পান্থগৃহের উঠোনে/তিন

 কত বড় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দায়! মৃত্যু ছড়ানো এই আশেপাশে, তবু জীবনের নেই ঠাঁই!
দিনের শেষে হৃদয়ের ঘরে শান্তি কেবল, সেখানেই বাঁচি নিজের রূপটা আড়াল করে!
শত যুগ ধরে হেঁটে চলি কেবল পথের খোঁজে, পথ এসে যায় চলার পথেই,
ইশারা সুরার কিংবা সুরের আমায় ছোটায় ঠিক সততই.........সরাবসুধা পেলেই থামি।


বন্ধু তুমি আর ভেবো না, আমি তো আছি, হবে না কিছুই---শেষ করে যা!
পানশালাতেই প্রার্থনাঘর, এখানটাতেই আসন মেলে মনদেবতার, খুঁজে নিতে হয়!
প্রার্থনা হোক নৈঃশব্দ্য আর নিবেদন হোক সংবেদ্য, এলে কোলাহল ফাঁকিই জমে!
প্রেমিক জানে, কোন জানালায় কোন আলোতে হৃদয় টানে কেমন করে, কী সে মানে!


প্রভু যেখানে থাকেন, সে ঘর ইটপাথরের সজ্জা তো নয়, হৃদয়ে গড়া---ভুল বুঝলে ভুলটা মেলে!
মন হারানোর সময় তো নেই, ধ্যানের প্রহর ওই সামনেই,
শতক গেলেও মুহূর্তরা ঠিকই জাগে নিজ নিয়মেই---হিসেবে রেখো, নাহয় ওদের হারাবে, দেখো!
ধ্যানপিয়াসি, ধ্যান ভেঙে আজ কর্মে এসো---প্রার্থনা হোক কাজের বেদী!


সুরার খেয়াল এক পেয়ালায় পান করে নেয় হিন্দু-যবন,
দ্বিধায় কাঁপে ধর্ম যত, ঐক্যে মাতে কর্ম তত,
প্রার্থনা হোক ভিন্ন তবু হৃদয়ভাষা এক তো জানি!
পানশালা এক আজব মাচা......সকল মতের, সকল পথের মানুষ যত---এক মার্গেই ওতেই বাঁচা!


সুরাপাত্রে যেটুক থাকে, নেশা ধরে যায় ওটুকখানি সওয়ার আগেই!
হৃদয়ে যদি প্রেম না থাকে, সুরার নাচন দেহেই জাগে স্তব্ধ চোখে,
পানশালাতে যে ঘুরে যায়, সে-ই বুঝে নেয় ভিন্ন জনম---শবের স্তূপে আর খোঁজে না জীবনগাথা।
হৃদয় বুঝেই নোয়ায় মাথা, অমন মেজাজ আসলে তাকে পেশির জোরে যায় না বাঁধা!


এক ঢোঁকেতেই জমে না নেশা, চুমুক দিয়েই পেয়ালা ফুঁকো,
ফুরিয়ো না---না ফুরোতেই! পুড়িয়ো না---না পুড়তেই!
কোনও একদিন ক্ষণের দায়ে ঢুকলে পাথর দেউলঘরে, চিরদিনের দেবতা হয়েই আসন পাতে!
প্রতিদিনের আসাযাওয়ার ভক্ত তবু ভক্তই থাকে---কোন সাধনায় একদিনেতেই দেবতা হয়ে পাথর বাঁচে?


বধূ আমার কেমন মায়ায় ঘোমটাফাঁকে আড়চোখে চায়,
সে ঘোমটা সরালে বধূর হৃদয় কাঁদে, তবু হেসে যায় সময়-ফাঁদে!
রাতের মধু লোভের ঝড়ে দিনেই খেলে,
অপার যে সুখ আর যত মউ এরও পরে, হারায় সবই!


ফুলকি শীধুর আগুনে ওড়ে, উল্কি যাদুর হৃদয়ে পোড়ে,
পানের ঘোরে অন্য সুরের আবেশ মেশে, দিন ফুরোলে মদই মাতায় সাকির বেশে।
আগের সময় যখন ফেরে আচার কিংবা ধর্মধাতে, তখনই দেখি, ঢেউ উঠে যায় কালের স্রোতে,
বদলে সময় সময় আসে---এ অনুভব সত্য কেমন, সত্যি তাকে যায় কি বোঝা?


