পরজন্মের ছক

আমি আর-এক জন্মে আকাশ হব,
আমার বুকের কান্না যত, তোমায় বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেবে!
নইলে আমি মাটিই হব---ওতে স্যাঁতসেঁতে এক ঘ্রাণ থাকবে।
গাছের সারি, লতার বাহার…আর যা আছে সব, আমার বুকে জায়গা দেবো।
যখন লোকে বিদায় নেবে, তখন…আমিই ওদের বন্ধু হব।


আমি নাহয় গনগনে এক ধুমধাড়াক্কা নায়িকাই হব!
হাজারো মানুষ ছুঁতে চাইবে, আমার মতন হতে চাইবে তপস্যাতে।
আমি অভিনয়ে ওদের চোখে হাসি-কান্নার ঢেউ আনব।


হয়তো এক ক্ষুদ্র দেহের পিঁপড়েই হব,
দুনিয়াতে সবাই হবে অনেক বড়ো, শুধু আমিই ছোটো,
আমার জায়গা হবে অনায়াসে সবখানেতেই!


কখনও ভাবি, খুব মারদাঙ্গা এক প্রেমিকা হব,
প্রেমিক যখন ভুল করবে, তখন গুনে গুনে ওর চুল ছিঁড়ব।
মান-অভিমান তুলব শিকেয়, মুখের উপর বলেই দেবো মনে যা আসে,
এদিক থেকে ওদিক হলেই চড় মারব, সাথে ভুঁড়ি ফাটাব ইচ্ছেমতো!
বিশ্বাসটুকু জিইয়ে রেখে ওর অতীতের ভুল শুনব চোখ রাঙিয়ে।
তা না হলে এক লক্ষ্মীমন্ত গিন্নি হব, ক্ষুধাপেটে ঘোমটা মাথায়
বরের বাড়ির ফেরার পথ চাইব। প্রার্থনাতে আমিই ওর সঙ্গী হব,
ওকে একটু এগিয়ে রেখে আমি নাহয় বসব পিছে।


প্রেমিকের ঘামে ভেজা জবজবে ওই আকাশি রঙের শার্টটা হব,
ওর ঘামের গায়ে লেপটে রবো, গুটিয়ে-রাখা আমার হাতায়
সে যখনই কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছবে,
আমি তখন ওর গায়ের ঘ্রাণে একপৃথিবী সুখ খুঁজব।


জীবনানন্দের বনলতা হয়ে শান্তি দেবো,
নজরুলের প্রমীলা কিংবা রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী…
ওসব যদি হতে না পারিও, মুজতবার শবনম কি
শঙ্খ-সুনীলের মার্গারিট তো হবই হব!


আমি সেই মুষলধারার বৃষ্টি হব,
যেখানে কান্না ধরে হাজার চোখের,
কিংবা হব কৃষ্ণচূড়াই, জড়িয়ে রবো
তোমার নীল প্রেমিকার মত্ত খোঁপায়,
সে আমায় ছোঁবে আর আনমনা হয়ে খুঁজবে তোমায়!


বেলিফুলের যে চারাটা কিনে দিয়েছিলে, সে গাছটা
বড়ো হতে হতে তুমিই কেমন করে হারিয়ে গেলে…
সেই গাছের প্রতিটি ফুলে আমায় পাবে, ঘ্রাণটা নিয়ো।
নয়তো সেই সস্তা বকুলফুলের মালাই হব, যে মালাটা
তোমার ভালোবাসে যে, সে তোমায় দেবে না দেবে...
দ্বিধায় পড়ে নিজের উপর নিজেই চটে বাড়িতে ফিরে
বইয়ের ভাঁজে অবেহেলায় ফেলে রেখে দেবে।


আমি হব প্রেমিকচোখের নোনতা জলে ভেজা হাজারো চিঠি,
নয়তো আমি সরলা প্রেমিকার কাঁচাহাতে সেলাই-করা রুমালই হব!
আমি সেই কালবোশেখী ঝড়টা হব,
যে ঝড়ে উড়ে যাবে কারও প্রেমিকার নীল ওড়না,
খুলে যাবে রাশ...বেঁধে-রাখা আঁট কোঁকড়ানো চুল!
শোনো মেয়ে, তোমার প্রেমিককে খুব সাবধানে রেখো।
যদি না রাখো, আমি এক রহস্যময়ী নারীই হব,
যার চোখেতে ডুবেই যাবে দুর্দান্ত তোমার প্রেমিকপ্রবর!


