ফুরায় কেবল মনে

 
এক।

এখানেই আমার জায়গা, এখানে আমাকে
টানটান শিরদাঁড়ায় সামনে এসে দাঁড়াতে হবে।
চিঠির মতোই, তাদের কবিতায় তাদেরও জায়গা রয়েছে এবং
সেখানেও তাদের অবশ্যই সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে।
কিছু ভয়ানক বড়ো মুখ কেমন একটা অচেনা অবয়বে এদিকে তাকাচ্ছে,
তা দেখে মেষশাবকটি ভয়ে আকাশে কুঁকড়ে যায় এবং
চাঁদটাও বেশ গোলমাল বাধিয়ে দেয়। এমন সময় চুপিচুপি হাসা ভাল।
আমি যদি এখনই আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনের এই পর্বতটিকে বিধ্বস্ত করি,
তবে লেখকের কলম থেকে একটি উপন্যাস, নিদেনপক্ষে,
একটি ক্ষুদ্র কালো চিঠি বেরিয়ে আসবে।


আমার নেতৃত্বে অবোধ ভেড়ার একটি পাল চরে,
আমার স্মৃতিগুলিকে তাদের নাম দিয়ে ডাকি,
মুশকিল হল, আমি আজও মানুষকেই ভালোবাসি।
নক্ষত্রের উজ্জ্বল বৃষ্টির নীচে, আমি
সন্ধ্যায় উপবাস করি, প্রার্থনা করি এবং
মৃত্যুর প্রতিটি নৈশভোজে
আমার টেবিলে একটি বিশেষ প্লেট রাখি।
যদি তারা জিজ্ঞাসা করে, আমি স্নিগ্ধভাবে উত্তর
দেবো, আমি পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি, করি বলেই
আমি ভূগর্ভস্থ সমাধির সাদা মার্বেল পাথরে একটি নাম লিখে রেখেছি।


আমি বাতাস হয়ে তোমার আকাশের নীলচোখে ধুলো ফেলে দিয়েছিলাম।
আমি কি সে অপরাধের ক্ষমা পাবো?
আমি সকাল হয়ে তোমার বুকের সকল শিশিরবিন্দু পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধে ক্ষমা চাইছি।
আমি শরৎ হয়ে তোমার দাম্ভিক কাঁধে একটি চিঠি গুঁজে দেওয়ার জন্যও ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
আমি ঘাস হয়ে তোমার পায়ের গোড়ালি বুটের ভেতর দিয়ে স্পর্শ করার পাপ থেকেও মুক্তি চাইছি।
আমি জল হয়ে তোমার উত্তপ্ত অশ্রু ভিজিয়ে দিয়েছি বলে আমাকে আর অভিশাপ দিয়ো না।
আমি ছায়া হয়ে দুর্ঘটনাক্রমে তোমার মুখের উপর আলো ফেলে দেওয়ার কষ্টে নিজেও মরেছি বহুবার, এইটুকু অন্তত বিশ্বাস করো।


দুই।
হ্যামিলনের কিংবদন্তী বাঁশিওয়ালাকে অনুসরণ করে
সে এই ঘোরতর সন্ধেবেলায় বাঁশিতে ফুঁ ঝাঁকাচ্ছে।
আমি তাকে সেই যাদুকরের গল্প শুনিয়েটুনিয়ে কোনওমতে রাজি করিয়েছি।
আমাকে এমন করতেই হল, কেননা এই শহরটিও অভিশপ্ত।
এ শহরের উদ্যানগুলিতে ইঁদুরের উদয় হয়।
তারা জমে আর ক্ষয়ে-যাওয়া জীবনগুলি হজম করে ফেলে।
অনেক রকমের ইঁদুর শহরবাসী ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছে:
ঝামেলার ইঁদুর, দারিদ্র্যের ইঁদুর,
শোকের ইঁদুর, পাপের ইঁদুর,
রোগের ইঁদুর এবং মৃত্যুর ইঁদুর।


ওরা সবাই মিলে সবকিছুতেই কালোরং লাগিয়ে দেয়।
ওরা ঘুমন্ত মাথায় হামাগুড়ি দেয়
এবং মানুষের ঠোঁট কামড়ে ধরে।
এতে মানুষগুলি মারা যায় বা পাগল হয়ে যায়।
আপনি আমি এমন আপদ সরাতে পারব না।


আমার নিরীহদর্শন বাঁশিটি যার হাতে দিয়েছি, সে
যাদুকরের নৈপুণ্যে, দুঃখের বুননে, দারুণভাবে ওটাকে বাজিয়ে দেবে।
বড়ো রাস্তাটার উপর ততক্ষণই সবার চোখ থাকবে, যতক্ষণ
সে মানুষের অভিশাপ ও এক বিলিয়ন ইঁদুর সাথে করে চলতে থাকবে।
সে ধীরেধীরে শুরু করবে, কাঁচামাটির পাহাড় পিছলেপিছলে ওপরে উঠবে।


গোটা শহরের দুর্দশার সমস্তটা গায়েব হয়ে যাবে, যখন
ইঁদুরের বীভৎস স্রোত বাঁশিওয়ালাকে অনুসরণ করে হারিয়ে যাবে।
সন্ধ্যায় ঘরেঘরে লাল আলো জ্বলতে থাকবে, আনন্দউল্লাস হবে, এবং
বাঁশিওয়ালার খোঁজ ভুলেও কেউ কখনও করবে না।


তিন।
সবার থেকে আলাদা শব্দে হেসে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
তোমার কাছে রক্ত খোয়ানোর অর্থই কি লড়াই?
আমি বললাম, আমার লড়াই তো পৃথক লড়াই,
আপনি আমার মুখ থেকে আসলে কী শুনতে চান, বলুনতো?


তিনি শরৎকালের সেই সকালে
তাঁর শোকার্ত চোখ খুললেন। বললেন,
মহামৃত্যুর বর্ণ চেনার আগে
ক্ষুদ্রমৃত্যুর নীরবতা কিংবা লঘুতার চিতায়
নিজেকে নিঃশব্দে তুলে দাহ করতে হয়।


করলাম। দেখলাম, প্রেমিকের দল এই শরৎকালে কোথায় যেন ছুটে চলেছে!
আধোঘুমে আরও দেখি, আমার নাম এবং যে রেখায় নামটা লিখেছিলাম,
দুইই হারিয়ে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে।
পর্বতমালা থেকে রঙ ঠিকরে পড়ছে দেখে
সে রঙে আমি নিজেকে একটু রাঙিয়ে নিলাম।
মনে পড়ল, আজ সবকিছু ভুলে যেতে হবে!
সবকিছুকেই আজ মাফ করে দিতে হবে!


ওরা বলল, শুনুন তবে আগুনের তাণ্ডবধ্বনি!
আপনার মুখটি ধোঁয়ায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে, দেখুন! মনে পড়ল,
সমৃদ্ধ সব পাতার ঘূর্ণি এবং মূল্যবান শরতের বিস্তৃতিকে ঘিরে
ব্যস্ত হতে গিয়ে আমরা কেউই সেই জ্ঞানী বৃদ্ধকে মনে রাখিনি।