প্রাণ যখন জীবন হয়ে ওঠে/ দ্বিতীয় অংশ

 
৫১। প্রতিদিনের রাতের কিংবা ভোরের ঘুমকে উপেক্ষা করি আমার স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখব বলে, আর আমায় দেখে তোমরা কিনা বল, আমি কেমন রাতারাতি সব কিছু পেয়ে যাই! যদি দেখতেই হয়, আমার বাইরেরটাকে দেখো না, আমার ভেতরটাকে দেখো। ওখানে রাতদিন যে দহন চলছে, তার উত্তাপটা অনুভব করার চেষ্টা করো। যদি তা না পার, তবে আমার সম্পর্কে কিছু বোলো না, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেয়ো না, শুধুই আমার কাজগুলিকে উপভোগ করো। যদি তাও করতে ইচ্ছে না করে, তবে আমার দিকে বা আমার কাজের দিকে তাকিয়ো না, তাকানোর মতো তো জগতে অনেক কিছুই আছে, তাই না? আমার উপর বিশ্বাস রাখো, আমি কখনওই তোমাকে আমার দিকে তাকাতে বাধ্য করব না, সে সময়ই আমার নেই।
৫২। প্রতিদিন নিজের আত্মবিশ্বাসকে নতুন করে দৃঢ় করি, কারণ আমি বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাস এমন একটি মানসিক শক্তি, যেটি আমাকে যা আমি করতে চাই তা করতে সাহায্য করে। হ্যাঁ, তাই প্রতিদিনই এটার যত্ন নিতে হয়, নইলে তা হারিয়ে যায়। ভাবো তো, একদিন গোসল করে এক সপ্তাহ কাটিয়ে দিতে পারবে? আত্মবিশ্বাসও ঠিক তেমনই একটা জিনিস, প্রতিদিনই একে গায়ে ও মনে মাখতে হয়।
৫৩। চলার পথে কখনও কাউকে এতটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করার চেষ্টা করি না, যতটা বিশ্বাস করলে সে আমার ক্ষতি করার সুযোগ পাবে। ভুল তবু হয়েই যায়। কিছু মানুষকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাসটা ভেঙে ফেলে। মানুষ তো, এইটুকু ভুল না করে বাঁচার সত্যিই কোনও উপায় নেই। তবে যে একবার বিশ্বাস ভাঙে, তাকে আর কখনও বিশ্বাস করা যাবে না।
৫৪। ছোট মানসিকতার মানুষদের সঙ্গ যেকোনও মূল্যে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, কারণ বেশিরভাগ সময় এই ধরনের মানুষগুলো স্বভাবে বাজে হয়ে থাকে। যার মন ছোট, তার সাথে মেশার কিছু নেই। আর এক ধরনের মানুষকে এড়িয়ে চলি---কৃপণ মানুষ। যার সামর্থ্য নেই, তাই খরচ করতে পারে না, আমি তার কথা বলছি না। আমি তার কথা বলছি যার সামর্থ্য আছে, কিন্তু খরচ করে না। ওদের চাইতে বিরক্তিকর লোক আর হয় না। ওরা মরে যাবার পর ওদের রেখে-যাওয়া অর্থে অন্যরা আরামে থাকে।
৫৫। মানুষের মানসিক সৌন্দর্যে যতটা আকৃষ্ট হই, বাহ্যিক সৌন্দর্যে ততটা আকৃষ্ট হই না। কারণ মানসিক সৌন্দর্য আমাকে প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত এবং উজ্জীবিত করে, কিন্তু নিছকই বাহ্যিক সৌন্দর্য করে বিব্রত। তবে যার বাহ্যিক ও অভ্যন্তর, দুইই সুন্দর, তেমন কাউকে পেলে মুগ্ধ হই, তাকিয়ে থাকি। দেখতে সুন্দর হলেই যেমন ভালো মনের হয় না, তেমনি দেখতে কুৎসিত হলেও খারাপ মনের হয় না। মজার ব্যাপার হলো, আমরা অনেকেই সুন্দর মানুষকে মোটাদাগে খারাপ মনের ভেবে বসি। কেন যে ভাবি, তা আমরা নিজেরাও জানি না। আমি নিজে অনেক কুৎসিত লোককে বাজে মানসিকতা ধারণ করতে দেখেছি।
৫৬। প্রতিদিন কোনও না কোনও ভালো কাজ করার উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখি…রাতে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমাবো বলে। আত্মত্যাগের মানসিকতা প্রশান্তিতে ঘুমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিনই কারও না কারও উপকার করুন, যদি তা নাও করতে পারেন, কাউকে দুটো ভালো কথা বলুন, কারও মনটা ভালো করে দিন। মানুষের কল্যাণে বাঁচার চেয়ে শান্তি ও স্বস্তির আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে।
৫৭। মেয়েদের বলছি, হয়তো তুমি কোনও বড়লোক ঘরের মেয়ে নও, দেখতে সুন্দরী নও, স্মার্ট নও, ঠিক করে গুছিয়ে কথাও বলতে পার না, নামিদামি কোনও স্কুলে পড়ার সৌভাগ্যও তোমার হয়নি, তুমি হয়তো কখনওই ভালো ছাত্রীও ছিলে না, তবে এই সব তথাকথিত ‘ভালো গুণ’ না থাকলেও তোমার মধ্যে একটা শক্তি রেখো---তোমার নিজের দেখা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো সৎসাহস ও পরিশ্রম করার মানসিকতা। স্রেফ এই দুই দিয়ে আমি অনেককেই অনেক দূর অবধি হাঁটতে দেখেছি।
৫৮। আমার একটি অসীম মানসিক শক্তি আছে---যেকোনও পরিস্থিতিতে মানুষের দেওয়া অপমান ও লাঞ্ছনা চুপ করে সহ্য করার, সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার এবং কিছু শিখার। কী করি, জানো? যখন যে মুহূর্তে আমি অপমানিত হচ্ছি, তখন মনকে বোঝাই, এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাকে আর কতক্ষণই-বা যেতে হবে? বড়জোর ঘণ্টাখানেক…এই তো, না? তার পর তো সব ঠিক হয়ে যাবে। জীবনটা আগের মতোই হয়ে যাবে। আমার সব কিছু আমারই তো আছে, কিছুই হারায়নি। তো যেতে দিই না সেই সময়টা, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করিই না, কী হবে? সত্যিই পৃথিবীর সব ঝড়ই একসময় থেমে যায়। ওটার জন্য অপেক্ষা করতে জানতে হয়, এটা শেখার জিনিস।
