নীলু, তোমাকে ভালোবাসি

 
আর কোনও দিনই এত রাত করে বাসায় ফিরব না, আজকের মতো দরজাটা খোলো, প্লিজ নীলু। তিন ঘণ্টা ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, মশার কামড় খাচ্ছি। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, নীলু। প্লিজ, এবার দরজাটা খোলো। দেখো, তুমি কী চাও, বলো। এই মুহূর্তে তুমি যা চাও, তা-ই দেবো। প্লিজ, তুমি শুধু দরজাটা খোলো। রাত চারটা বেজে গেছে, নীলু। আর একটু পর তো ভোর হয়ে যাবে। প্লিজ নীলু, দরজাটা খোলো। আচ্ছা, তোমার কত টাকা লাগবে, বলো? দুই হাজারে চলবে? এই নাও, দিচ্ছি দুই হাজার। দেখো, দরজার নিচ দিয়ে দুহাজার টাকা দিয়েছি। এবার প্লিজ নীলু, দরজাটা খোলো। একটু পরে কাজের বুয়াও চলে আসবে। ওরা যদি আমাকে এ অবস্থায় দেখে, তাহলে আজকেও বুঝে যাবে যে তুমি আমাকে আবার সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ। ওরা তারপর অন্য যে-সব বাসায় কাজ করে, সব বাসায় বলে বেড়াবে যে আমি রাত করে বাড়ি ফিরলে আমার বউ আমাকে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে। সেটা কি ঠিক হবে, বলো?


আমি বললাম তো, আর কক্ষনো এমন করব না। রাত বারোটার মধ্যেই কাল থেকে বাসায় চলে আসব। কাল থেকে আর রাত করে ক্লাবে আর থাকব না। তুমিই বলো, আমি কী করব? সব বড়ো বড়ো বিজনেসম্যানরা দশটার পরে ক্লাবে ঢোকে। সবার সাথে দেখা করে ফিরতে ফিরতে এত রাত হয়ে যায়। সবার সাথে দেখা না করলে কনস্ট্রাকশনের বড়ো বড়ো কাজগুলি কীভাবে পাব, বলো? সাইডের বিলগুলি ঠিকমতো তুলতে হলে ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, তুমি তো জানো। আচ্ছা, আমি কাল থেকে আরও জলদি জলদি আসব। আমি বারোটার মধ্যেই বাসায় চলে আসব, প্লিজ লক্ষ্মীটি, তোমার পায়ে পড়ি নীলু, এত রাতে আমি কোথায় কার বাসায় যাব, বলো? প্লিজ, এবার দরজাটা খোলো। আচ্ছা, আরও দুহাজার লাগবে? আচ্ছা, দাঁড়াও, এই নাও দেখো, আরও তিন হাজার দিয়েছি। একটু দরজার নিচে তাকিয়ে দেখো, ভেতরে দিয়ে দিয়েছি। পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি নীলু, প্লিজ! আর করব না, কানে ধরে বলছি, আর করব না।


আমাকে মাফ করো, দরোজাটা এবার খোলো, নীলু…না না, আমি আর কখনওই এমন দেরি করব না। আমার মনে থাকবে। হ্যাঁ বলছি তো, বিশ্বাস করো, আর করব না। এবার খোলো? আচ্ছা আচ্ছা, করব না বললাম তো! এইবারের মতো তো মাফ করো প্লিজ, সোনা আমার! তোমাকে তো বলেইছি, আগামী মাসেই তোমাকে ওই ওয়াইন-কালারের গাড়িটা কিনে দেবো। সত্যিই বলছি, আজকে সেই বড়ো বিলটার জন্যে ভাইয়ের সাথে কথাও বলে এসেছি। বিলটা হয়ে গেলেই তোমার গাড়িটা এবার কিনে দেবো, বিশ্বাস করো, নীলু। হ্যাঁ হ্যাঁ, দেবো দেবো…। এবার তাহলে খোলো, জান।…আহহহ্‌ বাঁচালে।


