ফিরে আসি ফের ছায়ার কাছে/ প্রথম অংশ

 
জিরোপয়েন্টে বসে আছি নতুন বন্ধু-হওয়া দুজন বান্ধবী ইবনাত আর ফউজিয়ার সাথে। আমরা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। প্রথমবর্ষ।


তিনজন নতুন বান্ধবী বসে আছি। আমার পরনে কালো টপস, নীল স্কার্ট। একপাশে বিনুনি-করা চুল। তখনও বেশ লম্বাচুল ছিল। কখনও কখনও বন্ধুরা জোর করে চুল খুলে দেখতে চাইত। সিল্কি সিল্কি লম্বাচুল ধরে টানতে নাকি তারা বেশ মজা পেত। আমিও মাঝে মাঝে তাদের আবদারে সায় দিয়ে নিজের চুলের বারোটা বাজাতাম!


জিরোপয়েন্টে রাস্তার যে পাশে স্টুডেন্টরা বসে থাকতো দলে দলে, সেখানে আমরাও বসে আছি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্টুডেন্টরা ক্লাস করার চেয়ে মূলত নতুন নতুন ছেলে বা মেয়ে দেখতেই নিয়মিত ক্যাম্পাসে যায়। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। যেতাম আসলে সুদর্শন ছেলেদের দেখতে।


জিরোপয়েন্ট এমন একটা জায়গা, যেখানে ভার্সিটির সব ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীরা এক হয় ট্রেনের সুবাদে। সেই হিসেবে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর একে অপরের সাথে দেখা, কথা, পরিচয় হয়। অনেকের আবার প্রেমও হয়ে যায়। আয়তনে বিশাল হওয়ায় ক্যাম্পাসের সবটা দেখা হয়ে ওঠে না তেমন। এমনও হয়, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর একসাথে পড়েছি, অথচ ডিপার্টমেন্ট আলাদা হওয়ায় পাঁচ বছরে কারও সাথে দেখাই হয়নি একবারও।


সেদিন ২০১৪ সালের কোনও এক রোববার। বসে আছি আমরা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, অন্যদের খেয়াল করছি, দেখছি আর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ঝিরঝির বাতাস বইছে। রাস্তায় এখানে ওখানে পড়ে আছে কিছু নাম-না-জানা গাছের ফুল। মৃদুহাওয়া এসে কখনও চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে, কখনওবা একটু দূর থেকে ঝরাপাতাগুলো উড়িয়ে উড়িয়ে আশেপাশে নিয়ে আসছে। কখনও ফুলগুলো কুড়িয়ে হাতে নিচ্ছি, কখনওবা কিছু ঝরা শুকনো পাতা হাতের তালুতে নিয়ে হাতের আঙুলে কড়মড় করে পিষে দিয়ে হাতটা মেলে পাতার গুঁড়াগুলো ফুঁ দিয়ে এপাশ ওপাশ উড়িয়ে দিচ্ছি। আমাদের অপেক্ষা চারটার ট্রেনের জন্য।


মৃদু এক হিমেল বাসন্তী বাতাস চোখে দোলা লাগিয়ে এসে অবাধ্য চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ পর পর চুল ভাঁজ করছি, আবার ভাঁজকরা সামনের চুলগুলোকে কী মনে করে জানি ফের এলোমেলো হবার আস্কারা দিচ্ছি। ভালোই তো লাগছে! কুড়াচ্ছি, উড়াচ্ছি, ফের ভাঁজ করছি। হঠাৎ রাস্তার ওপারে আমার চোখ আটকে গেল।


দেখলাম, এক যুবক, পাতারংয়ের টিশার্ট আর কালোজিন্স পরা। কানের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত ভারী ভারী হালকা বাঁকানো এলোমেলো ঘনকালো চুল, মুখভর্তি ঘনদাড়ি। গোলগোল মুখ, দেখতে উজ্জ্বল মেঘবর্ণের, ফিটফাট ছিমছাম গড়নের ভারি মায়াবী চেহারার এক ছেলে। বন্ধুদের সাথে মৃদু হেসে হেসে আমার সামনে দিয়ে কোথায় জানি হেঁটে চলে যাচ্ছে। আমি একপলকে ঠায় তার দিকে তাকিয়ে আছি। এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ সরাচ্ছি না। ইচ্ছে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা জোর করে আটকে রাখি! ঠিক এই মুহূর্তে আমার কাছে পৃথিবীটাকে রংধনুর ‘চৌদ্দটি’ রং মনে হতে লাগল। ওই মুখ, ওই চোখ, ওই চিবুক, ওই হাসি আমার সমস্তটা প্রতিমুহূর্তেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।


