পান্থগৃহের উঠোনে/এক

 এ সুরা সদ্য দারুণ পদ্য, প্রিয় হে ওগো, গিলেই দেখো!
নিজের হাতে তোমায় দেবো স্বপ্ন-আবেশ, সাজাবো সেখানে মনের মত,
ওই দুচোখে তোমার নিয়ো মেখে সব, নিয়ো চেখে খুব ওই দুঠোঁটে,
এসো প্রিয় আজ, এই আয়োজনে---এই নিরালায়, এই নির্জনে।


পিপাসায় তুমি ক্লান্ত ভীষণ, সরাও পৃথিবী, আমায় দেখো,
আমার সুরে, আমার ছন্দে নেচে ওঠো আজ গানে, আনন্দে,
জীবনের সুধা পান করে নাও, পাবে না সময় আর হয়তো---কে জানে তা!
পৃথিবীর এই পানশালাতে নাও নিজেকে, ভয় পেয়ো না, আমি তো আছি!


চেয়ে দেখো প্রিয়, আমিই তোমার পেয়ালা তৃষার,
তৃষ্ণা তোমার আমায় করে কেমন পূর্ণ, যখনই আমি হই শূন্য,
তোমায় আমি জ্বালিয়ে মেরেছি, পুড়িয়েছি মন---আমার তোমার.........কত কতবার......মনেও রাখিনি!
মনে পড়ে, প্রিয়? তবু বারেবার এক হয়েছি কী যাদুতে!


আজ আমি এই আসরে এসেছি ছড়িয়ে, বাঁধতে তোমায় কল্পলোকের সুতোয় জড়িয়ে,
সুরের যাদু মাতাল করে যেমনি করে, তেমনি তোমায় দেবো ভরে প্রাণের যাদুতে।
এক চুমুকেই পান করো না, রয়েসয়েই মাতাল হয়ো,
সৃষ্টি আমার সুরের শরাব, পান করে তা ধন্য করো দীন আমাকে।


ভালোবাসাটা সুখ দিয়ে যায় সারাজীবনই এই আমাকে,
তুমি কেবলই পান করে যাও আপনমনে জাগাতে তৃষা,
আমি তোমার মোহেই উঠবো জেগে,
তোমার সেবায় সরাই খোলা হৃদয়ে আমার---সুযোগ করে বসতে এসো!


ঘরের ঘোরে পান করে সে পানীয়কেই শুধায় হেসে,
“কোথায় যাবো? কেমন করে?”
ধর্ম সুরার মাতাল করা! পথের খোঁজটা সে কী জানে?
“হেঁটে চলো তবু! হেঁটে যেতে পাবে পানশালার ওই পথের দিশা।” কে যেন বলে!


হায়-হায় করি! হেঁটেই কেবল পার করেছি কতক সময়!
“আরও, আরও দূর.........” তবু সে বলে!
“এগোও বন্ধু! এগোতেই হয়!” সাহস হয় না! ভয় করে চলি.........
ক্লান্ত লাগে খুব। ভুল করে ভাবি, মেটাতে পিয়াসা হাঁটতে হয় যে আরও কতদূর!


আরও কত পথ পেরোলে পরে মদ ও মধু তফাতে পড়ে, তা-ই বুঝি না!
হাতের মুঠোয় গল্প পুরে তেপান্তরের হাওয়ায় উড়ে যখন চলি,
তখন আমি মদ ও নেশার সাঁকোয় দুলি কিছু না বুঝেই---দুই প্রান্তই এক করে নিই!
মনের ভুলে মন থামলে মনকে বোঝাই, নাহয় পথ হারালে মত হারাবি, আর তুই হারালে হারাবি সবই!


যদি পেয়ালা নেশার সাজায় হৃদয়, গহীন প্রাণে মাতায় নেশা,
পানের নেশা তবেই জাগুক, এর আগে নয়!
ধ্যানে তুমি মগ্ন যখন, পান করো না, বেঁধো নিজেকে,
পসরা পানের সাজিয়ে রেখো, ধ্যানের পরেই পানটা করো!


এঁদো মধুতে মদ ঢেলে দাও, আর চুপটি করে তামাশা দেখো!
যাজক তবু হায় মদ যেচে যায়! কীসের আশায়? চুপ করে দেখি।
আর বেশি নয়, চারটি কদম পেরোলে যদি স্বর্গ আসে, নরক খোঁজো কীসের আশায়?
সব বুঝেও, দেখি, কত লোক বাজে বকে যায়, ভুল শুনে যায়, পান করে যায়, ঘ্রাণ শুঁকে যায়.........পাপ নিয়ে ধায়!


এক পেয়ালা ঘুরে চুমু খায় আরেকটাকে, আর তার মাঝেতেই আংটি ঘোরে,
বীণায় বাজে সুরের শরাব, ঘরের মেঝে উঠোন ছেড়েও বাইরে ছড়ায়,
কোত্থেকে ওই মধু-ব্যাপারি আর কারবারি মদের দোস্তি পাতায়,
মুগ্ধ মদের ঘোর কাটাতে মধুর স্খলন---যোগবিয়োগে মদেরই জেতা!


হাতের তালুয় মদের কৌটো,
সোনালি চুলে ঝড়ের নৌকো,
মাতালের দল বেপরোয়া ছুটে,
যেমনি গোধূলি রংধনু লুটে!