…দরজাটা অবশেষে খুলল আমার বউ। বিয়ের আগে যদি জানতাম, বিয়ের পর বাকি জীবনটা এভাবে বউয়ের চাকর হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে, তাহলে এ জীবনে আর যা-ই হোক, বিয়ে করতামই না। যদিও সব পুরুষই বিয়ের পর এসব বলে, অথচ বিয়ের আগে ওরাই বিয়ের জন্য আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কখন বিয়ে করব, বউ ঘরে আনব! থাক, ওসব কথায় না যাই আপাতত! ওসব কথা থাকুক। আল্লাহ! আজকের মতো তো বাঁচা গেল। আজকেও যদি বউটা ঘরে ঢুকতে না দিত, তাহলে আজকেও আমাকে বারান্দার মেঝেতে রাত কাটিয়ে দিতে হতো। তারপর মশার কামড়ের দাগে দাগে কাল আর বাইরে বেরুতে হতো না। সেবার বারান্দায় রাত কাটিয়ে পরদিন অফিসে যাবার পর আমার লেবারারও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে বলেছে, ‘ভাইজানের কী রাইতে ঘুম অয় নাই? চোখ দুইডা গর্তে চইলা গ্যাসে তো হেইজইন্যে মনে অইলো রাইতে মনে ভালো ঘুম অয় নাই। ভাবি ঠিক আছে তো?’


আজকাল ওরাও সুযোগে আমার সাথে মশকরা করতে ছাড়ে না। ভাবটা এমন যেন আমার বউয়ের মতো বউ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আসলে সবার ঘরেই আছে কম-বেশি, সবার ঘরেই এমন ঝামেলা আছেই, কেবল আমারটা মাঝে মাঝে একটু বেশিই প্রকাশ পায়। আমার বউটা আসলে কিছু বোঝে না। একটু রাত করে বাড়ি ফিরলেই সেদিন আর ঘরে ঢুকতে দেবে না। আরে বাবা, অত রাতে কোথায় যাই? একবার মনে মনে ভাবছিলাম, পাম্পে গিয়ে শুয়ে থাকি, তারপর আবার মনে হলো, থাক, ওখানেও তো লেবারাররা রাতে ঘুমায়, যদি টের পায়, আমি রাতে ওখানে ঘুমাতে গেছি, তাহলে নির্ঘাত টের পেয়ে যাবে, আমি বাসায় ফিরতে দেরি করেছি, এজন্য নীলু আজও ঘরে ঢুকতে দেয়নি। এই বউজাতিটা কেমন যেন, মাঝে মাঝে জীবনটা এমন জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়ে দেয় যে তখন মনে হয়, কীসের সংসার, কীসের কী! যাই চলে একদিকে, যেদিক দুচোখ যায়। কিন্তু মাথা ঠান্ডা হলে বুঝি, আসলে আমিও মাঝে মাঝে একটু বেশিই করে ফেলি।


আজকেও দেরি হয়ে গেল। এসব ক্লাবে গিয়ে একবার বসে গেলে হঠাৎ করেই উঠে আসা যায় না। অনেক প্রয়োজনীয় কাজ থাকলেও সেখান থেকে বের হবার উপায় নেই। নীলু ওসব বোঝে না, ও শুধু টাকা আর সংসার বোঝে। আসলে ওকেও দোষ দেয়া যায় না। বেচারি সারাক্ষণই সংসার নিয়ে পড়ে থাকে, বাইরে সংসারের কেনাকাটা ছাড়া তেমন একটা বের হয় না। তা ছাড়া বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওর কোনও বন্ধুবান্ধবও দেখিনি। সংসারই ওর কাছে সব। বুঝি এজন্যই এমন করে। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা থাকে। তিন ঘণ্টা ধরে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কোনও স্বাভাবিক মেয়ে তার জামাইকে তিন ঘণ্টা কীভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে! তারপরও মেজাজ গরম করতে পারি না কখনও। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে।…বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। এইমাত্র আমার বউ হঠাৎ আমার মুখের কাছে এসে…


