বিভোর সম্বিতে ফেরা-১

 এক।
মেঘের চোখে চোখ রেখে যাই,
বর্ষাতে ধুই সবকিছু আজ--
রাগ, অভিমান, আর অনুযোগ।
রাগ অনুযোগ থাক বা না থাক,
অভিমানটা খুব প্রয়োজন।
নইলে জীবন হারায় যে তার সব আয়োজন!
বৃষ্টি কেন নোনতা জলে,
ধোয় অভিমান, মায়া রেখে যায়?
মায়াই বাড়ায়, ভালোবাসাকে নেয় না সাথে,
বৃষ্টিজলে বৃষ্টি ভাসে মায়ার বানে।
 
প্রভুর কাছে মিনতি করি,
মায়ামমতা ছাড়ুক আমায়,
ভালোবাসাহীন নিস্প্রাণ জড়--হই এবেলা!
বাঁচতে জানি কেমন লাগে! ভুলেই গেছি!
প্রার্থনা হায় পৌঁছে কোথায়, পাই না খুঁজে!
আমার চাওয়ায় ফাঁকটা শুধু তিনিই জানেন,
আমায় দেখে মুচকি হেসে বলেন কেশে,
বৃষ্টি কেন চাইছো বাপু?
অল্প খরায় ভালোই আছ, যাচ্ছে দেখা!
এমনি করে প্রার্থনারই রাস্তা ধরে প্রার্থনা হায় যায় যে মরে!
নির্দয়তায় জীবনবাজি আর ধরি না,
প্রার্থনাতে বাঁচার নেশা আর সরে না,
কী হাসিতে জীবন কাটে অচেনা সাজে মৃত্যু খুঁজে!
 
দুই।
অবাক চোখে আমায় দেখে শুধাও যখন,
কেমন আছ?
তোমার চোখে আমায় দেখে ভাবতে বসি,
অদ্ভুত এই ভুলগুলো,
চোখের তারার ফুলগুলো--
উদাস হাওয়ায় উড়তে থাকে আনমনা।
তোমার ছিপ নৌকোর যাত্রী যখন ওই মেয়ে,
আমায় কেন ডাকো বলো, কী পেয়ে?
ভালো তো বাসি, জানো ঠিকই!
জানতে যখন না চায় ও মন,
তবুও কেন এই অকারণ বিনয়-পাশে আমায় বাঁধো?
ভেবো না অতো, বিরহে আমি বেঁচেই থাকি!
পৃথিবী নাহয় ফাঁকিতে ঘোরে,
মন কি ঘোরে ভুলের জোরে?
 
সেই কবেই তোমার হাত ছেড়েছি!
আমি এখন ভালোই থাকি,
কী লাভ বলো, খারাপ থেকে?
কেন তবু আজ
মিছেই তোমার সময়টুকু নষ্ট কর
লোকদেখানো ভদ্রতাতে?
বৃষ্টি কখনও--আমায় ভেজায়--অনিচ্ছাতেই।
কখনও আমি--বৃষ্টি মাখি--অনিচ্ছাকে লুকিয়ে রাখি!
দুই নাটকেই শরীর ভেজে--একই তেজে।
আমি বৃষ্টি গিলি, বৃষ্টি নামাই,
বৃষ্টি আমায় যেমন ভেজায়, আমি তেমন বৃষ্টি ভেজাই।
যুদ্ধ সন্ধি সমান-সমান।
 
তিন।
কতটা আর সরাবে, বলো?
দূরেই তবে রেখো, প্রিয়।
পারবে কি আর জিততে শেষে?
ঠিক যতটা রেখেছি তোমায় বুকের কাছে,
জিততে হলে--
ঠিক ততটাই আমায় দূরে রাখতে হবে! পারবে, বলো?
হাসছ নাকি? এই আমিও হাসছি, দেখো! দুই হাসিতে অনেক ফারাক!
পারবে নাগো রাখতে আমায় অমন দূরে,
যেমন কাছে তোমায় রাখি আপন সুরে।
কখনও তুমি জানবেও না,
ঠিক কতটা ভীষণ কাছে,
নিভৃত এ হৃদয় মাঝে তুমি বাঁচ।
তাইতো বলি, আমায় ঠেলে ঠিক ততটা দূরে সরানোর চেষ্টা তোমার
বৃথাই কেবল।
এই যে এমন দূরে ঠেলো,
তোমার এমন তাড়া আমায়
তাড়ায় না আর আগের মতো।
তোমায় দেখি, কেবল হাসি,
সে হাসিতে অশ্রু শুকোয়,
বুকের ভেতর রক্ত লুকোয়।
 
