ফিরে আসি ফের ছায়ার কাছে/ শেষ অংশ

 
এই কয়েক মাসে তাকে ছাড়া আমার একটা ঘণ্টাও কাটেনি। প্রতি ঘণ্টায় কোনও না কোনওভাবে দুজন দুজনের সাথে কানেক্টেড ছিলাম। হয় ফোনকলে, নয়তো মেসেজে। এটাই আমার প্রথম দীর্ঘবিচ্ছেদ। সন্ধে ছটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত! এই কয়েক ঘণ্টার ভেতর কত কত কথা যে হয়ে যেত এতক্ষণে!


কেন জানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। বুকের ভেতর ডুকরে ডুকরে কে জানি কেঁদে কেঁদে উঠছে। ভয়ংকর অস্থিরতায় আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একবার একসেকেন্ডের জন্য একটু করে ওই কণ্ঠটা শুনতে পেলে আমি এই মুহূর্তে বেঁচে যাব, নয়তো শুষ্কতম মরুভূমির পিপাসার্ত কোনও প্রাণীর মতো এখনই মরে যাব, এই মুহূর্তেই মরে যাব! আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, ওপারে থাকা আমার মানুষটিও ঢের অস্থিরতায় তড়পড় তড়পড় করতে করতে আমাকে বারবার মেসেজ করছে, কিছুক্ষণ পর পর কল দিচ্ছে, কিন্তু আমার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছে। ভীষণ অস্থিরতায় আমাকে মনে করতে করতে হয়তো একটু পর পর উদাসও হয়ে যাচ্ছে।


রাত ঠিক পৌনে একটা। মায়ের পাশ থেকে নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরে চলে গেলাম। পরিচয়ের পর সন্ধে সাড়ে ছয়টা থেকে রাত পৌনে একটা পর্যন্ত সোয়া ছয় ঘণ্টার এটাই প্রথম আমাদের এত দীর্ঘ বিচ্ছেদ। ফোন করলাম অস্থির হয়ে। কল রিসিভ হতেই আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। ওপাশ থেকে অস্থিরতায় সে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দে ওপারের ফোনকলে-থাকা মানুষটার অস্থিরতা কমে নীরবতা এল। কেউ কোনও কথা বলছি না। তার নিঃশ্বাসের শব্দে আমার বুকের সবকটা ব্যথা গলে গলে যাচ্ছে। আমার কান্নার মৃদুশব্দে তার নিঃশ্বাস ভারী থেকে আরও ভারী হচ্ছে। আমার চোখবেয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে, আর সে জল আমার সকল অস্থিরতা, তৃষ্ণা মুছে মুছে দিয়ে যাচ্ছে।


সুনসান নীরবতা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর বিজলি চমকাচ্ছে। বিজলির শব্দে হৃদয়ভেঙে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল-ফোনের লাইনে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে-থাকা দুজন মানুষ কাছ থেকে আরও কাছে হচ্ছে। মৃদুকান্নার শব্দ, এর পর দুজনের গভীর মৌন। ওপাশ থেকে কথা ভেসে এল…মনে হচ্ছে যেন কয়েক হাজার বছর পর তোমার সাথে কথা বলছি!


এবার আমার কান্নার শব্দ মৃদু থেকে বদলে জোরালো হয়ে উঠল। মাত্র সোয়া ছয় ঘণ্টা! এই ছয় ঘণ্টার বিচ্ছেদে আমি ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছি! ওপাশ থেকে সে সান্ত্বনা দিয়ে নরমগলায় হঠাৎ গান ধরল…শাওন রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে…


আমি চিরাচরিত নিয়মে তার গলার সুরে চোখ বন্ধ করে সেই সুরের তালে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। এই সুখ এই জীবনের প্রথম আবেশী সুখ, এই প্রেম এই জীবনের প্রথম কলজেছোঁয়া প্রেম, এই ভালোবাসা এই জীবনের প্রথম কাউকে এতটা গভীরতায় ভালোবাসা। ভালো লাগছে। সবই ভালো লাগছে। সে আছে বলে আমার সবই আছে।