…না না, আমি খাইনি! বিশ্বাস করো নীলু, আমি ওসব কিচ্ছু খাইনি। ওই আমার পাশে বসে আদনানভাই একটু খেয়েছিল, এজন্যই সেই গন্ধ পাচ্ছ। না নীলু, বিশ্বাস করো, আমি ওসব খাই না এখন আর। আচ্ছা আচ্ছা, শোনো, লক্ষ্মীবউ আমার! আমি আসলে একপেগ খেয়েছি, এর বেশি না, বিশ্বাস করো!...না না, আর খাব না, আর কক্ষনো কোনও দিনই খাব না, নীলু। আমার ভুল হয়ে গেছে, নীলু! দেখো, এত রাতে চেঁচিয়ো না, প্লিজ! আমি আর খাব না বললাম তো। আচ্ছা, তোমার পায়ে পড়ি, জান! আজকে মাফ করে দাও। আচ্ছা আচ্ছা, আর খাব না! সত্যিই আর খাব না। উফফফ্‌…বউটা যে কী, সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠিক ঠিক বের করে ফেলবে। ক্লাবে গিয়ে সবার সাথে ড্রিংক করতে না চাইলেও ওদের ‘না’ করা যায় না, কিন্তু বাড়িতে যে আমার জন্যে যমদূত বসে আছে, এটা আমি কাকে বোঝাই!


যা-ই হোক, এতক্ষণ বউকে নিয়ে যা-কিছু বদনাম করলাম, তার সবটা আসলে ঠিকও না। আমার বউ কেন যে এমন করে, তা আমি বুঝি। ছেলে-মেয়েরা বড়ো হচ্ছে, সেখানে আমি বাবা হয়েই যদি এত রাত করে বাসায় ফিরি, তাহলে ওর পক্ষে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা সম্ভব হবে না। এজন্যই এত সব করে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে নীলু তখন সবে এইচএসসি’তে ভর্তি হয়ে একদিন মাত্র কলেজ করেছে, তখন ওকে আমি আমার বউ করে ঘরে তুলি। না, আমাদের মধ্যে কোনও প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। নীলুর চাচা আমাকে প্রথম বলেছিলেন, ‘আমার ভাইস্তিকে বিয়ে করবে? যদি রাজি থাকো, তবে বলো। তোমাকে আর কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার ভাইয়ের যথেষ্ট আছে। ব্যবসাবাণিজ্য যা চাও, ভাই তোমাকে সাহায্য করবে। আর আমি তো আছিই!’ আমার তখন সবে ঠিকাদারির ব্যবসা কিছুটা ভালোই চলতে শুরু করেছে। একটু একটু করে কাজ পাচ্ছি মাত্র, কিন্তু হাতে কাঁচাটাকা না থাকায় আরও কাজের বেশ কিছু অফার থাকলেও তেমন ধরতে পারছিলাম না। ঠিকাদারির ব্যবসাই এমনই, যত টাকা তত কাজ।


নীলুকে প্রথম যেদিন দেখতে গেলাম, সত্যি বলতে, অমন মেয়ে হয়তো আমি কখনও বিয়ে করতাম না। অবশ্য, আমার তখন বিয়ের কোনও চিন্তা মাথায় ছিলও না। তখন কেবল ভাবতাম, আগামী মাসটা কী করে চলবে। নতুন কোনও কাজের জন্য কোথা থেকে কিছু টাকা গোছানো যায়। আমার বাবা তেমন কিছু করতেন না। জমিজমা যা ছিল, শুধু বাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া তার প্রায় সবই বেচা শেষ। আমরা ছয় ভাই তিন বোনের বিশাল এক পরিবারে আমি সবার বড়ো। বাবাকে কখনও কাজ করে সংসারের হাল ধরতে দেখিনি। পারিবারিক যা সম্পত্তি পেয়েছি, আর কিছু ক্ষেতের জমি দিয়ে ততদিন পর্যন্ত দুমুঠো ভাত কোনও রকমে জুটলেও অন্য কিছু তেমন জোটেনি। আমরা পড়াশোনাও কোনও ভাই-বোনই করিনি, কেবল আমার ছোটো বোনটা কিছুদূর পড়েছিল বলে এখন একটা বিমা-অফিসে কিছু একটা করে খাচ্ছে।


