পুনরাবর্তন

কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপ। ওরকমই বেশি! এটা যে কী, কে জানে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এটা কোনও রিলেশনশিপই না। দুইজন মানুষ আছে, কাছাকাছি আছে, পাশাপাশি আছে, কিন্তু আবার নেইও। ছুঁয়ে দেয়া যায়, এমন দূরত্বে দুজন মানুষ; অথচ হাত বাড়ালেই নেই! কখনও-কখনও হাত বাড়াতেও ভয়! সেই ভয়টা যে কীসের, সেটাও ওরা কেউ জানে না। এমনও হয়, দুজনই জানে, ওরা যা করছে, যেভাবে করে ভাবছে, যা যা ঘটছে, সেগুলি ঠিক হচ্ছে না, তাও সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই এক ধরনের হারানোর ভয় থাকে, সবচাইতে প্রিয় কিছুকে হারানোর ভয়। মজার ব্যাপার হল, অনেকসময়ই সেই প্রিয় কিছুটি এমনকিছু হয়, যা আসলে ওর নয়ই, অথচ সেটিকে ঘিরে ওর মধ্যে অসীম অধিকারবোধ জন্মে গেছে। যা ওর নেইই, সেটি ও আবার হারিয়ে ফেলে কী করে? তবুও মানুষ সেই ভয়ে বাঁচে। দুজন মানুষের মধ্যে যে মায়াটা তৈরি হয়ে গেছে, সেটা ছাড়িয়ে সরে এলে দুজনের জন্যই বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে। তার চাইতে এ-ই ভাল। থাক না, যতদিন রাখা যায়! দুজন দুজনকে ভালোবাসে, অথচ সেই ভালোবাসার দায়টুকু দুজনের কেউই নিতে চায় না। প্রায়ই, দুজন দুজনকে আর কখনওই সময় দেবে না, এটাই ঠিক করে রাখে। কিন্তু সময় না দিলে আবার সময় কাটতেই চায় না। আবারও ভুল করে ভুল মানুষকে সময় দেয়া। জানে, ভুল হচ্ছে। এও জানে, ভুলটা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চাইতে জীবন থেকে পালানো ঢের সহজ। যে জীবনটাই ভুলে গড়া, সে জীবন থেকে ভুলকে সরিয়ে দেয়া সহজ নয়। কিংবা, এরকমও হয়, দুজনই ভালোবাসে অন্য দুজনকে, কিন্তু সেই অন্য দুজনের প্রতি যে ভালোবাসা, সেটা ওদেরকে ঠিক কাছে টানে না। ভালোবাসা যে শুধুই কাছে টানে, তা নয়। অনেক ভালোবাসা দূরে ঠেলে দিলেই বরং আরও অর্থময় হয়ে ওঠে।

দোলা জানে, ও চাইলেও এই সম্পর্কটাকে একটা সুন্দর সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারবে না। হয়তো, এর কোনও সমাপ্তিই নেই। থাকে না কিছু সম্পর্ক, যেখানে কখনওই ‘অতঃপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ বলে কিছু থাকে না। সেসব সম্পর্কের কোনও অতঃপর নেই, পূর্বাপর নেই, কিছুই নেই। দোলাকে এখনই এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখনই মানে, এখুনিই! কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। দোলা এখান থেকে বেরোতেই পারছে না। কেন? বেরোতে চাইলে নিজের প্রয়োজনেই বেরোতে হবে। প্রয়োজনটা কীসের? নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার। একটু ভালভাবে বাঁচা। ওটার জন্য সবার আগে দরকার নিজের জন্য ভালোবাসা। যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে নিজেও বাঁচতে পারে না, আরেকজনকেও বাঁচাতে পারে না। দোলা নিজের জন্য কোনও ভালোবাসাই রাখেনি। সব ভালোবাসা আরেকজনকে দিয়ে দিলে ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে যায়—মানুষ আর একা-একা নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারে না। দোলার ভয় হয়, যদি কোনওভাবে ওর এই অবস্থাটা ওর আয়নাও বুঝে ফেলে, ও আর সরে আসতে পারবে না। দোলার খুব ইচ্ছে হয়, নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। ও নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জায়গা খুঁজতে থাকে। খুঁজতে-খুঁজতে একটাসময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আজকাল নাকি প্রেম-ভালোবাসায় বিশুদ্ধ আবেগের ব্যাপারটা থাকে না। তবে ওটা কোথায় থাকে? ওই কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপে? অনেক কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপই সোশ্যালি কমিটেড রিলেশনশিপের চাইতেও বড়।

এই টানাপড়েনের কথা আর কেউ জানে না। শুধু ওরা দুজন জানে। দুজন মানে, দোলা আর বর্ণ। ওরা ভাবে, ওরাও কি আদৌ জানে? জানে; আবার, জানে, এটা ভাবতেও ভয় হয়। দোলার প্রায়ই মনে হয়, কারও কাছে এই ব্যাপারটা বলতে না পারলে ও মরেই যাবে। কিন্তু কাকে বলবে দোলা? যাকেই বলবে, সে-ই পুরো বিষয়টাকে সোশ্যাল পার্সপেক্টিভ থেকে জাজ করবে, ওটার সাইকোলজিক্যাল পার্সপেক্টিভটা তো বুঝতেই পারবে না, জাজ করা তো অনেক পরের ব্যাপার। কিছু-কিছু সম্পর্কের কথা কাউকে বলতে হয় না, বলা যায় না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এরকম না-বলা সম্পর্কের সাথে পরিচয় ঘটে। সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসছে করে-করেও সেই সম্পর্কটি মানুষ টিকিয়ে রেখে দেয়।

