পাশফেরা মুখের আদল

 একগ্লাস জল হবে? খুব ইচ্ছে হয়,
ভালোবাসাটা একঢোঁকে খাই!
অমন কি আর হয় কখনও…ভালোবাসা?
সারাদিনই তো একটু করে, আধটু করে,
চায়ের মতন সুড়ুৎ-সুড়ুৎ শব্দ হয়ে
ধীরে, সুস্থে শরীর বুঝে সমস্ততে ছড়িয়ে পড়ে!
অমন ভালোবাসার যন্ত্রণা কী, বুঝবে…সে কে!
একগ্লাস দেবে কি জল…ভালোবাসার?
নাহয় এইবেলাটা ভালোবাসা গিলেই ফেলি
চোখ বুজে, নাক বেঁধে…একটা ঢোঁকে!
তখন মরি কি বাঁচি, দেখা যাবে’খন!
 
যখন আমি একাই ছিলাম, ভালোবাসা…সে আসেনিকো,
তখন তো খুব চেয়েইছিলাম…দুহাত তুলে,
ভীষণ কেঁদে…ভালোবাসাটা যাক না হয়ে!
সবার মতো আমিও তাকে রাখব বুকে---আদর করে, যত্ন করে!
এখন দেখি…
ভালোবাসা তো এলই এল,
সাথে এল যন্ত্রণা কী…যায় না সওয়া!
যেন বেঁচে থাকতেই মরণ এল!
আমার এ কি ছিল প্রেমের চাওয়া? তখন
একে ভেবেই পার করেছি অগুনতি কত রাতের প্রহর!
 
একটু ভালোবাসাই খুঁজতে গিয়ে---
ভোরের আলোয় ছুঁয়েছি শিশির মুক্তো ভেবে,
ভিজেছি রোদে সকাল হতেই, প্রতিদিনই
গোধূলিফাঁকে সন্ধে নেমে ফিরেছে পাখি নিভৃত নীড়ে,
শীতের হিমে ডুব দিয়েছি পুড়িয়ে দুচোখ কী উত্তাপে!
ফুলের রঙে, পাতার টানে ফুরেছে কত বিকেলবেলা,
পাখির গানে ঘুম ভেঙেছে স্বপ্ন এনে,
সবুজ ঘাসে হেঁটেছি তো পথ হারিয়ে সীমা,
মাটির ঘ্রাণে গা ধুয়েছি নিবিড় প্রেমে…
তালপাতার ডোঙা খুলে ঘুরেছি নদী আবোলতাবোল,
কাঁচা আমের মেনেছি শাসন,
ভেলায় চড়ে মাছ ধরেছি তুমুল রাগী বৃষ্টি ভুলে,
কত গভীর রাতে বর্ষা ডেকে ভিজেছি অবাধ!
করেছি সবই…এক টুকরো ভালোবাসার স্বাদ যদি পাই…সে ভরসায়!
 
পথের ধুলোয়, বন্ধুরা সব আড্ডা পেটায়
চায়ের কাপে, ধোঁয়ার ঝাঁপে, ক্ষণের মাপে!
আমি তখন চশমা-ফাঁকে…দুই লালফিরোজা চুলের ফিতে,
দুই-পা ঢোকে শুভ্রসাদা জুতোর খোপে।
স্কুল খুলে নতুন বইয়ে মুখ গুঁজতেই ঘণ্টা বাজে,
ছুটির আগেই বিপিন স্যারের ‘পড়াশোনা করিস রে, মা!’
…এমন স্নেহের ভাঁজেই বই খুলতাম।
বাড়িতে যখন রাত নামত,
টিকটিকির টিকটিকটা ঘড়িই নিত,
চুপ-রাত্রির ঘুমটা ভেঙে ঝিঁঝিঁ পোকার হুটোপুটিতে
সেই গভীর রাতে দূরে কোথাও গাজীর গানে মন ভরত।
মাড়ভাঙা মায়ের শাড়ি…চিকন সুতোর, মোটা পাড়ের…সেদিন
ঈদের কার্ডে, চাবির রিংয়ে বন্ধুকে ঠিক পাওয়াই যেত…
এসব দেখে ভালোবাসাকে খুঁজছি কত তন্ন করে বুঝে না-বুঝে!
 