ওদিকে সে হেঁটে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর বন্ধুদের সাথে খুনসুটির ছলে খিলখিল করে হাসছে। হাসছে, খুনসুটি করছে, এলো-চুলগুলোকে বাধ্যশান্ত করবার চেষ্টা করছে। হাসছে, হেসেই চলেছে, আর আমি মুগ্ধতায় ডুবেই চলেছি। একটানা তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমার মনে হচ্ছে, ওইখানে দাঁড়িয়ে-থাকা ওই যুবকটিকে আমি কয়েক যুগ ধরে চিনি। তার সাথে আমার কয়েক জন্ম ধরে পরিচয়। কয়েক লক্ষ-কোটি বছর ধরে এই যুবকটিকেই, হ্যাঁ, এই যুবকটিকেই আমি খুঁজে চলেছি! আমি চোখ ফেরাচ্ছি না আর কোথাও, ঠায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি।


পড়ন্তবিকেলে রাস্তার দুধারেই সারি সারি গাছের মেলা। বড় বড় গাছগুলো যেন মাথা উঁচিয়ে ওই নীলাভ আকাশকে নিমিষেই ছুঁয়ে দেবার হুমকি দিয়ে গড়গড় করে উপরে উঠে চলেছে। পুরো রাস্তায় ছড়িয়ে-থাকা গাছের শাখা-প্রশাখার বিস্তীর্ণ ছায়ারাশি কী এক স্নিগ্ধ আবেশে লেপটে দিয়ে গেছে সারারাস্তাই! ওই মাঠ, ট্রেনের ছাদ, আর…ওই বালকের চিবুক! আমি দেখছি, দেখেই চলেছি…


গাছের প্রশাখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছিটকে-পড়া ধূসর ছায়ার ছিদ্র ভেদ করে কিছু নরম মিষ্টি রোদ ওই বালকের গাল পিছলে পিছলে যাচ্ছে। কিছু সময় পর পর মৃদুল রোদের ছটা ওই বালকের চুলে আছড়ে পড়ছে যেন! সেই ধাক্কায় চুলগুলো কেমন জানি ঝলকে ঝলকে উঠছে! বালককে ছুঁয়ে-যাওয়া ওই রৌদ্রমালা, ওই ছায়ারাশি, ওই মৃদুহাওয়াচক্রে আমার হিংসে ক্রমেই বাড়ছে। কত নিমিষে ওরা তাকে ছুঁয়ে ফেলছে, আর আমি ঠায় বসেই আছি তার প্রতি একপৃথিবী দৃষ্টি-নির্বাসন দিয়ে! কোনও মানে হয়!


সেই যুবক একটিবারের জন্যও আমার দিকে তাকাল না। একপলকের জন্যও না! আমি মুগ্ধ হচ্ছি, আমি কী এক গভীরে ভেসে চলেছি, আমি এই অসহ্য দৃষ্টি-নির্বাসনে ওই বালকের গাল নিবিড় মায়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি! আমি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছি আর মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি আরও বেশি করে। এমন করে, এতটা আবেশে, এরকম মুগ্ধতায় আমার চোখ আগে কখনও কাউকে ছুঁয়ে যায়নি। মনে হচ্ছে, ওই মুখটির জন্য আমি কয়েকশো ট্রয়নগরী কয়েক হাজারবার ধ্বংস করে ফেলতে পারি। আরও কয়েকটাবার মহাযুদ্ধের ঘোষণা আমিই দিয়ে দিতে পারি ওকে না পেলে!


খানিকবাদে সে তার বন্ধুদের সাথে কী জানি কথা নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। এই হাসির ছুতোয় দুষ্টুমির ছলে বন্ধুরা তার কাঁধে বারবার হাত দিচ্ছে, আবার কখনওবা পেটে আদুরে ঘুসি মারছে, আবার ভুঁড়িতে হাতবুলিয়েও দিচ্ছে। আমার হিংসে আরও বাড়ছে! মনে মনে ভাবছি, তোমার বন্ধুরা তোমায় কত সহজেই অমন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, আর আমি ছুঁতে চাইলেই কেন এত আইন, এত অপরাধ, এত অন্যায়?


হঠাৎই কুউউ শব্দে ট্রেন ছেড়ে যাবার হুইসেল বাজল। আমার হুঁশ ফিরে এল। যারা এখনও ট্রেনে উঠে পড়েনি, ওরা তাড়াহুড়া করে দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে চলেছে। আমার বন্ধুরা আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাতধরে ট্রেনে তুলে নিতে চাইছে, কিন্তু আমার ধ্যান তো ওই ট্রেনে নয়, অন্য কোথাও আটকে আছে! বন্ধুরা আমায় ট্রেনে যেতে হাত ধরে একপাশে টানছে, আর আমার মন আমাকে রাস্তার ওপারে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পড়েছি এক আশ্চর্য দোটানায়! একদিকে আমার শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বন্ধুরা, অন্যদিকে মনটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওইখানে দাঁড়িয়ে-থাকা ওই যুবকটি। মন এবং শরীর এই দুইয়ের টানাটানিতে কে জিতে কে হারে, দেখার পালা যেন!


