর। আর আমি কাঁটার মতো অসুন্দর। তবুও আমার ফ্রেন্ডকে খুশি করার জন্য বললাম, ঠিক বলসিস। পুরাপুরি আমার মতো দেখতে। ওয়াও! আমি তো ওর মা’কে চিনিও না। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? আল্লাহ ওকে বাঁচায়ে রাখুক।

: ওই ফাজিল! তুই এরকম বুড়া মানুষ স্টাইলে প্রার্থনা করতে শিখসিস কোত্থেকে? আর তুই যতোটা অবাক হইসিস দেখাচ্ছিস, তার অর্ধেকও হস নাই। বদমাইশ, তোরে আমি চিনি। আমার ভাইটা আসলেই অনেক কিউট হইসে। আল্লাহ! এতো কিউট, এতো কিউট! কালকে সারারাত ঘুমাই নাই। ওর পাশেই সন্ধ্যা থেকে বসে আছি।

: স্বাভাবিক। কিউট হওয়ারই কথা। আমি নিজেও অনেকবেশি কিউট। তুইই তো বললি, ও আমার মতো হইসে।

: উফফ! খুউব, না? একটা কষ্ট কর না, বন্ধু। ওর একটা নাম ঠিক করে দিবি?

: না, দিবো না। আমি নাম ঠিক করতে পারি না। মাফ চাই, প্রার্থনাও চাই।

: দে না প্লিজ! এরকম করতেসিস ক্যান? দেখবি, ও একদিন অনেক বড় হবে। তোর ঠিক করে-দেয়া নামে বড় হবে।

: বড় তো মাস্ট হবে। তোর কি ধারণা ও সারাজীবন এরকম নেংটু আর ছোটো হয়েই থাকবে?

: যন্ত্রণা করতেসিস ক্যান ভাই? বড় মানে, বড় মানুষ। এইবার হইসে? তুই কি নাম ঠিক করে দিবি?

: আচ্ছা, ওর নাম রাখ, বড় মিয়া। জন্ম থেকেই বড়। জীবনেও কোনওদিন ছোটো হওয়ার আর কোনও চান্স নাই।

: একটু সিরিয়াস হবি, প্লিজ? আমার এই উপকারটা কর, ভাই। আমি তোর জন্য প্রার্থনা করবো।

: তোর প্রার্থনা ধুয়ে আমি কি পানি খাব?

: আচ্ছা যা, তোরে ট্রিট দিবো। কসম! এইবার বল।

: এইবার ঠিকাসে, লাইনে আসছস। কিন্তু ওই নামে প্রবলেম কী? ক্যান? পছন্দ হয় নাই? আচ্ছা, ওর নাম রাখ, খোয়াথল্যাংতুইপুই। অতি চমৎকার নাম। এই নামে সেইরকম ভারিক্কি একটা ভাব আছে না? একদম মন থেকে চিন্তাভাবনা করে নামটা দিসি। যা! আর জ্বালাবি না। ট্রিটটা কখন কোথায় দিচ্ছস?

: তোরে আর নাম রাখতে হবে না। দুনিয়ার মানুষের নাম রাখিস। আমার এতো ফুটফুটে একটা ভাইয়ের নাম কীসব তুইপুই পাইসিস, না?

: দেখ, নামটা কিন্তু খারাপ না। অনেক আনকমন। তার উপরে নদীর নামে নাম। দেখবি, তোর ভাইয়ের মন নদীর মতো বড় হবে। বয়ে যাবে, ছুঁয়ে যাবে, কিন্তু কোথাও বাঁধা পড়বে না। দুনিয়ার সব মেয়েরে গার্লফ্রেন্ড বানায়ে ফেলবে। বিশাল প্রতিভা! তাছাড়া এই নামের একটা ওয়েটও আছে। একটু চিন্তা করে দেখ। বুদ্ধিটা খারাপ না কিন্তু!

: এরকম করতেসিস ক্যান? একটা নামই তো চাইসি। আর তো কিসু চাই নাই। দে না ভাই! আচ্ছা, তোর কাজ সহজ করে দেই, একটা হিন্টস দিচ্ছি। ওর আরও ২ ভাইবোন আছে। জিয়াদ আর জাইমুন। এবার দে। মিল রেখে একটা নাম বল। এখন বলতে না পারলে সময় নে, রাতে বল। নো প্রবলেম। আমাকে আঙ্কেল নাম রাখার দায়িত্ব দিসে। আচ্ছা, জিহান নামটা কমন হয়ে যায়, না?

