ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১০ম অংশ)

ভাবনা: চৌষট্টি।

……………………..

কিছু প্রশ্ন—সত্যিই, প্রশ্নেই শুধু সুন্দর। আর কিছু উত্তরের—কখনো প্রশ্ন থাকতে নেই। সুন্দর হয়ে থাকাটাই তো বড় কথা, সে সুন্দর—কী প্রশ্ন কী উত্তর, কী এসে যায় ওতে? কিছু প্রশ্নের উত্তর এলে প্রশ্নটা বড্ডো অসুন্দর লাগে। কিছু উত্তর প্রশ্ন না করতেই আপনিই এসে পড়ে। জনকবিহীন পুত্রের কদর কখনোই কি নেই? পুত্রবিহীন জনকের কি জনক হওয়ারই অধিকার নেই?

কিছু-কিছু ভালোবাসা প্রশ্নের জন্ম দেয়। উত্তর মেলে না।

কিছু-কিছু ভালোবাসা উত্তর দিয়ে দেয়। প্রশ্নই সেখানে নেই।

কিছু-কিছু প্রশ্ন থেকেও ভালোবাসা চলে আসে স্বচ্ছন্দে।

কিছু-কিছু উত্তর ঘুরপাক খেতে-খেতে ভালোবাসায় গিয়ে তবেই থামে।

ভালোবাসা, আমরা সবাইই চাই—সত্যিই চাই; স্বীকার করি বা না করি, চাই।
এই ভালোবাসা, না পেলে বিপদ, পেয়ে গেলে আরও বড় বিপদ—আর পাওয়া না-পাওয়ার মাঝখানে দুলতে থাকলে, বিপদ কেন আসছে না, সে চিন্তায় সবচাইতে বিশ্বস্ত বন্ধুটির চাইতেও বিশ্বস্ত—ঘুমটাও, পর হয়ে যায়। বিপদের জন্য প্রতীক্ষা বিপদের চাইতেও ভয়ংকর।
কেউ, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে দিনরাত এক করে ফেলুক, এক ভালোবাসাতেই সময়টা সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাক—এমন ভালোবাসা, আমরা হয়তো অনেকেই চাই না।
আবার—
একবুক ভালোবাসা নিয়ে—কেউ দম বন্ধ করে থাকুক, প্রয়োজনে দম আটকে মরে যাবে–তবুও বলতে পারবে না ‘ভালোবাসি’—এমনটিও চাই না।

মানুষ হয়তো এমনদের ভালোবাসাই চায়—যারা জানে—
কী* ভালোবাসতে হয়…..
কীভাবে ভালোবাসতে হয়…….
ভালো কতটা বাসতে হয়……
কতটা ভালোবাসা ভেতরে ধারণ করে—‘ভালোবাসি’ বলতে হয়….
কিংবা—না বলে থাকতে হয়…..
কতটা, অপ্রকাশ্যে রাখতে হয়—প্রকাশের জন্যই…..
কোথায় শুরু করতে হয়…….
কোথায় থামতে হয়…….কত সময়ের জন্য—বাঁচতে।
আর, কোথায় একেবারেই থেমে যেতে হয়—তাও ওই বাঁচতেই!
কতটা জানাতে হয়—-কখন, কোথায়, কীভাবে…….এমনকি কখনো-কখনো—কেন’টাও।
কতটা ভেতরে চেপে রাখতে হয়—চিরদিনের জন্য……যত কষ্টই হোক। সে কষ্ট বাইরে এলেই সবকিছুকে শেষ করে দেয়, একেবারে খুন করে ফেলে।
আর, এও জানে—
কীভাবে প্রকাশ করতে হয়…….
কখন প্রকাশ করতে হয়…….
……..কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে, অনুভবের ধরনে, চোখের ভাষায়, হৃদয়ের ঐশ্বর্যে।
এই হিসেবনিকেশ যে যত ভাল জানে, যত ভাল পারে, যত ভাল দেখায়—হয়তো আমরা, তাদেরকে তত ভালোবাসি….

(অন্যরকমও হয়? হবেই তো! ভিন্নতা তো থাকতেই পারে….তাই না?)

