বার্থডে-উইশ

আজ একটা জন্মদিন ছিল। একজন বৃদ্ধার ৭২তম জন্মদিন। সকাল থেকেই তাঁর মেজাজ বেশ ফুরফুরে। শরীর ও মন, দুই-ই বেশ চনমনে! তিনি আজ বাড়িতে পুডিং বানিয়েছেন, বড়সড় একটা কেক ও কিছু চকলেটও এনে রেখেছেন। আজ তাঁর খুব খরচ করতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই। ২৭ বছর বয়সের যুবকের গায়ে ধরবে, এরকম ৬টা টিশার্ট আর জিনস প্যান্ট কিনে এনেছেন কাছের শপিংমলটি থেকে। তিনি আজ ভাবছেন, এত সঞ্চয় করে কী হবে? বাঁচবেনই-বা আর কদ্দিন!


ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটির এই রুম থেকে ওই রুমে ইন্দ্রাণী হালদার ক্রমাগত হেঁটেই চলেছেন। উত্তেজনার বশে একই কাজ আজ তিনি দুইবার করে করছেন। প্রতিটি কাজেই বেশ তাড়াহুড়া তাঁর। কীসের সেই তাড়া, তা তিনি নিজেও জানেন না। তাঁর হাতে মোবাইল ফোনটি সারাক্ষণই লেপটে আছে। তিনি সম্ভবত কারও ফোনের অপেক্ষায় আছেন। বুড়ো বয়সে কে-ইবা তাঁকে ফোন করবে!


আসলে তিনি তাঁর একমাত্র নাতি, একমাত্র আপনজন পাভেলের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি জানেন, পাভেল তাঁকে ফোন করবেই করবে! ব্যস্ততার জন্য হয়তো সে এখানে আসতে পারবে না, তবে ফোনে উইশ করবে, ঠাকুরমার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবে। বৃদ্ধার মনে ক্ষীণ আশা, যদি তাঁকে অবাক করে দিয়ে পাভেল এসেই পড়ে! আহা, জীবনে কতকিছুই তো ঘটে, তাই না? স্বপ্ন দেখতে দোষ কীসের?


পাভেল কিন্তু আসলেই ব্যস্ত। কত বড়ো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে সে! সব সময়ই দৌড়ের উপরেই থাকতে হয় তাকে। পাভেল চাইলেও এখানে আসতে পারবে না। ফোনেই ঠাকুরমাকে ‘শুভ জন্মদিন’ বলে সে কাজ চালিয়ে নেবে। সেই কলটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন ৭২’য়ে পা-রাখা ইন্দ্রাণী হালদার।


পাভেল তাঁর ছেলের ছেলে। পাভেলের জন্মের আগ পর্যন্ত তাঁর কোনও ধারণা ছিল না যে, কেউ তার নিজের সন্তানের চাইতেও বেশি কাউকে ভালোবাসতে পারে! পাভেলের জন্মের কিছুদিন পরেই তার বাবা-মা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। এরপর থেকেই পাভেল মানুষ হয় বিধবা ঠাকুরমার কাছেই।


দিনের পর দিন বাবা-মা দুজনেরই ভালোবাসা দিয়ে ইন্দ্রাণী হালদার পাভেলকে বড়ো করেন। নিজের সব বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে শহরে চলে যান, ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নেন কেবল নাতিকে মানুষ করার জন্য। একমাত্র ছেলে ও বউমার মৃত্যুর পর তাঁর পুরো জীবনটাই কেটেছে পাভেলের পেছনেই। তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম, ধর্ম, সাধনা সবই ছিল পাভেলকে ঘিরে। বলা যায়, তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কেবল পাভেলের জন্যই।


পাভেল আজ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। অনেক বড়ো একটা চাকরি করে সে, অন্য একটা শহরে।


তিনি অপেক্ষা করেই যাচ্ছেন। টেবিলের পাশে একটা সোফায় বসে আছেন আর পাভেলের জন্য কেনা পোশাক, খাবার আর চকলেটগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন। পাভেল চকলেট খেতে খুব পছন্দ করে। ওর প্রিয় সব চকলেটই কেনা হয়েছে আজ। উপহারগুলি রং-বেরংয়ের র‍্যাপিং-পেপারে মোড়ানো। দুই সপ্তাহ আগে এক প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা তাঁকে একটি দামি ক্যানডেল উপহার দিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলার ছেলে সুইজারল্যান্ড থেকে এরকম তিনটা ক্যানডেল পাঠিয়েছে মায়ের জন্য।


সেই ক্যানডেলটিও টেবিলের উপর রাখা আছে। আজ পাভেল যদি আসত, কী যে ভালো হতো! যদি সে না-ও আসে, তা-ও তার ফোন পাওয়ামাত্রই ক্যানডেলটি জ্বালিয়ে ইন্দ্রাণী হালদার কেক কাটবেন। এটাই তাঁর প্ল্যান।


দিনটা আস্তে আস্তে কেটে গেল। ইতোমধ্যে সূর্যও ডুবে গেল। সারা দিন এ-ঘরে ও-ঘরে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত ইন্দ্রাণী হালদার টিভির সামনে পুরনো সোফায় ক্লান্তভাবে বসে আছেন। কাজের মেয়েটি কয়েকবার বলে গেছে, ‘দাদি, রাত আটটা বাজে। আর কখন কেক কাটবেন?’ মেয়েটিকে ‘যা এখান থেকে!’ বলে তিনি জি-বাংলায় তাঁর প্রিয় সিরিয়ালটা দেখছেন টিভির ভলিয়্যুম লো করে রেখে। তাঁর তীক্ষ্ণ মনোযোগ হাতের সেলফোনটির দিকে।


তাঁর হাতের ফোনটি একবারও বাজল না।


হঠাৎ! কেউ দরজায় কড়া নাড়ল! তিনি একলাফে সোফা থেকে উঠে দরজা খুলে দেখেন, পাভেল এসেছে! আজকের দিনে পাভেল ঠাকুরমার সাথে দেখা করবে না, এটা কী করে সম্ভব! চিৎকার করে ‘হ্যাপি বার্থডে টু মাই সুইটহার্ট!’ বলেই ঠাকুরমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে বার্থডে-সং আওড়াতে লাগল পাভেল। ইন্দ্রাণী হালদারের মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তাঁর চাইতে সুখী আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তাঁর বয়স দুম করে ৭২ থেকে ২৭ হয়ে গেল যেন! খুশিতে তিনি পাভেলের চোখে গালে চিবুকে চুমু খাচ্ছেন আর রীতিমতো লাফাচ্ছেন!


ইন্দ্রাণী হালদারের চিৎকার শুনে কাজের মেয়েটি দৌড়ে এল। তিনি সোফা থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে কোমরে ভীষণ চোট পেয়েছেন। মেয়েটি আজকের বার্থডে-লেডিকে ধরে ধরে সোফায় বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, আর তখনও তাঁর ভেজা চোখ দুটোর দৃষ্টি পড়ে আছে সেলফোনের দিকে…


রাত পৌনে বারোটা। না, পাভেল এখনও ঠাকুরমাকে বার্থডে-উইশ করেনি।


ইন্দ্রাণী হালদারকে খুব সম্ভবত আরও চৌদ্দ মিনিট কিংবা আরও তিনশো পঁয়ষট্টি দিন চৌদ্দ মিনিট অপেক্ষা করে বাঁচতে হবে উইশটা পেতে চাইলে।