না, ট্রেন চলে যায় তো যাক, আজ চারটার ট্রেনে ফিরব না। এখন আমি যাবই না ফিরে এখান থেকে! সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ ফিরব সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে। বন্ধুদের বললাম, চলে যাও তোমরা। আমি পরের ট্রেনে আসব। ওরা অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থেকে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে চলে গেল। আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওই বালকটির দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি, ছেলেটি নেই ওখানে! আমার চোখের পাহারা থেকে কিছু সময়ের মুক্তিতে সে কোথায় পালিয়ে গেল? আমি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক খুঁজে চলেছি। খড়ের গাদায় সুই পড়লে মানুষ যেমনি তন্নতন্ন করে খুঁজে, আমিও তেমনি করেই খুঁজে চলেছি তাকে। না, কোথাও নেই সে! এদিক ওদিক, এখানে ওখানে…কোথাও নেই। গোটা একপৃথিবীর চেয়েও ভারী হয়ে গেল মনটা। সেই মন নিয়ে অস্থির হয়ে ওকে খুঁজে চলেছি। ওকে আমার চাই! আজ, এখনই, এই মুহূর্তে, এই বেলাতেই চাই! ওকে আমার ভীষণ রকমের চাই-ই চাই!


এত এত ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়ে সে কোথায় জানি হারিয়ে গেল। মনটা ভারি বিষণ্ণ হয়ে উঠল। ইচ্ছে হচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিই! জিরোপয়েন্ট প্রায় ফাঁকা। সবাই ট্রেনে উঠে গেছে। ট্রেন ছেড়ে দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গেছে। এদিকে আমি আগের জায়গাতেই বসে আছি, উদাস হয়ে ওই একটা জায়গাতেই আমার দৃষ্টি ও ভাবনা বন্দি হয়ে আছে। বাতাস বয়ে চলছে, বিকেলের আলতো আলোয় আমার মনটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে, টুপটাপ করে পাতারা ঝরে ঝরে পড়ছে, কিছু শুকনো পাতা উড়ে আসছে পায়ের কাছে, কিন্তু তবুও কেন জানি একটুও ভালো লাগছে না এসব। বারবারই মনে হচ্ছে, কী যেন নেই! আমি কী যেন হারিয়ে ফেলেছি! আমার খুব কাছের কেউ হারিয়ে গেছে!


উদাস হয়ে বসে আছি। জগতের সকল নিয়ম ভেঙেচুরে তার হাতটা ধরে ওই হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে চলে যেতে খুউব মন চাইছে। আজ এই মুহূর্তে হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপকে আমার কাছে বড় আপন আপন লাগছে। ইস্‌, যদি যাওয়া যেত, এই জগতের যত কিছু, সব কিছু ছেড়েছুড়ে ওর হাত ধরে এখনই নৌকায় উঠতাম যদি! এত ভালো আগে কাউকে তো লাগেনি কখনওই।


খানিক বাদে খেয়াল করলাম, আমার সামনে দিয়ে ওই যুবকটি আবার হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। এবার জগতের সকল আনন্দ এসে আমার চোখেমুখে ধাক্কা দিল! আমি ঠায় তাকিয়ে আছি তাদের চলে যাবার পথের দিকে। দেখলাম, ছেলেদের হলের রাস্তার দিকে ওরা চলে গেল। বুঝলাম, সে ক্যাম্পাসের হলেই থাকে। একধরনের ভালোলাগায় আবিষ্ট হয়ে আছে মন, প্রাণ, শরীর। তার চলে-যাবার পথের দিকে চেয়ে থেকে যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।


এর মধ্যে সাড়ে পাঁচটার ট্রেন চলে এসেছে। আমি ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অনেকটা খালি ট্রেনটাতে জানলাধারের সিটে বসেছি, আর ওদের চলে-যাবার সদ্যপুরনো পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি, একবার, আর একবার যদি দেখতাম ওকে! হায়, এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ঝনঝন করে ট্রেন চলছে। শরীরটা নিয়ে ঘরে ফিরছি, তবে মনটা রেখে যাচ্ছি ওই অপরিচিত যুবকের বুকপকেটে!


