বিভোর সম্বিতে ফেরা-২

 সাত।
অনুভূতি--বাধা মানে না,
আবেগ--বাধা শোনে না,
মনের এ দুই অবাধ্য সন্তান--এ নিয়েই মনযাপন।
আজ ভালো থাকার প্রার্থনা নয়, ভালো থাকতে হলে, যা যেমন দরকার আর যতটুক, তা তেমনই হোক আর ততটুক--এই প্রার্থনা।
সম্পর্ক হোক দীর্ঘ ঠিক ততটাই--যতটা হলে দুজন মানুষ নিজেদের মতো করে ভালোথাকার বোঝাপড়ায় চলে আসে।
এই অজ পাড়াগাঁয়ে এমন শান্ত মায়াবী সকালে,
রোজ এক ছোট্ট মেয়ে আসে, একটা করে লাল গোলাপ দিয়ে যায়।
এই অকারণ নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়, কিছু কষ্ট দৌড়ে পালায়!
ভালোবাসার এই হাতবদলে মন চুপিসারে শুধু বলে যায়--জীবন সুন্দর...
কখনও কেমন করে ভাসায় নদী,
কখনোবা ভাসিয়ে নেয় তার জলহীন রেখা,
জলের এমন তীব্রতায় মনের শরীর হয়তো বেঁচে পালায় ঠিকই,
তবু তার রেখার তীক্ষ্ণতায় ঠিক ঝরে যায় রক্তধারা কোন গোপনে...
সময়ের দৌড়ে...সময় ক্লান্ত...
সময়ের অপেক্ষায়...সময় অস্থির...
 
বাকি সব...সবকিছু
নাহয় থাকুক দূরে—ওই দূরেতে,
কেবল দুচোখে চোখ রেখে আজ
এ দৃষ্টির তেষ্টা মেটাতে
কেটে যাবে যুগ শতাব্দী ঘুরে
কী অনায়াসে!
তীক্ষ্ণ রোদে পোড়ে রৌদ্র,
আজ চুপিচুপি বৃষ্টি বলে--আসছি আমি, থেকো প্রতীক্ষায়!
প্রকৃতি তার সীমা ছাড়ায়--
প্রতি মুহূর্তেই--সুন্দরে!
আমিও যে হায় আমায় হারাই--
লজ্জা ডুবাই--দুঃখ বাড়াই!
সামনে তোমার আমায় টানি,
ভালোবাসি তাই প্রেমকে মানি,
আমায় না চিনে তোমায় জানি।
যতই আমায় করো অপমান,
দূরে ঠেলে দাও ভুলে সম্মান,
তবু ভালো থেকো নিজের মতো,
আমি ভালো আছি, থাকব ভালোই।
তুমি বিনে পয়সায় কষ্ট বিলাও,
আমি জীবন দিয়ে কষ্ট কিনি।
কষ্ট মনে, মুখে হাসি,
এইতো আমার ভালোথাকা--ভুলে সব কিছু--মান অপমান।
থাকই জানি, বলছি তবু, তুমিও ভীষণ ভালো থেকো।
 
আট।
স্থির আমি তাই,
অপলক চোখে চেয়ে থাকি,
নিভৃত কোণে নীরব ব্যথায় ডুকরে কাঁদি,
আড়ালে তবু তোমায় ঢাকি।
এসব কথা খুব হিসেবে মিলিয়ে নিও সেদিন তুমি,
যেদিন আমায় খুঁজে পাবে না--বিস্মৃতিটাও হাতড়ে দেখো!
যন্ত্রণাকে নিংড়ে নিয়ে সুখের মন্ত্রে দুঃখে বাঁচি,
সবাই বলে, জীবন নাকি ভালোই দামি,
আমি ভাবি, কোনটা দামি? জীবন, নাকি, আমি-তুমি?
মীমাংসাটা সেদিন করো,
যেদিন আমি চলে যাবো অভিমানে অনেক দূরে।
কেমন আছো?
কী দরকার জানতে চাওয়ার?
হাজার প্রশ্ন অবহেলায়--মুক্তি পেলো,
স্রেফ ওইটুক প্রশ্নঘুড়ির নাটাইটাকে
রাখছ কেন বেঁধে মিছেই আকাশে তোমার?
দাও না ছেড়ে ওই দায়টুকুও,
কী-ই বা এমন যাবে এসে?
‘শুভ সকাল’কেও মুক্তি দিলে কী-ই বা হবে?
তোমার এসব প্রেম-অভিনয় আমার কাছে জীবন, জানো?
হয়তো বলবে, কী ভীষণ বোকা! বুঝবে কবে, প্রেম কোনটা, কোনটা ধোঁকা!
আমি নাহয় হাসিমুখে বোকাই রবো! কী করবো বলো, ভালোবাসি যে!
 