ছোটবেলা থেকেই দোলা খুব গোছানোভাবে বড় হয়েছে। পড়াশোনা করত, বইটই পড়ত, ভাল গান শুনতে ভালোবাসত, বন্ধুদের সাথে গল্প করত। আর ১০টা সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়ে যেভাবে করে বেড়ে ওঠে, ঠিক সেভাবেই দোলার ছোটবেলা কেটেছে। ওর মায়ের কাছ থেকে একটা বোধ ওর মধ্যে সেই ছোটবেলাতেই প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, সেটা হচ্ছে, স্বকীয়তা—নিজের জীবনটা নিয়ে নিজের মত করে ভাবা। বালিকাবেলা থেকেই মা ওকে শিখিয়েছিল, কারও স্ত্রী, বোন, কিংবা মা হওয়া ছাড়াও ওর একটা নিজস্ব পরিচিতি দরকার। সবাই সমাজে বাস করে, কিন্তু সমাজের একটা বিশেষ অংশ হয়ে উঠতে পারে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে আলাদা করে চেনাতে আলাদা কিছু করতে হয়। যাদের আমরা চিনি, তারা নিশ্চয়ই আমাদের মত করে ভাবে না, আমাদের মত করে জীবনটাকে দেখে না, আমাদের মত করে কাজ করে না। ১০ জনের মত করে জীবনটা কাটিয়ে দিলে, ১০ জন যেভাবে বাঁচে, সেভাবে করেই বেঁচে থাকা হয়। বড় মানুষের জীবন কাটানোর ধরনটাকে বুঝতে না পারলে এবং সেই ধরনে নিজের মত করে জীবনের চর্যা ও চর্চা না করলে কিছুতেই নিজের জীবনটাকে ওরকম বানানো সম্ভব নয়। এসব ভাবনাই ছিল দোলার প্রেরণা। যেসব স্বপ্নের মধ্য দিয়ে ও বড় হয়েছে, ও হঠাৎ করেই আবিষ্কার করতে থাকে, সেগুলি আস্তে-আস্তে মরে যেতে বসেছে। মানসিক শক্তিটা দিনের পর দিন ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বাঁচে, কাজ করে মনের শক্তিতে। সেই শক্তিটাই যখন নিঃশেষিত হতে থাকে, তখন বেঁচে থাকাটা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। জীবন কাটানো আর জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া, এক কথা নয়। দোলা ওর জীবনটাকে খুব টেনেহিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আর কত?

দোলার কাজিন নিলয় দোলাকে অসম্ভব রকমের পছন্দ করতো। ও ছিল এয়ারফোর্সের পাইলট। সুদর্শন, রুচিশীল, কেয়ারিং। সেন্স অব হিউমার ছিল অসাধারণ, দোলার সাথে খুব মজা করে কথা বলত। অন্য মেয়েদের সাথে ব্যবহারে সে ছিল ভীষণ মার্জিত, সংযত। দোলা যখন ক্লাস নাইনে পড়ত, তখন থেকেই নিলয় দোলাকে পছন্দ করে, কিন্তু ওর পড়াশোনায় ক্ষতি হবে ভেবে কখনওই দোলাকে প্রপোজ করেনি। সে দোলাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। নিলয়ের পছন্দ ছাড়া দোলা একটা চুলের ক্লিপও কিনত না কোনওদিনও। দোলা বুঝত সবই; দোলা যে বুঝত, এটা নিলয়ও বুঝত, কিন্তু দোলাকে বুঝতে দিত না যে, ও ব্যাপারটা বোঝে। ওদের বোঝাপড়াটা ছিল ভীষণ রকমের সুন্দর। ওদের দুই পরিবারেরই এই বিয়েতে নীরব সম্মতি ছিল। দোলাকে নিলয় বিভিন্ন মডেলের প্লেনের ছোট-ছোট রেপ্লিকা উপহার দিত, প্লেন চালানোর মজার-মজার অভিজ্ঞতার কথা বলত। নিলয় খুব ভাল মিমিক্রি করতে জানত। ও নানান অঙ্গভঙ্গি করে মিমিক্রি করতো, আর তা দেখে দোলা হেসে খুন হত। দোলা ফুল ভালোবাসত বলে নিলয় ওর জন্য অনেক অনেক তাজা ফুল কিনে নিয়ে আসত। এসব জিনিস দোলাকে কখনওই ওর কাছ থেকে চাইতে হয়নি। প্রত্যেক মেয়েই মনে-মনে খুব করে চায়, ওর প্রিয় মানুষটি চাওয়ার আগেই ওর ভাললাগা জিনিসটি ওর জন্য নিয়ে আসুক, ওর পছন্দের কাজগুলি করুক।