সত্যিই তখন নীলুকে কিছুটা দায় থেকেই বিয়েটা করেছিলাম। অত দেখাদেখির কিছু ছিল না। আমার তখন কেবলই কাজের নেশা। কী করে কাজ বাড়ানো যায়! এত বড়ো পরিবারের জন্য দুমুঠো ভাতের জোগাড় করতে হবে তো! নীলুর চাচার কাছ থেকেই আমি কাজ পেতাম। উনি বড়ো বড়ো কাজগুলি পেতেন, তার থেকে আমাকে মাঝে মাঝে ছোটোখাটো কিছু কাজ দিয়ে দিতেন। সেই থেকেই ওঁর মনে বিশ্বাসের একটা স্থান পেয়েছিলাম। বিয়ের আগে প্রায় তিন বছর ধরে নীলুর চাচার সাথে কাজ করেছি। সে সূত্রে তিনি মোটামুটি আমার কাজের খবরাখবর জানতেন, আর একই শহরের হওয়ায় আমার চারিত্রিক সব কিছুই মোটামুটি ওঁর জানা ছিল। আমার শ্বশুর অনেক সম্পদশালী মানুষ, মনের দিক দিয়েও ভালো। নীলুকে জলদি আমার হাতে গুছিয়ে দিতে পারলে ওঁরা বেঁচে যান, সেটা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি।


একে তো নীলুর গায়ের রঙ বেশ ভালোই ময়লা ছিল, তার ওপরে উঠতি বয়সের মেয়ে বাড়ির দিনমজুরের সাথে প্রেম করছিল। এর কিছুই আমার শ্বশুরের জানা ছিল না। উনি কাজের মানুষ, সারাক্ষণ এখানে সেখানে কাজের চাপে ছোটাছুটি করেন। হঠাৎ একদিন রাতে দেখেন, তাঁর মেয়ে ঘরে নেই। খুঁজতে খুঁজতে টের পেলেন, সেই দিনমজুর তাঁর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। আমার শ্বশুর একটু মেজাজি মানুষ। সেই রাতেই তাঁর ভাইদের নিয়ে মেয়েকে খুঁজে আনলেন। তার পরদিনই আমার সাথে নীলুর কাবিন হয়। আমার কাবিননামা হয় পাঁচশত এক টাকা, নীলুর বাবাই ঠিক করেছিলেন কাবিননামার টাকার পরিমাণ। ভোর চারটা বেজে গিয়েছিল নীলুকে খুঁজে আনতে আনতে। সেই ভোররাতেই নীলুর কাকা আমাকে ফোন দেন। আমি একটু ভয় পেয়ে যাই। অত ভোরে ফোন দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম এই ভেবে, হয়তো কোনও মাল চুরি গেছে।


আমাদের ঠিকাদারির অনেক কাঁচামাল সারারাত বাইরে পড়ে থাকে, বিশেষ করে রড নিয়ে বেশি ভয়ে থাকতে হয়। অনেকবার এভাবে অনেক টাকার রড চুরি গেছে আমার। সেই থেকেই কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। একে তো টাকার সমস্যা, তার উপর মাল চুরি হলে করব কী! নীলুর চাচা সকাল সকাল ফোন দিয়ে নীলুর ঘটনার কথা জানালেন। বললেন, খুব কষ্টে মেয়েকে খুঁজে এনেছেন। আজ কালের মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারলে গ্রামে মুখ থাকবে না। তা ছাড়া গ্রামে জানাজানি হয়ে গেলে একে তো মেয়ে দেখতে অমন কালো, তার উপর এই অবস্থা, কে তখন বিয়ে করবে? নীলুর চাচা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, ‘বাবা, আমাদের মেয়েটাকে তুমি নাও, আমরা তোমাকে দেখব।’ আমি আমার শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা আগে থেকেই কিছুটা জানতাম। বেশ ভালো ক্ষেতি-জমিজমা আর মার্কেটেও দোকানপাট আছে। তিনি বেশ টাকাপয়সা গুছিয়েছেনও বটে। তা ছাড়া এরা পাকা গেরস্ত ঘর। এজন্য আর কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলাম।


পরদিন সকালেই আমি বাসায় বাবা-মাকে জানিয়ে দিলাম বিয়ের কথা। মা হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু অখুশি ছিলেন না। বাবা তখন খুব অসুস্থ, মাকে কয়েকবার বলেওছিলেন যে আমার বিয়েটা অন্তত দেখে যেতে চান। বাবা তখন চোখে ঠিকমতো দেখেন না। বিছানা ধরেছেন আরও কয়েক মাস আগেই। আমার বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ের অতিথিরা বাসায় থাকতেই বাবা মারা যান। তো সেদিন সন্ধ্যায়ই কাবিনের কথা হলো। সকাল আটটার কাছাকাছি সময়ই নীলুর চাচা আমার চাচার সাথে পাকাপাকি কথা বলে গেলেন। আমার মনে আছে আজও, আমার বড়ো বোন নীলুর চেহারা দেখে ‘আল্লাহ গো!’ বলে চেঁচিয়ে আক্ষরিক অর্থেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ফিরতেই বোন উচ্চস্বরে ভাইবউয়ের চেহারার ফিরিস্তি গেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ির ভরামজলিসে কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। কী একটা কাণ্ড যে সেদিন হয়েছিল!


