পরবর্তী ধর্ষণের আগে ও পরে করণীয়

 একটি ভ্রূণের গলায় ঝুলিয়ে দিলেম এ পৃথিবীর আদিমতম ঠিকানা।
এতো জ্বালা কেন তোমার পুরুষালি ওই রুদ্রকলমে?
হে মাননীয় কবি, আমি এ সভ্যতা মানি না, সংস্কৃতি মানি না।
তোমার কলম চলুক নিরাপদ পথে, সে কপট পথে যাব না ভুলেও!
আহা......থামুন, দাদা! চটেছেন কেন? আসুন, বসুন! একটা স্পেশাল লাচ্ছি খান! আমরা আমরাই তো!


শুনুন মন দিয়ে! এসব আমাদের মত ভদ্র, ধর্মমুখর দেশের নিরীহ, ধার্মিক নাগরিকদের কাজ হতেই পারে না!
এসব অমানবিক, বর্বর, মধ্যযুগীয়! ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে এসব করেছে বা করিয়েছে। দেশটা, থুক্কু.....ব্রহ্মাণ্ডটা এবার বুঝি রসাতলেই গেল!
ঐ সব ফুলের মত নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ লোকগুলো বেবাক ফেঁসে গেছে। দেখুন দেখি কাণ্ড!
বোধসম্পন্ন সব্বাই তাই এক হয়ে স্বদেশরক্ষায় রাস্তায় নেমেছে। নামবে না-ই বা কেন, বলুন?


আপনি যে কী করেন না, দাদা! কিছু না বুঝেই খামোখা একটা ফ্যাসাদ.........
আরে মশাই, দাঁড়ান, দাঁড়ান! অমন করে খেপছেন কেন? শুনুন, শুনুন! ব্যাপারটাকে ধরে......ওই ওরা কী একটা জানি বলে না........অপার্থিব, না কী যেন? রাইট, রাইট! অপার্থিবই তো! হ্যাঁ, ব্যাপারটাকে ধরে অপার্থিব মাত্রায় টেনে তুলুন! আপনিই বলুন না, এতো সুন্দর পৃথিবীতে এসব হয় নাকি? তাও আবার এই স্বর্গীয় পুণ্যভূমিতে!
তুলুন, ব্যস্‌ দেখুন তারপর......কেমন জমছে খেলা!


সত্যি খেলা জমল। ফেসবুক তোলপাড়। চারদিক হল স্লোগানে মুখর। ফাঁসি চাই, দিতে হবে। এক পোস্টেই হাজারে হাজার.......মানে, লাইক আরকি! এক অপরাধেই ধর্ষক বেচারা ঝুলল ফাঁসিতে হাজারবার---ফেসবুকেই! উত্তেজনার এই চরম মওকায় সবাই খুশি!
এরপর......অন্য ইস্যু। আগের ইস্যু ইউজড্‌ টিস্যু! নতুন নিয়েই ব্যস্ত সবাই।


কিচ্ছু লিখো না। কোনো লাভ নেই, ওরা কেউ পড়বেই তো না!
বইয়ের পাতা দেখলেই ওরা পালিয়ে বাঁচে শতসহস্র যোজন দূরে!
সহ্য হচ্ছে না? রাগে গা জ্বলছে? নিজের গালেই কষে একচড় মারো! আর কিছু হোক বা না হোক, মশা তো মরবে! কর্পোরেশন আর কত মারবে, বলো! তুমি না দেশের ডিউটিফুল বিউটিফুল সিটিজেন? একটু হেল্প করোটরো!
আয়না ভাঙো, ডায়রির পাতা ছিঁড়ে ফেলে দাও। আর কিছু পাও বা না পাও, বাদামওয়ালার প্রার্থনা পাবে। হয়ত এক বিকেলের প্রেমটাও ফ্রি! কে বলতে পারে! লুঙ্গির মতই ভাগ্য খোলে অকস্মাৎই!
বুকের মধ্যে নখ বসিয়ে কলিজাটা বাইরে টেনে ডাইনিং-টেবিলে প্লেটটা সাজাও। টাটকা রক্তে মোড়ানো জ্যান্ত কলিজা, দেখতে কিন্তু ভালই লাগে!
ডানহাতের সব আঙুল কেটে পকেটে পুরো! একেকটা আঙুল বেপরোয়া হয়ে বারুদের মত ছোটে! কোনও মানে হয়, বলো? ওদের বড্ড বাড় বেড়েছে! আর বাড়তে দিয়ো না!
এবার নিঃশঙ্ক চিত্তে সবাইকে ডাকো, উল্লাস করো! চেঁচিয়ে বলো, “স্বাধীনতার এতগুলো বছর হল.........এসো, উদযাপন করি। নাও, কেক খাও.......হ্যাপি বার্থডে টু.........”