দোলা অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়ার পর ওদের বিয়েটা হওয়ার কথা ঠিক ছিল। ইন্টার পরীক্ষা দেয়ার পর দোলা অ্যাডমিশন কোচিং করছিল। ১৬ জুলাই দোলার জন্মদিনে ওদের দেখা করার কথা। নিলয় সেদিন লাঞ্চের পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিল আগেই। কথা ছিল, বিকেলে কোচিংশেষে দোলার জন্য অনেকগুলি ফুল নিয়ে কোচিংয়ের সামনে আসবে, দুইহাতে ফুলগুলি ধরে মাথাটা একটুখানি সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ওকে প্রপোজ করবে। এরপর দুজন মিলে রিকশায় কার্জন হলে ঘুরে বেড়াবে, সন্ধ্যায় একটা কেক, আড়ং থেকে কিছু বেলুন আর মোমবাতি কিনে দোলার বাসায় গিয়ে সবাই মিলে জন্মদিন সেলিব্রেট করবে। দোলার সাথে দেখা করতে আসার সময় ভীষণ উত্তেজনায় তাড়াহুড়োয় বাইক চালাতে গিয়ে রোড অ্যাক্সিডেন্টে নিলয় মারা যায়। তাজা রক্তের স্রোতে শাদা-শাদা গ্ল্যাডিওলাসগুলি লাল হয়ে এদিকওদিক ছড়িয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। রক্তের রঙে হলুদ কাগজের এই কয়টি বেগুনি অক্ষর ঢেকে গিয়েছিল: “আমার দেখা সবচাইতে সুন্দর মানুষটিকে শুভ জন্মদিন”। বুকপকেটে রাখা আংটির কৌটো খুলে দোলার জন্য কেনা আংটিটি রাস্তার চারপাশে ছিটকেপড়া নিলয়ের মগজের সাথে একাকার হয়ে মিশে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। নিলয়ের দেরি হচ্ছে দেখে নিলয়ের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল দোলার। ওর মোবাইলে টানা ফোন করেই যাচ্ছিল করেই যাচ্ছিল। ও জানত না, নিলয় আর কোনওদিনই ওর জন্য দুহাত ভর্তি করে ফুল নিয়ে আসবে না। কোনওদিনই যখনতখন হুট করে বলে বসবে না, “এই পচা মেয়েটা অনেক ভাল!” যাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিল, সেই ওকে ফাঁকি দিয়ে এভাবে চলে গেল। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী পড়ার সময় গান্ধীজীই নির্দয়ভাবে বইটা টান মেরে ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন।

এরপর দোলা মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংও নিতে হয়েছিল। প্রায়ই অসুস্থ থাকত, বিষণ্ণতায় ভুগত, এলোমেলো প্রলাপ বকত। সেইবার ওর আর অ্যাডমিশন টেস্ট দেয়া হয়নি। পরের বছর পুরো টালমাটাল অবস্থায় অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছে। খুলনা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কিন্তু ডিপ্রেশন আর ওর পিছু ছাড়ল না। নিলয়ের হাশিখুশি মুখটা সারাক্ষণই দোলার চোখের সামনে এসে যায়। ঘুমের মধ্যেও নিলয় এসে আগের মতই দোলাকে গল্প শুনিয়ে যায়। দোলা যতদিন বাঁচবে, ততদিনই সেই মুখটার স্মৃতি নিয়েই বাঁচবে। দোলা একটাসময়ে বুড়িয়ে যাবে, কিন্তু নিলয়ের বয়স সেই ২৩ই থেকে যাবে। দোলার স্মৃতিতে ওর অস্তিত্ব সারাজীবনই চিরতরুণ হয়েই থাকবে। সবার সাথে হৈহুল্লোড় করে কাটানো মেয়েটির বয়স প্রতিদিনই এক বছর করে বাড়তে লাগল যেন! দোলার এখনকার দিনগুলি কাটে নিলয়ের একটা বাঁধানো ছবি বুকে জড়িয়ে। ওর চোখ দুটোতে চুমু খায়, গালে আলতোভাবে আঙুল ছোঁয়ায়, চোখের পানিতে ফ্রেমের কাচ ভিজে ওঠে বারবার।

পড়াশোনা, ক্যারিয়ারভাবনা, এসব ছাড়াও আরও অনেক সুন্দর-সুন্দর পরিকল্পনা ছিল দোলার। ও দারুণ সংসারী হবে, ভাল একজন স্ত্রী হবে, অসাধারণ একজন মা হবে, ওর বাচ্চাদের সবচাইতে কাছের বন্ধু হবে। ওর একটা ছিমছাম ‘শান্তা পরিবার’ থাকবে, যে পরিবারের সবকিছুই হবে ওর নিজের হাতে সাজানোগোছানো, পরিপাটি, চমৎকার। নিলয়ের সাথে দোলার মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ছিল খুবই ভাল। ওরা একে অপরকে বুঝত, সম্মান করতো। ওরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে নিজেদের মত করে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। সবকিছুই ওদের ইচ্ছে আর স্বপ্নের হাত ধরেই এগোচ্ছিল। কীভাবে যেন একটা দমকা হাওয়া এসে ওর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেল। মুহূর্তেই সবকিছু বদলে গেল, সব স্বপ্ন থমকে গেল। বেঁচে থাকার সময়ে আমরা যে স্বপ্নগুলি দেখি, সেগুলি যে কতটা অসহায় মৃত্যুর কাছে, এটা আমরা কোনওদিনই ভাবতে পারি না। মৃত্যু স্বপ্নের চাইতেও বড়, জীবনের চাইতেও সত্য।

