প্রদোষে বিধেয়/ ১

 এক।
একসময়, বাবা আমাকে কাছে ডেকে রাজনীতি বোঝাতে চেয়েছিলেন।
তিনি আমার সামনেই সময়কে ডেকে অনুরোধ করলেন,
আমাকে একটি আঙুল দাও তো হে, ধরব। যখন সময় একটি আঙুল দিল, তখন বাবা
কায়দা করে পুরো হাত দিয়েই ওকে ধরলেন। সেদিন,
আমি সময়ের চোখে স্বভাবসুলভ নিঃসংকোচ দেখেছি।
ওটা সঙ্গত কি অসঙ্গত ছিল, বুঝে ওঠার আগেই
আমরা খেয়াল করলাম, সময় তার জিভ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে চেয়েছিল,
ওদিকে জিভ ছিল পিচ্ছিল! হল না। দাঁতে ময়লা আটকে ছিল।
সময় সারারাত জেগে সকাল অবধি মদ্যপান করল, নাচল।
ভোরের দিকে দেখি, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি বুঝলাম, বাবা নিজেই রাজনীতি বুঝতেন না, তবে বোঝানোর ইচ্ছে রাখতেন।


দুই।
পার্টির সদস্য, আধিকারিক, শ্রেণীর অন্যরা---
সবার মাথায়ই ছিল একটি করে বড়ো টুপি।
সেই টুপির নিচে ওরা সবাইই পরম উষ্ণতায় আরামে ঘুমাত।
টুপিটি সরানোর নিয়ম নেই। চোখ ও কান ঢেকে ওটা পরলে আরও ভাল।
টুপি পরে কারও ভাল লাগছে কি লাগছে না, কেউ জিজ্ঞেসও করে না।
ওখানে থাকতে চাইলে ওটি পরতেই হবে; কেন, কেউ কিছু বলতে পারে না।


সেই টুপিটির জন্য ওদের বেতন হতো কয়েক কিস্তিতে। বোনাস জুটত, প্রফিটশেয়ারিংও ছিল, শুনেছি।
যদিও টুপির জন্যই ওদের যত কষ্ট,
তবু সেই টুপিই ওদের ঘৃণ্য অথচ শ্রদ্ধেয় বানিয়ে রাখত।
কোথাও ওদের নাক আটকে যেত না, ওরা চোখে দেখত অন্যদের চেয়ে ঢের বেশি।
টুপির কারণেই ওরা যাকে ইচ্ছে, তাকেই রাস্তায় ধরে বিভ্রান্ত হতে বাধ্য করতে পারত।
লজ্জায় মুখ লুকানোর কোনও উপায় ছিল না, কেননা
টুপি ওদের অন্ধ ও নির্লজ্জ হতে শিখিয়ে দিয়েছিল।


তারা দেখতে পেত না, হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেললেও বুঝতে পারত না।
হারানো পথও একটা পথ হতে পারে, ওদের কাছ থেকে এটাই শেখার আছে।
শেষ পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে দিয়ে কেউ একজন টুপির নিচে বিবেকের খোঁজ পেল!
পরে দেখা গেল, সেই বিবেকের নবায়ন করা হয়নি বলে তা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে।


তিন।
এখানে, আপনি চাইলেই আপনার সমস্ত উদ্বেগ দূর করে দিতে পারেন।
রেড ওয়াইন ভেবে রক্তও পান করতে পারেন পিপাসা পেলে, তবে আঘাত করবেন না কাউকেই……
কেউ আপনা থেকেই আহত হলে আপনার কী-ইবা করার আছে!
আপনি যা চান, তা পাবেন, যদি আপনি নিজের বোধকে পকেটে রেখে হাঁটতে পারেন।
অদ্ভুত জিভ এবং উদ্ভট কথাবার্তা, এই দুইকে সাথে রাখতে ভুলে যাবেন না ভুলেও,
চোখ বুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে খুব ছোটো মাপের মস্তিষ্ক নিয়ে বারুদের ঘ্রাণে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিন।