তবে আমার শ্বশুর আমাকে পেয়ে বেশ খুশিই ছিলেন। আমার শ্বশুর আজও আমাকে তাঁর অন্য মেয়েজামাইয়ের চাইতে, এমনকি তাঁর নিজের ছেলেদের চাইতেও বেশি স্নেহ করেন। বাবাকে হারিয়েছি বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায়, তারপর থেকে আমার শ্বশুরই বাবার অভাব পূরণ করে গেছেন সব সময়ই। বিয়ের কিছুদিন পরপরই নীলুর বাবা-চাচারা সেই দিনমজুর রাখাল ছেলেটাকে নীলুকে নিয়ে পালিয়ে যাবার অপরাধে পেটাতে পেটাতে এতটাই জখম করেছিলেন যে ছেলেটা পরদিনই মারা যায়। তারপর ছেলের বাড়ির লোকজন নীলুর বাবাসহ নীলুর কাকাদের মার্ডার-কেসের আসামি করে সবাইকে এক দিনেই জেলে পোরে। তখন নীলুর বাবা আর চার কাকা হঠাৎ করে সবাই জেলে। কে ছাড়ায়, কে জামিন করে! আমিই সবকিছু করলাম। তখন আমার শালারা সব ছোটো, ওরা তেমন কিছুই বোঝে না। আমি ছিলাম আমার শ্বশুরের বড়ো ছেলের মতো, আর সেদিনের পর থেকে শ্বশুরের বড়ো ছেলেই হয়ে গেলাম।


আমি সব দায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে শ্বশুর আর চাচাশ্বশুরদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনায় আমার শ্বশুর আজও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। উনি সব সময় বলেন, ‘আমার বড়ো জামাই থাকতে আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আমি মরে গেলেও আমার বড়ো জামাই সবকিছু ঠিকই একহাতে ঠিক করে ফেলবে।’ আমার শ্বশুরের স্নেহ, তাঁর ঠিক বাবার মতো ছায়াই আমাকে সব কাজের জন্য সাহস জোগায়। নীলুর উপর আমি কখনও রাগ করি না। ও এসে আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। আমার সংসার, মা, ভাই-বোন সবাইকে ও-ই প্রথম আপন করে নিয়েছে। নীলু যখন আমার ঘরে আসে, ও তখন নিজের হাতে ভাতটা পর্যন্ত খেতে পারত না। আমার শ্বাশুড়িমা বড়ো আদরে ওকে মানুষ করেছেন। এ বাড়িতে এসে নিজের হাতে ভাত খাওয়াই ওর সবচাইতে বড়ো সমস্যা ছিল। আমার ছোটো ভাই নীলুকে খুব পছন্দ করেছিল।


আমি সারাক্ষণই নানান কাজে বাইরে থাকতাম। বউকে ভাত খাইয়ে দেওয়া, আদর করে কথা বলা, বউয়ের আঁচলের নিচে নিচে থাকা আমার সারাজীবনের স্বভাববিরোধী। আমার ছোটো ভাইটাই নীলুকে এই পরিবারের করে তুলেছিল ধীরে ধীরে। তা ছাড়া ওরা দুজনেই সমবয়সি, আমার ছোটো ভাই হয়তো ওর ছমাসের বড়ো হবে। আমার ছোটো ভাই বিয়ের পর প্রায় দেড় বছর নীলুকে নিজহাতে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। নীলু অত সামাজিকতা জানত না। একেবারেই সোজাসরল কোনও প্যাঁচ না-বোঝা গ্রাম্য মেয়ে ছিল নীলু। মনে আছে এখনও, বিয়ের পর পরই এক মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন আমগাছে আম পাড়তে উঠে যায়। মা সেদিন নীলুকে কাছে নিয়ে অনেক বুঝিয়েছিল। আমার আশেপাশের কাকিমারা এ নিয়ে আজও তামাশা করেন বেশ। কিন্তু ওঁরা নীলুকে খুব ভালোবাসেন। যে মেয়ে কখনও নিজের বাড়িতে ভাত মেখে খায়নি, সে আজ আমার পুরো সংসারটাকে অনেক শক্ত হাতে আগলে রেখেছে। ওর উপর রেগে যাওয়া আমাকে মানায় না। আসলে আজকে আমার সংসারটা যে পর্যায়ে আছে, তাতে নীলুর অবদানই বেশি।