সেই বিপর্যয়ের দুই বছর পরের একদিন ফেসবুকে নিউজ ফিডে একটা ছবি চোখে পড়ল দোলার। একটা মেয়ে বৃষ্টির সময়ে এমনভাবে ছাতাটা ধরেছে, যাতে বৃষ্টিভেজা হাওয়া এসে ওর শরীরটা ছোঁয়, একইসাথে নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছে যে, ছাতাটার জন্যই সে ভিজছে না। প্রচ্ছন্নতা আর উন্মোচনের অপূর্ব সহাবস্থান। কোনওকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার অভিনয়ে সেটিতেই নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার যে আনন্দ, সেই দৃশ্য। ছবিটি দেখলে চট করে বোঝার কোনও উপায়ই নেই যে আসলে ওটি একটি অয়েল পেইন্টিং। সেই আর্টিস্টের পেইজে গিয়ে দেখল, এরকরম অসাধারণ সব পেইন্টিং। তুলিতে নয়, হৃদয় দিয়ে আঁকা সব ছবি। বাস্তবের চাইতেও অনেকবেশিই বাস্তব। মুগ্ধ হয়ে বর্ণের আঁকা ৫২৩টি ছবির সবকটিই কয়েকবার করে দেখে ফেলল দোলা। এত ভাল আঁকাছবি জীবনে আর কোনওদিনই দেখেনি দোলা। ৩দিন আর্টিস্টের পেইজ আর প্রোফাইলে বুঁদ হয়ে ছিল সে। প্রতিটি ছবির নিচেই দুইতিন লাইনে ভাস্কর চক্রবর্তীর মত বর্ষণমুখর মেঘলা দিনের বিষাদমাখা মধুরতার মতন মোলায়েম সব ক্যাপশন। ছবির পেছনের গল্পটিকে এত সুন্দরভাবে অল্প কথায় লেখা, যা পড়লেই মনে হতে থাকে, বর্ণ নয়, ছবিটিই কথা বলছে! অনেক অনেকদিন পর দোলার ভেতরের পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে গেল। বর্ণ অসম্ভব রকমের নিবেদিতপ্রাণ একজন আর্টিস্ট, কঠোর পরিশ্রমী, সামাজিক নানান কাজকর্মে ভীষণ সক্রিয়। রক্তদান, শীতার্ত আর বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, দুঃস্থ-দুঃখীদের সাহায্য করা, পথশিশুদের পড়াশোনা করানো, এসব কাজে ব্যস্ত থাকে, অন্যদেরকেও ভাল-ভাল কাজ করতে উৎসাহিত করে নিজের লেখার মাধ্যমে। কিশোরীবেলার দুরন্ত প্রেমের টালমাটাল উন্মাদনায় ভাসতে লাগল দোলা। অনেক কষ্টে অস্বস্তি, দ্বিধা, সংকোচ, ভয় কাটিয়ে বর্ণকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ইনবক্সে লিখে দিল: “প্রত্যাখ্যান মেনে নেয়ার সাহস থেকেই বন্ধুত্বের শুরু—এটা মাথায় রেখেই আপনার বন্ধুত্ব চাইছি।” “এই দোলা! এই!! বন্ধুত্বই শুধু? আর কিছুই নয়? ঠিক আছে, কী আর করা! আমি ওতেও রাজি!” রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্টেড হতে সময় লেগেছিল ১ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড, দোলা মনে রেখে দিয়েছে। নিলয় দোলাকে সবসময়ই ডাকত, “এই দোলা! এই!!” বলে। বর্ণের টেক্সটটা পড়ার সময় দোলার বারবারই মনে হয়েছিল, যেন সে সত্যি-সত্যিই ওর কণ্ঠে সেই পুরনো ডাকটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। এমন আশ্চর্য মিল কীভাবে সম্ভব? প্রেমেপড়া খ্যাপাটে মানুষের মত দোলার মাথাও কাজ করছিল না।

দোলা তখন গুরুতর অসুস্থ। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, অপারেশন করে মাত্র কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে, ঠিকমত হাঁটতে পারে না, ক্রাচে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে হাঁটতে হয়। মানুষ যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেটা সেরে উঠতে অনেকদিন সময় লাগে, তখন একটাসময়ে তার মনের মধ্যে এই ভয় ঢুকে যায়, “যদি আর কোনওদিনও সুস্থ না হই, তখন কী হবে?” দোলার বারবারই মনে হত, সে বুঝি আর কোনওদিনই হাঁটতে পারবে না। এ নিয়ে ও খুব হতাশ ছিল। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে দিন কাটানোর বিষণ্ণ সময়টাতে বর্ণের আইডি’টা আবিষ্কার করেছিল দোলা।

পরিচয়ের পরের গল্পটা জীবনানন্দের কবিতার মতন, রবীন্দ্রনাথের গানের মতন, বনফুলের ছোটগল্পের মতন, কিংবা আরও অনেক-অনেক সুন্দর!