৫৯। আমার তেমন কোনও বন্ধু নেই, কারণ আমি জানি, আমার নিজের চেয়ে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত আর কেউ নেই, তাই আমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যার সাথে বন্ধুত্ব রাখলে মন খারাপ হয়, নিজেকে ছোট মনে হয়, তার সাথে বন্ধুত্ব দূরে থাক, সম্পর্কই রাখার কিছু নেই। আর একটা ব্যাপার হলো, যাদের আমরা বন্ধু ভাবি, তাদের বেশিরভাগই কিন্তু আসলে বন্ধু নয়, স্রেফ পরিচিত। ওদের সাথে সময় দিতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয় ও নিজের কাজগুলি ঠিকভাবে করা হয় না। আমি এখনও পর্যন্ত এমন একজনকেও দেখিনি যে লোকটা অনেকদূর গেছে রাস্তায় রাস্তায় আড্ডাবাজি করেও। যার হাতে পৃথিবীর সবার জন্যই সময় আছে, সে একটা অপদার্থ ছাড়া আর কিছু নয়।
৬০। আমার কষ্টের সময় আমার চোখের পানি কেউ কখনও মুছে দেয়নি, কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি, কাঁদছে যারা তাদের চোখের পানি মুছে দেওয়ার, অন্তত কিছু মানুষের জীবনে একটু পরিবর্তন আনার। আমি নিজেকে তৈরি করতে চাই মানুষের কষ্টের সঙ্গী হওয়ার জন্য। আমার দুঃখের সময় দুটো ভালো কথা বলেছে, এমন যারা ছিল, তাদের সংখ্যা হাতের কড়ে গুনে ফেলা যাবে। তেমন কাউকেই পাইনি যে দয়া করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার সে সময় কোনও আর্থিক সাহায্যের দরকার ছিল না, ছিল একটু মায়াভরা চাহনির কিংবা সহানুভূতিপূর্ণ দুইএকটি পরামর্শের। বিশ্বাস করো, তখন কাউকেই পাইনি পাশে। আমি সেই শূন্য জায়গায় দাঁড়াতে চাই যেখানে কেউ এসে দাঁড়ালে অনেক জীবনই বেঁচে যেত।
৬১। লজ্জা পেয়ে পেয়ে মাথা নিচু করে যেসব জায়গা থেকে সরে আসতে হয়েছে, প্রতিদিনই একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করেছি সেসব জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াব বলে। হ্যাঁ, এখন সেসব জায়গায় ডাকলেও হয়তো যেতে পারি না সময়ের অভাবে। কীসের ব্যস্ততা? আরও বড় বড় জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাব, তার জন্য যে প্রস্তুতি, সেটির ব্যস্ততা। যেসব জায়গা আমাকে মূল্যায়ন করেনি একসময়, এখন সেসব জায়গার মূল্যায়নকে তোয়াক্কা করার সময়টাই আমার হাতে নেই। যে আমার ফোনটা ধরার প্রয়োজন মনে করেনি একসময়, এখন তার ফোনটা ধরার সময়টুকু পর্যন্ত আমার নেই।
৬২। বাস্তবতা এমন যে স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে নিয়ে কিছুই চিন্তা করে না। আমি নিজেকে এমনভাবে তৈরি করব যাতে মানুষ আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও আমার কাজ নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য থাকবে। এমনকি যারা আমাকে অপছন্দ করে বা সহ্যই করতে পারে না, তারাও আমার কাজগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমায় ভালো না বাসুক, তবু আমার কাজকে ভালোবাসতেই হবে। আমার চিন্তার এবং কাজের প্রতিফলন এমন থাকবে যে, অন্য মানুষ আমার কাজ দেখে বলবে, আমিও জীবনে এমন একটি কাজ করতে চাই। আমার কাজ এবং আমার ভাবনাগুলোকে মানুষ সম্মানের সাথে মনে রাখবে। এটাই নিজের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ।
৬৩। এখন আমার সমবয়সীরা আনন্দ করছে, আমি প্রচুর কষ্ট করছি, একটা সময় আমি আনন্দ করব, আমার বন্ধুরা এবং সারাপৃথিবী চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে সে আনন্দ দেখবে---আমি এমনি করেই ভেবেছি জীবনে। হয়তো সেই আনন্দের সময়টা এখনও আসেনি, তবে আমি যেমন ছিলাম, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ভালো আছি এখন। এটা আমার সেই ভাবনার ফল। তুমি হয়তো পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাবে না, তবু সে চূড়ায় পৌঁছানোর স্বপ্নটা তোমার মধ্যে থাকতেই হবে। যদি তাও না থাকে, তবে তুমি নিজেকে বর্তমান অবস্থান থেকে নাড়াতেই পারবে না।
৬৪। কারও সাথে আমার কোনও প্রতিযোগিতা নেই, আমার সমস্ত প্রতিযোগিতা নিজের সাথে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ---আজকের ‘আমি’টা গতকালকের ‘আমি’টার চেয়ে ভালো হবে, আগামীকালকের ‘আমি’টা আজকের ‘আমি’টার চেয়ে ভালো হবে। আমি প্রতিদিনই নিজেকে আগের দিনের চেয়ে ছাড়িয়ে যেতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন। আমার বুকে দম থাকলে কারও সাধ্য নেই আমাকে হারিয়ে দেওয়ার।