সবাই কেমন চুপ হয়ে যায়!
এদের কিছু নেইতো বলার,
তাই এরা চুপ।
আবার ওদের দেখো, অনেক কিছু বলার আছে,
তাই ওরা চুপ!
নানান কারণ নানান ঢঙে কথা কেড়ে নেয়,
তবুও সবাই সাথেই আছি, গন্তব্য এক!
যেমনি কথা কাছে টানে,
নীরবতাও তেমনি আনে--
দূরের মানুষ অনেক কাছে।
আমি নাহয় সব মেনে নিই,
প্রকৃতি যে হায় মানে না কিছুই!
শ্রাবণ যখন অঝোরে ঝরে,
তবুও তখন হয় না কিছুই,
প্রতীক্ষাটা আকুল হয়ে ভীষণ ভাবায় কখনও হঠাৎ!
সুদূর পৌষের শিশিরভ্রূণ
মনকে কেন করে ব্যাকুল? কোন স্বপ্নে? কীসের নেশায়?
বিদ্যেজাহাজ, বলতে পারো?
আমার যতো রৌদ্রসকাল--কুয়াশাভেজা,
বাঁকা চাঁদরাত আঁধারে-ঢাকা।
এমনটা হয়। বোঝো কিছু?
 
নয়।
দাঁড়িয়ে আমার এই সীমানায়,
মেললে দুচোখ, কিংবা হৃদয়,
আর কিছু নয়, তাকেই দেখি।
তার সীমানায় সে-ই থেকে যায়,
আর কেউ নয়।
সেখানটাতে দাঁড়িয়ে আমায় যায় না দেখা।
আপন মনে নিজের সাথে বলি,
তবে সারাদিন আর সারাবেলা,
আমার সকল কাজের মাঝে
এই যে এত গল্প করি, স্বপ্ন দেখি,
সে কার সাথে?
কার আদরে কোন সুখেতে আমি মাতি?
অভিমান হয় কার উপরে?
আজ কেন হায়,
নিজেকে দেয়া শাস্তিতে,
কষ্টে বাঁচি ক্লান্তিতে!
কার সাথে তবে রাত হয় ভোর,
কোন কবিতার পঙক্তিতে?
 
আমার যত কল্পনায়, রঙ মিশিয়ে আলপনায়,
রঙিন করে কে মেখে দেয় স্বপ্নগাথার জাল বোনায়?
মনের মাঝে পাথরে-গড়া সে ঘরে
তবে কে বাঁচে ভালোবাসায় নিশ্চুপে?
রোজকার এত এই লোনাজলে যাই ভাসি,
জীবন শুধু গল্পে ফুরোয়, স্বপ্ন শুধু কষ্ট কুড়োয়,
তবু হাসি আমি কার আশে?
কখনও হঠাৎ আবছা হাওয়ায়,
কেমন নেশা মন যে দোলায়,
আমি আসি, দিই দেখা।
নোংরা হাসির তীক্ষ্ণ বাঁশি
যায় বেজে, ক্লান্তিও নেই--যায় ভেঙে সব কিছু!
দ্বৈত বলে, ভালোই তো বেশ!
ওপার থেকে উড়ে চলে আসা দৃষ্টিতে--
খুঁজে পাবি না তুই তোকে।
আলোআঁধারি খেলছে যেটুক,
খেয়াল করিস, সামলে চলিস--তোর ছায়া!
ভুল করে হায় ভুলকে নিয়ে ঘর বাঁধি--
এসব দেখি, দুঃখ ভুলে কষ্ট গিলে এ-ই ভাবি,
মিথ্যে সবই!
সত্যিটাকে খুঁজতে গিয়ে জীবনটাকে আজ সাজাই।
সব গুছিয়ে শেষ হলে,
দেখি ফিরে এসে,
করেছি আসলে--
সব এলোমেলো...হিসেব কষেই!
পসরা সুখের সাজিয়ে ডালায় স্বস্তি পালায়--কে বোঝে তা?
অতি উত্থান দ্রুত পতন,
অনুভূতির উর্ধ্বপাতন--এইতো জীবন!
 
