বিভাবের দ্বৈরথে

 
কখনো-কখনো, ভেতরের আমি’টা কীসব যে করে!
বাইরের কোনো এক আমি’কে ডাকে, মিতালি গড়ে।
সেই ‘আমি’ আসে, কিন্তু থাকে না।
আসে আর আসে, অথচ যায় না রাখা।
কী এক কুণ্ঠায় ফিরে যেতে-যেতে বলে,
“তবে কি সত্যিই দেবে না থাকতে?
এই আসাযাওয়াই আমার নিয়তি?
ভেতরের ঠাঁই বাইরে মেলে কি হায়?”
শুনি, আর ভাবি,
“বলেছিলে যে তবে, আছ?
ছিলে না কখনোই?
আছ, এই ভুলেই কাটছে সময় অসময়?
জানো, এমন দ্বিধার রেশটুকুও আসেনি কখনো! এতোটাই অভিনেতা হলে!
এমন অভিনয় শত জন্মের পুণ্যে আসে? নাকি, পাপে?”
কী এক অসীম সম্পীড়নে
সে ‘আমি’ কিছুই বলে না।
কারো-কারো কাছে, সময়ে-সময়ে,
পৃথিবীর সকল ভাষাই অথর্ব হয়ে রয়,
নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে, অশ্বত্থের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়।
সেসময়, আর কিছু নয়, একটা বর্ণের জন্য অপেক্ষাও যে কতটা অসহায় করে দিতে পারে, কে বুঝবে!
 
কল্পনা থেকে বাস্তব? নাকি, বাস্তব থেকে কল্পনা?
কোন পথে জীবন চলে?
এই দ্বন্দ্বেও কাটবে প্রহর, আগে ভাবিনি।
বাস্তবের অবসাদে কল্পনাও ঝিমোয়, আর
ছুটির দরখাস্তটা টেবিলে রেখেই ছোটে, পালায়--
পাছে ‘না’ বলে দিই!
কল্পনার উদ্ধত প্রতর্ক বাস্তবের অভিক্রমণ আর বিদ্রূপে মাতে।
ইদানিং আর ‘না’ বলি না। সঙ্গী হয়
নিষ্প্রাণ চোখ, অচৈতন্য মন, নিথর শরীর।
যে দৃষ্টির প্রাণ গেছে, সে দৃষ্টিতে আবার কীসের আহ্বান?
যে মন পাথরেবাঁধা, সে মন স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখায় না।
শরীরছোঁয়া বাস্তব মনছোঁয়া কল্পনার গলাটিপে ধরে!
 
আমি কিছুই বুঝি না বুঝি?
এই ভেবে কেউ যদি ভালো থাকে, থাক্‌!
মনের ইচ্ছেটা তীব্র; স্বীকার করছি, শরীরেরটাও।
আমায় যে ভালোবাসে না, তাকেও ভালোবাসাতে পারি।
আর যে ঠকায়, তাকে কাছে টানি কীকরে? কোন মায়ায়? কীসের আশায়?
প্রবঞ্চকের সাথে হাঁটা যায় বড়োজোর। থেকে যাওয়া কি সম্ভব?
বোকা সেজে আছি বটে, বোকা তো আর নই!
 
নিজের সাথে খুব যুদ্ধ হয়, আগেও হতো।
সে যুদ্ধ ছিল ধরে রাখার, আর এ যুদ্ধ যেতে দেয়ার।
হায়, দুটোতেই আমার ছোরার ওই প্রান্তে আমিই!
যুদ্ধটা করে যাচ্ছি, যাবোও।
যতক্ষণ পারি, যতটা পারি, যেভাবে পারি।
চলে যাবো, আর ফিরবোই না। সেও ভালো!
যে নিঃশ্বাস প্রতি মুহূর্তে বাঁচিয়ে রাখে, তার দেখা কে পায়?
যে আকাশ আমার সমস্তটা ছোঁয়, সে তো আমার ছোঁয়ারও বাইরে।
শরীরী স্বার্থপররাই হৃদয়জুড়ে থাকে, অন্যরা বাঁচে অকারণ তাচ্ছিল্য আর বিরক্তিতে।
ফেরার জন্য বাঁচা? নাকি, বাঁচার জন্য ফেরা?--এ প্রহেলিকায় সময়চোরকে কত আদরে ডাকি!
 