বলছি, লিখো না কিছুই! লিখে কী হয়?
হাত দুটো যদি নেহায়েতই নিশপিশ করে, তবে ওদের ধরে হাতকড়াটায় চালান করে টেলিভিশনে চোখদুটো রাখো। দেখো, এই পৃথিবী কত সুন্দর! মরেই তো যাবে, তার আগে চোখ মেলে দেখবে না ওকে!
দেখো দুনিয়ার যত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের ঝলমলে বিজ্ঞাপন! মেয়েরা ক্রিম মেখে কনফিডেন্ট হচ্ছে তো! ঘণ্টায়-ঘণ্টায় নারীমুক্তি মিলছে, আর তুমি কিনা একবারও তাকিয়ে দেখবে না? এতো ব্যাকডেটেড হয়ে বেঁচে আছো কীকরে?


তবু লিখতেই হবে? ও আচ্ছা! তাই বটে! তা......লিখে কী হবে? ওরা যে পড়তে জানে না! জানে যারা, তারা পড়তে চায় না। এখন?
যারা একটু পড়ে, তারা বুঝে না বুঝে পড়ে নেবে হয়তবা। এরপর? হয় ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকবে, নয় নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে।
আর কিছুদিন যেতে দাও। এরপর দেখবে, ওদেরই কেউকেউ নোংরা আরশোলার মত সুড়সুড় করে চলেছে ব্যালটবক্সের দিকে........
যেমনি করে ইতর প্রাণীদের সহজেই বংশ বাড়ে, তেমনি করে নারীবাদীদের অনায়াসেই ফলোয়ার বাড়ে। কে না জানে! অতএব, নারীবাদী হওয়াই উত্তম, যুক্তিযুক্ত, সময়োচিত। ফলোয়ার বাড়লে কিন্তু স্বর্গের ফার্স্টক্লাস টিকেট কনফার্ম!
ভাইসব, নারীবাদের বাস্তবায়ন আমাদের জাতীয় কর্তব্য! আসুন, সবাই মিলে গলা ছাড়ি, স্লোগান প্র্যাকটিস করি.........


কষ্ট হচ্ছে, কথা আটকে আসছে, অসহায় লাগছে.........
মেয়েগুলির বয়স দশের নিচে বলে নয়, আরও কারণ আছে।
এ সমাজে প্রতিবাদ করলেই বেজন্মা বেয়াড়া বেয়াদব.........ওকে ধরো, মারো, ঝোলাও!
দিনেদিনে আমরা মানুষের মতন দেখতে হয়েছি, মানুষ হইনি।
আমরা আধুনিক হয়েছি সেই মধ্যযুগের ঘন তীব্র আঁধার নিয়েই।
আলো নেই, আমরা সবাই অন্ধের মত হোঁচট খেতেখেতে কোথায় যেন হেঁটে চলেছি!
আইন এবার ভাঙবে? নাকি মচকাবে? নাকি আইনও আজকাল ধর্ষিত হতেহতে ক্ষয়ে যাচ্ছে!