মনে হচ্ছে, পৃথিবীর বুকে আমিই একমাত্র সুখীমানুষ। ফোনকলের ওপারের ওই মানুষটি, এপারের এই আমি, আর আমাদের এই স্বর্গসমতুল্য ক্ষণগুলো। ভালো লাগছে, ভারি ভালো লাগছে, সে গান গেয়ে চলেছে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে চলেছি, বাইরে বৃষ্টি, ঝড়ো দমকাহাওয়া, কিছুক্ষণ পর পর বিজলি। আহ! কী মধুময়! কী অপূর্ব মুহূর্ত! কী সুধাময় এই আমাদের দুজনের এই এক হয়ে-যাওয়া! একই সুরে, একই তালে, একই লয়ে আমাদের আজকের এই আনন্দযাপন!


সেদিনের রাতটির পর বুঝলাম, তার প্রতি অদ্ভুত রকমের ভালোবাসার আবেশে আমি পুরোদমে আবিষ্ট। তার সবই আমার ভালো লাগে। তার যত ভুল, যত অপারগতা, যত ব্যর্থতা, যত গ্লানি…সবই ভালো লাগে। তার ভালোমন্দ সবটা নিয়েই আমি তাকে ভালোবাসি। এত বেশি যে ভালোবেসে ফেলেছি কখন, তা টের পাইনি। স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের একটা কুঁড়েঘর হবে, ও ঘরে দুটো মানুষের ছানা থাকবে, তার মতো ভারি মিষ্টি হবে আমার ছানাগুলো। ওরা এঘর ওঘর দাপিয়ে বেড়াবে, সারাটা উঠোন জুড়ে ওদের কলকলানিতে আমার সারাবেলা ভারি ব্যস্ততায় কেটে কেটে সন্ধ্যায় ঘনাবে।


সারাদিনের কাজশেষে আমার গরীব, ক্লান্ত বরটি সন্ধের পর অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরবে। আমি ভারি আদুরে ছোঁয়ায় গামছা দিয়ে তার সকল ক্লান্তি মুছে দেবো। আমার কিছুই চাই না, আমার শুধু ওই মানুষটিকে চাই, একান্ত নিজের করে, আজীবনের জন্য…আপাদমস্তকই। ঘরে অভাব থাকবে, অনটন থাকবে, তবে ভালোবাসায় ভর্তি থাকবে আমাদের সংসার।


এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমাদের স্বর্গীয় দিনগুলো। এক এক করে ছমাস কেটে গেল। সেই সকাল থেকে গভীররাত পর্যন্ত চলত আমাদের খুনসুটি। গভীররাতে ফোন করলে দুজনের খুনসুটিতে হাসাহাসির ধুম পড়ে যেত। সে পৃথিবীর সমস্ত কথার ঝুড়ি নিয়ে ঠিক রাত সাড়ে বারোটায় ফোন করত। বলতে বলতেও তার কথায় কোনও ক্লান্তি বা শেষ নেই। এদিকে আমার শুনতে শুনতেও শোনায় কোনও ক্লান্তি বা শেষ নেই। ভোর থেকে রাত অবধি প্রতি মিনিটে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে বলে যেত…কী কী করল, কী কী দেখল, কী কী করার বাকি যা কাল করতে হবে…আমি তার সবই জানতাম। তার জন্মের পর থেকে এখন অবধি তার জীবনে কখন, কোথায়, কীভাবে, কী কী ঘটেছিল, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আমি জানতাম। তার পরিবার, পাড়া, প্রতিবেশি আমি চিনতাম। তার বন্ধুবান্ধব, হললাইফ, আর্থিক দোটানার জীবন…মোটকথা, তার সবকথাই আমাকে বলতেই হবে…এমন করেই সে ভাবত।


আমাকে তন্নিষ্ঠ শ্রোতা পেয়ে সে বরাবরই চমৎকার বক্তা হয়ে উঠত। সে বলেই চলত আর আমি শুনেই চলতাম। ইচ্ছে হতো, ওই কণ্ঠটা শুনতে শুনতে আমি একটাজীবন পার করে দিই, আর একটা জন্মে কেবল তাকে দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেবো, তার পরের জন্মে নাহয় ওর কথা বলতে বলতে কাটিয়ে দেবো!