৬৫। গভীর আন্তরিকতার সম্পর্কে আমার কখনও কোনও অর্থনৈতিক লেনদেন থাকে না, আর যেখানে অর্থনৈতিক লেনদেন থাকে সেখানে আমার কোনও আবেগ থাকে না। তাই আমি ঠিক করেছি, যাদের আমি ভালোবাসি, তাদের সাথে আমি কখনওই অর্থনৈতিক লেনদেনের সম্পর্কে যাব না। আন্তরিক সম্পর্কে টাকাপয়সার লেনদেনের ব্যাপারটা চলে এলে সে সম্পর্কটাই আর আগের মতো থাকে না, এমন হতে আমি অনেক দেখেছি। বেশিরভাগ মানুষই আর্থিক ব্যাপারে কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে পারে না বা রাখতে চায় না। আর ওরকম কিছু হলে আন্তরিকতা নষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক।
৬৬। যখন কোনও কিছুতে কাউকে ‘না’ বলতে হয়, তখন স্পষ্টভাষায় ‘না’ বলি। যখন ‘হ্যাঁ’ বলি, তাও বলি স্পষ্টভাষায়। আমাদের মূল সমস্যা, যেখানে ‘না’ বলতে হয়, সেখানে ‘না’ বলতে জানি না। আমরা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলি, যেটা দিয়ে ‘হ্যাঁ’ও বোঝায় না, ‘না’ও বোঝায় না। যাকে বলছি, যদি ‘হ্যাঁ’ শোনাটা তার দরকার হয় তবে সে ধরে নেবে ‘হ্যাঁ’, আর ‘না’ দরকার হলে ‘না’। এমন প্রায়ই হয় যে আমি যেটা বলতে চাই, সে ধরে নেয় তার উল্টোটা। তখন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কী দরকার? তার চাইতে আগেই নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলে ভালো।
৬৭। মানুষকে অজুহাত দিতে পছন্দ করি না, আর নিজেকে কোনও পরিস্থিতিতেই অজুহাত দিই না। যখন যা করব ভাবি, পরিস্থিতি যা-ই হোক, করে নেওয়ার চেষ্টা করি। মানুষকে যতই অজুহাত দিই না কেন, দিনের শেষে মানুষ শুধু একটা কথাই মাথায় রাখে---আমি কাজটা করতে পারলাম কি পারলাম না। কাজটা না করতে পারলে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলেই বরং ভালো, এতে লোকের সম্মান পাওয়া যায়। লোকে অজুহাত পাত্তা দেয় যতক্ষণ আমার সামনে আছে ততক্ষণই, সামনে থেকে দূরে গেলে আমার ব্যর্থতার কথাটাই শুধু মাথায় রাখে। ওদের দোষ দিয়ে কী হবে? আমি নিজেও হয়তো তা-ই করি।
৬৮। কোনও মানুষের জন্য কিছু করে তাকে খুশি করা অসম্ভব কঠিন কাজ মনে হয়। তাই কখনওই কাউকে খুশি করার জন্য কিছু করি না। নিজে যা পছন্দ করি, যে কাজ করতে আমার ভালো লাগে, যা মন থেকে করতে চাই, সেটাকেই সঠিকভাবে, সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে করার চেষ্টা করি সব সময়। আমার পক্ষে একটা কাজ সবচেয়ে ভালো যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকুই করি। খুব করে চেষ্টা করি কাজটা আগের বার যেভাবে করেছিলাম, তার চেয়ে ভালোভাবে করার। নিয়ত অনেক বড় জিনিস, ওটা ঠিক থাকলে বাকিটা এমনিই হয়ে যায়।
৬৯। সময় আমার জন্য অপেক্ষা করে না, অন্যদিকে আমার কাজগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দেওয়া থেকে সব সময় বিরত থাকি। এ জীবনে ফালতু আড্ডা দিয়ে কখনও সময় নষ্ট করিনি, ওরকম আড্ডায় ডাকে যারা তাদের আমি বরাবরই খুব কৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। ওদের অনেকেই আছে যারা আমায় ভালোবাসে, তাই ওদের মনে কষ্ট দিই না, ওদের এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়ে প্রায়ই নানান অক্ষতিকর মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়।
৭০। কোনও সমালোচনায় কখনওই কোনও পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করি না, সমালোচনা আমাকে সংকুচিত করে রাখে। অন্যদের আলোচনা চুপচাপ শুনে যাই, তেমন কোনও মন্তব্য করি না। আমি খুব ভালো করেই জানি, যাদের নিজেদের করার মতো কোনও কাজ নেই বা যাদের কাজটা করার ক্ষমতাই নেই তারাই সে কাজটার সমালোচনা বেশি করে। এর মানে কী দাঁড়াল? সমালোচকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু অপদার্থ ও নিষ্কর্মার দল। ওদের সে দলে যোগ দিয়ে নিজেকে ওদের লেভেলে নামিয়ে ফেলার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। মানুষ সমালোচনা করুক কিংবা আলোচনাই করুক, দিনশেষে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ নিজেকেই করতে হয়। তাই আমার কাছে আমার কাজ এবং আমার সময়, মানুষের আলোচনা এবং সমালোচনার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
৭১। আমি নিজেকে কোনও দিনই কারও জন্য পরিবর্তন করিনি এবং ভবিষ্যতেও না করার সম্ভাবনা বেশি, কারণ আমি আমাকে সবচেয়ে ভালো জানি, আমি জানি আমার আমাকে কোথায় পরিবর্তন করতে হবে আর কোথায় পরিবর্তন করতে হবে না। সবশেষে আমার পারা না পারা, ভালো মন্দ আমার সাথেই, অন্যের জন্য নিজের সাথে কিছু করতে আমি প্রস্তুত নই, অন্যের চেয়ে আমার ইচ্ছেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের জন্য নিজেকে বদলে ফেলে যারা এবং এরকম করতেই থাকে, তারা কখনও সুখী হতে পারে না।