দশ।
জানলাটার পাশে বসে,
চায়ের কাপে চুমু ঘষে,
কী দারুণ বর্ষাযাপন!
এই পৃথিবী ছাড়তে যখন ইচ্ছে ভীষণ,
বৃষ্টি তখন হাজারটা দেয় বাঁচার কারণ।
আমি একলা পথে
একলা হাঁটি
উদাস করে মন,
শূন্য পথটা পেছনে ফেলে
দুঃস্বপ্নের দৃষ্টি মেলে স্বপ্নপথে
এক-এক করে ফেলি কদম।
ফেলে-আসা মুছে-যাওয়া
ক্লান্ত পথের, শ্রান্ত স্মৃতির
চেনা শূন্যতায়
ভেজা মনটা
তবু কেন হায় খুঁড়িয়ে চলে!
হঠাৎ কোথাও
ভুলেও ক্ষণিক
ভুল মানুষের মিললে ছায়া--
মন কেন হায়
আরও বেশি কেঁদে ওঠে! কীসের মোহে!
 
বৃষ্টি মনে, অলস ঘুঘুর রোদ-দুপুর।
আমায় একটু মাথায় ওঠাও,
যেমনি তোমায় ওঠাই মাথায়।
দাম হারিয়ে দাম বাড়িয়ে দামের খেলায় দাম হারাই!
করছি শপথ, যেদিন সত্যি মাথায় নেবো তোমায়, দেখো,
ওই উঁচুতে একশো তলায় ছাদের ওপর লিফটে উঠে,
আদর দেবো, ভালোবাসি বলিয়ে নেবো--বলবে নাতো?
ভালোই হবে, রেলিং ধরে রাস্তা দেখে মারবো ছুঁড়ে!
জানো প্রিয়,
অধীর মনে শুধু ক্ষণেক্ষণে
প্রশ্নরা সব ভিড় করে যায়--
এই অবহেলা, অবজ্ঞা আর না-পছন্দের তীব্র দহন,
অভালোবাসায় মোড়ানো যত বিরক্তি আর অমন ঘৃণা,
চেতন কিংবা অবচেতনের নাগরদোলায় আমায় তাড়ায়!
হবেও বা! হতেই পারে! তোমার ব্যাপার!
কারণটা কি বলা যাবে? মিথ্যে করেও?
 
এগারো।
যখন বলো, কেমন আছ?
ভাবতে বসি, সত্যি আমি আছি কেমন!
কষ্ট তোমার, কষ্ট আমার--শুধুই বাড়ে অকারণে!
কথা তো কিছু বলো না অতো,
ওই একটা কথাই বলার থাকে!
ওটাও নাহয় বাদ দিয়ে দাও!
সত্যি যখন জানতে চাইবে কেমন আছি,
আর কিছু নয়, একটা ডট-ই নাহয় পাঠিয়ে দিয়ো!
আমি ঠিক বুঝে নেবো, উত্তর দেবো যেমন খুশি!
বাঁচবে সময় অনেকটুকু!
ওই সময়টা প্রিয় কাউকে দিয়ে দিয়ো!
ওকে কোরো দারুণ খুশি!
আমি তো বাবা খুশিই আছি!
কী দরকার! তাই না, বলো?
 
অনিচ্ছাতেও কখনও যদি যাই হারিয়ে,
তবুও তুমি
থেকো মিশে--এই মিনতি!
সত্যি যা হোক, তেমনি থাকুক!
মিথ্যে আমায় জড়িয়ে রাখুক এমনি করে,
নইলে বলো বাঁচব কীসে?
জেনে রেখো,
হারিয়েও যদি যাই কখনও,
থাকবো যতো,
ভুলেও তুমি যদি থেকে যাও,
থাকতে ততো পারবে নাগো আমার মতো!
বাতাসে তোমায়
রেখেছি মিলিয়ে, অস্তিত্বের এ নিঃশ্বাসে...
মুক্তি তোমার কোথায়, বলো? ভাবছই বা কোন বিশ্বাসে?
থাকবে তুমি সারাজীবন আমার পরশ-যত্নতে!
তোমাতে আকাশ দিয়েছি এঁটে ওই সে কখন কোথায় কবে!
কীভাবে পাবে মুক্তি বলো, আমার অসীম দৃষ্টি যখন ঠিক বাঁধে বেশ সাধে?
তোমার সকল নৈঃশব্দ্য আর কোলাহলে--আমায় পাবে!
কখনও ভুলে ডেকেই দেখো!
যখন হাত বাড়ালে কেউ না আসে,
হাতটা আমার চেয়েই দেখো!
দিচ্ছি কথা, থাকলে বেঁচে, বাড়িয়ে দেবো!
পারবে তুমি বাতাস থেকে, আকাশ থেকে, শব্দমিছিলের বাহার থেকে--
পালিয়ে যেতে?
আড়ালে ওসব না লুকিয়েই,
অদৃশ্য এই ‘আমি’ থেকে অস্তিত্বকে সরিয়ে দেবে?
এমনি আরও ভাবছ তুমি, শেষ জ্বালাতন সওয়া শেষে বেঁচেই গেছো!---বাবুসোনা, এতই সোজা?
হয়নি দেখা তোমার সাথে,
জানি, কখনওই।
বলোনি কথা আমার সাথে
একটি বর্ণও খর্চা করে।
এও জানি, এবং মানি,
হবে না দেখা, হবে না কথা--
কোনওদিনই!
তবুও আমি পাশে রবো,
থেকে যাবো অনড় হয়ে।
ভাবছো তুমি,
আবোলতাবোল এসব আমি
বলছিটা কী? তাই না, বলো?
সময় এলে বুঝবে সবই,
সেদিন নাহয় মিলিয়ে নিও!
 