বিয়ের দু-তিন বছরের মাথায়ই আমার আমার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালোই হয়ে যেতে লাগল। নীলু অনেক হিসেব করে আমাদের সংসারটা সাজিয়েছে। ও খুবই হিসেবি মেয়ে। হিসেবের বাইরে সে কিছুই বোঝে না, কিন্তু সে কখনও কোনও কিছুতেই কার্পণ্য করেনি। গ্রামের পাঁচ জন অসহায় মানুষ নীলুর কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে এলে কখনও তাদের ফিরিয়ে দেয়নি সে। অকপটে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে থেকেছে। আমার ছোটো ভাইগুলিকে ও-ই বিয়ে দিয়েছে, তাদের সংসারও নীলুই গুছিয়ে দিয়েছে। এ সংসারের হাল ধরার পর থেকে নীলুকে কখনও ভোর ছয়টার পর বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখিনি। আমি আসি রাত একটা-দেড়টায়। অত রাতেই ঘুম থেকে তুলি খাবার গরম করে দেবার জন্য, এতে ও আমার উপর একটু রাগ দেখাবেই, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে আমার অতটা কষ্ট হয় না কখনও। রাতে যতই রাত করে ঘুমাই না কেন, সকালে ঠিক পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে যাবে সে।


আমার বিয়ের আগে থেকেই আমার বড়ো বোনের সাথে আমার সম্পর্ক বেশি একটা ভালো নয়। ওর উপর আমার কিছু রাগ জমে ছিল, নীলু সেটা জানত। কিন্তু কখনও সে এটিকে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যাবার জন্য কাজে লাগায়নি। বরং আমার বোনের যত সমস্যা, ও নিজেই মাঝে মাঝে আমাকে না জানিয়ে সমাধান করে দেয়। আমাকে জানায় না, কারণ আমি উলটো ওকে বকা দিই। ও তখন বুঝিয়ে কেবল এটুকুই বলে, ‘তোমারই তো বোন।’ আমি জানি, আমার বোন, ওর জন্যে আমার মায়া কি কম? কিন্তু ভুলতে পারি না অনেক কিছু, এজন্যই অতটা রাগ দেখাই। আমার ব্যবসা যখন সবে শুরু, তখন আমার বড়ো বোনের বিয়ে হয় অনেক ধনী পরিবারে। আমার দুলাভাই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। টাকাপয়সার কোনও কমতি নেই। আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগেই তাঁর তিনটা গাড়ি বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকত। আমি কেবল বিশ হাজার টাকা ধার চেয়েছিলাম ব্যবসা শুরু করতে। ওদের সে টাকা দেওয়াটা সাধ্যে কুলোয়নি, বরং আমার সাথে কী একটা বাজে ব্যবহার করে ওদের বাসা থেকে যা-তা বলে বের করে দিয়েছিল।