আমি গীতিকারের সেই গীতটা হব, যা গুনগুনিয়ে একই সাথে
বুড়ো হবে দুনিয়ার দুইপ্রান্তে একই আত্মার দুজন মানুষ।
আমি বেহালার সেই নরম করুণ সুরটা হব,
যে সুর শুনে আকুল হবে নিতান্তই এক পাষাণহৃদয়!


আমি দুচোখের কাজল হব, সাক্ষী রবো অশ্রু কিবা মিষ্টি সুখের।
আমি নাহয় সিঁদুর হব, টকটকে লাল আলতা হব কিংবা আবির,
সিঁথিতে, পায়ে, গালে জ্বলব রক্তআভায় জ্যান্ত হেসে।
দুটো মানুষের পথটা চলার শুরু কি বিকাশ, দুই-ই হবে আমায় দিয়ে।


আমি ফুটফুটে একটা শিশুই হব, আধো আধো বোল ফুটলে কথা বলব,
ভুলভাল শত ছড়া কাটব, থাকব মায়ের বুকে নয়তো বাবার কোলে।
নতুবা আমি পুরো জন্মে শুধু মা-ই হব, অনেক শিশু ঘিরে থাকবে,
ওদের সবাইকেই আমি বুকে লেপটে তৃপ্তির ঘুম ঘুমোব রাতে।


আমি সেই কবিতা হব, যে কবিতা লিখতে কবির কাটে
নির্ঘুম রাত নিয়ম করে, যে কবিতা লেখা অবধি
কবি ভীষণ অসুখেই ভোগে। সেই কবিতায় শামিল হবে,
হাজার হাজার কবিতাপাগল মানুষের ভিড়, যে কবিতার
দাঁড়িতে, কমায়, সেমিকোলনে ভেসে চলে যাবে পাগলের দল!
উপন্যাসও আমি হতেই পারি, বড়ো কোনও উপন্যাসের
ছোট্ট কোনও চরিত্র হব, যে চরিত্রই হবে মোড় ঘোরানোর।


হব মায়ের সাড়ে বারোহাতি নেতিয়ে পড়া থানকাপড়ই,
যাতে লেগে থাকবে মায়ের গায়ের গন্ধ,
থাকবে এখানে সেখানে মশলার দাগ, আঁচলে থাকবে চাবির গোছা,
হয়তো সে থানে থাকবে ছেঁড়াও খানিক কোথাও।


আমি হব বাবার ওই শক্ত দুহাত, যে হাতে বাবা
পুরো পরিবারই বুকে আগলে রাখেন,
আমার সাফল্য দেখে যে ভেজাচোখে হাসেন তিনি,
নাহয় আমি সেই একটি জোড়া চোখই হব।


আমাকে শুনছ তোমরা? আমি পাখি হব গো, পাখি!
উড়ে বেড়াব সারাপৃথিবী। গুঁড়িয়ে দেবো নটা-পাঁচটার রুটিন যত।
আমি হব সেই দস্যি মেয়ে, ডাকাবুকো এক কিশোরীবেলার,
গাছের এ-ডালে সে-ডালে ঘুরে বেড়াব, কাদামাখা হয়ে
কালিসন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে, চালতা-আচারে কবজি ডুবিয়ে,
দাদির বকা শুনব, আর সবকটা দাঁত বের করে দিয়ে হাসব ভীষণ!


আমি আরও একবার জন্ম নিলে পার করব সময় ঠিক গুনে গুনে,
এক সেকেন্ডও বৃথা দেবো না। খুব দারুণ করে বেঁচেই নেবো,
নাহয় না ঘুমিয়েই কাটাব সময় খুব চেখে চেখে!


ও…শুনে রাখো! আমি কিন্তু আর-এক জন্মে নারী হব না,
…আর পুরুষ? না না, হব না সেও!
আমি শুধুই মানুষ হব…পরজন্মে, সাতজন্মে, শতজন্মে!