প্রতিদিনই বেলা ফুরোয়। একপারে সূর্য ওঠে তো আর একপারে সূর্য ডোবে। একদিন হঠাৎ কী হলো কী জানি! আবিষ্কার করলাম, আমি তার ব্লকলিস্টে! অধীর হয়ে উঠলাম! ভাবলাম, হয়তো তার জীবনে এসেছে নতুন কেউ! অথবা তার জীবনে ফিরে এসেছে আগের জন! ছয় মাসের এই সময়টায় আমার মধ্যে ছয় কোটি বছরের মায়া জমিয়ে দিয়ে সে হয়তো অন্যকারও মায়ার জালে আটকে গেছে! আমার ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে হয়তো অন্যকারও ঘরে ইদানীং সে আলো জ্বালায় হঠাৎ করেই! আমার সবটুকু হাসি ছিনতাই করে সে হয়তো অন্যকারও হাসি হয়ে গিয়েছে! কতকিছুই তো হতে পারে, কতকিছুই তো হয়! কে বলতে পারে!


এদিকে পৃথিবীর সব অবসাদ এসে ভর করেছে আমার জগতটায়। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়লে কেমন লাগে, এর আগে জানতাম না। কোনও কিছুতেই হাসতে চাইছে না মন। আমার একমাত্র হাসির কারণ তো সে-ই ছিল। এর আগে তো কখনও ততটা মনখুলে হাসিনি, যতটা তার একটা মেসেজ পেয়ে খিলখিলিয়ে হাসতাম। কেন জানি একটুও কান্না পাচ্ছিল না সে রাতে। যে রাতে সে স্বেচ্ছায়, অকারণে, না জানিয়ে আমাকে ব্লক করেছিল, সে রাতে খুব চেয়েও আমি কাঁদতে পারছিলাম না।


দীর্ঘ ছয় মাসের অভ্যস্ততায় যে মানুষটির সাথে প্রতি মিনিটে মিনিটে আমার যোগাযোগ ছিল, যার সামান্য বিচ্ছেদেও যে আমি ভারি অস্থির হয়ে উঠতাম, যে মানুষটিকে ছাড়া আমার একসেকেন্ডও কাটত না, সে মানুষটি হঠাৎই পাল্টে গেল! যাবার বেলায় একবার বলেও গেল না ঠিক কোন দোষটা আমার ছিল, কোন ভুলটা, কোন কারণটা, কোন অযোগ্যতাটা আমার আছে বলেই সে চলে গেছে! আটকে রাখতে কখনওই চাইনি বলে আমিও শুধু একবারই তাকে কল করেছিলাম। দেখলাম, তার কন্টাক্টলিস্টেও আমি ব্লকড। সেই একবার ছাড়া আমি দ্বিতীয়বার আর কল করিনি ওকে। তাকে ছাড়াই গোটা একটা দিন কাটিয়ে দিলাম। গোটা একটা দিন তাকে ছেড়ে ছিলাম! দেখলাম, এর পরও কেন জানি কান্না পাচ্ছে না।


সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত আসছে, আমার ভয় বাড়ছে। রাত দেড়টা। এপাশ ওপাশ করে ঘুমাতে চাইছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার বুক ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে, চোখফুঁড়ে, কলিজাভেঙে কান্না পাচ্ছে। যে ব্যালকনিতে বসে বসে সারারাত কথা বলতাম, ওখানে গেলাম। এই তো এইখানেই, এই জানলার গ্রিল, এই গ্রিলের ফাঁকঘেঁষে ওই আকাশ, এই ব্যালকনির কোনায়-থাকা চড়ুইপাখিদের ঘর। ওই কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলোয়, কোনার চেয়ারটায়, দেয়ালের সাদারংটায়, ও-বাড়ির ছাদের কার্নিশটায়, এই ঘোর আঁধাররাতের কালোরংটায়, চাঁদছেঁড়া জ্যোৎস্নার ঝুলিটায়…সব কিছুতেই কেমন জানি তার মুখটা খুঁজে খুঁজে পাচ্ছি! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে!