সেদিন সারারাতই কেন জানি ঘুমাতে পারিনি। একধরনের অস্থিরতা, একধরনের সুখ আর ভালোলাগায় আমি বিভোর হয়ে আছি। বন্ধুদের ফোন করে সবকথা জানালাম। বললাম, যে করেই হোক, তাকে আমার চাই-ই চাই। বন্ধুরাও বেশ উদগ্রীব। কাল চলবে আমাদের ‘সার্চ দ্যাট মিস্টার!’ অভিযান। যেকোনও মূল্যেই হোক, তার সব ডিটেইলস আমার জানা চাই। দরকার হলে বছরের পর বছর খুঁজতে খুঁজতে ক্যাম্পাসজীবন বরবাদ করে দেবো! তবুও তাকে লাগবেই লাগবে! সে বহিরাগত হলেও তার খোঁজ আমার চাই!


পরের দিন সকাল সকাল ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে একটা ক্লাস করার পর কিছুতেই নিজেকে আটকানো যাচ্ছে না। ওদের ফোন করে করে ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে পৌঁছলাম জিরোপয়েন্টে। বসে আছি, আর খুঁজছি। আশেপাশে, ডানেবামে, দূর থেকে দূরান্তরে থাকা একটা মানুষকেও বাদ দিচ্ছি না, সবার উপরই চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। এমনকি সামনে দিয়ে যাওয়া প্রতিটা রিকশা, সিএনজি সবকটাতেই কড়া নজরদারি চলছে। কোনওমতেই যাতে আমার চোখফসকে সে গলে না যায়! বন্ধুরাও বেশ উদগ্রীব। কে সে, কেমন সে, কোথাকার, বহিরাগত, না কি ক্যাম্পাসেরই? না, তার দেখা নেই। আমার যেন কোথাও কেউ নেই!


এদিকে দেড়টার ট্রেন এসে চলে যায়, কিন্তু তার দেখা মিলে না। আড়াইটার ট্রেন এসে চলে যায়, তার দেখা মিলে না। চারটার ট্রেন এসে থেমেছে। এবার আমরা হতাশ। ভারি বিষণ্ণতা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চারটার ট্রেনে উঠে গেলাম। জানলার পাশের সিটে বসে তখনও তাকে খুঁজে চলেছি। দুইচোখ দিয়ে পুরো ক্যাম্পাসকে বন্দি করে রেখেছি। তবুও তার দেখা মিলে না! ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ঝকঝক করে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ট্রেনের গতির সাথে সাথে দ্বিগুণ হয়ে বাড়তে লাগল আমার বিষণ্ণতা।


একদেখাতে কী করে একটা মানুষকে এত ভালো লেগে যায়? এ কি ভালোলাগা? ক্রাশ? ভালোবেসে ফেলা? স্রেফ ক্রাশই যদি হতো, তবে সারারাত ঘুম হয়নি কেন? আজ সারাদিন ওই একটি মুখই কেন খুঁজতে খুঁজতে এত অস্থিরতা জাগল? তবে কি ভালোবেসে ফেলেছি তাকে? এত সহজে ভালোবেসে-ফেলা মানুষ তো আমি নই! এ কেবলই ভালোলাগা নয়…মোটেও নয়, এ নিখাদ ভালোবাসা…হ্যাঁ, ভালোবাসাই। নইলে আমার মনটা কেন এত তন্ন তন্ন করে তাকেই এমন উদগ্রীব হয়ে খুঁজে চলেছে? আমার মনখারাপ বাড়ছে, ট্রেনের গতি আরও দ্রুত হচ্ছে। ট্রেনের জানলার পাশে মাথা রেখে এক উদাসদৃষ্টি দূরে, আরও দূরে নিক্ষেপ করে আমি কোথায় যেন তাকিয়ে আছি…


হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা বড়গাছের শেকড়ের গুঁড়িতে চুপচাপ বসে ট্রেনমুখী হয়ে ট্রেনের দিকে উদাসচোখে তাকিয়ে আছে সেই ছেলেটি। আমার পুরো মনপ্রাণ আর শরীর জুড়ে একধরনের ভয়ংকর শক্তি অনুভব করলাম। তাড়াহুড়া করে বন্ধুদের দেখাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন খুব দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে দিয়েছে। নেমে দৌড়ে যাব, সে উপায় নেই।


ট্রেন যতই দ্রুতগতিতে চলছে, ওই ছেলেটি ততই ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে। যতই ক্ষুদ্র হচ্ছে, তাকে দেখার আগ্রহ ততই আমার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ট্রেন অনেক দূরে চলে গেল, এর পর তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।


অদ্ভুত এক প্রাণশক্তি নিয়ে ঘরে ফিরছি। বন্ধুদের সাথে আলোচনা হলো কী করা যায়! যেকোনওভাবেই হোক, ওকে আমার চাই। এই জন্মেই চাই! এই নগণ্য জীবনটাতেই চাই। নইলে যে বড় সাধের এই জীবনটার বারোআনাই ফাঁকি! সিদ্ধান্ত হলো, ‘সিইউ ক্রাশেস অ্যান্ড কনফেশনস’ নামের ফেসবুক-পেইজে তাকে নিয়ে পোস্ট করা হবে। খোঁজা হবে তাকে।