৭২। যে মানুষ অন্যকে সম্মান করে না, আমি তার আশেপাশে অবস্থান করতেও ভয় পাই, মেশা তো অনেক পরের কথা। এমন মানুষকে সাথে নিয়ে চললে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার আশংকা সবচেয়ে বেশি। ওদের কাছ থেকে কিছুই শেখার নেই, বরং ওদের সাথে চললে নিজের আত্মার ক্ষয় হতে থাকে। আমি আমার নিজেকে যথেষ্ট সম্মান করি, বিশ্বাস করি, এরকমটাই সবাই করে। তাই অন্যকে অসম্মান করে এমন মানুষদের সাথে কখনওই মিশি না, তা সে যত দামি মানুষই হোক না কেন।
৭৩। অন্যের শরীর ও মনকে সুস্থ করতে গিয়ে নিজেকে অসুস্থ করা থেকে বিরত থাকি, কারণ আমি সুস্থ থাকলে আমি ভালো থাকব ও অনেক মানুষকে ভালো রাখতে পারব। ঘরের কাজ ও বাইরের কাজ, ঘরের ও বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক, আমার ও আমার কাছের মানুষগুলির ভালোলাগা, এসব ঠিকভাবে গুছিয়ে রাখতে হলে নিজেকে সুস্থ রাখাটা জরুরি। আমি অসুস্থ হলে আমার সাথে সাথে একটা পুরো পরিবার অনিশ্চয়তার দিকে যাবে। এর সাথে আমি সেই কাজগুলি করতে পারব না, যে কাজগুলি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই নিজেকে সুস্থ রাখার ইচ্ছায় অপ্রয়োজনীয় মানুষের উপকার করা থেকে কখনও কখনও বিরত থাকি। সবচাইতে বড় কথা, অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নিজের সময় ও শ্রম ব্যয় করে অপ্রয়োজনীয় লোকের উপকার করলে সেই লোকগুলি পরবর্তীতে আমার অনেক ধরনের ক্ষতি করে ফেলে। বাঙালিদের পেটে না-চাইতেই-পাওয়া উপকারের ঘি হজম হয় না।
৭৪। যে মানুষের কাছ থেকে আমার কিছু শেখার থাকে না, জানার থাকে না, আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ সময় তার পিছনে নষ্ট করা থেকে বিরত থাকি। সময়ের চেয়ে বেশি দামি অনেক কিছুই হয়তো আছে, তবে সেগুলি পেতে চাইলেও সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাই সময়কে ফালতু কাজে ব্যয় করার কোনও মানে নেই। জীবনে সামনের দিকে এগোনোর প্রথম ধাপ হচ্ছে এটা বুঝতে পারা যে সবাইকে সময় দেওয়ার কিছু নেই। ‘আমি ব্যস্ত।’ এর অর্থ হলো, ‘আমি তোমার বেলায় ব্যস্ত।’
৭৫। যে মানুষ আমাকে দুর্বল মনে করে, অসহায় মনে করে, সহজলভ্য মনে করে---আমি তার মুখোমুখি হই আমার সমস্ত যোগ্যতা নিয়ে…এতটাই তীব্রভাবে যে আমার সম্পর্কে দ্বিতীয়বার ওরকম করে ভাববার আগে সে অন্তত দশবার চিন্তা করবে। আপনার ভেতরের শক্তিটাকে অবমূল্যায়ন করে যে, তাকে কখনও ছাড় দেবেন না, আপনার কাজের মধ্য দিয়ে তাকে দেখিয়ে দিন যে তাকে গোনার সময়ও আপনার নেই। অন্যদিকে, যে মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে, সম্মান করে, ভালোবাসে---আমি তার মুখোমুখি হই আমার সমস্ত দুর্বলতা নিয়ে। এমন মানুষের কাছে হেরে যাওয়া অনেক আনন্দের। পরিস্থিতি বুঝে অপ্রোজনীয় মানুষের কাছে সঠিক সময়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া ভালো। যারা ভালোবাসে, এমনকি কোনও কারন ছাড়াই ভালোবাসে, তাদের কাছে তা না দিলেও চলে।
৭৬। কোনও সমস্যা তৈরি হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার চেয়ে জরুরি হলো সমস্যাটা নিয়ে ভাবা, সত্যিই ভাবা, কেননা সমস্যায় পড়লে বেশিরভাগ মানুষের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়, কাজই করে না ঠিকমতো। উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়িয়ে না গিয়ে কান্নাকাটি না করে ওটার সমাধান কী হতে পারে, আগে সেটা চিন্তা করতে হবে। যেকোনও সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম ও সবচেয়ে কঠিন ধাপটি হলো, সেটি সমাধানের প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়া। আমরা সমস্যা সমাধানের কাজটাই শুরু করতে পারি না, দেরি করে ফেলি। আর তা সমাধান হয়ে যাওয়ার পর, কেন সমস্যাটি হয়েছিল, এখানে আমার নিজের কী ভুল ছিল, এসব খোঁজার ও বুঝার যথেষ্ট চেষ্টা করি। সময়ের সাথে নিজেকে শুধরে নিয়ে দ্বিতীয়বার যেন একই ভুলটি আর না হয়, সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি। বেশিরভাগ সমস্যাই আসলে ততটা বড় নয়, শুরুতে সেগুলিকে যতটা বড় মনে হয়। আর একটা ভুল কাজ আমরা করে থাকি, তা হলো, সমস্যায় পড়লে এমন লোকজনের কাছে ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিই যাদের কাছে যাওয়ারই আসলে দরকার নেই। এটা স্রেফ সময়ের অপচয় আর উদ্বেগবৃদ্ধির আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়। যাদের দেখলে আমাদের মনে হয় তাদের কাছে গেলে বোধহয় কাজ হবে, তাদের প্রায় কেউই কোনও কাজের নয়।