দোলা বর্ণকে ভালোবেসে ফেলেছিল সেই প্রথম থেকেই। ওর লেখা পড়ে, ওর কাজ দেখে, ওর সাথে ইনবক্সে কথা বলে, দোলার বারবারই মনে হতে লাগল, “এরকম কাউকেই আমি মনে-মনে খুঁজছিলাম।” ও ঠিক করে ফেলল, যদি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতেই হয়, তবে বর্ণকে ছাড়া আর কাউকেই নয়। বর্ণকে দোলা কিছুতেই হারাতে দেবে না। মরতে-মরতেও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখবে। বর্ণ নিলয়ের মতন সুদর্শন নয়, কিন্তু কী এসে যায় ওতে? ওর মনের সৌন্দর্য আর নিলয়ের মনের সৌন্দর্য, দুইই একই রকমের অসীম। সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যের প্রতি এবং মেয়েরা ছেলেদের মানসিক সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ছেলেদের চোখ খোঁজে মেয়েদের দেহের রং, মেয়েদের চোখ খোঁজে ছেলেদের মনের রং। একটা ছেলের চুলের রাজত্ব মাথায় থাক, গালে থাক, কিংবা অন্যকোথাও থাক, এসব নিয়ে মেয়েরা খুব একটা মাথা ঘামায় না। ছেলেরা রূপের পাগল, আর মেয়েরা গুণের। ভাবনার এই দ্বিমেরুতাই ওদেরকে পরস্পরের কাছে টেনে নিয়ে আসে।

নিয়মিত চ্যাটিং হতে লাগল। বর্ণ দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকত। সব কিছু সামলেও সময় বের করে সে দোলাকে সব রকমের মেন্টাল সাপোর্ট দিতে লাগল। একটু ফাঁক পেলেই দোলাকে সময় দিত। দোলা মানসিকভাবে ক্রমশ বর্ণের উপর ডিপেনডেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। কোনও কাজই বর্ণের বুদ্ধি ছাড়া ঠিকভাবে করতে পারত না। বর্ণের কথা ছাড়া এক পাও কোথাও দিত না। দোলা হলের পাঁচতলায় থাকত। আহত পা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে ভীষণ কষ্ট হত। দোলার কষ্ট অনুভব করে বর্ণ ওকে বলত, “বাবু, তুমি একটুও চিন্তা কোরো না। আমি তোমাকে কষ্ট করতে দেবো না। মনে-মনে ভাবো, তুমি আমার পিঠের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছ, আমি তোমাকে খুব ধীরে-ধীরে নামিয়ে দিচ্ছি। একটুও কষ্ট হচ্ছে না তোমার। পায়ে কোনও ব্যথাই পাচ্ছ না।” দোলার ঘুম না এলে ফোনেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত বর্ণ। খেতে ইচ্ছে না করলে খুব আদর করে করে বুঝিয়েশুনিয়ে খেতে পাঠিয়ে দিত। বর্ণের জন্যই একটি মুহূর্তের জন্যও দোলার মনখারাপ হতে পারত না। অন্যের কল্পনাকে নিজের মত করে প্রচণ্ডভাবে ছকে বেঁধে ফেলতে পারত বর্ণ। ওর সাথে গল্প করার সময় দোলার মনে হত, বাস্তবও এতটা বাস্তব হয় না। চোখের সামনেই সবকিছু ঘটতে দেখত সে। “কী কর?” “বসে আছি।” “ওমা! আমার বাবুটা বসে আছে। আমি যে এতক্ষণ বাবুটার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছি, সে খেয়াল আছে বাবুটার? আমাকে বসতে বলা হোক!” বর্ণের বলার ধরনটা এতটাই আশ্চর্য রকমের বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে দোলা হঠাৎ চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকিয়ে হলের পুরো করিডোরে বর্ণকে খুঁজতে থাকত। ওর ইনসমনিয়ার সমস্যা ছিল, রাতে ঘুম আসত না। দোলার মনে হত, বর্ণ এভাবে করে পাশে থাকলে সে সারাজীবনও হাসিমুখে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। এভাবে রাতের পর রাত কল্পনায় বর্ণের পাশে বসে কাটিয়েছে দোলা।

পৃথিবীতে একমাত্র বর্ণের সব কথা শুনত দোলা। পারিবারিক কিছু কারণে বাবার সাথে দোলার দূরত্বটা বেড়ে গিয়েছিল। বর্ণের পরামর্শে বাবাকে চিঠি লিখে সেই দূরত্ব ঘুচিয়েছিল। সেই আইসব্রেকিং চিঠির দুই-তৃতীয়াংশই বর্ণের লিখেদেয়া। ও সবসময়ই একটা কথা বলত: “আমি তোমার পাশেই আছি। সাথে আছি, থাকব।” এই সামান্য কথাটাও দোলার কাছে অদ্ভুত রকমের সুন্দর মনে হত। মেয়েরা একবার প্রেমে পড়ে গেলে সে প্রেম শুধু বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। তখন ওর ভালোবাসার মানুষটির তুচ্ছ কথাটিকেও অতি অসামান্য মনে হয়। বর্ণের “এই তো, তোমার পাশেই আছি!” এটা শুনলেও আনন্দে কেঁদে ফেলত দোলা। দোলার ভেতর থেকে কে যেন বারবারই বলে দিচ্ছিল, “আমি এতদিন শুধু ওর প্রতীক্ষাতেই ছিলাম।”

একদিন পড়ন্ত বিকেলে। “দোলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি!” বর্ণের এই টেক্সটটা ইনবক্সে আবিষ্কার করামাত্রই পুরোপুরিই পাগল হয়ে গিয়েছিল দোলা। সে তো আগে থেকেই বর্ণকে ভালোবেসে ফেলেছিল। বর্ণের কাছ থেকেও ভালোবাসার কথা শুনে খুশিতে লাফাতে লাগল দোলা। চ্যাট অফ করে এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে ছোট একটা টিলার ওপরে সন্ধে পর্যন্ত নিজের সাথে থাকল, নিজের সাথেই খুনসুটিতে মেতে ছিল, আনন্দে অনেক কাঁদল। সন্ধ্যায় রুমে ফিরে দেখে ইনবক্সে ৯৬টি মেসেজ, সবগুলিই বর্ণের পাঠানো। ও ভাবছিল, “স্বপ্নও কি এত সুন্দর হয়?”