তখন আমার বন্ধুদের ফেসবুক আইডি থাকলেও আমার ছিল না। আমি ব্যবহার করতাম না, করতে জানতামও না। বন্ধুরা সেই রাতেই আমাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। সব শিখিয়ে দিল। আমার আইডি থেকে বন্ধুরা ‘সিইউ ক্রাশেস অ্যান্ড কনফেশনস’ পেইজে তাকে নিয়ে লিখল। ওর যেহেতু নাম জানতাম না, নাম দিলাম ‘দ্য ডার্ক নাইট’। তার আগের দিনের সকল বর্ণনা, ড্রেস, ড্রেসের কালার, তার হালচাল…একেবারে সব কিছুর বর্ণনা দিয়ে ওই পেইজের ইনবক্সে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং সাথে বলে দেওয়া হলো, যদি সে এই পেইজের এই পোস্ট দেখে থাকে, তবে যেন একটা কমেন্ট করে। কমেন্ট করলে তাকে সেখান থেকে খুঁজে বের করে নক দেওয়া হবে।


যে-ই কথা, সে-ই কাজ। ভূরি ভূরি কমেন্ট, ভূরি ভূরি ঠাট্টা মশকরা, নানান আলোচনা-সমালোচনায় ভরে গেছে পোস্টের কমেন্টথ্রেড। এদিকে আমি চেক করেই যাচ্ছি। যারাই কমেন্ট করছে, সবারই আইডি চেক করে করে দেখছি ছেলেটা সে কি না। নাহ্‌! তার দেখা নেই।


অনেকক্ষণ পর একটা আইডি থেকে কমেন্ট এল…আমি নই তো?...আইডিটা খুলতেই দেখি, এই সেই ছেলেটি! রাত তখন এগারোটা ছাব্বিশ মিনিট। আমি হুরররেরেরের, ইউরেকা ইউরেকা বলে সশব্দে চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালাম! পৃথিবী আমার কাছে পুরোপুরি রংধনুর সাতরঙে রঙিন মনে হতে লাগল। বন্ধুদের ফোন করে করে দ্রুতই জানিয়ে দিলাম যে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। এই খুশি আমার সারাজন্মের খুশি! এই খুশি হাতে একটুকরো স্বর্গ পাবার চেয়েও ঢের আনন্দের।


ওর ফেসবুক নাম অনিন্দ্য অব্যয়। অ্যাবাউট সেকশনে লেখা আছে, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে নগণ্য মানুষটি।


খুললাম। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ আইডি থেকে মেসেজ দিলাম।