ঠিক এখানেই হৃদয় হাসে!---বোলো না এমন আর কখনও।
এক পেয়ালা হলেই হলো!---শুনো না সেকথা, সব পেয়ালাই এক নয়কো!
যতটা মাথা, ততটা কথা। এরই সাথে আড্ডা চলে, আর চলে পান।
কাজ করে তো একটা মাথা, বাকিরা কেবল বাজে বকে যায়, ফালতু বাঁচে!


শ্রম, সংকট, কিংবা ক্রোধে ভুল মেরে বসো অন্য বোধে,
যা শিখেছ, যা নিয়েছ আপন বোধে কিংবা হাতে, পড়ে থাকে সব......নেশার মাতন তোমায় বাঁধে!
জন্ম তোমার ঠুনকো হতেই!---যদিও শোনো, বিশ্বাস রেখো নিজের কাঁধে! যার আছে প্রাণ, সে-ই সৈনিক!
যে গৃহতল দেয় না ছায়া মনের মতন---থাকুক পড়ে! অন্যঘরে অন্যস্বরে তোমার যতন---ওতেই বাঁচো!


সবাই কেমন হৃদয় টানে.........সুরার মানে, মধুর গানে,
আজ নয় থাক, কালকে আসি......যতই বোঝাই,
হেসে বলে সাকি, পালাও দেখি! যদি না বাঁধি, পেয়ালা সাধি---বাঁচবে কীসে!
সুর এসে যায় বেসুরো ধাতে, শরাব হাতে প্রেমের দোলায় হৃদয় মাতে।


আজ নয়, কাল---এমন শপথ মিথ্যে শপথ। নগদ বুঝেই সেয়ানা চলে,
বাকি যেটুক, সেটুক দিয়েই পেয়ালা ভরুক, সাকির হাতে বাকির শরাব কেবলই ফাঁকি!
পেয়ালা তুলে চোখ ভরে নাও, ফুরোলে সময় পিয়াস বুকের কালকে মেটাও, খেদআর্তি তোলাই থাকুক!
যদি না ফিরি পানশালাতে আর কখনও, তবু পুড়বে না চোখ মদের নেশায়।


সুযোগ এলেই ঘুমকে ভাঙাও, গোপন থেকেই প্রকাশ বাগাও,
মওকা পেলে বর্মে লুকাও, সুরার ঘ্রাণে সুরকে নাচাও।
রূপের ধাঁধায় সাকির ভ্রমে গুণের কদর যখনই কমে,
আপন চিনে আপন চেনাও, আগুন ধরাও, জীবনসরাই লুফে নাচো!


বলছি প্রিয়, আজকে বাঁচো, পেয়ালা ভরে হৃদয় সাঁচো!
এই ওষ্ঠযুগল হয় না বাসি ভুলে কখনও, চেখেই দেখো সুরার মতন!
মনে আসে যেন ওই নিবিড় বাহুর গভীর ডোরে মৃত্যু আমার,
সেই মরণেই মুক্তি খুঁজি......হে আসবপ্রভু, মিনতি রাখো, মিলনে বাঁধো!


কত সুন্দর, কত আলোমাখা, কত মায়াময় ওই হাসিমুখ,
দাম আছে যার, দারুণ জানি---দেখতে চোখে কিংবা চেখে,
আমি মদ ঢেলেছি, মদ গিলেছি, দিন ফুরিয়ে রাত নেমেছে......কেউ নেই পাশে, তিমির ছিল---সে-ই তো ভাল!
কে তুমি আর কোথা হতে এলে আমার মাঝে? নিজেকে চেনালে কোন শরাবের কোন সুরজালে?


দুদিন হল, মিনতি করে বলছে মধু.........শরাব ফেলো, আমায় ঢালো!
সামনে রাখা মদ্য, মধু---দুইই যাদু, কোনটা ছাড়ি? কোনটা ধরি?
ঘুমের ঘোরেই ঘুমকে তাড়াই, মধু কি শরাব---মাতাল হতে ভাবনা বাড়াই!
এক জীবনে কত বা নেবো, কতই দেবো......দ্বৈতে মাপি! এসব দেখি আর কেবলই দ্বিধায় কাঁপি!