সব কিছুতেই তার হাসির শব্দ, কথার ঝুড়ি, তার গানের সুর, তার লেখা কবিতা, জীবনের যত অলিগলি সব…একেবারে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছি, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি! হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি! ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কোথাও কোনও জনমানব নেই। আমি বসে আছি এই জনান্তিকে!


চারিদিকের ভয়ংকর রকমের নীরবতায় বুকের ভেতরের পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। না, আর পারছি না! এবার চোখবেয়ে দরদর করে জল নামল। আমি কাঁদছি, হাউমাউ করে কাঁদছি, ব্যালকনির গ্রিল ছুঁয়ে কাঁদছি, চড়ুইপাখির সংসারটা ছুঁয়ে কাঁদছি, ওই বাড়ির ছাদটায় দৃষ্টিছুঁয়ে কাঁদছি, এই রাতগভীর সুনসান নীরবতার বুক ছুঁয়ে কাঁদছি! আমি কাঁদছি আর কাঁদছিই! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি, বুকফাটিয়ে কাঁদছি। আমার খুব একা লাগছে, পুরো পৃথিবীটাকে মরুভূমি মরুভূমি লাগছে। আমি কাঁদছি, কেঁদেই চলেছি। একসময় ভোর হলো, কিন্তু ঘুম হলো না।


ক্যাম্পাসে গেলাম এক সপ্তাহ পর। ওকে খুঁজছি এদিক ওদিক। ঝুপড়িতে গিয়ে বসলাম। দেখলাম, আগের মতোই মুখোমুখি দোকানে এসে বসেছে সে। আমি ওকে দেখেও না-দেখার ভান করে আছি। সে বারবার তাকাচ্ছে। আমি চা খেয়ে বের হয়ে গেলাম। আমার মনে হাজার রকমের প্রশ্ন ঘুরছে। হাজার রকমের অমীমাংসিত জটের উত্তর খুঁজছি। কিন্তু কিছুতেই কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।


জিরোপয়েন্টে সেই আগের জায়গায় গিয়ে বসে আছি, আর জোর করে করে ঠোঁটে হাসি লেপটে রাখছি। খানিক বাদে সেখানেও সে এল। প্রথম যেখানে তাকে দেখেছিলাম, ওখানেই দাঁড়িয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। আমি না-দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও আমার নজর ঠিক তার দিকেই। ইচ্ছে করছে, দৌড়ে গিয়ে ওর গালে মুখে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে দিতে কলার ধরে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুকে শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করি, ‘কোন দোষটা আমার ছিল? কোন কারণে আমাকে এমন বিনানোটিশে ছেড়ে গেলে? কোন গোপন বলতে-না-পারা কথাটা বলতে গিয়েও থেমে থেমে যাও বারবার?


ইচ্ছে করছে, ওকে বুক থেকে ছাড়িয়ে তার বুকে হাত রেখে তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, তার পর বলো, কেমন আছো? কেমন কেটেছে এই কটা দিন আমাকে ছাড়া? ঘুমাতে পেরেছিলে তো ঠিক? আমাকে মনে না করে থাকতে পেরেছিলে তো সত্যিই? প্রতিদিনের সকাল থেকে রাত অবধি জমিয়ে-রাখা কথাগুলো কোন পকেটে রেখেছ? ওসব আমায় না বলে থাকতে পেরেছিল তো ঠায়? হলের ডাইনিংয়ে বাজে খাবারগুলো হজম করতে কষ্ট হয়নি তো? রুমমেট বন্ধুটি ওই মেয়েটাকে পটাতে পেরেছে কি শেষপর্যন্ত? আমাকে ভাবি-ডাকা তোমার জুনিয়র ছোট ভাইটি আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে কি এর মধ্যে? আমচুরি করতে গিয়ে এবারও ধরা খেয়েছ, না? গত এক সপ্তাহে কয় প্যাকেট সিগারেট পুড়িয়ে নিজেকে পুড়িয়েছ, বলো? আমিও যে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি, সে খবর রেখেছ?