আমার বোন তখন বিয়ের পর এ বাড়িতে প্রায় আসতই না। সব সময় নাকউঁচু একটা স্বভাব, যেন এ ঘরে সে জন্মায়ইনি অথবা অন্য কোথাও মানুষ হয়েছে! সে তখন এ বাড়িতে এলেই সকালে এসে কোনও রকমে সারা দিন থেকে বিকেলে শ্বশুরবাড়ি চলে যেত। এর মাঝে কম করে হলেও দশবার শোনানো হয়ে যেত, ‘কীসের মধ্যে যে তোমরা থাকো! এভাবে থাকা যায়!’ ওর ভাবখানা ছিল এমন যেন ও নিজে ভিনদেশে মানুষ হয়েছে! এরপর থেকেই ওর উপর আমার রাগ। আজ ওর সেই আগের অবস্থা আর নেই কিছুই। এজন্যই হয়তো অহংকার কিছুটা কমেছে, সে আমি বুঝি। নীলুর মনে কোনও কূটচিন্তা নেই, সেজন্য সে এসব কিছু হয়তো বোঝে, কিন্তু কখনও প্রকাশ করে না। বিয়ের বিশ বছরের মধ্যেও নীলু কখনও একটা দামি শাড়ির আবদার আমার কাছে করেনি। তা ছাড়া এখন ওর আমার কাছে আবদার না করলেও চলে। তবু নিজের জমানো টাকা দিয়েও নীলুকে কখনও বিলাসিতা অথবা অযথা কোনও খরচ করতে দেখিনি, বরং সেই টাকা দিয়ে অনেক অসহায় লোকজনকে সাহায্য করে গেছে দিনের পর দিন, এমনকি তার সবটা আমি জানিও না।


আজ ঘরে ঢুকতে যে পাঁচ হাজার টাকা নিজের বউকেই ঘুস দিতে হলো, সে টাকা আসলে আমার সংসারের কোনও-না-কোনও কাজেই পড়ে যাবে, সে আমি জানি বলেই ওকে টাকা দিই। তা ছাড়া নীলু অতশত বোঝেও না। ওর কেবলই টাকা চাই, সে টাকার পাগল, কিন্তু সে টাকা কোথায় খরচা হলো, সে নিয়ে তার মাথাব্যাথা বা লোভ নেই মোটেই। হয়তো আছে, কিন্তু আমাকে সে বোঝায় না সেসব। এই তো সেদিনও নীলু আমার পকেট থেকে তিন হাজার টাকা সরিয়েছে। সে টাকার পরিমাণ দেখে টাকা সরায়। পরিমাণ বেশি থাকলে বেশি সরায়, কম থাকলে কম। আমি যে কিছু টের পাই না, তা না, কিন্তু টের পেয়েও কোনও সময়ই ওকে ওটা বুঝতে দিই না।


সেদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে বাজারে ঢুকেছি বাজার করতে। আমি সাধারণত সকালের হাঁটা শেষ করে বাসায় ফেরার পথেই বাজারটা করে নিয়ে যাই। তো সেদিন দোকানে গিয়ে দেখি পকেটে তিন হাজার টাকা কম, অমনিই বুঝলাম, এটা নীলুর কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেই সে হেসে ফেলল। আমি বললাম, ‘আরে, এটা তো বাজারের টাকা, তুমি সেটাও সরিয়েছ!’ সে হেসে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি বাজার থেকে কাউকে পাঠিয়ে দাও, আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ আমি ভেবে পাই না, এমন সময় ওর উপর রাগ করব কি না…সেদিন এক ভাই বলছিলেন গল্পচ্ছলে, ওঁর বউ নাকি দুবছরে পাঁচ লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেলেছিলেন কেবল জামাইয়ের পকেট মেরে! হা হা হা…। সেই ভাই আবার ব্যবসায়ী মানুষ, অত কিছু বোঝেন না এক ব্যবসা ছাড়া। ওদিকে ব্যবসায়ীর বউও আর-এক ব্যবসা ধরে বসে আছে!


না, আমি নীলুর উপর কোনও কিছু নিয়েই রাগ করি না। আজ আমার সবই আছে। একটু একটু করে একটা একটা করে আজ আমার ভালোই গোছানো হয়ে গেছে। আমার প্রথম তেলের পাম্পটা করার পরামর্শ আমার শ্বশুরবাবাই আমাকে দিয়েছিলেন। এখন আমার দুইটা তেলের পাম্প, একটা ইটের ভাটা, মার্কেটে গোটা বিশেক দোকান।…ভালোই গুছিয়েছি আমি, আর এর সবই আমার শ্বশুরবাবা আর আমার নীলুর হিসেবি জীবনের চলনে সম্ভব হয়েছে। আজ পঁচিশ বছর হতে চলল আমাদের বিয়ের, অথচ আজ পর্যন্ত আমি নীলুকে নিয়ে একা কাছে কিংবা দূরে কখনও কোথাও বেড়াতে যাইনি। নীলুকে কখনও তার জন্মদিনে কোনও উপহার আজও আমার দেওয়া হয়নি। প্রতি ম্যারেজ-ডে’তে নীলুই বরাবরের মতো আমার জন্যে জামাকাপড়, পাঞ্জাবি কেনে। আমি কখনও কিছুই কিনিনি ওর জন্যে। ব্যবসার কাজে আমাকে বাইরে যেতে হয় অনেক, কখনও নীলুকে কোথাও নিইনি অথবা সেখান থেকে কিছু কিনে এনেও নীলুর মনরক্ষা করতে হয়নি কখনও।