- হ্যালো মিস্টার সবুজ হিমু!
সাথে সাথেই রিপ্লাই এল, টিয়ারঙের টিশার্টের যাকে খুঁজছিলেন, সে তা হলে আমি?
- হ্যাঁ, আপনিই। আপনাকেই খুঁজছিলাম! ভীষণরকম খুঁজছিলাম! তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম। আপনাকে যতটা নিখুঁতভাবে খুঁজেছি, ওভাবে খুঁজলে আমি একশোএকটা পৃথিবী খুঁজে বের করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আপনাকে খুঁজতে ভারি কষ্ট হয়েছে।
- ইস্‌! টিস্যু লাগবে, কপালের ঘামটুকু একটু মুছে নেন তো! খুব পরিশ্রম করেছেন খোঁজাখুঁজিতে।
- হ্যালো মিস্টার, গত তিন দিন ধরে যে হারে আপনাকে খুঁজতে চেষ্টা ও পরিশ্রম করেছি, সেভাবে খুঁজলে এতদিনে লায়লাও মজনুকে খুঁজে পেয়ে যেত!
- এত পরিশ্রম তো ইট-ভাঙতেও হয় না। বাপরে! তো, কোন ডিপার্টমেন্ট? সেশন?
- আমি ইসলামিক হিস্ট্রি, ১৪-১৫ সেশন, ফ্রেশার। আপনি?
- নেহায়েতই এত খুঁজলেন! কী দরকার ছিল এত খোঁজার? আপনার ডিপার্টমেন্ট থেকে দুইকদম নিচে নামলেই তো আমার ডিপার্টমেন্ট। আমি বাংলা ডিপার্টমেন্ট, ১১-১২ সেশন, নামে ফোর্থইয়ার, তবে ক্লাসে থার্ডইয়ার।
- বাহ্‌ রে, একই ফ্যাকাল্টিতে ছিলেন! ফোর্থফ্লোরে আমি, থার্ডফ্লোরে প্রতিবেশি দেওয়াল হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টকে একটু মাড়িয়ে নিচে নেমেই সেকেন্ডফ্লোরে আপনি, বাংলাতে।! অথচ দেখুন, আপনাকে খুঁজতে ওই জিরোপয়েন্টের ইঞ্চি ইঞ্চি তল্লাশি করেছি। ডিপার্টমেন্ট থেকে নেমে ওই বাংলা ডিপার্টমেন্ট চোখে না দেখে আমি কিনা আপনাকে খুঁজতে যেতাম সেই সাহারা মরুভূমিতে! আহা, ঘরটা আপনার আমার ঘরের একঘর পরেই, আর আমি কোথায় কোথায় খুঁজেছি!
- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে, একটি শিশিরবিন্দু। খাটের নিচেই ছিলাম, অথচ আমাকে খুঁজতে সারাপাড়া তোলপাড় করে দিলেন!
- জানব কী করে, বলুন! আচ্ছা, গতকাল বিকেলে ওভাবে গাছের গোড়ায় বসে ছিলেন কেন অত বিষণ্ণ চোখে? খুব কি মনখারাপ ছিল?
- হ্যাঁ, কিছুটা। আমার আবার রাশি রাশি, ভূরি ভূরি দুঃখ। আমি দুঃখ নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসি। যাক, দুঃখটা বাদ থাকুক! বলুন, আপনার নাম কী?
- স্বাগতা।
- ব্যস্‌? আগে পরে কিছুই নেই? হিন্দু, না কি মুসলিম?
- হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
- হা হা হা হা। আমি কিন্তু মোটেও গোঁড়া নই। জাস্ট জানতে চাইলাম আরকি!
- স্বাগতা রহমান। আরও একটা আছে, জান্নাতুল ফেরদৌস। শুনেছিলাম, আরও একটা নাম আমার ছিল। খাদিজা। বিবি খাদিজার নামানুসারে ওটা রেখেছিল। তবে ওই নামে কেউ কখনও ডাকেনি। এই তো!
- আমার জন্মের আগে পরে এই একটাই নাম---শফিক। গ্রামে সবাই শফিইইক্কা বলেই ডাকে। আপনি চাইলে ওই নামটা টুকে রাখতে পারেন।…ওহহ্‌, আর একটা নাম আছে। দ্য ডার্ক নাইট। এক মেয়ে আমাকে এই নামটা দিয়েছে। হা হা হা হা…
- হ্যালো দ্য ডার্ক নাইট, আমার দেওয়া নামটাকে এভাবে হেনস্তা করতে পারেন না। আপনাকে এই নামেই চিনি, এই নামেই ডাকব।
- জো হুকুম, ম্যাম! আপনার ছবি দেখতে পারি? মনে হচ্ছে, আমি একটা ভূতের সাথে কথা বলছি। দেখলে একটু বুঝতাম যে কার সাথে বলছি, কে আমার জন্য এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে।
- ঠিক আছে। প্রাইভেসি ওপেন করছি, ওয়েট। পাঁচ মিনিট।
- আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলাম। অ্যাকসেপ্ট করুন। অ্যাকসেপ্ট করলে ছবি পাবলিক না করে ফ্রেন্ডস করলে আমি দেখতে পারব। মেয়েমানুষের ছবিতে হালকা প্রাইভেসি থাকা ভালো।
- আপনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট সাদরে গৃহীত হলো, দ্য ডার্ক নাইট। ছবি দেখুন। পাঁচ মিনিটের জন্য ফ্রেন্ডস-করা। আমার লিস্টে কিন্তু মাত্র কয়েকজন ফ্রেন্ড। তবুও হাইড করে রাখি।
- বাহ্‌! আপনি তো বেশ দারুণ। সামনের কাটা-কাটা এত সুন্দর সিল্কিচুলের জন্য সরকারকে আপনি ভ্যাট দেন না? সরকার এখনও আপনার উপর কর বসায়নি? কেন বসালো না? এ তো অন্যায়!
- বাহ্‌ রে, আপনার এত্ত সুন্দর সুন্দর চুল-দাড়ি নিয়ে মানুষ পাগল করে ছাড়ছেন, তাতে যদি সরকারের ভ্যাট না বসে, তা হলে আমার মতো গরীবের চুলে কর বসালে খুব কি অন্যায় হতো না? আগে আপনার অপরিশোধিত বকেয়া ভ্যাটের বস্তা উদ্ধার করা হোক, তার পর নাহয় আমার জন্য কয়েক টাকা করই দিলাম!
- না না, আপনার চুলগুলো বেশি সুন্দর। বাহ্‌! শাড়িতে এত দারুণ আপনি? আমাকে খোঁজার এত কী দরকার ছিল? আমি আপনাকে আগে দেখলে তো কিডন্যাপই করে নিয়ে চলে আসতাম!
- জো হুকুম হুজুর, আমি প্রায় ক্যাম্পাসে যাই, চারতলা থেকে নেমে ফ্যাকাল্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকব, আপনি রিকশা, সিএনজি, হোন্ডা যা-ই পারেন, তা নিয়েই সোজা আমাকে উঠিয়ে কিডন্যাপ করে যেখানে খুশি নিয়ে যাবেন। আপনার কাজ সহজ করে দিলাম। কোনও চিৎকার চ্যাঁচামেচি হবে না, হই হুল্লোড় হবে না, জাস্ট তুলে নিয়ে যেখানে খুশি নিয়ে যাবেন। প্লিজ, আমাকে কিডন্যাপ করুন!
- বাব্বাহ্‌! এই মেয়ে, তোমার কোনও ভয়ডর নেই? সত্যি সত্যি যদি তুলে নিয়ে যাই, করবেটা কী, শুনি? তবে তুমি রাজি না থাকলে তুলে নিয়ে যাবার কথা ভাবতাম, কিন্তু এখন যেহেতু তুমি রাজি, তোমাকে কিডন্যাপ আর করব না। তুমি রাজি না থাকলে সত্যিই তুলে নিয়ে আসতাম।
- বিশ্বাস করুন, আমি একটুও রাজি না!
- হা হা হা হা! রাজি না থাকলে থাক, কিডন্যাপ করব না।
- চিটার চিটার! ওরে বাটপার! এত সুযোগ দিচ্ছি, তাও তুলে নিচ্ছে না। এত সুযোগ কিন্তু আর কেউ দিবে না। সময় থাকতে তুলে নিয়ে যান, নয়তো অন্যকেউ এসে তুলে নিয়ে যাবে, হুঁ…
- কার এত বড় সাহস, তোমাকে তুলে নেয়? খুন করে ফেলব না!
- বাহ্‌! জেলাসি হচ্ছে? খুব জ্বলছে? ভালোবেসেটেসে ফেলেননি তো আবার? প্লিজ প্লিজ, কিডন্যাপ মি! আমাকে কিডন্যাপ করতে যত সহযোগিতা লাগে, সব আমি আর আমার বন্ধুরা করে দিব। আপনি শুধুই কিডন্যাপের প্ল্যানটা করুন। প্লিজ, কিডন্যাপ মি, দ্য ডার্ক নাইট!
- কিন্তু আমি নিজেই তো ঠিকঠাকমতো থাকার জায়গা পাই না, থাকি বঙ্গবন্ধু হলে, তোমাকে কিডন্যাপ করে রাখবটা কোথায়?
- যেখানেই খুশি রাখুন, দরকার হলে আমি আমার বাসায় থাকব, আর আপনি আপনার বাসায়। তবুও আপনি আমাকে কিডন্যাপ করুন। প্লিজ, কিডন্যাপ মি, দ্য ডার্ক নাইট! আই ওয়ানা গেট কিডন্যাপড বাই ইউ! প্লিজ প্লিজ প্লিজ, হেল্প মি গেট কিডন্যাপড!
- এইই মেয়ে, তোমাকে সত্যি সত্যি কিডন্যাপ করব! তোমার নাম্বারটা দাও।
- না, দেবো না, আগে প্রমিজ করেন যে আপনি আমাকে শিওরলি কিডন্যাপ করবেন। প্রমিজ?
- ওকে, প্রমিজ করলুম শেহজাদি, তোমাকে কিডন্যাপ করব একদিন!
- ০১৯১২৪৪১১৩৯, এটাই।
- তোমাকে ফোন করছি, লাস্টে ৬৯।