…না, আমি এসবের কিছুই করছি না, করবও না। আমাকে ছেড়ে সে থাকতে পারলে, তাকে ছেড়ে আমিও ঠিকই থাকতে পারব।


ট্রেন এল, ট্রেনে উঠে গেলাম, ট্রেন ছেড়ে দিল। সে তখনও রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। আমি চলে যাচ্ছি, ফিরে একবার দেখলাম সে কী করছে। দেখলাম, পৃথিবীর সমস্ত ব্যথায়, অপরাধবোধে ঠাসা ওই চোখ দুটোর দৃষ্টি আমার ট্রেনের বগির দিকে নিক্ষেপ করে ঠায় দৃষ্টিতে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে। ওই চোখে বলতে-না-পারা কী এক কঠিন যন্ত্রণা! ওই চোখের কোনায় লুকানো যন্ত্রণায় বলতে-না-পারা অনেক কথা, বলতে-না-পারা অনেক গল্প যেন খুব স্পষ্টই দেখতে পেলাম।


ট্রেন দ্রুত চলছে, তার দৃষ্টি ঠায় আমার দিকে। ট্রেন চলতে চলতে সে ক্ষুদ্র থেকে নিমিষেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যতই তাকে ছেড়ে ট্রেন দূরে সরে সরে যাচ্ছে, অনুভবে তাকে আমি আরও খাবলে খাবলে জড়িয়ে ধরছি। উপরিভাগে কঠিন রুদ্র-রুষ্ট মূর্তির মুখের অবয়বে, শরীরের ভেতরে তার জন্য কুসুমনরম হৃদয় ধারণ করে রেখেছি। মুখের অবয়বে তার জন্য রাগ, অভিমান, এমনকি ঘৃণার রেশ রাখলেও হৃদয়ে তার জন্য একসমুদ্র ভালোবাসা বেঁধে রেখেছি। সেই অথই জলসমুদ্রে আমি তলিয়ে তলিয়ে যাচ্ছি।


বাসায় ফিরে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম, চড়ুইপাখির ডিমফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে তিনটা, তাকে বলা হয়নি।
ব্যালকনিতে দুটো কাক একজন আর একজনের সাথে ঠোঁটে ঠোঁটে ঝগড়া করেছে আজ বিকেলে, তাকে বলা হয়নি।
পাশের বাসার ব্যাচেলর ছেলেগুলো আজকেও ওদের ব্যালকনি থেকে গান ধরেছে ‘আশা ছিল মনে মনে, ঘর বাঁধিব তোমার সনে’, তাকে বলা হয়নি।
ওই টিয়াপাখিটা আবারও বাড়ির ছাদে এসেছে, কিছুক্ষণ থেকে উড়ে চলে গেল, তাকে বলা হয়নি।
আজ বিকেলে চা বানাতে গিয়ে চিনি বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম, তাকে বলা হয়নি।
পাশের বাড়ির কৃষ্ণচূড়াফুলের গাছটিতে ওদের ভাগের পশ্চিমদিকের ডালটির কিছু ফুল ঝরে গিয়ে আমার ভাগের পূর্বদিকের ডালে নতুন কিছু ফুল গজিয়েছে, তাকে বলা হয়নি।
ব্যালকনির গাঘেঁষে বেড়ে-ওঠা নারকেল-গাছটির চৌদ্দটা নারকেল থেকে তিনটা নারকেল আপনাআপনি ঝরে পড়ে গেছে, তাকে বলা হয়নি।
বাড়িওয়ালাদের এই পেয়ারাগাছ থেকে কিছু দস্যি বাচ্চাছেলে পেয়ারা চুরি করছে…আমি দেখেছি, তাকে বলা হয়নি।
ব্যালকনির যে কোনাটার চেয়ারটাতে বসে বসে কথা বলতাম, ওই চেয়ারটা ভেঙে গেছে, ওখানে নতুন চেয়ার বসানো হয়েছে, তাকে বলা হয়নি।
আমার রুমমেট নুসরাত আর তার বয়ফ্রেন্ড সুমনের মধ্যে গতকাল রাতে খুব ঝগড়া হয়েছে, ওরা আজ সারাদিন কথা বলেনি, তাকে বলা হয়নি।