খেয়াল করে পেয়ালার আগেই নাকটা দেখো, ঝোঁকে কোনদিকে,
আমি জেগে থাকতেই জাত চেনাব, করে দেবো মাত,
যার নেশার আগেই মৃত্যু আসে, তার কথা বাদ,
যে হাঁটে পথ, চিনেই হাঁটে। ভুল পথটাও---বুঝেই কাটে।


লাল আখরের আলোটাকে তুমি নাচতে দিয়ো তোমার মতে,
মৌরি দেখে শরাব চিনো, কোনও খেয়ালেই ছেড়ো না ওকে,
সেধেনেয়া যত যন্ত্রণা বড় জাগায় নেশা, সুরার স্মৃতি খুঁজলে তুমি আমায় পাবে.........
যে সুখ এলো কষ্ট বেচে, সেই সুখেতেই এ ঘর বাঁচে!


হালাল হারাম হয় না মদে, কিংবা পাঠে। ভাবনা আবার কোন দূষণে দুষ্ট, বলো?
আমি যা করি, তাইতো হালাল, কিংবা হারাম। মদ বলো, আর পেয়ালাই বলো, তা কখনও হয় না হারাম।
যে পেয়ালায় আগুন ধরে, সে পেয়ালাই হৃদয় পোড়ায়, শরীর পোড়ায়!
ভয় পেয়ো না, বন্ধু আমার, হৃদয় খুলে এসো পানশালায়।


রাত্রি যখন মাঝঘুমে,
মোমটা তখন মদ টানে,
কেন এলে প্রিয় এই হৃদয়ে, এই আত্মায় এই অবেলায়?
ভালোবেসে কেন করলে মাতাল চলে যাবে যদি?


সত্য এমন এলো কোত্থেকে?
আমি তো বন্ধু বলিনি কিছুই!
এ হৃদয়ে চোখ রেখেছ, সময় ও মন, দুইই দিয়েছ এ আত্মায়---
তাইতো আমি হারিয়েছি পথ অন্য পথে!


সে মুহূর্ত অমর হয়েছে, যে মুহূর্তে এসেছ তুমি।
আজ দেখি ফিরে, পুরনো ও পথেও তুমিই ছিলে!
যে ধ্বনি আজও বাজে হৃদয়ে,
সে ধ্বনি দেখি.........প্রতিধ্বনি---সে দানও তোমার!


যে দেবতারা এসেছে এখানে ঈশ্বরের হাতে,
যাদের সাথে খেলেন তিনি আপন মতে,
ওরা কেন হায় আমাদেরই হাতে কষ্টে কাঁদে?
কেন বলো, হায়, স্বর্গবীণা মর্ত্যলোকে বেসুরো বাজে মলিন সাজে?


যে বাঁশি কেবল স্বর্গ যাচে,
যে সুরে কেবল স্বর্গ নাচে,
সে যাদু যখন পৃথিবী মাতায়,
কষ্টই পায়---যাদুর ঘরটা বুঝি এইখানে নয়!


এ মনের কামনা কত ঝড়ের মত
জীবনে এসে জীবন ভাঙে, মরণ ভাঙে!
হৃদয় বড়ই অচিন সুরে, নিঠুর স্বরে
আমায় ছোটায়---পাগল হয়ে পাগল করে।


পথ চলতে ঘুম এসে যায়, ভার বুঝতেই হাল্কা লাগে,
পেয়ালা তবু ঠোঁটটা পোড়ায়, চোখটা জ্বালায়, হৃদয় রাগায়।
শরীর যখন শুকনো নিথর, দুচুমুকেই হৃদয় ভেজে,
মধ্যরাতের প্রিয়ার মতন মধু ঢেলে দেয় কী অকৃপণ ওই পেয়ালা!


জ্ঞান পুড়িয়ে আগুন নেভাও, শিখা উড়িয়ে জীবন সাজাও,
হৃদয়ে তোমার খোঁজো মন্দির, বাইরে যা আছে, ভোলো এইবার!
পথের দিশা তোমার ও মনে, প্রেরিত পুরুষও তা-ই তো জানে!
এসো এই ক্ষণে এই মধুবনে। ভয় পেয়ো না, সাজাবো তোমায় তোমার মতে, তোমারই পথে!


এই একটা জীবন কাটিয়ে দিল ভাতঘুমেতেই,
এমন মানুষ পেয়ালা কখনও নিল না ছুঁয়ে,
মদ কি মধু, দুইই সরাল এক জীবনে,
শুকনো জীবন কাটাল যেজন, জানল না সে জীবন কেমন!


এক পূজারিই জানে নৈবেদ্যের দাম, বাকিরা কেবলই ভুল বুঝে নেয়,
যে মধুর নেশায় ভ্রমর মাতাল, সে খোঁজ তুমি জানবে কীসে?
ছুটে যাও ওই ধর্মতলায় পানের নেশায়, সময় থাকতে পান করে সুরা সাজিয়ে নাও গো জীবনটাকে,
সুর ও সুরার যুগল যখন হয় বন্দি সাধ্য-সাধের সীমানা মেনে, তখনই বুঝি, এ-ই তো জীবন!


এই যে এত পসরা ভোগের, কিছুই তো তার থাকবে না আর,
এ সুরাই কেবল টিকবে, জেনো। যত রস দেখো ছড়ানো ওখানে---শুকিয়ে যাবে,
রাজা, রাজ্য---ফুরোবে সবই। ভাঙবে প্রাসাদ, ধুলো হয়ে রবে, স্পৃহা যত আছে, জলো হয়ে যাবে,
আমরাই কেবল রবো জেগে, ভাসব সে সুরে, যে সুর বাঁধে স্বর্গলোকের অমর চাবি।