পৃথিবীর মোট আয়তন কত? ঠিক এই মুহূর্তে মনে নেই। আমার কাছে পুরো পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় বন্দি একটুকরো স্বর্গ মনে হচ্ছে। এত সুখ, এত আবেশ, এত ভালোলাগা এর আগে কখনও অনুভব হয়নি। ছোটবেলা থেকে ভয়ংকর দুঃখকষ্ট সয়ে সয়ে বড়-হওয়া এই আমার কাছে হঠাৎই মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে কোনও দুঃখ নেই। আমার যত সুখ, ভালো থাকার জাদুমন্ত্র ওই একটা মানুষের কাছে বন্দি হয়ে গেল একনিমিষেই!


এভাবেই চলছিল ফোনে কথোপকথন। বাড়ছিল টেক্সটিং। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল দুজনের প্রতি দুজনের আকর্ষণ, অনুভূতি। অনুভব করছিলাম, বাড়ছে প্রেমও।


সে বড্ড সাহিত্যরসে-ভরা মানুষ। সদা হাসিখুশি, রসিক, প্রাণখোলা, নরম মনের। গাইতে পারে বেশ দারুণ। তার কণ্ঠে যেন মুক্তা ঝরে! ওই মুক্তাঝরা গলায় আমি গোটা একটা জীবন মুহূর্তেই উৎসর্গ করে দিতে রাজি!


