নিজের সত্তার প্রতি


এক।
কিছু ভাষা পেলে আমিও বলে যেতাম না-বলা হাজারো কথা,
কিছু বর্ণ হাতে পেলে আমিও যেতাম ভেসে কথার ভেলায়,
যে বোধগুলো চুপ করে থেকে থেকে ভেঙে যায় রোজ রোজই,
যে রোদ্দুর ক্ষণিকের তাড়ায় এই উঠোন মাড়ায়,
কিছু ভাষা পেলে সব কিছু এক করে বেঁধে ফেলতাম একটি সুতোয়;
এই হৃদয়ের ভাঙা বাঁশি এত করুণ সুরে বাজে---
যে জানে সে খোঁজ, সে বেদনাদের আকঁড়ে ধরে রাখতে পারে ঠিকই।


দুই।
একপশলা বৃষ্টি হয়ে আমার জীবনে এলে,
একমুঠো রোদ হয়ে আমার জীবনে এলে,
ভোরের শিশিরকণা হয়ে আমার জীবনে এলে,
সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আমার জীবনে এলে,
আষাঢ়ের ঢল হয়ে আমার জীবনে এলে,
কালবোশেখি ঝড় হয়ে, এক সাইক্লোন হয়ে আমার জীবনে এলে,
আমার ভাঙা-ঘরে জোছনার আলো হয়ে এলে,
দুপুরের মিঠে-কড়া রোদ হয়ে এলে,
আমার মৃত্যুর আস্ত ফাঁদ হয়ে এলে,
আমার চোখের কাজল হয়ে এলে,
আমার হৃদের প্রদীপ হয়ে এলে,
আমার গভীর ঘুম হয়ে চোখে এলে।


তিন।
আমি তোমার কাছেই সঁপেছি নিজেকে,
তোমার হৃদয়ে রেখেছি জমা এ হৃদয়খানি,
তোমাকে করেছি জীবনের পুরো অর্থই,
তোমাকেই নিয়েছি গেঁথে নিজের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়,...
জানা ছিল, আঘাতটা তাই দেবে ঠিকই,
জানা ছিল, মনের খুঁটি ধরে নিজের ইচ্ছে-খুশি নাচাবেই এ মন।
তবু হারিনি কখনও,
পথিক যেভাবে যায় পথ মাড়িয়ে,
ঠিক সেভাবেই গিয়েছি হেঁটে রোজ...তোমার ভালোবাসার ও-পথে।


চার।
তোমাকে ভালোবাসি এই কারণে নয় যে তোমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারি না।
তোমাকে ভালোবাসি, কেননা তোমাকে ভালোবাসতে বড়ো ভালোবাসি!
তোমাকে এ হৃদয়টা উজাড় করে ভালোবাসতে পারলে,…
তোমাকে নির্লজ্জের মতো, বেহায়ার মতো, অসভ্যের মতো,
কুকুর যেমনি তার প্রভুর প্রভুত্ব মেনে নেয় আনন্দের সাথেই, তেমনি করেই---
তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি!
কেননা, তোমাকে ভালোবাসলে এই হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে,
তোমাকে ভালোবেসে সুখ পাই, তাই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, এজন্যেই ভালোবাসি,
তোমার জন্য এই ভালোবাসা আমাকে আমার যোগ্যতার ঊর্ধ্বে উঠতে শেখায়, তাই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসলে আমি পৃথিবীর তামাম ভালোবাসার কাছে নত হতে পারি, এইজন্যই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসলে, ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে একটি সর্বজনীন ভাষা এনে দিতে পারি সহজেই, সেজন্য ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসলে আমি যে নিজেকেই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসি, এই সত্যকে নিজের কাছে অস্বীকার করতে চাই না বলেই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসলে আমি আমার প্রতিটি অনুভূতির পরোয়া করি যত্ন করে,
তোমাকে ভালোবাসলে আমি যে আমার ভালোবাসাকে খুব ভালোবাসি, এই বোধটুকু আমার আত্মাকে শান্তি দেয়, তাই ভালোবাসি,
তোমাকে ভালোবাসতে পারাটাই আমার যোগ্যতা,
নিজেকে এই যোগ্যতাটুকুর বাইরে আর কোনও অর্জন এনে দিতে পারিনি তো, এই কারণে অন্তত এইটুক হলেও যোগ্যতা ধরে রাখার চেষ্টা করি!
কী যে বিশ্রী দেখায় আমার এই উটকো ভালোবাসা তোমার কাছে, জানি না সে কথা,
তুমি কী ভাবো আমাকে, তা-ও জানি না আমি,
হয়তো ভাবো, আমার চেয়ে বোকা আর আত্মসম্মানবোধহীন একজন মানুষ হয়তো পৃথিবীতে আর একটিও নেই,
হয়তো ভাববে কখনও, যে তাকে ভালোবাসে না, তারই পিছু ছুটে মরার কী এমন মানে!
হয়তো মনে মনে বলে বসবে, ‘এই পৃথিবীটা আসলেই পাগলের পাগলামোতেই ছেয়ে আছে!’
অথবা বলতেই পারো---দেখো, সবাই, একেই বলে, বেকার লোকের প্রেম!
খেয়ে দেয়ে কাজ নেই,
পড়াশুনোয় মন নেই,
সংসারের চিন্তা নেই,
কাম কাজের ধার ধারে না যে, তার আবার ভালোবাসা ছাড়া কাজের কাজ কী-ইবা এমন থাকবে, বলো!
জানি, বলবে আরও, এই পৃথিবীটা ছেয়ে গেছে যত অকাজের ভালোবাসায়!
তুমি বলবেই, অকাজের মানুষগুলো কাজ পায় না, তাই বসে বসে ভালোবাসার বুলি আওড়ায়,
কেননা ভালোবাসার বুলি আওড়াতে যে পয়সার খরচা নেই,
তেমন কোনও শারীরিক কিংবা মানসিক শ্রমও দিতে হয় না,
---তো এর চেয়ে সহজ কাজ আর কী আছে পৃথিবীতে!
ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখা যায় সকলের কাছ থেকে,
কিন্তু একে কখনও নিজের মনের কাছ থেকে আড়াল করা যায় না,
তবে যে নিজ সত্তাটিই নিজের কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে!
তোমার যা খুশি বলতে পারো,
চাইলে অপমানে কিংবা আঘাতে আঘাতে শেষ করে দিতে পারো,
তবু আমি বলব, ভালোবাসার প্রতি অসীম বিশ্বাস আর ভালোবাসার বোধ থেকেই
নিজের ভালোবাসাকে ভালোবাসি, আমৃত্যু ভালোবাসব।


পাঁচ।
আমার তো প্রতিদিনই মৃত্যু হয়,
প্রতিদিন তোমাকে ভালোবেসে বেসে মরি,
আবার নতুন রূপে জন্মাই,
পুরনো আমিটাকে প্রতিনিয়তই শুদ্ধ করি, ঋদ্ধ করি
নতুন ভালোবাসায়।