তাকে বলা হয়নি অনেক অনেক কিছুই। এক সপ্তাহ ধরে জমিয়ে-রাখা অনেক অনেক কথা তাকে বলা হয়নি। আমার এত এত জমানো-কথা তাকে ছাড়া আর কাকে বলি? কে বুঝবে আমার ওসব কথাগুলোর অর্থ…এক সে ছাড়া? সবাই কি আর কপিলার পদ্মা নদীর কুবের মাঝি হতে পারে? সবাই কি আর একজন আপাদমস্তক ‘তুমি’ হতে পারে? সবাইকে কি আর মনটা খুলে দেখানো যায়, যেমন করে দেখাই ওকে? সবার কি আর সেই মনটা দেখতে পারার চোখ থাকে নাকি?


…না না, পারে না। সবাই তোমার মতো করে আমার ‘তুমি’টা হতে পারে না।


ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম, আমি আনব্লকড। কিন্তু কেউ কাউকে মেসেজ করছি না। দুজনের মধ্যেই ইগো কাজ করছে। প্রতিমুহূর্তেই ওর ওয়ালে পড়ে আছি, কেন পড়ে আছি জানি না, জানতে ইচ্ছেও করছে না। ওর ছবি, ওর পোস্ট বারবার দেখছি। কেন দেখছি, জানি না। সারাক্ষণই ওকে দেখছি আমি! তবু ওকে মেসেজ পাঠাচ্ছি না। সেও পাঠাচ্ছে না। আচ্ছা, সেও কি আমার ওয়ালে পড়ে আছে?


দিন গড়াচ্ছে। আগের মতো ক্যাম্পাসে আর যাই না। মাসে একবার বা দুইবার যাই। প্রতিবারই আমি যে দোকানটায় নাস্তা করতে বসতাম, ঠিক তার পাশের দোকানটায় গিয়ে বসে থেকে ব্যথাতুরা চোখে কিছুক্ষণ পর পর সে আমার দিকে তাকাত। ওই ব্যথায়-মোড়ানো চোখের দৃষ্টিতে কী জানি এক বলতে-না-পারা কঠিন গল্প লুকানো ছিল; ওই চোখ, ওই ঠোঁট, ওই চাহনি আমাকে অনেক অনেক কথাই বলে যেত!


আমি নিজের কাজ শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে ট্রেনে উঠে যেতাম। সে ঠায় তাকিয়ে থাকত আমার চলে-যাবার পথের দিকে। আমি গুরুত্ব না-দেবার ভঙ্গিতে এদিক ওদিক চোখ ছোটাতাম, ভাবখানা এমন রাখতাম যেন তাকে আমি কখনও চিনতামই না। যেন ও আমার কেউই হয় না, কিছুই হয় না।


মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে এভাবেই। বিনানোটিশে ছেড়ে-যাওয়া মানুষটিকে ছেড়ে-যাবার পরও ঘৃণা করার জন্য বিন্দু পরিমাণও ঘৃণা খুঁজে পাচ্ছি না। এত খোঁজাখুঁজির পরও তার জন্য কোনও অভিযোগ, রাগ খুঁজে পাচ্ছি না। ওকে আগে যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটি মনে হতো, এখনও তেমন একজন মানুষই মনে হচ্ছে। অভিমানেও, তাকে ভালো না বাসার প্রতিজ্ঞা করেও, তাকে ভালো না বেসে কিছুতেই থাকতে পারছি না। কিছুতেই না, কিছুতেই পারছি না আমি!


আমার পছন্দের কালো টিশার্টটা পরে এখন সে নিয়মিতই আমার সামনে সামনে ঘুরঘুর করে। ক্যাম্পাসের কোনও বড় ভাই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠালে সে খোঁজখবর নিয়ে সেই বড় ভাইকে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে এসে তাকে চিনি কি না জিজ্ঞেস করলে সাফ জানিয়ে দিতাম ওই নামের কাউকে আমি চিনি না। সে খোঁজখবর নিয়ে নিয়ে আমার কাছে যত প্রেমের প্রস্তাব আসত, তার সবকটাই নিজদায়িত্বে ভেঙে দিত। সে আমাকে নিজের করে গ্রহণও করবে না, আবার আমার অন্যকারও হয়ে-যাওয়াটাও সে হতে দিবে না। অদ্ভুত সব কার্যকলাপ ছেলেটার!