ছোট্ট জীবন! কতটুকই বা পারব নিতে!
যে জীবনে পুরো পৃথিবী চেনা হয়ে যায়, সে জীবন জানি কষ্টে বাঁচা!
আগমনেই ছক বাঁধা হয় নিগমনের---সময় এমন!
শুরু করলে হয় নাতো শেষ; কেবল শেষ হয়ে যায়, শেষ দেখে নেয়---আমার জীবন, আমার সময়!


পান কোরো না আসলে প্রবোধ, ক্ষণিকমোহে হয়ো না অবোধ, শরাব ভেবে খেয়ো না জহর,
শুদ্ধ মানুষ শুদ্ধ পথে না যদি পাও, এক জীবনে ধূসর সময় আঁকড়ে দারুণ একাই বেঁচো!
হারানোর ভয় বাঁচাবে যত, মরবে তত; যা হারানোর, এমনিই হারায়,
আঁকড়ে ধরে, শেকলে বেঁধে, কোনও ফিকিরেই যায় না পাওয়া যা হারাবেই!


হারিয়ে ফেলার ভয় এলে তো পাওয়ার সুখই হয় যে ফিকে!
আমার ঘরে কত কী এসে স্তূপই জমে, জায়গা আমার কেবলই কমে,
তৃষ্ণার জল পান করি যত কণ্ঠ ভরে, তবু কেন হায় মন ভরে না?
আমার ঘরে পূর্ণ কলস, তবু কলসে অশ্রু ঢালি! তোমার ঘরে শূন্য গেলাস, তবু গেলাসে হাসির ডালি!


থেকো না ঘরে, বাইরে এসো, সুরার মালা ফুলের মেলা সাজায় দেখো,
পিপাসা এলে আর কী লাগে? সুরলহরীর সুরাপ্রহরীর মিলনসুধায় হৃদয় ভাসে পীযূষধারায়।
পেয়ালায় যা, ওইটুকুতেই ভাগ্যলেখা---নিয়ে নাও তা জলদি যেটুক রাখতে পারো,
কতকত রাহা পেরুলে বন্ধু, তবু ঠিকানা তোমার সরাইখানায় ক্লান্তপায়ে থামবে তুমি যেখানে এসে!


যত্ন নিয়ো, যা পেয়েছ, রত্ন সে যে---আগলে রেখো; আমিও নেবো, যা দিয়েছ নানা খেয়ালে,
কণা যদি দাও, তাও বড়, মাথায় রাখি মণির সাজে, কে-ই বা জানে, কখন লাগে!
আছি বলে আজ দাম বোঝো না, হারিয়ে গেলে মরবে খেদে, পূজলে তখন কী লাভ হবে?
লোকে কেন হায় নগদহিরে সরিয়ে রেখে বাকিধুলোর কদর খোঁজে---দেহ হারালে মূর্তি বানায়!


থাকতে চোখে মনে ডাকে না, থাকলে মনে ডাকে চোখে---কেমন বোকা, তাই না, বলো?
থাকতে জীবন মরণ সাধে, মরণ এলে জীবন বাঁধে--- উৎসর্জনে আবাহিত হয় ত্রপাই কেবল!
হাঁটতে গেলেই হোঁচট আসে, থামতে গেলে দায় এসে যায়, আর থমকে গেলে সন্ধে ডাকে,
পেয়ালা সাকির ফিরালে পরে জীবনসুধায় কমতি পড়ে, সে অকুলান মেটাতে গেলে ফুরায় যে প্রাণ মরণ-ঘায়ে।


পলকা মতির ভীষণ গতি, নিচুর তেজে পেয়ালা ভেজে অহেতুকুই---থাকতে সময় কেউ বোঝে না!
জীবনের দায় মৃত্যু শোধে; সত্য করুণ, তাও সে মধুর---যা নিতে হয়, তা-ই মধু কয়!
পরব চলে---মৃত্যু এলে! ফুরায় জীবন? ফুরাক না তা! নিঠুর সাকি দেয় না জিরান শুঁকলে পিরান!
সময় চলে দৃপ্ত ধাপে অমর ক্ষয়ে.........অসময়ে সময় ভোলে---এমন যেজন, সময় এলে সময় ভোলে---এ-ই তো জীবন!