প্রতি দশমিনিট অন্তর অন্তর অকারণেই একজন আর একজনকে ফোন করি। কয়েক সেকেন্ড কথা বলে রেখে দিয়ে আবার মেসেজে ব্যস্ততা। তখন মেসেঞ্জার ছিল না। চ্যাটিং করতে করতে পনেরো বিশ মিনিট বা আধাঘণ্টার বেশি হয়ে গেলে আবার ফোন করে দুজন দুজনকে দোষারোপ করি। কেন ফোন করলাম না, কেন এতক্ষণ পর কণ্ঠ শুনালাম!


ভালো লাগছে! ওই আকাশ, মেঘ, সন্ধের জ্যোৎস্না, গভীর রাত্রি, সবই ভালো লাগছে। সবই! যা-ই দেখি, তা-ই ভালো লাগে! এই ভালোলাগার মোহে একটাজন্ম অনায়াসে বিসর্জন দিয়ে দিতেও আমার কোনও দ্বিধা নেই। এতটা ভালোথাকা, এতটা ভালোবাসা আগে কখনও হয়নি। আগে কখনও কাউকে এতটা হৃদয় দিয়ে সবটা জুড়ে ছুঁয়ে-যাওয়া হয়নি। যতই দিন গড়াচ্ছে, এ প্রেমের গভীরতা গভীর থেকে আরও গভীর হচ্ছে। সাথে বাড়ছে নির্ভরতা, বাড়ছে বিশ্বাস, আর বাড়ছে মায়ার ঘনত্ব।


আমার ধ্যান, জ্ঞান, প্রাণ সবটা জুড়ে সে। তার সবকটা মুহূর্তকে ঘিরেও আমি। সকাল থেকে গভীররাত, এমনকি ভোর পর্যন্ত চলে আমাদের খুনসুটি। সারাদিন একটু একটু করে কথা হলেও রাত বারোটা বা সাড়ে বারোটার দিকে দীর্ঘসময়ের জন্য কথা হতো। সকাল থেকে রাত অবধি কোথায় কখন কী ঘটল না ঘটল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। সাথে চলত তার সুরেলা কণ্ঠে গলাছেড়ে সেই বিরহীপ্রেমের গান, ভালোবাসার গান। আমি জগতের সবটা মনোযোগ ফোনের ওপারে-থাকা ওই কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে একধরনের অদ্ভুত ভালোথাকায়, ভালোলাগায়, ভালোবাসায় ডুবে থাকি।


দুজনেই ভারি লাজুক ছিলাম। কেউ কারও সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও পেতাম না। আমি ক্লাস শেষ করে কলাঅনুষদের ঝুপড়িতে গিয়ে বসলে, মুখোমুখি আর একটা দোকানে গিয়ে সেও বসত। কেউ কারও দিকে না তাকালেও ঠিকই দুজনেই বুঝতে পারতাম যে আমরা দুজনেই কাছাকাছি কোথাও আছি। বাসায় ফিরে সে ফোন করে জানিয়ে দিত কখন, কোথায়, কোন রঙের জামায়, কোন দোকানে আমি বসেছিলাম। আমিও গড়গড় করে বলে দিতাম যে কখন, কোথায়, কোন পোশাকে, কোন দোকানে সে বসেছিল।


তার পর? তার পর দুজনেই কলকল করে হাসতাম। ওই হাসিতে সত্যি সত্যি সুখ ছিল, ভালোবাসা ছিল। মনে হতো, জীবনে প্রথমবার এত সুখ পেয়েছি। ওই ছুঁতে-না-পারার ব্যথা, কাছে-না-পাওয়ার ওই আকুতিতে রাশি রাশি বড্ড আবেগি প্রেম ছিল। প্রেম এসেছে! হ্যাঁ, সত্যি সত্যি প্রেম এসেছে নির্জনা এই বুক-সংসারটায়!


সেবার গ্রামে গিয়েছিলাম। বর্ষাকাল। গভীর রাত। ঝুউম বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামে সচরাচর মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ভয়ংকর রকমের ঝামেলা করে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কারও সাথে আমার কোনও চ্যাটিং বা ফোনকল হয়নি। বর্ষার কারণে দুপুর থেকে গ্রামে কারেন্টের লাইন চ্যুত, চার্জ না থাকায় অনেকক্ষণ থেকেই ফোনটা অফ। সাড়ে বারোটায় কারেন্ট এল, আর আমি দৌড়ে গিয়ে ফোনটা চার্জে দিলাম।