৭৭। আমি মানুষকে খুব দ্রুত ক্ষমা করে দিই, সুযোগ পেলেও প্রতিশোধ নিই না…সত্যিই নিই না। মানুষকে ক্ষমা করতে পারলে নিজের কষ্ট অনেক কমে যায়। তবে সে কেন আমার সাথে ভুল আচরণ করেছে এবং আমি কেন তাকে ক্ষমা করতে বাধ্য হচ্ছি, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখি। যদি মনে হয়, সে যা করেছে তা ঠিক, তবে নিজেকে সংশোধন করে নিই। আর যদি ভুলটা তার হয়, তবে তাকে ওভাবেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসি। সে বাঁচুক একটা ভুল মানসিকতা নিয়ে, যোগে বিয়োগে এটাই তো একটা বড় শাস্তি। তবে হ্যাঁ, যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনও অন্যায় করে থাকে কেউ, তবে আমি তাকে সহজে ছাড়ি না, এর শেষ দেখে তবেই ছাড়ি।
৭৮। আমি আমার সমস্ত পরিস্থিতি একা সামলিয়েছি, সামলাচ্ছি। একা বলতে একদমই একা। আমি জীবনে এমন যুদ্ধেও একা লড়াই করে গেছি, যখন আমাকে লড়াইটা করতে হয়েছে অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে এবং আমার পাশে থেকে একটু সাহস দেওয়ার জন্য কাউকেই পাইনি। অনেকেই অনেকভাবে জীবনে আসে, আবার চলেও যায়, কঠিন কোনও সময়ে আমি তাদেরকে কখন সাথে পাইনি, পাশেও পাইনি। জীবন থেকে আমি বুঝেছি, মানুষ নিজের ছায়ার সাথে নিজে একাই হাঁটে। তাই আমার চারপাশের সমস্ত পরিস্থিতির জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখি। আমার কর্মের দায় আমার, আমার সফলতা-ব্যর্থতা…আসলেই আমার। সাফল্যের সুবিধা ও আনন্দের ভাগ নেওয়ার অনেককেই পাওয়া যায়, কিন্তু ব্যর্থতার সকল দায় ও ভোগান্তি আমার একার। পৃথিবীতে দিনের শেষে প্রতিটি মানুষ একান্তই নিজের। মানুষ নিজের জন্যই বাঁচে। সে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় যদি কেউ উপকৃত হয়, অন্য কারও ভালো হয়, তবে তা নিছকই কাকতালীয়। সে অন্যকে বড়জোর ভালোবাসতে পারে, পাশে থাকতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। একজন আর একজনের জীবনটা যাপন করতে পারে না, কষ্টটা ভোগ করতে পারে না। যখন কেউ বলে, আমি অনুভব করতে পারছি তোমার যন্ত্রণাটা, তখন আমি মনে মনে ভাবি, তুমি নিজেই জানো না কত ভুল একটা কথা তুমি এইমাত্র বললে!
৭৯। আমি সন্দেহপ্রবণ মানুষকে আমার জীবনে প্রশ্রয় দিই না, আমি নিজেও এ ব্যাপারটার সাথে সহবাস করি না। যার যার জীবন তার তার। কাউকে ভালোবাসা মানেই তাকে কিনে নেওয়া নয়। মানুষকে ভালোবাসতে হয় তাকে তার পৃথিবীতে তার নিয়মে থাকতে দিয়ে, আমি এটাই বিশ্বাস করি। আমি সম্পূর্ণ আস্থার জায়গা থেকেই ভালোবাসি, নিজের মনের বিশালতা নিয়ে ভালোবাসি, বাকিটা অপর প্রান্তের মানুষটির নীতির উপর নির্ভর করে। যদি কোনও কাজ করতে তার নীতিতে বাধা না দেয়, তবে আমি বাধা দেওয়ার কে? বাধা দিলে সে ওই কাজটি লুকিয়ে করবে, কিন্তু করবে, এটা নিশ্চিত। কেউ যা করতে পছন্দ করে, তাকে সে কাজটি করতে বাধা দেওয়ার অর্থই হলো তার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়া। আমি বরং চাই, সে আমার সামনে নিজেকে লুকিয়ে না রাখুক। সে আদতে যেমন, আমি তাকে তেমন করেই দেখতে চাই। যদি ওটা মেনে নিতে না পারি, তবে আমি নিজেই সরে যাব, আর মেনে নিতে পারলে থেকে যাব। এই তো! অনুভূতি স্বচ্ছ হলে সে জীবনে থেকে যাবে, অস্বচ্ছ হলে সে যেকোনও সময় হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাওয়া কোনও কিছু নিয়ে আমার কোনও আফসোস থাকে না। যা হারিয়ে যায়, তা আমার ছিল না বলেই হারিয়ে যায়। কেন হারিয়েছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করি, এই চেষ্টায় কিছু অভিজ্ঞতা হয, একটা যথোপযুক্ত শিক্ষা হয়, যা আমাকে পরবর্তীতে ভালো পদক্ষেপের নেওয়ার জন্য তৈরি করে।
৮০। জীবনে যেসব মানুষ আমার উপকার করেছে, তারা আমার জীবনের সাধুসঙ্গ, তারাই আমার ঈশ্বর। বেঁচে থাকতে তাদেরকে ভুলে যাওয়ার বা তাদের উপকারের কথা অস্বীকার করার ইচ্ছা, সাহস এবং স্পর্ধা কোনওটাই আমার নেই। আমি তাদের সকল নিয়মের, সংস্কারের, যুক্তির, কারণের, সত্যের ঊর্ধ্বে ভালোবাসি। তাদের সব কিছুই আমার চোখে সঠিক। তাদের জন্য আমি করতে পারি না, এমন কোনও কাজ নেই। আমার ব্যস্ততা, আমার আবেগ, আমার বোধ, আমার বিবেক সব কিছুর উপরে তারা অবস্থান করে, করে যাবে আজীবন। যার কাছে আমার স্থান পৃথিবীর সকল সত্যের উপরে, তার জন্য আমিও যেকোনও সত্যকে তুচ্ছ করতে পারি অনায়াসেই। এমনকি আমার জীবনের বাঁকে ছোট্ট পরিবর্তন এনে দেওয়া মানুষটাকেও গভীর শ্রদ্ধায়, নিবিড় কৃতজ্ঞতায় মনে রাখি। আমি বিশ্বাস করি, কৃতজ্ঞতা মানুষের সবচাইতে বড় গুণ।
৮১। যে মানুষ বিশ্বাস নষ্ট করে, বিভিন্ন উপায়ে চালাকি করে, কৌশলে আমাকে ব্যবহার করে কোনও উদ্দেশ্য হাসিল করে, আমি যখনই তা বুঝতে পারি, তখনই খুব দ্রুত সেখান থেকে সরে আসার চেষ্টা করি। এমনভাবে সরে আসি যেন সে আমার শত্রু হয়ে না ওঠে এবং তাকে যে আমি বুঝতে পেরেছি, সেটাও যেন সে না বুঝে। এমন কাউকে আমার জীবনের জন্য ভুল মানুষ বলে সন্দেহ করি না, বরং নিশ্চিতভাবেই জেনে নিই যে আমার জীবনের স্বার্থেই তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা যাদের খারাপ বলে সন্দেহ করি, তাদের বেশিরভাগই সত্যি সত্যিই খারাপ, সন্দেহ করার কিছু নেই।