এমন এক দ্বীপে চলে যান, থেকে যান, যেখানে আপনার সব ইচ্ছেই পূরণ হবে, তবে এক শর্তে:
আপনাকে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চর্চা করে নিতে হবে, পরবর্তীতে
যেগুলির প্রত্যেকটিই আপনি ভুলে যাবেন।
শপথ করবেন আপনি, ভুলে যাবে আপনার প্রেতাত্মা। এতে কোনও দোষ নেই।
আপনি চক্রান্ত করতে জানলে ভাল, না জানলে মানুষের মৃত্যুতে নির্বিকার থাকতে শিখে নেবেন।
সবসময়ই মাথায় রাখবেন, ঘটনা যা-ই ঘটুক, দোষী তারাই, যারা আপনার দলের নয়।
এখানে কেউ আপনার কথা ভাববে না, এটা মেনে নিয়ে আপনিও কারও কথা ভাববেন না।


কেউ যদি আপনার পেছনে আপনাকে জারজ সন্তান বলে,
ওটা কানে নেবেন না, নিলেও অনুগ্রহ করে নিজের অন্য কানটি কাজে লাগাবেন---তা বের করে দিতে।


চার।
নীরবতার সুদীর্ঘ ক্রমটি ক্রমেই আমাদের হুমকির মুখে ফেলছে।


যখন---
কোলাহল দূরে থাক, কথাবলাই নিষিদ্ধ,
টেবিলের মেন্যুতে আটকে থাকে ধর্মের দৌড়,
মজা কিংবা রসিকতা করা যাবে প্রেম আর কাম নিয়েই কেবল,
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎপ্রার্থী কবরের ও তার উপরের সবাই,
বিশ্বশক্তিও কৌশলে অভিজাতদেরই সমর্থন করে,
সমস্ত উপগ্রহ চিত্র প্রয়োজনমাফিক শ্রেণিবদ্ধ করে দেয়া হয় এক মুহূর্তেই,
আটকেযাওয়া বিমান আকাশের নয়, স্থলের নিয়মে যাত্রা শুরুর অনুমতি পায়,
নিহতের কোনও স্মৃতিস্তম্ভ থাকবে না, একটি বোর্ডই যথেষ্ট, এমন নির্দেশ আসে,
রাস্তায় মোমবাতি জ্বালবেন না, এমন দাবি তোলেন পরিবেশবাদীরা,
একই সাথে, ওইদিকে, ফুটবল অনুরাগীদের পোস্টারগুলিতে কেউ হাতও দেয় না,
রেডিও শোনা যাবে, প্রেস শোঁকা যাবে, তবে ওইটুকু নিয়েই শান্ত থাকতে হবে, এ নীতিতে চলে রাষ্ট্র,
সবকিছু ভুলে যাওয়াই নিরাপত্তার ধারক হয়ে ওঠে,
এক বছর আগের সম্পর্ক, এক বছর পরের সম্পর্ক, কোনটা কী, ওতে কারও কিছু এসে যায় না,
সময়ের দাবিতে পুরাতন পতিতা সংক্ষিপ্ত সলজ্জ স্মৃতিতে ঢুকে পড়ে হুট করেই,
আয়েশি ভবিষ্যৎ ঘুমিয়ে থাকে গোল টেবিলের ঘূর্ণির মধ্যেই,
তখন---
নাগরিকদের চোখের সামনে অসময়ই হয়ে ওঠে একমাত্র প্রসবসম্ভবা,
তার সম্মানে সময়ের পৌরোহিত্যেই অন্য সমস্ত ভ্রূণকে হত্যা করার মহাআয়োজন চলতে থাকে।


নীরবতার সুদীর্ঘ ক্রমটি ক্রমেই আমাদের সুরক্ষার মুখে ফেলেছে।