বর্ণের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ছিল ম্যারিড। এটা নিয়ে কোনওদিনই ওকে কোনও প্রশ্ন করেনি দোলা। বর্ণও কিছু বলেনি কখনও। বর্ণের অনেক-অনেক মেয়ে ফ্যান। দোলা ধরেই নিয়েছিল, বর্ণ ওটা মজা করে লিখেছে। কিংবা, এইজন্য লিখেছে, যাতে মেয়েরা ওকে না জ্বালায়। সেই বিকেলের ঠিক চার বিকেল পর একদিন দোলা বর্ণকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আচ্ছা, আপনি কি বিবাহিত?” “হ্যাঁ। কেন?” “ধুর্! আপনি শুধু মজা করেন। বলেন না!” “মজা না, সিরিয়াসলিই!” “মানে কী?” “হ্যাঁ, বিয়ে করেছি অনেকদিন হয়ে গেল। আমার ৩ বছর বয়েসি একটা ছেলেও আছে।”

বর্ণ দোলাকে ভড়কে দেয়ার জন্য মজা করছে—-দোলা বারবারই এটা বিশ্বাস করতে চাইলেও ওকে একটা সময় সত্যিটাই বিশ্বাস করতে হল। পৃথিবীর আর ১০টি নিষ্ঠুর সত্যের মতই এটাও সত্য—বর্ণ বিবাহিত। দোলা পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়। “আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। এটা হতে পারে না। আপনি আমার সাথে মজা করছেন! আপনি বলে দিন না, আপনি মজা করছেন!” ফোনে দোলা চিৎকার করছিল। দোলার পুরো পৃথিবীটাই সেদিন আরেকবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

বর্ণের সাথে পরিচয়ের মাত্র দুমাসের মধ্যেই দোলা এ ধাক্কাটি খেয়েছিল। সেই দুমাসে দোলা পুরোপুরিই বর্ণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বর্ণ বললে দোলা পড়তে বসে, বর্ণ বললে দোলা গান শোনে, বর্ণ বললে দোলা হলের সামনের মাঠ থেকে একটু হেঁটে আসে, বর্ণ বললে দোলা ডায়নিংয়ে খেতে যায়। বর্ণ যা করতে বলে, দোলা তা-ই করতে পারে। দোলার স্বপ্নের সাথে বর্ণ মিশে গিয়েছিল পুরোপুরিই। কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব, দোলা সেটা আলাদা করে ভাবা ভুলে গিয়েছিল আস্তে-আস্তে। তার ভাবনাজগতটাকে সে কোনওভাবেই বর্ণের কাছ থেকে আলাদা করতে পারে না।

দোলা কোনও যুক্তি খুঁজতে চাচ্ছিল না, শুধুই বর্ণকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিল আরও বেশি করে…. আক্ষরিক অর্থেই দোলা একা-একা দাঁড়াবার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। মরে যেতে চেয়েছে অনেকবার। শুধু বর্ণের কথা ভেবে মরতে পারেনি। দোলা মরে গেলে সেও ওরকম কিছু একটা করে বসবে। বর্ণ দোলাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। কত কিছুই মাথায় আসত। তারপর আবারও সবকিছু ভুলে দোলা নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে। নিজেকে বুঝিয়েছে, “ভবিষ্যতে যা হয়, হবে। কিন্তু এখন আমি ওকে হারাতে পারব না।” জীবনে কখনও-কখনও এমন সময় আসে, যখন মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভাববারও শক্তি পায় না। বর্ণের সাথে একটু কথা না বললে দোলার জীবনীশক্তি একেবারেই ফুরিয়ে যায়, পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, ঘুমানো, কোনওকিছুই চালিয়ে যেতে পারে না। তার চাইতে ভাল, এভাবেই চলুক। যখন যা হয় হোক।

বর্ণ নিজেও প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভোগে। দোলাকে ঠকাচ্ছে, দোলাকে মিথ্যে স্বপ্নে অভ্যস্ত করে তুলছে, দোলার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ–দুটোই নষ্ট করে দিচ্ছে, এইসব অপরাধবোধ বর্ণকে কুড়ে-কুড়ে খায়। বারবার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার শপথ করেও বন্ধ করতে পারে না, আবারও ছুটে আসে। দোলার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে, এই ভয় নিয়ে বর্ণও ভালো নেই। নভেম্বরের ১২ তারিখ ওদের প্রথম দেখা হয়। বর্ণ দোলাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদেছে। দোলা বর্ণকে বিব্রত করতে চাইল না, কারণ ও বর্ণকে অনেক ভালোবাসে। তবুও ওর সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি নাহয় কিছু জানতাম না, কিন্তু আপনি কেন সব জেনেশুনে এই জটিলতার মধ্যে ঢুকেছেন?” বর্ণ কাঁদতে-কাঁদতে বলেছিল, “তোমাকে ভালো না বেসে আমার উপায় ছিল না। আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করি, আমরা শুধু আমাদের জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছি। শুধু একটু দেরিতে আমাদের দেখাটা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো আমরাই আছি, না? তোমার কাছে আমি শান্তি পাই। তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে আমার পাগল-পাগল লাগে, ভেতরটা পুরোপুরিই অশান্ত হয়ে যায়। আমি পারব না তোমাকে ছেড়ে থাকতে।”