৮২। যা আমি করতে পারব না, তা করতে পারার উদারতা নিয়ে আমি মানুষের কাছে যাই না, আমি যথাসময়ে আমার সীমাবদ্ধতা জানিয়ে দিতে পছন্দ করি। জানিয়ে দিতে পারাটা আমাকে অনেক ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়। দিনের শেষে লোকে তাকেই বেশি সম্মান করে যে কোনও একটা কাজ পারে না বলেই ‘পারি না’ বলে দেয়। আমাদের সমাজে ‘পারি না’ বলে দিতে পারার মানুষ কম, চারিদিকে দেখলে মনে হয়, আহা, সবাই-ই তো সব কিছু পারে, কেবল আমিই কিছু পারি না। নিজেকে ও অন্যকে অহেতুক ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে এই ‘পারি না’ বলতে পারার জুড়ি নেই। কাউকে ভুল বা অনুমাননির্ভর তথ্য দেওয়ার চাইতে অনেক ভালো নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে নেওয়া।
৮৩। আমি নিজেকে ভালোবাসি, মানুষকে ভালোবাসি। মানুষ আমাকে কষ্ট দেয়, আমি নিজেকে কষ্ট দিই। কষ্ট পেয়ে কাঁদি, নিজেকে ভুল বুঝি, মানুষকে ভুল বুঝি। কান্না মুছে আবারও আমি নিজেকে ভালোবাসি, মানুষকে ভালোবাসি। নিজের জন্য কাজ করি, মানুষের জন্য কাজ করি। এটা আমাকে সুন্দর অনুভূতি দেয, বাঁচতে সাহায্য করে। ভালোবাসলে ভুল বোঝাবুঝি হবেই, এটা স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভুল বুঝলেও একদম ছেড়ে না যাওয়া, সময় এলে সব ঠিক হয়ে যায়। সময়ই সব ঠিক করে, ওই সঠিক সময়টা আসার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হয়।
৮৪। চলার পথে প্রতিটি মানুষের সাথে ভদ্রভাবে, আন্তরিকভাবে এবং হেসে কথা বলার চেষ্টা করি। আমি আমার নিজস্বতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তাই আমাকে কোনও ধরনের আরোপিত অহংকার করে বাঁচতে হয় না। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষকেই মূল্যায়ন করা উচিত। কাউকেই বিন্দুমাত্র অসম্মান করা ঠিক নয়। Every dog has his day. যাকে আমি আজকে অবমূল্যায়ন করছি, এমন একটা দিন আসবে যখন সে আমাকে মূল্যায়ন করার মতো সময়ই পাবে না, কারণ তখন সে তার চাইতে জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকবে। যারা মানুষকে মূল্যায়ন করতে জানে না, তাদের জীবনে অনেক ধরনের দুঃখ নেমে আসে। তাদের সাথে মেশা মানেই সে দুঃখের ভাগীদার হওয়া।
৮৫। আমার নিজের দেখা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে কোনও অজুহাত দেখিয়ে কখনওই বাধার সৃষ্টি করব না---বুকের ভেতরে এই প্রত্যয়টা থাকতে হবে। বরং প্রতিনিয়ত অনুশীলন এবং নিজেকে উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উত্তরণের শীর্ষে নিয়ে যাব। যে কাজটা আমি একবার ধরি, সে কাজটা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে কোনওভাবেই ছুটি দিই না, তা আমার যত কষ্টই হোক না কেন! আমি নিশ্চিত জানি, দেখা-স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলে আমার চারপাশটা দ্রুত আলোকিত হয়ে উঠবে। চারপাশের আলো চারপাশ থেকে আসে না, নিজের ভেতর থেকেই আসে। আমার কাছের সবাই তার সুফল ভোগ করবে, আমাকে দেখে আরও অনেকেই সেই স্বপ্নের পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা পাবে। আমি আমার জন্য কাজ করতে গিয়ে অনেকের জন্যই কাজ করতে পারব।
৮৬। আমার জীবনে যদি ১০০ জন মানুষ থাকে, তাদের মধ্যে একজন মানুষও যদি পজিটিভ চিন্তাভাবনার হয়, তবে আমি খুব দ্রুত বাকি ৯৯ জনকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিই।‌ হাজার মানুষের চেয়ে একজন পজিটিভ চিন্তাভাবনার মানুষ আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। কেননা আমি তো জানিই যে আমি পারি না। এখন এটা আবার নতুন করে শোনার তো কোনও মানে হয় না। বরং যদি এমন কাউকে পেয়ে যাই যে আমাকে ভুল করে হলেও বলবে যে আমি পারি, এবং আমি যদি মনের ভুলেও তা বিশ্বাস করে ফেলি এবং তা সত্যি সত্যি পারার জন্য চেষ্টা করতে শুরু করে দিই, তবে কোনও একটা ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা তো অন্তত থেকে যায়। স্রেফ এইটুকু সম্ভাবনার জোরেই আমি অনেককেই ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি।
৮৭। কেউ আমার জন্য কিছু করেছে কি না, এটা আমি কখনওই চিন্তা করি না, সব সময় খুব চেষ্টা করি আমি কারও জন্য কিছু করতে পারবো কি না এবং সেটা কীভাবে সম্ভব, তা ভাবতে। কারও জন্য কিছু করতে পারার সৌভাগ্য সবার হয় না। অনেকের সামর্থ্য থাকে না, অনেকের সময় থাকে না, অনেকের অবশ্য ইচ্ছেও থাকে না। কে করল, কে করল না, এটা তাদের ব্যাপার। যে যেভাবে ভালো থাকে। অন্যের জন্য কাজ করতে আমার ভালো লাগে, নিজেকে ভালো রাখার জন্য হলেও আমি কাজটা করব। যেভাবে অগ্রসর হলে কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারব, আমি নিষ্ঠার সাথে শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টাটা করি। আমি কাজ করি নিজেকে আনন্দে রাখার জন্য, কারও স্বীকৃতির আশায় নয়।