দিন ফুরিয়ে দিন চলল, কোনও একদিন সেই মানুষ দেখি সত্যি এল!
অবাক ব্যাপার! সে বিস্ময়ঘোর না কাটতেই সে বলেই বসে,
আমার তোমার সবটাই চাই নিজের মতো!
সে আসল…এসেছে, ভালই। বসল গেড়ে মনের ভেতর চুপটি করে!
আমিও কেমন ঘাপটি মেরে সয়েই গেলাম…থাকুক না সে!
কিছু দিনেই টের পেয়ে যাই, ঘুণের মতো কুঁড়েকুঁড়ে
কিছু একটা শেষ করে দেয়…কখনও অমন হয়নি তো আগে!
বুকের ভেতর ফাঁপা লাগে, মাথাও কেমন ফাঁকাই লাগে---
ভালোবাসা…এই কি তবে?
 
ভালোবাসাটা এমন কেন? এক শিশিতে যায় না পোরা?
এরপর দেহে সুঁই ফুটিয়ে চিমটি-দেওয়ার একটু ব্যথায়
শিরায় নেওয়া যায় না ওকে?
এই ভালোবাসা চেয়ে মরেছি কী যে…কোনও একদিন!
আমারও এক ভালোবাসা হোক, খুব নিবিড়-গাঢ়…
আমায় দেখে বলুক সবাই…এই দেখে যাও, ভালোবাসা একেই বলে!
ভালোবাসলে বেসো এমনই!
যখন সব ভেঙেচুরে ভালোবাসা এল, সুখের বদলে দুঃখ দিল,
বেদনা কি জ্বালা…সইতে না পেরে, ভাবি,
ভালোবাসাকেই রাখব দূরে…আলাদা করে নিজের থেকে…
ভালোবাসাটা সরাতে গিয়ে হঠাৎ দেখি, নিজেই কোথায় হারিয়ে গেছি!
 
ভেবেছি আমি, ভালোবাসা বুঝি মামাবাড়ির শিকেয়-তোলা
মিঠের হাঁড়ি! পেলে একবার, এদিকওদিক তাকিয়ে নিয়ে
গপ-গপাগপ গিলে ফেলা যায়!
ভালোবাসাকে নিয়েছি ভেবেই---অতিথি পাখি…
এই ক’মাস এখানে থাকে, আরেক ক’মাস অন্য কোথাও!
বোকার মতন নিয়েছি ধরেই---ভালোবাসা, সে তো মৌসুমি ফল,
শীতে এক তো গ্রীষ্মে আরেক…এখন বুঝি,
ভালোবাসা কাছে না এলে মনে রঙবেরঙের কত কী আসে!
 
এই ধরো না নানুর কথাই…কত ভালোবাসতেন,
আদর করে খাইয়ে দিতেন তেঁতুলআচার,
ঝালের বড়া…তবু সে ভালোবাসাটা বোঝার আগেই,
ভালোটা ওঁকে একটুখানি বাসার আগেই…
নানু কেন চলেই গেলেন?
আমিও বুঝি নানুর মতন
ভালোবাসা পাবার আগেই চলে যাব অনেক দূরে!
 
আচ্ছা, ভালোবাসা কি ফেরত হয়?
যেমন ধরো, উপহারটা বদল হয়,
শুভকামনাও এহাত থেকে ওহাতে যায়…
ভালোবাসাও তেমনি করে হয় না বদল?
বাক্স ভরে এক ঠিকানায়…প্রাপক অমুক,
আরেক বাক্স অন্য কোথাও…প্রাপক তমুক,
হয় না অমন? হলে খুবই সুবিধে হত…
ভালোবাসা সব বাক্স ভরে পাঠিয়ে দিতাম তোমার ঘরেই!
তখন তুমি ঠিক বুঝতে, এই আমিটা ধনী কেবলই ভালোবাসা পেলে!
 
