বয়েসি টিস্যু

 দেড়-দেড়টা যুগ কেটে যায় দেড় সেকেন্ডের কমে!
আঠারো সেতো! এমন কী আর? সামান্যতোই ক্ষয় সময়ের, মুহূর্ততোই এক পলকের!
কেটে গেল কী সহজেই! কেটেও যায় এমনি করেই...
চোখের সামনে দুঃখেরা মরে।
সহজ মৃত্যু সহজ কত! বোধ এসে যায়, কী সহজেই শোকটা গত! ভাবায় না আর অতশত।
ছোট্ট জীবন! মরলো কত দুঃখই তো, দেখাও গেলো হয়ে! এই বেশতো, এই বেশতো!
দেখতে-দেখতে সুখের জন্ম, সুখের সন্তান গুনতে-গুনতে, ক্লান্ত আমি আজ যে বড়ো!
একটা মানুষ ফ্রেম হয়ে যায় কী সহজেই!
দেয়ালে ডেস্কে, হাওয়ার মনে ঘরের কোণে তাকিয়ে থাকে--চোখ অপলক, নিশ্চুপ স্বর...নেই অভিমান, নেই অভিযোগ।
এইতো সেদিন! আজো মনে হয়...এই হাতেতে সময়কে ছুঁই, কণ্ঠ কাঁপে,
“বাবা, তুমি দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে!”
এতোটাই নির্ভার! এতোটাই নিরুদ্বিগ্ন! এতোটাই নিশ্চিন্ত! এতোটাই নিরুত্তাপ!
অমন সৎ বিশ্বস্ত অনুভূতি কোনো মিথ্যেও কখনো দেয় না!
বেঁধেদেয়া ডাক্তারি সময়টা ভুলে থাকার সে কী চেষ্টা কিংবা অভিনয়!
কেটেও যাচ্ছিলো দিনগুলি! কেটে যায়ই তো অমনি করে!
ডিসেম্বর ১৬ই। উনিশশো আটানব্বই। চলছে ক্লাস ফোর।
বিশেষ দিন, বিশেষ আয়োজন। স্কুলে। একদিনের নাচে দুনিয়া উল্টে ফেলার শপথের দিনে আমি! নদীর মাঝি বলে, এসো নবীন...
বাবা বেডে, আমি প্যারেডে। মা বলেছিলো, “যা মা, হবে না কিছু। বাবাকে দেখাস্‌ প্রাইজটা এনে।”
কুচকাওয়াজ আর বিজয়গান, বিকেলেহেলা সোনালি দুপুর।
বিজয়ের খুশি, পকেটমানির একটু প্রমোশন।
বাদাম, লজেন্স, হাওয়াই মিঠের চড়ে পিঠে হাওয়ায় উড়ে রৌদ্র জুড়ে বাসায় ফেরা।
হাতে চকবার--আধেকটা নেই।
“একটু দিবি, মাগো?”
“কাকা বকবে।”
“জানলেই তো। জানবে নাতো! দে না, মা! একটুকু খাই। ইচ্ছে করছে!”
খাইয়ে দিলেম। মুখ গড়িয়ে কিছু আইসক্রিম লেপটে গেলো ওই টিস্যুতে।
সরালেম চুল, সাদা কপালটা। খেলেম চুমু । হাসল বাবা। “পাগলি মেয়ে!”
তৃপ্তি এলো সে কী এক, ফুরলো পুরো আইসক্রিম আধেক। তৃপ্তি অমন বাবার চোখে হয়নি আগে!
“বলিস নে মা কাউকে আবার। বকবে ভীষণ। দিবি, আরেকটা?”
“আর না বাবা।”
“চলে গেলে আমি হঠাৎ, বলিস মা তুই, বাবাটা বড্ডো ভালো ছিল। আর একটু বোকাও ছিল। বলবি তো মা?” হাসল বাবা, আর চোখে জল।
এমনি করে বললে বাবা, বলতে কী হয়, হয়নি জানার বয়েস আমার।
সবটা জানে এই বাবারা, তাইতো অমন তাকিয়ে থাকে করে ফ্যালফ্যাল।
ওসব দিনে, অখাদ্য আর কুখাদ্য খেয়ে বাঁচতো বাবা। বয়েস ফুরায়, খাবার পালায়। নিয়ম কী সব!
কখনো কোথাও ভুলেও মনের, ফিরে তাকাননি যে আইসক্রিম, তার জন্যই কী আকুতি!
মৃত্যু বুঝি সবই টানে এমনি করেই, সেই আইসক্রিমও...!
হলো না আর বাবাকে কখনো আইসক্রিম খাওয়ানো। কয়েকটা মৃত্যুও দিব্যি কেটে যায় এক আফসোসেই...
বছর ঘুরে বারেবারে উঁকি দিয়ে যায় ১৬ই ডিসেম্বর। ভোঁতা আইসক্রিম হাতুড়ি বসায়, বসিয়েই যায়, এই মাথায় এই শরীরে, আজো নিরন্তর...
 
এ জীবনের
কষ্ট যতো
দুঃখ যতো
গ্লানি যতো
বেদনা যতো
অভিমান যতো
সবটাও নিয়ে করলে জড়ো,
তার চাইতেও জীবন বড়ো। গুণে শতো!
আজো আছে জীবন ঠিকই, পাগলিটাও বাবারই আছে, পাগলি ভীষণ আগের মতন, ওকে অমন পাগলি কেউ আর ডাকে নাকো।
ফ্রেমটা আছে, সেদিনের সেই শার্টটা আছে। হাতে জড়িয়ে আদর মাখাই, চোখের ঠোঁটের পরশ ছোঁয়াই। ভাবছি আজো, বাবা আছে! এইতো পাশে, একটু বোকা, যখন হাসে!
আছে আরো সেই টিস্যুটা--কষ্টের চেয়েও বয়সে বড় সেই টিস্যুটা!