৮৮। আমি একান্তই নিজের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করি, এই সময়টা আমাকে নতুন কিছু চিন্তা করার সুযোগ দেয়। নিজের সাথেই একা থাকার সময় পায় না যারা, তাদের পক্ষে সৃষ্টিশীল হওয়া অসম্ভব। নিজের ভাঙাচোরা মনের মেরামত করতে ও নিজের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে এর কোনও বিকল্প নেই। লোকের ভিড়ে থেকে নিজের হৃদয়ের অলিগলিতে হেঁটে বেড়ানো যায় না। আমি একা থেকে নিজের হতাশাকে ও ব্যর্থতাকে উপভোগ করি নতুন কিছু সৃষ্টি করব সে স্বপ্নে ও আনন্দে।
৮৯। যে কাজটি করতে আমার ইচ্ছে করে না, তেমন কিছু আমি কখনও জোর করে করি না। যে কাজটি আমার মনকে টানে, আমি সেটাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করি, এবং এখানে আমি এক ধরনের স্বস্তি পাই। হ্যাঁ, একটা কাজ আমি ইচ্ছে করলেও করি না করলেও করি, কেননা তা না করলে আমার বাকি কাজগুলি করার অনেক সুযোগই বন্ধ হয়ে যাবে, সে কাজটা হলো---চাকরি। আমি মনে করি, চাকরি ভালো লাগার জিনিস নয়, মন্দ লাগারও জিনিস নয়, চাকরি কেবলই করার জিনিস।
৯০। আমি দায়িত্ব নিতে কখনও ভয় পাই না। আমি যদি কোনও ভুল করি, তবে দায়িত্ব নিয়ে বলি, হ্যাঁ, ভুলটা আমার। যদি এমন কোনও কাজ আমাকে করতে হয় যে কাজটা আমার, তবে সে কাজটার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিয়ে নিতে পারি, সে সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাস আমার আছে। যে কাজটা করার সুযোগ আমি পেয়েছি, তা আমি করতে পারব না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি, যে কাজটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব, কোনও না কোনও উছিলায় সে কাজটা করার সুযোগই আমি পাব না। আমি সব সময় দেখেছি, যেটার জন্য আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি, সময় দিয়েছি, শ্রম দিয়েছি, সেটাতে আমি সফল হয়েছি। আমি আমার সবটুকু দিয়ে কাজটার শেষ দেখেই ছাড়ি, হেরে যাওয়ার আগেই হেরে যাই না।
৯১। যাতায়াতের সময় আমি যখন যে যানবাহনেই থাকি না কেন, চালকদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি, যেমন রিকশাচালক। ওদের জীবনযাপন কেমন, তা বুঝার চেষ্টা করি। পথ চলতে চলতে শ্রমজীবী মানুষদের সাথে পরিচিত হলে, যেমন শ্রমিক, পথশিশু, ফেরিওয়ালা…যখন যেখানে যার সাথে দেখা হয়, তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি, একজন উচ্চবিত্ত সফল ব্যক্তির জীবনী পড়ে আমি যা শিখতে পারি না, ওদের সাথে আলাপ করে এর চেয়েও আরও অনেক বেশি শিক্ষা পাই।
৯২। আমি মানুষ হিসাবে অনেক ত্রুটিপূর্ণ। আর দশটা মানুষের যেসব অন্ধকার দিক আছে, সেগুলির অনেকগুলিই আছে আমার মধ্যে। আমি তেমন কোনও ক্ষেত্রেই কোনও বিষয়েই সেরা নই, অ্যাভারেজ বলা চলে। খুব কম ক্ষেত্রেই আউটস্ট্যান্ডিং বলা যাবে আমাকে। তাই যতটুকু সম্ভব অন্যের ভুলধরা ও অন্যকে দোষারোপ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি। পারস্পরিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, এতে করে নিজেকে শুধরানোর সময়, পরিবেশ, সুযোগ অনেকটাই পাওয়া যায়। যারা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারি, আসলে ওরা অন্যের চোখে নিজেকেই দেখছে এবং নিজের যা দোষত্রুটি তা অন্যের বলে মনে করছে।
৯৩। আমার একটি ভালো গুণ আছে, তা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কেউ আমাকে রাগালে, কষ্ট দিলে আমি তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করি। রাগের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত যে কোনও আয়নার (বা ক্যামেরা অন করে সেলফিমুডে দিয়ে মোবাইলের) মুখোমুখি হয়ে যাই, যেহেতু আমি নিজেকে ভয়ংকর এবং বিশ্রী দেখতে চাই না, তাই তখন দ্রুতই নিজেকে সংযত রাখতে সক্ষম হই। তাতেও কাজ না হলে বা সামনে আয়না না থাকলে সামনের দেয়ালের দিকে বা নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে কারও সাথেই একেবারে একটিও কথা না বলে চুপ হয়ে থাকি। যার সাথে রাগ হয়, তার কাছ থেকে দূরে সরে অন্য জায়গায় চলে যাই। কারও কোনও কথারই উত্তর দিই না। এসব করলে কাজ হয় অনেক সময়। এর পর রেগে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করি এবং এ পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