: হুঁ, খুব কমন। তারচে’ জিয়া-জলে-জান-জলে নামটা রাখ। একটু বড় অবশ্য, তবে এই নাম তামাম দুনিয়ার আর কারওর নাই। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম।

: উফফ!! হারামজাদা! বেশি জ্বালাস তুই। একটা নাম দে না ভাই! তোর পায়ে পড়ি। যা! তোর ছেলের নাম আমি দিয়ে দিবো।

: আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে, তুই জানস ক্যামনে?

: আচ্ছা, তোর যা হবে, তার নাম আমি দিবো। অনেক কিউট একটা নাম দিবো। এইবার দিবি, ভাই?

: আচ্ছা, এবার আমি সিরিয়াস। ট্রিট দিবি তো? তোর কাছ থেকে আরও ২টা ট্রিট পাওনা আছে।

: দিবো, দিবো। সব দিবো। যেখানে চাস, সেখানে দিবো। প্রমিজ। আমি গত মাসে প্রফিট বোনাস পাইসি।

: ওকে। ওর নাম রেখে দে ‘জানেমন’। ডাক নাম রাখবি ‘জান’। দুনিয়াসুদ্ধ সুন্দরীরা ওকে জানেমন ডাকতে বাধ্য। ও হবে সবার জান, আই মিন, কলিজার টুকরা। আইডিয়াটা ভাল হইসে না?

: অনেক ভাল হইসে। আমার তো এখনই ধেইধেই কইরা নাচতে মঞ্চাইতেসে। তোর কোটি জন্মের ভাগ্য যে তুই এই মুহূর্তে আমার সামনে নাই। তোর মতো খারাপ মানুষ তুই নিজে আর কখনও দেখসস?

: শুন সুন্দরী, আমি সুন্দর খারাপ মানুষ। সুন্দর মানুষ খারাপ হলে কিসু হয় না। সুন্দর মানুষরা খারাপই হয়। আর আমি তো হেব্বি সুন্দর, তাই হেব্বি খারাপ। দেখিস না, মাইনষ্যে সুন্দর কাউরে দেখলে, দেখতে আমার মতো বলে?

: ও আল্লা! যা, তুই সুন্দর! তুই মাধুরীর চাইতেও সুন্দর। খুশি? এবার একটা নাম দে বাপ। ছোট্টো ফুটফুটে একটা মানুষ! বেচারা নাম ছাড়া থাকবে?

: ও কি আসলেই অনেকবেশি সুন্দর হইসে?

: আসলেই হইসে! তুই ক্লিনিকে চলে আয়। দেখে যা। আমি ঠিকানা দিবো?

: না বইন, দরকার নাই। আমি নাম দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কাউরে বলতে পারবি না যে তুই নাম দিসিস। আমি অ্যাকনলেজমেন্ট ছাড়া কাজ করি না। ওর নামের সাথে আমার নামটাও বলতে হবে, মানে, বলতে হবে, নামটা আমি রাখসি। রাজি?

: ওকে দোস্তো, রাজি। ডান! ট্রিটও দিবো। আগেরগুলা সহ দিয়ে দিবো।

: আচ্ছা ঠিকাসে। ওর নাম রাখ মুশকিলাসানালী। চলবে তো?

: পারফেক্ট! চলবে মানে?! দৌড়াবে। পুরাই তোর রুচিমতো নাম হইসে।

: ট্রিটটা?

: তা তো দিবোই!

: কী খাওয়াবি?

: সেটা খেতে আসলেই দেখবি।

: দেখ, আমি কিন্তু তোর জন্য অনেক কষ্ট করসি, অনেক মাথা খাটাইসি। এবারেরটা আবার ফাঁকি মারিস না। কবে দিবি বল?

: অবশ্যই আমার মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার আগে! আজকে সন্ধ্যায় ফ্রি আছিস তো? জিইসি’র মোড়ে চলে আয়। তোর জন্যে বিশাল ট্রিট ওয়েট করতেসে।

: বুঝসি। আমি ওইসময়ে ফ্রি নাই, ডার্লিং। আমার ট্রিট লাগবে না। নামটা আমি তোরে ফ্রিতে দিলাম।

: তুই পুরাই একটা ফাউল! দুনিয়ায় তোর মতো আরেক পিস পাইলে আমারে একটু জানাইস তো। কল দেয়া লাগবে না, মিস্‌ড কল দিস। আমিই ব্যাক করবো। হারামি……….

আহ! এরকম একটা বন্ধু থাকলে মন খারাপ করে থাকে কোন রামগরুড়ের ছানা?! (ভাল কথা, সেই খোকাবাবু আমার দেয়া নামেই বড় হচ্ছে—আরণ্যক ইসলাম অরণ্য।)

আচ্ছা, আপনার নামটা কে রেখেছিলেন, জানেন তো? কমেন্টে লিখুন, আমরাও জানি।