এভাবে ফার্স্টইয়ার শেষ করে সেকেন্ডইয়ারে উঠে গেলাম। দুজনে কেউ কারও কাছে যাচ্ছি না, আবার কেউ কাউকে ভুলেও যাচ্ছি না। অদ্ভুত এক নিয়মহীন নিয়মে জীবন কাটছে। আমি ভুলতে চেষ্টা করার পরও ভুলে উঠতে পারছি না, সেও আমার কাছ থেকে দূরে থেকেও আমার পিছু ছাড়ছে না। এভাবে দিন যায়, মাস ফুরায়, বছর গড়ায়। সাথে পাল্লা দিয়ে দ্বিধাও বেড়ে যায়। দুজনের কেউ পরস্পরের কাছে না গিয়েও দুজনের কাছাকাছিই থেকে গেছি…তবে দূরে দূরে থেকেই।


এমনি করে তার ক্যাম্পাসলাইফ শেষ। আমারটা শেষের পথে। আগের মতো সে আর ক্যাম্পাসে আসে না। আমার পিছুও নেয় না। জীবন তাকে ব্যস্ত করে দিয়েছে, এদিকে সময় আমার ক্ষতগুলো শুকিয়ে দিয়েছে। এই আশ্চর্য জাদুকর সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়।


অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও এত চেষ্টা করেও তার জন্য একফোঁটাও ঘৃণাও তৈরি করতে পারিনি। আগের মতোই আমার নিবিড় ভালোবাসাগুলোতে এতটুকুও ছেদ পড়েনি। কমেনি তিলমাত্রও ভালোবাসা। শুধু সীমাহীন বেড়েছে অভিনয়ের দক্ষতা। ‘তাকে আমি ভুলে গেছি, তাকে আমি আর ভালোবাসি না।’ নিজেকে এটা বোঝানোর অভিনয়-দক্ষতা বেড়ে গেছে!


মাঝে মাঝে তার অনেকগুলো কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে। অনেক কিছুই তো জানা হয়নি!


আমার কখনও জানা হয়ে ওঠেনি…
আগের মতো এখনও সে কাশির সিরাপ খেয়ে ঘুমায়?
বন্ধুদের সাথে একসাথে বসে কি অনেকগুলো পেঁয়াজু এখনও খায়?
হলের ডাইনিংয়ের ডালটা খেতে পারে এখন?
ক্যাম্পাসের কাঁঠাল আর নারকেল চুরি করে আর ধরা খেয়েছিল?
ওদের বাড়ির বেড়ালটা বেঁচে আছে আজও?
আমার পছন্দের কালোরংয়ের টিশার্টটা এখনও পরে সে?
কালোরং এখনও ভালোবাসে সে?
গলাছেড়ে সে এখনও কি অঞ্জন-মান্না-নচিকেতার গান করে?
এখনও কি সে খুব সামান্যতেও কেঁদে ওঠে?
নুডলস কি তার এখনও খুব প্রিয়?
রান্না করতে গিয়ে কি সে এখনও হাত পুড়ে ফেলে?
এখনও কি সন্ধে হলে আমায় ভাবে আগের মতো?
এখনও কি খুব মনখারাপ হলে খোলাআকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে সে?
সে কি আজও জ্যোৎস্না দেখতে ভালোবাসে?