রাতে, থেমে-থেমে, বেহালার সুর আসে ভেসে...
করুণ সে সুর ভাসায় কে? নাকি, এ কেবলই ভ্রম?
কাউকে ডেকে জানতে ইচ্ছে করে।
ডাকি। হায়! কেউ যে নেই!
নেই-রাজ্যের মাটি আর বাতাস অহেতুকই ভারি হতে থাকে।
 
কষ্টজল কেন হায় চোখ দিয়ে ঝরে?
জলের দাগ মুছলেও ইতিহাসটা যায় না মোছা! অক্ষয় হয়ে রয়ে যায়।
তা কেউ কি বোঝে?
দেখা চোখ সহজ যত, বোঝা চোখ শক্ত ততই! দেখার মানুষ কতশত, বোঝার মানুষ কই?
সময়ের নৌকোয়, তারায়-তারায় আকাশ পাড়ি দিই,
কারো কাছে, এই-ই ভালোবাসা, কারো কাছে বা স্রেফ পাগলামো, হয়তো মূর্খতাই!
যে যা বলুক, আমি তো জানি, এক এই বাঁচাই অন্ধকারে বাঁচা!
এক জীবনের সব কষ্ট কাগজপোড়া গন্ধে মিলাক!
এই জন্মে নাহয় বেঁচে পুড়ি, ওই জন্মে পুড়ে বাঁচবো।--কথা দিলাম পাক্কা!
 
ভালোবাসা দেয়া বা নেয়া--দুটোই আশ্চর্য জাতের নির্দয়তা।
এ সত্য কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না, কেউ বুঝেও বোঝে না।
এই রাতে আমার মন আর ওই তেলাপোকাটার শরীর---দুইই জেগে, দুইই অস্থির, অতএব, দুইই একই!
সম্পর্ককে--কেউ দেয় নাম, কেউ দেয় প্রাণ। দুই দলই কষ্টে পোড়ে।
নাম শুধু এক মন মনে ধরে যদি, সে সম্পর্ক কাঁদায় তবে।
যে প্রাণ শুধু এক প্রাণ হতেই বয়, সে প্রাণ প্রাণটাই নেয় কেড়ে।
জীবনটা হোক মিথ্যে, তবু জীবনের সবকিছু সত্য হয়েই বাঁচুক--এই বোধে
প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডও শতাব্দীর যন্ত্রণা দিচ্ছে। সময়ের অকরুণ দুঃসাহসে
কারো জন্য--হোক ভুল কেউ, তবুও, সেই কারো জন্যই
নিজের মধ্যে জমেথাকা অনুভূতির একগুঁয়ে দেয়ালটা ভাঙতে না পারার কষ্ট...
 
বেশ বুঝছি, মনটা এবার শোধ নেবে শরীরের ওপরই।
নেয় নিক, তবু, আর ফিরে যাবো না।
যে অনুভূতির যোগ্য যে নয়, যা নয়, সেই পাত্রটি ওই অনুভবে নিলে
বড় পাপ হয়। অমন পাপে, ক্ষমা চাওয়াও যে পাপ!
এক মৃত্যুর জীবনের চেয়ে বরং এক জীবনের মৃত্যুতে জীবন খুঁজে নেবো!
 
না হোক দেখা
না হোক কথা
না হোক কিছুই লেখা...
তবু, রোজ নোনাজলে
‘তারে’ ঠিক বাঁচিয়ে রাখা।
জীবনের খোঁজ নেই, অথচ এই জীবন-জীবন খেলা!
 
ভাবি, কখনো মানুষ সত্যিই ভালোবাসতে শিখে গেলে মারণাস্ত্র ব্যবসায়ীরাও কবিতা বেচবে।