আমার জামাকাপড়গুলি বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত নীলুই আয়রন করে। কখনও সেগুলি লন্ড্রিতে দিতে হয়নি, অন্তত আমার কাপড়গুলি দিতে হয়নি। একবার ব্যবসার দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক করেছিলাম বেশ ক’বছর আগে। তিন দিন আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। এনজিওগ্রাম করাতে হয়েছিল হার্টে ব্লক আছে কি না দেখতে। নীলু আমার কাছ থেকে সেই তিন দিনে এক পা-ও কোথাও সরেনি। কাচের দেয়ালের পাশে নীলুর ক্লান্ত মুখখানি আমি সেদিনও আমার সামনেই পেয়েছিলাম। যেদিন এনজিওগ্রামের রিপোর্টে নেগেটিভ এল, নীলু অশ্রুসিক্ত চোখে আত্মীয়স্বজন সবাইকে খুশির সংবাদটা দিচ্ছিল। সেদিন ওর চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ওর চেয়ে সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে আর নেই। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত নীলুর সাথে আমার দুবার ঝগড়া লেগেছে। হ্যাঁ, গুনে গুনে দুবার মাত্র ঝগড়া লেগেছে। একবার নীলু ঝগড়া করে বাবার বাড়ি চলে গেলে আমি ফোনে ওকে কেবল বলেছিলাম, ‘তোমাকে এক্ষুনি বাসায় দেখতে চাই, আমার বউ বিয়ের পর বাপের বাড়ি থাকবে, এটা যেন কিছুতেই না ঘটে।’ সে সঙ্গে সঙ্গে সেই মুহূর্তেই বাসায় চলে এসেছিল।


বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত নীলুকে ছাড়া ঘুমিয়েছি খুব কম। হ্যাঁ, আমি নীলুকে কিছুই দিইনি, অন্য সব পুরুষ যেভাবে দেয় ওদের বউকে। আমি কখনও নীলুকে, ‘ভালোবাসি’ বলে পাগল করিনি অথবা আজ পর্যন্ত কখনও বলা হয়নি, ‘নীলু, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’ তারপরও আমি জানি, নীলু আমার জীবনে কী! নীলুর উপর রাগা যায় না, কোনও কারণেই নীলুর রাগে উলটো রাগা যায় না। গতকাল রাতে দেরিতে ফিরেছি, শাস্তিস্বরূপ তিন ঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে হয়েছে, তারপরও আমি নীলুর সাথে উচ্চস্বরে কোনও কথা বলিনি, কারণ নীলু আমার, ওর উপর রেগে-যাওয়াটা আমার সাধ্যে নেই। গতরাতের শাস্তির কথা কিছুদিন মনে থাকবে---হয়তো এক মাস, ঊর্ধ্বে দেড় মাস। তারপর আবার একদিন একই কাজ করে বসব, আবার নীলুর শাস্তি আমাকে মাথা পেতে নিতেই হবে। ওর কাছ থেকে শাস্তি পেতে আমার একধরনের ভালোও লাগে। সবকিছুর পর বলব, আমি নীলুকে নিয়ে দিব্যি আছি। আমার বউয়ের আসল নাম সৈয়দা রাশেদা আক্তার। বিয়ের পর আদর করে নীলু নামটি আমিই রেখেছিলাম। প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে গেইটে থাকতেই নীলুকে জোরগলায় নীলু নীলু বলে ডাকতে ডাকতে যখন ক্লান্ত আমি ঘরে ফিরি, তখন বুঝি, শান্তি এটাই। এ শান্তি যে অঢেল টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না! নীলু, তুমি যেমনই থাকো, আমারই থেকো।