শফিক, খুব ভালো আছ নিশ্চয়ই! তোমাকে আমার বলা হয়নি, তুমি চলে যাবার পর জীবনে অনেকেই এসেছে, চলেও গেছে…তবু তোমার মতো করে কেউ এই হৃদয়টা ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
সেই যে তোমার হাত ধরে ভালোবাসা আমার এই শহর ছেড়ে পালিয়েছে, তার পর থেকে আমার এই শহরটায় প্রেমিকের সংখ্যাই কেবল বেড়েছে, প্রেম আর বাড়েনি।
তোমার মতো করে কেউ আমার ভেতরটা খুলে দেখতে পায়নি।


তোমাকে বলা হয়নি, শফিক…
আমি এখনও সন্ধে হলে আকাশ দেখি, এখনও আমি জ্যোৎস্না খুব ভালোবাসি।
এখনও কালোরংটিই আমার প্রিয় রং।
এখনও তোমাকে ভেবে মধ্যরাতে হু হু করে কেঁদে উঠি, এখনও কখনও কখনও তোমার কথা ভেবে বুকে চিনচিন ব্যথা করে।
এখনও আমার শহরে সকাল আসে, বিকেল গড়ায়, সন্ধে নামে, রাত গভীর হয়…একা একাই!
এখনও তোমার ফিরে-আসার পথ চেয়ে কত কত হাত ফিরিয়ে দিই, তুমি ভাবতেও পারবে না!


আমার মাঝে মাঝে তাকে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে। তাকে জানানো হয়নি…
আমার বুকের ডানপাশটায় একটা কালোতিল আছে, বাঁহাতের তালুতে তোমার প্রিয় তিলটা এখনও আছে। এখন আর আগের মতো হাসতে পারি না, আগের মতো কারও ফোনকলের অপেক্ষায় রাত বারোটার পর ভালোবাসায় জেগে থাকি না, আগের মতো আর কাউকে তোমাকে যেমন করে বলতাম তেমন করে কলিজার ভেতর থেকে ‘ভালোবাসি’ বলি না। আগের মতো একটা কুঁড়েঘরের সংসারের স্বপ্ন আর দেখি না, আগের মতো দুটো আদুরেছানার গল্প বুনি না। আগের মতো কারও বউ হবার সাধ আর জাগে না। আগের মতো হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে আর করে না। আগের মতো কারও বুকে গোটা একটা পৃথিবী দেখতে পাই না। আগের মতো আর কাউকে ভালোবাসতে পারি না। আগের মতো সামান্য বিচ্ছেদে হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসাই না। আগের মতো করে…তোমার মতো একজন ‘তুমি’ আমার আর পাওয়া হয়নি যাকে সারাটা দিন সারাটা রাত মুহূর্তেই হাসিমুখে দিয়ে দেওয়া যায়!


তোমাকে হয়তো আর বলাই হবে না…
সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের ভিড়েও একটি মেয়ে তোমাকে খুব মনে করে, প্রতিদিন মনে করে, প্রতিবেলায় সে তোমাকে এখনও ভালোবাসে। এখনও সেই নিখাদ ভালোবাসায় একটুকুও ছেদ পড়েনি!
এখনও তোমাকে একবার পাবার নিশ্চয়তা পেলে সে পুরো দুনিয়া ভেঙেচুরে দিয়ে তোমার কাছে পুরো একটা জীবন হাসিমুখে সঁপে দেবে। আবারও সে হাজার বছর বাঁচতে চাইবে। আবার দুটো ছানার আর একটা কুঁড়েঘরের স্বপ্ন সে দেখবে, নতুন করে সংসারের গল্প বুনবে।


এই তো সেদিন, মাত্র সোয়া ছয় ঘণ্টার বিচ্ছেদে যে আমি অস্থির হয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, সেই আমিই আজ ছয় ছয়টা বছর তাকে ছাড়া অনায়াসে নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিয়েছি! তাকে ছেড়ে থাকতে তেমন কষ্ট হয়নি, তবে তাকে ভুলে-থাকা তেমন একটা হয়ে উঠেনি। আমি আজও শিখিনি কী করে তাকে ভুলে থাকতে হয়! তার সেই চলন, বলন, হাসি, গান, সুর আজও ভোলা হয়ে ওঠেনি। তার মতো অমন নিখাদ মানুষও আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি, আমারও আর কাউকে তার মতো করে কখনও ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি।


জীবন চলছে, জীবন চলেই। সময় গড়াচ্ছে, সময় ফুরোচ্ছে। দিন, মাস, বছর গড়িয়ে ছয় ছয়টা বছরও চলে গেছে!


…আসলেই মানুষ সব পারে!