যখন সূর্য জ্বলে প্রখর তাপে, ঝলসে হৃদয় কয়লা হাসে…দেখেছ এমন?
গভীর রাতে, নৈঃশব্দ্যের দেয়াল ভেঙে কান্না জাগে…শুনেছ এমন?
ভালোবাসা কি তবে পুড়িয়েই ছাড়ে? কাঁদিয়ে তাড়ায় এমন করে?
চোখের সামনে সূর্য রেখে কোনও একদিন দাঁড়িয়ে দেখো কেমন লাগে!
বুকটা কেমন খাঁখাঁ করে, চোখের ঘরে কষ্ট সরে, স্মৃতিরা সব কেঁদেই মরে!
কষ্ট বেচার লোক পাবে না, অন্ধ চোখে নামবে আঁধার…ভুলবে আলো।
এই আমাকে ভালোবাসাও পোড়ায় তেমন…তার কিছুই তুমি বুঝ না যে!
 
কোনও একদিন রাত নামলে আঁধারটাকে ছুঁয়েই দেখো…তাকে তো আর কেউ ছোঁয় না অমন করে…
ছুঁয়েই দেখো…বুঝবে তখন, কিছু না পেয়ে বাঁচতে আশায় কেমন লাগে!
এপাশে-ওপাশে, সামনে-পেছনে প্রেমের নেশা জাপটে ধরে,
কীসের সে প্রেম…কিছুই যখন যায় না বোঝা,
ভালোবাসার রঙ দেখলে যায় না চেনা…
তখন নানান কথার ভাঁজে, কে যেন শক্ত হাতে পাঁজর ভেঙে হৃৎপিণ্ড ঠিক কেড়ে নেয়!
 
ভোরের হাওয়া, ভোরের আলো…কেমন মৃদু…গায়ে পড়লে বড়ো আরাম লাগে!
অমন নরোম রোদের মৃদু আঁচে ভালোবাসা কেন ছোঁয় না, বলো?
এক জনম ঘুরে আরেক এলেও রেশ রয়ে যায়…
এমন আলতো মায়ায় ভালোবাসার…বাজে কি সানাই?
ওরা বলে, ভালোবাসার নাকি সবটা ভাল?
পোড়ায়, কাঁদায়, ঝলসে দিলেও সারায় ঠিকই?
অমন আদরে বাঁধে, যত্নে সাধে সবটুকু প্রেম…
সে ভালোবাসা ঠিক কোথায় থাকে?
 
কয়েক দিন আগেরই কথা…
পাশের বাড়ির এক গোয়ালা ভাল দুধ দেয়,
তো বললাম তাঁকে, চাচা, আধ-সের করে দুধ দেবেন?
খাঁটি যেন হয়…পয়সা নাহয় বাড়িয়েই দেব!
পরদিন চাচা এলেন না আর, দুধটা হাটে বেচেই দিলেন!
কী যে হল, বুঝিনি কিছুই!
চাচার কেন আমার কাছে পয়সা নিতে অমন দ্বিধা?
নাকি হাটেই মেলে বেশি দামটা? নাকি চাচা…!
…বুঝি এমনি করেই ভালোবাসা কিছু ঠিক চলে যায়
অন্য ঘরে, অন্য দরে…আমার ঘরের সামনে দিয়েই!
 
সবচে’ বেশি ভালোবাসা যা, সে দেখতে হয়টা কেমন?
তার কি অনেক মায়া থাকে? সে বুঝি ঝগড়ুটে নয়?
কখনও সে কি হারে না এমন?
হিসেব এলে সেও পালায়?
ভুলের মাশুল দেয় না কি সে এমন করে?
গরমিলে কি সে মেলেই শেষে?
নাকি ফাঁকি মেরেই হিসেব মেলায়?
…যা হবে হোক! আমি তো ভাবি, এখানে কীসের আবার ডেবিট-ক্রেডিট?
মানুষ যদি ভালোই বাসে, তবে অমন কেন হিসেব কষে?
 
অতো কথায় কী আর হবে! বলেই ফেলি…
থাকে কেউ একজন, যার ভালোবাসা পেতে এখুনিই আমি যেকোনও শর্তই নিতে রাজি!
থাকে কেউ এমনও, যাকে ভালোবাসা দিতে কখনওই আমি কোনও শর্ত দিতেও নারাজ!
…তুমিই আমার প্রথম সে জন!