অস্থিরতা কীসের অতো তোমার, বলো?
রেখেছ আমায় যোজন দূরে,
পাছে যদি আসি কাছে মনের ভুলে,
একটু হেসে তোমায় বলি,
খুব ভালো ঠিক আছ তো?
সে ভয়েতে জেগে থাক,
ঘুমকে তাড়াও, নিজেও ছুটো!
আহা অমন ভাবছ কেন?
সত্যি বলছি, সত্যি দূরেই বেঁচে আছি!
আমায় তুমি থামতে বলো,
হৃদয় ছেঁড়ো, শেকল বাঁধো,
জীবন কি আর থামে, বলো?
থমকে আবার ছুটতে থাকে!
এ দুনিয়ায় স্থায়ী কী আর দুঃখ বাদে?
তা-ই যদি হয়, ধরেই নিলাম,
সব অনুভব হারাবে যেদিন অভিমানে,
মনটা সেদিন ভুলবে সবই,
হোক না সেটা মিথ্যে করেই!
আমি নাহয় থাকব ভুলে,
অবহেলা আর বিস্মরণে,
এই যত প্রেম নিয়েছ ভরে,
ভুলবে সবই কেমন করে?
হাসছ, না, খুউব?
ভাবছ হেলায়, মনে রাখার কী-ই বা আছে!
কাজের ভেলা ভাসিয়ে নেবে তোমায় নাহয়,
তবু কালের খাতায় সব লেখা রয়--মাথায় রেখো!
 
চার।
আমি লিখি, তুমি পড়।
তুমি লিখ, আমি পুড়ি।
সবাই ভাবে, চায়ের ছোঁয়ায়
ঘুমকে তাড়াই...
আর কেউ নয়, আমিই জানি--
চুপিসারে
কার যে নেশায়
ঘুমটা পালায়...
ঘুমের সাথে সেও ঘুমোয়,
এ রাত জাগে, আমি জেগে রই।
আজও তবু
কিছুই তাকে হয় না বলা,
সব কথাকেই গিলে ফেলি লোনাজলে,
মনের কথা, মনের গাথা,
অযত্নতে মনের কোণেই থাকে পড়ে...
উপহাসে আর অবহেলায় কান্না মাপি।
আকাশ দেখি,
তাকিয়ে থাকি চুপটি করে,
কখনও হঠাৎ ইচ্ছে করে,
প্রাণটা খুলে, মনকে মেলে
আকাশটাকেই তুমি ভেবে কথা বলি!
 
দ্বৈতসত্তা শব্দে হাসে হোহো করে!
চমকে উঠি! হচ্ছেটা কী?
চোখ ভিজে যায় কেমন করে,
এমন সময় হঠাৎ দেখি,
মেঘ সরে যায়, আকাশ সাজে আমার রঙে!
দ্বৈতসত্তা সংশয়ে তার মুখটা লুকোয়,
ক্ষণিক পরে একটু হেসে আমি ভাবি,
জড়ও বুঝি মনকে বোঝে!
খারাপ সময় আশপাশটা
যতই ঘিরে,
মনের ভেতর
প্রিয়রা যেন
ততই ভিড়ে!
এ কী যাদু!
শূন্যতাকে হাতড়ে ফিরি,
ক্লান্ত মন শান্তি হারায়,
শূন্য তবু পূর্ণ ভেবে,
মনকে ভরাই, মৃত্যু ফেরাই!
 