৯৪। খুব খারাপ কিছু আমার সাথে ঘটলে আমি বারবার নিজেকে এটা বলে বুঝানোর চেষ্টা করি যে ভবিষ্যতে ভালো কিছু নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এতে মন অনেকটা শান্ত থাকে। আমার জীবনে যা চেষ্টা করেও হয়নি, আমি ধরে নিয়েছি, তা আমার নিয়তিতে লেখা ছিল না। হিন্দিতে আশ্চর্য রকমের সুন্দর একটা কথা আছে এরকম---ওয়াক্ত সে পেহ্‌লে অউর কিসমাত সে জ্যয়দা কুছ নাহি মিলতা। এর ভাবার্থ: উপযুক্ত সময় হবার আগে এবং ভাগ্যে যা লেখা আছে তার চেয়ে বেশি জীবনে কিছু পাওয়া যায় না। সত্যিই তা-ই। অনেকেই চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে না, কেননা হয়তো তা তার ভাগ্যে নেই কিংবা তার চাইতে ভালো কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে যা পাওয়ার জন্য তাকে নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। আমরা যা চাই, তা পাই না। আমরা তা-ই পাই, যা আমাদের দরকার। আমাদের কী দরকার, কী দরকার নেই, তা বোঝা আমাদের পক্ষে প্রায় সময়ই অসম্ভব। তাই যা হচ্ছে ও যা হচ্ছে না, তা মেনে নেওয়াই ভালো।
৯৫। অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন কিছু করতে বাধ্য হই, তখন নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হয়। কিন্তু ওই রাগের বহিঃপ্রকাশ উপস্থিত-কোথাও থাকে না, আমি নিজের জন্য সময় নিই‌ এবং বুঝার চেষ্টা করি, কেন আমি বাধ্য হয়েছি। এর পর থেকে যে কারণে বাধ্য হই, সেটা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি। এতে আমি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেকে কষ্ট দিয়ে মানুষের অনুগত হওয়া থেকে মুক্তির এক আশ্চর্য ঘ্রাণ পাই---স্বাধীন হতে পারার মতো সুখ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
৯৬। যখন প্রতারিত হই, ঠকে যাই, তখন নিজেকে খুব বোকা মনে হয়, মেনে নিতে পারি না, শুধুই কান্না পায়। নিজের কাছে নিজেকে খুব অসহায় লাগে, অপমানিত হই, ধৈর্য ধরতে বাধ্য হই। ধীরে ধীরে সময়ই সব ক্ষত শুকিয়ে দেয়। তার পর একসময় নতুন কিছু শিখি, মানুষকে নতুন করে বুঝি। তখন মনে হয়, মাঝে মাঝে ঠকে যাওয়া খুব বেশি প্রয়োজন---নিজেকে চেনার জন্য, নতুনভাবে বেঁচে ওঠার জন্য, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।
৯৭। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসতে শেখা। যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে আর কাউকেই ভালোবাসতে পারে না। আমি যখন থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি, অন্য সমস্ত মানুষ দুঃখ দিয়ে আমাকে আচ্ছন্ন করার ক্ষমতা হারিয়েছে। আর যে মানুষ একবার নিজে স্বাধীন থাকার আনন্দ বুঝে ফেলেছে, সে-ই একমাত্র জানে---কী দারুণভাবে জীবন উপভোগ করা যায়। নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে বাঁচার মতো সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। কাউকে শেকলে বেঁধে ফেলে তার কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করা কখনওই সম্ভব নয়। মুক্তির স্বাদের কাছে ভালোবাসার সাধ বড্ড ম্লান।
৯৮। একজন নারী কীভাবে চলবে, কী পরবে, কার সাথে ঘুরবে, কার সাথে শোবে---এসব ঠিক করে দেওয়ার আপনি কে? সে কি আপনার খায়, না পরে? না কি আপনি তার বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়ান? আপনি নিজে কী করেন, কী পরেন, কোথায় যাবেন, কার সাথে শোবেন---এসব কি অন্য কেউ ঠিক করে দেয়? আপনার চলাফেরায় ও ভাবনায় ওরকম করে শেকল পরিয়ে দিলে আপনার কেমন লাগত? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই কারও কোনও ক্ষতি না করে নিজের নিয়মে ও নিজের শর্তে স্বাধীনভাবে চলার অধিকার আছে, সে অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করার আপনি আমি কেউ না। যদি সভ্য মানুষ হন, তবে কখনও নিজের সীমাটা অতিক্রম করবেন না।
৯৯। বাঁচতে হলে সবাইকে দরকার নেই। আমরা যাদের চিনি, তাদের প্রায় সকলেই আমাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় মানুষ। আমরা আমাদের চারপাশে যাদেরকে আমাদের জীবনে প্রয়োজন ভাবি, তাদের বেশিরভাগই আমাদের জীবনে কোনও কাজেই আসে না। যাদের দেখে ক্ষমতাধর মনে করি, তাদের তেমন কেউই আপনার বিপদের সময় সে ক্ষমতাটা কাজে লাগাবেন না। যার ক্ষমতা মানুষকে বিপদকে থেকে উদ্ধার করতে পারে না, তার সাথে একজন পঙ্গু মানুষের তফাৎ কি খুব বেশি?
১০০। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ। তাঁদের পুণ্যকর্মের ফল হিসেবে আমি এ জীবনে অনেক সৌভাগ্য অর্জন করেছি। নিজের যোগ্যতায় যা পেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি এই দুইজন মানুষের প্রার্থনার জোরে। এঁদের জীবনে পাওয়া ও এঁদের ভালোবাসতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। বাবা-মা মাথার উপর ছায়া হয়ে আছেন, এর চাইতে বড় স্বস্তির অনুভূতি এ পৃথিবীতে আর একটাও নেই।