বারো।
সত্যি বলছি, জানি নাগো, কী এমন চেয়েছি আমি!
না চাইতেই এত কিছু দিয়ে দিলে!
আমার গ্রহণ করার ক্ষমতা কত, বুঝেছিলে?
নাকি কিছু না বুঝেই খালি হাতে না ফিরিয়ে কষ্ট-বোঝাই বিদায় দিলে?
সৌজন্যকে ভয় করি আজ!
মানুষটাকেই চাইনি যখন,
তখন কী আর চাওয়ার থাকে?
চেয়ে না পাওয়ার কষ্ট অনেক...
কিন্তু চাইতে না পারার,
কিংবা না চাওয়ার,
কষ্ট জানো?
পাই বা না পাই, সে ভাবনা--
অন্য কথা! কিন্তু চাইলামই না...তবুও যখন...
হিসেবে তোমার
যদি আকাশপাতাল তেমন কিছু
চেয়েই থাকি,
ফিরিয়ে নিলাম সে দাবি আজ!
এবার খুশি?
পদ্ম কীসে বাঁচে, বলো,
জলটা ছাড়া?
ভালোবাসায় বাঁচে না সে,
জলকে যদি ভালোবাসে, কাছে টানে,
তবেই ফোটে পদ্মকলি!
ভালোবাসার জিনিসটারই দাম,
ভালোবাসা কী-ই বা দামি!
আকাশ ছাড়া রঙধনুকে কোথায় পাবে?
রঙধনুকে বাসলে ভালো,
ভালোবাসা মুঠোয়-মুঠোয় আকাশ ভরায়।
ভুলে গেলে আকাশ, বলো,
রঙধনু কি মেলবে ডানা?
গাছকে তুমি ভালোবাসো না,
ফুলকে নিয়েই বাঁচো!
বেশ তো ভালো! গাছকে ফেলে ফোটাও তো ফুল!
গাছকে ভুলে যে ফুল ফোটে,
নেই প্রাণ আর গন্ধ ওতে।
দারুণ রঙে যতই মাতাক সে ফুল তোমায়,
হৃদয় বাঁচে যে সুন্দরে, সে সুন্দরটা মিলবে কীসে?
 
সাগরতটে
ফুরোলে সময়, অসময়ের সময় এসে
হাজার পায়ের হাজার ছাপে নিশানা গাঁথে।
ভীষণ রাগী জলের শরীর
মুছে দেয় তা মুহূর্ততেই,
বারে-বারে।
তাই বলে কি মিথ্যে হবে
আনন্দেতে পা দুটো যার মেতেছিল কী উল্লাসে!
নরম বালির পরম ছোঁয়ার শিহরণটা--হৃদয়টাকে ছুঁয়েছিল, দিয়েছিল একটু হাসি!
তোমার যা কিছু বলার ছিল,
হয়তো তা কিছু হয়েছে বলা,
সেই কবে...শূন্য অনুভবে।
আমার যা কিছু বলার আছে,
ফুরোবে নাকো কখনও সে কথা--
বাজি ধরে বলতে পারি--কোনও কালেই!
তাইতো বোধহয়,
অর্থবোধক সব বর্ণই,
নিরর্থকই!
অর্থহীন বর্ণ যতো,
এক ক্লান্ত নীরব গভীর শ্বাসে--অভিমানে বাঁচিয়ে রাখি!
প্রতি মুহূর্তের সব অনুভূতি কত অস্থির!
আমার ভীষণ ইচ্ছে করে, এসব কিছু তাদেরকে দিই,
যাদের সকল অস্থিরতায় প্রিয় আমার স্থির জেগে রয়।
আমি অযাচিত। আমি যা কিছু অনুভব করি, কিংবা করাই--তা অযাচিত।
যন্ত্রণাটা বাড়ুক যতই, মেনেই নিলাম মিথ্যে যত মাথায় তোমার--সত্যি ভেবেই!
তাই বলে কি মিথ্যেটা হায় সত্যি হবে?
হয় যদিও সত্যি সে বা, পারবে নিতে আগের মতো?