পাঁচ।
বলবে কিছু? চোখে বোলো না, মুখে বলো।
কত শতবার ফিরে গিয়েছে প্রশ্ন কত--নিরুত্তরেই!
সময় পেরোয়, সময় ফুরোয়,
নিশিত তবু কিছু বলে না।
সময় রথের চাকা ক্ষয়ে যায়, ছোটে দ্রুত।
ব্যগ্র নিশি আবার শুধোয়,
কিছু তো বলো! হোক মন্দ, কিংবা ভালো!
বসেই আছি কখন থেকে! জেনে বলছি, সুযোগটুকুও আর পাবো না! অপেক্ষাতেও বাঁচা লাগে!
নিশিত বলে, বলছি শোনো...
তবু সে হায় কিছু বলে না!
যাচ্ছি, যাবো বলতে-বলতে
নিশি একদিন
পালিয়ে বাঁচে।
আর কখনও হয় না ফেরা,
এমন দেশে লুকিয়ে থাকে,
যে দেশ থেকে যায় না ফেরা।
 
সময় ছোটে স্মৃতির ফাঁকে,
নিশিত কখনও ভাবতে থাকে,
সত্যি নিশি হারিয়ে গেছে?
সবই জানে, সবই বোঝে।
তবু একদিন খেয়ালে হঠাৎ
ঠিকানা নিশির খুঁজতে থাকে।
মিলবে না খোঁজ, তবুও খোঁজে!
নিশীথিনী নামলে পরে
নিশি আসে--নিশিত দেখে।
আমার কাছে প্রশ্ন যত,
উত্তর সব নিয়ো খুঁজে
আমার সব লেখার মাঝে--যা লিখেছি, পুড়িয়েছ যা।
বলতে চাও আমায় কিছু? আজও কি চুপ হয়ে বাঁচো?
আমায় যদি বলতে না চাও,
বলে দিয়ো ওই আকাশটাকে।
কান পেতে সব নেবো শুনে যতন করে।
ঘুমের ঘোরে নিশিত কাঁদে,
বিড়বিড়িয়ে হঠাৎ জাগে! ‘নিশি’ ‘নিশি’ ডাকতে থাকে।
এরই আগে--ভালো থেকো, ভীষণ ভালো!
এটুক বলেই নিশি কোথায় যায় মিলিয়ে...
নিশিতের ধ্যান ভেঙে যায়, ভ্রম ছুটে যায়।
কত কিছুই বলতে সে চায়, হয় না বলা
কোনও কিছুই!
নিশিত শুধুই আপন মনে আকাশ পানে
রয় তাকিয়ে।
রাতের সাথে অশ্রু ঝরে সাক্ষী হয়ে।
সময় গেলে অসময়ে ভালোবাসা কষ্ট মাপে!
 
ছয়।
আমি হারিয়ে গেছি যে আমি’তে,
সে আমি’কে সঙ্গে করে
লাভ কী বলো, কাছে এসে?
তাইতো আমি তীরেও ভিড়েও ফেরাই তরী যতন করে।
আমার চোখে চোখ রেখো না ওই অনীহায়,
আমি করুণা ছাড়াই বাঁচতে জানি,
ভালোবাসায় ডুবতে জানি একা-একাই।
বুঝে গেছি--
বাস্তবতায় বাঁচা ভালো,
কল্পনায় ভাসাও ভালো।
বাস্তবতা জেনেবুঝেও
কল্পনায় ভাসতে গেলেই বিপদ বড়,
কোত্থেকে যে কষ্ট এসে ভারটা বাড়ায়!
যেচেসেধে অমন করে ভাসতে গেলেই নষ্ট জীবন একেবারেই!
জীবন ডোবে, মরণ ভাসে।
কিছু মানুষ ডুবেও বাঁচে।
অমন বাঁচাও ভয়কে মারে!
সেই সাহসে ভর করেও জীবন সাজে।
 
আলোকপানে চাই কি না চাই,
তোমার মাঝেই পথ খুঁজে পাই।
আলোআঁধার আর মেঘমেদুরে,
উষ্ণশীতল সব আদরে,
তোমায় ভেবে দিন কেটে যায়
নানান কাজের অবসরে
কত রঙের স্বপ্ন আঁকি...
রাত্রি নামে এই দুচোখে,
তোমার সাথেই ছন্দে মাতি,
নতুন করে বাঁচতে যাচি,
তোমার তরেই নিত্য সাজি।
ফিরেও যদি না দেখো তা,
চোখজোড়া যে আর হাসে না,
উদাস নয়ন জলেই ভাসে।
বোঝো সবই, তাও বোঝো না।