এখনও বসে আছো? তোমাদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই? তোমাদের বিবেক কি আজ জুতোর তলায়?
ওই কচি মৃত মেয়েদের জন্য শোকসভায় যাও, গলা ফাটাও, সেলফি তুলো, আপলোড করে দাও! তালিয়া! লাইক হবে, লাইক!
এই ছোকরারা! চুপ কেন তোরা? ভাত খাস না নাকি? চিল্লা, শালা শুয়োরের বাচ্চারা! দেশ এগোচ্ছে না!
ঝিমিয়ে পড়ো না, এই আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে, দরকার হলে কাঁচাআমের জুসে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নাও! জুসে মনে করে বরফের কুচি ছেড়ে দিয়ো, আরাম পাবে!
.........ভায়া, একটু চেক করে দেখবে চুলটা ঠিক জায়গায় আছে কি না! যদিও আমার ক্যামেরা-ফেস অতো ভাল না, তবুও........ভিডিও-ক্যামেরাটা একটু সরাবেন, প্লিজ? জাস্ট এক মিনিট!.........আচ্ছা, আপনাদের চ্যানেলে এটা কয়টায় সম্প্রচারিত হবে যেন?.........ওহ্‌ লাইভ চলছে? শিটটট্‌!


এরপর? থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর! রমাকান্তকামার! উল্টাও আর পাল্টাও, দাদা, যেমন খুশি! চলছে, চলুক! মিটিং, মিছিল, প্রতিবাদ সভা! ফেসবুকে ঝড়!
আরেকটা মরেছে? এক মিনিট! এক মিনিট! কী যেন নাম? নাদিরা? নাকি নাদীরা? হ্রস্ব ই-কার? নাকি দীর্ঘ ই-কার? ঠিক করে বলোতো, ভায়া! এই তোরা থামবি একটু! তোদের বোন রেইপড্‌ হয়েছে, আর তোরা না বুঝেই সমানে চিল্লাচ্ছিস! তোরা শালারা সব হিপোক্রিটের দল!
হ্যাঁ, বলো!......হ্রস্ব? ওকে ডান! ইভেন্ট খোলো, সবাইকে সাদর নিমন্ত্রণ পাঠাও! লিখে দাও, আজকের এই ধর্ষণ-পরবর্তী মহতী কর্মযজ্ঞে আপনাদের সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান.........
মিছিলে নামো! মেয়ের পেট থেকে বেরনোর পর আজ পর্যন্ত যত গালি শিখেছ, সবকটা উগরে দাও একএক করে। ফেসবুকে ওই ক্রিমিনালের আটাশগুষ্ঠি উদ্ধার করো!
“এসব ছাড়ুন! এবার কাজের কিছু করুন!” “কাজের কিছু? কী বলতে চান? ওহ্‌ বুঝেছি, বুঝেছি! বলেন তো একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে ফেলি? উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন?”
সমাধানের পথ এমনই এদেশে! এর চাইতে ভাল কী আর হবে?


আমরা ক্রমেই বাঁচতে শিখেছি চেতনার ঘর ছেড়ে বহুদূরে গিয়ে......
কাতরতা যত, আসে কেবলই
ব্যথা পেলে নিজে।
সহানুভূতি কিংবা দয়া---অভিনয় সবই!
আমরা মোমের নরোম আলোয় মিছিল করি,
সে আয়োজনে অন্য মানুষ যত খুশি কাঁদুক বেশি, কী এসে যায়?
দোষ আসলে কারুরই নয়, পরিস্থিতির পরিহাসে এটাই জীবন!
বিপর্যস্ত এই সমাজে বাঁচার নিয়ম---কল্পলোকে করো বাস, থাকো সুখে বারোমাস!


আবেগ যত, চটজলদিই লুকিয়ে ফেলি নিতম্বে-সাঁটা পকেটটাতে
লোকের চোখ এড়িয়ে---দেখে ফেললে পাছে হেসে কুটি হয়!
সত্যিটা যা, তা ঢাকতে---কখনওবা নিজের কাছেই,
খুশির মুখোশ চড়াই মুখে; সব দেখেও কেউ দেখে না, সব বুঝেও কেউ বোঝে না,
আয়না ফেলে দৌড়ে বাঁচি---ভুলেও যদি চোখ পড়ে যায় নিজের চোখেই!


আসুন, আমরা সবাই চোখে রুমাল বেঁধে, কানে তুলো গুঁজে টেলিভিশন খুলে বসি।
এ বছর আলু ভালই ফলেছে! চিন্তা কী আর? আলুচাষিরা খুশি, আমরাও খুশি!
দেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে এটা ভাবতে ভাল লাগবে না কেন? কী সমস্যা আপনার?