দোলা এখন আর ছোটবেলার ওইসব সুখস্বপ্ন দেখতে পারে না—বিয়ে, সংসার, সন্তান—কিছুই না। জীবনের একটাই ছবি ওর চোখে—শূন্যতা। বর্ণের মুখের জন্য আর অন্য কারও মুখই ও দেখতে পায় না। দিনদিন দোলা একজন অর্ধমৃত মানুষ হয়ে যাচ্ছে। ও সত্যিই জানে না, ও সামনের দিনগুলিতে কী করবে, ওর জীবনের গতি কোন দিকে, ও কীসের মোহে সত্যের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ও ভাবতে চায়—“আমি শুধুই আমার পার্সোনাল আইডেন্টিটির জন্য কাজ করতে চাই। আমার নিজের জীবনটা এভাবে করে শেষ হয়ে যেতে পারে না।” এসব কথা ওর মন থেকে আসে না, কখনও-কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জোর করে নিজেকে দিয়ে বলায়। ও আর কোনও ধরনের শক্তি অনুভব করে না ভেতর থেকে। মনে হতে থাকে, ২৪টি ঘণ্টাই কী একটা যেন বুকের ভেতরে লাফাচ্ছে, ছটফট করছে, বেরিয়ে আসতে চাইছে, আর ওকে অশান্ত করে দিচ্ছে। মাঝেমাঝে ওর ইচ্ছে করে, “যদি জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ভেতর থেকে সবকিছু বের করে দিতে পারতাম!”

একমাস ধরে ওদের মধ্যে প্রায় কোনও স্বাভাবিক যোগাযোগ নেই। অস্বাভাবিক রকমের থমথমে গম্ভীর পরিস্থিতি। বর্ণ ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছে। এটার প্রভাব ওর পারিবারিক জীবনেও পড়েছে। এবং, এই একমাস বর্ণ একটাও ছবি আঁকেনি, নিজের একটা কাজও ঠিকভাবে করেনি। শুধুই পালিয়ে বেড়াচ্ছে এখানেসেখানে, নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে যেতে চাচ্ছে। ওর এরকম অবস্থা দেখে দোলার নিজের জন্য খারাপ লাগছে না, সারাক্ষণই বর্ণের দুর্ভাগ্যের ভাবনা ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওর জন্য দোলা নিজেও ভাল থাকতে পারছে না। দোলার বারবারই মনে হচ্ছে, বর্ণের এই অবস্থার জন্য ও-ই দায়ী। দোলা বর্ণকে ভাল দেখতে চায়। বর্ণ ভীষণ অন্তর্মুখী। মরে গেলেও কাউকেই কিছু বলতে চায় না। দোলাই জোর করে কথা বলত। বর্ণ নিজের কাছে বারবার কমিটমেন্ট করে, ও আর কখনওই দোলার সাথে কথা বলবে না। নিজের কাছে করা সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে না পেরে দোলার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে। আবার ‘সরি’ বলে। এইভাবেই চলছে…….

এক বিকেলে বর্ণের ফোন। “দোলা, আমি খুলনায় এসেছি। হাতে ঘণ্টা তিনেক আছে। দেখা করার সময় হবে?” দোলা প্রায় দৌড়ে বের হয়ে বর্ণের কাছে ছুটে গিয়েছিল। বর্ণের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। একজন প্রচণ্ড বিপর্যস্ত ভগ্ন মানুষ। ভাঙা ঘোলাটে চোখে দোলার দিকে তাকিয়ে আছে বর্ণ।

প্রায় নিঃশব্দেই পুরোটা সময় পাশাপাশি বসে কাটিয়েছে ওরা। কথা আর কান্না দলা পাকিয়ে পাকিয়ে দোলার গলায় আটকে ছিল। অনেক চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কিছুই বের করতে পারছিল না। হয়তো বর্ণের ভেতরেও একই অবস্থা……..হাজার বছরের নৈঃশব্দ্য নেমেছিল সেই বিকেলে।

একসাথে খেয়েছে। বর্ণ নিজে কিছুই খায় নি……দোলাকে খাইয়ে দিয়েছে জোর করে। খেতে-খেতেই বর্ণের সময় শেষ হয়ে গেল…….সময় ফুরিয়ে গেছে, অথচ কিছুই বলা হয়নি তখনও……….

বর্ণকে বিদায় দিতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গেল দোলা। তখনও বর্ণ কথা বলেই চলেছে বলেই চলেছে……প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলছিল কথার, তবুও কষ্ট করে-করে টেনে-টেনে বলছিল…….বারবারই বলে যাচ্ছিল, আমি আর পারছি না……..আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে……..পাগলের মত বাসে উঠেছে ঘোরের ভেতরেই………দোলা বাসে উঠে ওকে ধরে-ধরে সিটে বসিয়ে দিয়ে এসেছে।

বারবার দোলাকে বলছিল ভালো থাকতে। বলছিল, “নিজের দিকে তাকাও প্লিজ! নিজেকে এভাবে শেষ করে দিয়ো না। আমি তো তোমার পাশেই আছি। কী? আছি না, বলো……..! থাকব সবসময়ই! খুব খুব খুব ভাল থেকো, সোনা!”

বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেছিল, “ছোটবেলায় বাবা-মা বড় একটা ক্ষতি করেছে আমাদের। সবসময়ই শিখিয়েছে, ছেলেদের কাঁদতে নেই। কী ভুল কথা, তাই না? ছেলেরা কাঁদবে না কেন? আশ্চর্য!” বলেই প্রচণ্ড শব্দ করে হাসছিল। বাসের সবাই তাকিয়েছিল ওদের দিকে। বর্ণের ওই হাসি সহ্য করার ক্ষমতা দোলার ছিল না। ও প্রায় ছুটে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। পেছন ফিরে বর্ণের দিকে তাকানোরও সাহস ছিল না দোলার। বর্ণও আর পিছু ডাকেনি।

পুরো পরিস্থিতিতে দোলা আর স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ও প্রায়ই ভাবে, “আরেকজনের জন্য বাঁচলে মরে যাওয়াটা কী বিশ্রী রকমের কঠিন!” দোলা বর্ণের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ভীষণভাবে। ও একটা মুহূর্তের জন্যও ভাবতেই পারে না, বর্ণের সাথে ওর কোনও ধরনের যোগাযোগ থাকবে না। কখনও-কখনও দোলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে, “বর্ণ কি সত্যিই ভালোবাসে আমাকে?” ওর মন উত্তর দেয়, “বর্ণ আমাকে ভালোবাসে। দোলার চোখ কোনও ভুল দেখেনি বর্ণের চোখে।” ও প্রায়ই ভাবে, “কেন আমি বর্ণের সাথে থাকতে পারব না? কেন কেন কেন?? আমি কি ওকে ভালোবাসি না? ও কি আমাকে ভালোবাসে না?” পরিবার, সমাজ এসবকিছু ভেবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা ওদের কারও জন্যই সহজ নয়। দোলা জানে না, ও কী করবে। নানান দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সংশয়ে দুলতে-দুলতে দোলা এখন বড় ক্লান্ত…….জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে প্রতিদিনই একটু-একটু করে। দোলার সামনে এখন বর্ণের কথা ভাবা ছাড়া আর কোনও কাজই নেই। বর্ণের কথা ভাববার বাইরে পুরো সময়টাই দোলার জন্য অবসর। অবসর জিনিসটা বড্ডো বাজে, শুধুই উল্টাপাল্টা চিন্তা আসে মাথায়।

এতটা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটানোর পরও কাউকেই কিছু বলতে পারে না দোলা। দোলা খুব ইন্ট্রোভার্ট, নিজের কথা কাউকেই বলে না। কাউকে কিছু বলতে গেলেই নিজের মধ্যেই কেমন জানি এক ধরনের ইনফেরিয়র ফিলিং কাজ করতে থাকে। কাউকে কিছু বলার কথা ভাবলেই ওর মনে হতে থাকে, “আশ্চর্য! কেমন মানুষ আমি? নিজের সমস্যা নিজে ফিক্স করতে পারছি না…..অন্যের কাছে কান্নাকাটি করতে হচ্ছে…..কেউ একজন আমার মানসিক দুর্বলতার ‘সুযোগ নিচ্ছে’ আর আমি সেটা নিয়ে অন্যের কাছে হা পিত্যেস করছি কেন? যে সম্পর্কটি আমাকে কোনওদিনই আশ্রয় দিতে পারবে না, কেন আমি সে সম্পর্ককে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি? আমার কি নিজের উপর ডমিনেট করার ক্ষমতা নেই? আমি নিজে কেন নিজেকে ভালো রাখতে পারছি না? আমি কেন আমার কষ্টকে অন্যের কাছে খেলো করে দেবো? অন্যের কী দায় আমাকে ভাল রাখার? আমি কে অন্যদের কাছে? আমি কখন কী করেছি কারও জন্য? আমার সুখের ভাবনা কেন আমি অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি? এ-ই কি আমি দোলা?”

দোলার ইদানিং খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, যত কষ্টই হোক, ও নিজেকে নিজের জন্যই ভাল রাখবে। “যে করেই হোক, একটা গন্তব্যহীন ভুল পথ থেকে সে নিজেকে সরিয়ে আনবই আনব! দুঃসহ সময় কাটানোর নাম জীবন হতে পারে না। যদি মরে যেতে না-ই বা পারলাম, তবে এমন মৃতের মত হয়ে কেন বাঁচব? বেঁচেই যখন আছি, ভালভাবেই বাঁচব। যেকোনও মূল্যেই হোক, আমি নিজেকে খুশি করবই করব! আমি কিছুতেই এভাবে বাঁচার জন্য পৃথিবীতে আসিনি!”

মায়ের কাছ থেকে আত্মমর্যাদার যে শিক্ষা পেয়েছিল সেই ছোটবেলায়, সেটিকে নিজের মধ্যে আরও একবার প্রবলভাবে জাগিয়ে তুলতে চায় দোলা। পুরনো দিনগুলির স্মৃতি তো আর মুছে ফেলা যাবে না, কিন্তু সামনের দিনগুলি যাতে আর কোনওদিনই পুরনো দিনগুলির মত না হয়, সে চেষ্টা তো করা যাবে। ভালভাবে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে, এটা দোলা একবারের জন্য হলেও অনুভব করবে।

১৬ জুলাই আসছে। এর আগেই নিজের সমস্ত ক্ষত সারিয়ে ফেলবে দোলা; নিজের জন্য না হোক, নিলয়ের জন্য হলেও!