*কী: এর ব্যাপকতা, বৈশিষ্ট্য এবং মানুষে-মানুষে এর ভিন্নতা অনেক বেশি…..যা ব্যাখ্যা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়……মনের ক্ষুদ্রত্ব বা বিস্তৃতি–দুটোই তো ব্যাখ্যাতীত, প্রচ্ছন্ন; তাই, নিশ্চয়ই রহস্যময়।

ভাবনা: পঁয়ষট্টি।

……………………..

যে অনায়াসেই হাসিমুখে ঠকে যায়, কিংবা বুঝতেই পারে না, ঠকছে……
এমন কারো কাছে—
জিতেই বা কী লাভ? অমন পানসে খেলাতেও জেতার আনন্দ আছে? যে জিত অনায়াস, সে জিতের চাইতে লড়াইয়ের হার অনেক সম্মানের।
যে সৌন্দর্য নিজের ব্যাপারেই উদাসীন—
এমন সৌন্দর্যে ভাসতে পেরেই বা কী লাভ!
যে হীরে, নিজেকে বিকিয়ে দেয় পাথরের দামে,
এমন হীরের চেয়ে, নিজের মূল্য বোঝে—এমন জংধরা লোহাও যে দামি, আকর্ষণীয়!
যে অনিন্দ্যসুন্দরীকে বিছানায় নিয়ে নেয়া যায় চোখের মাত্র একটা ইশারায়, কিংবা কিছু কাগুজে দামে—
এমনের সাথে হাজার মিলনের চেয়েও—
আর কিছু নয়, এক দুর্লভ মানবীর স্রেফ ‘এক পলক’-এর নিবিড় দৃষ্টি—অনেক বেশি কিছু যে দিতে পারে…….তার খোঁজ সবাই পায় না; অবশ্য, সবাই যে তা চায়, এমনও নয়! সঙ্গমের সুখের চাইতে সে চাহনির সুখ কম কিছু নয়; একেবারে পাগল বিভোর করে দেয়, কখনো-কখনো।
পৃথিবীর, অনেক দামি কিছুই—সস্তার চেয়েও সস্তা।
আবার, অনেক সস্তা কিছুর—দাম ঠিক করার মতো—দামি জিনিসই পৃথিবীতে নেই!
দাম—এই ব্যাপারটা পৃথিবীর সবচাইতে গোলমেলে ব্যাপার…..কোনোকিছুরই কি দাম আছে, আদৌ?…….. প্রয়োজনীয়তা, অভ্যেস, ইচ্ছে কিংবা সামর্থ্যই কোনোকিছুকে মূল্যহীন কিংবা অমূল্য করে দেখায়। একেবারেই মূল্যহীনের বেশেথাকা কতকিছুই তো জীবনের সমস্ত সঞ্চয় বিকিয়েও কিনতে পারা যায় না।

ভাবনা: ছেষট্টি।

……………………..

জীবন কী?

প্রতিদিন সকালে ঘুমভেঙে নিজেকে জ্যান্ত দেখাই জীবন।

এই সহজ হিসেবকে আমরা কতভাবেই না জটিল করে দেখতে শিখে যাচ্ছি। ওই জটিলতায় সহজভাবে বাস করাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জীবন থেকে জীবনকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনের কাছে দিনরাত রাতদিন জীবনকে চেয়ে-চেয়ে মরছি।

পৃথিবীতে, যাদের যত বেশি হিংসা আর অহংকার, তারা তত বেশি দুঃখী….আমার তা-ই মনে হয়।

অহংকারীরা, নিজের ভালকিছুর অহংকারে অন্যদের তুচ্ছ করে। অন্যের ব্যাপারে এই তুচ্ছতাবোধ, অহংকারীদের মনকে কখনোই শান্তি দেয় না….তাদের মন সবসময়ই অস্থির হয়ে থাকে, নিজের কল্পনায় গড়া দুর্ভেদ্য দুর্গে আত্মতুষ্টিতে আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে থাকে। পুরো পৃথিবীটাকেই যে পায়ের নিচে ভাবে, তার পায়ের নিচে আসলে মাটিই নেই। সে ক্রমেই তলিয়ে যেতে থাকে অতল গহ্বরে। অহংকারীরা ভুলে যায়, যা নিয়ে সে অহংকার করছে, সেটার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্বে কারো কিছু এসে যায় না। আমার ঐশ্বর্যের সম্পূর্ণ ভাগীদার যখন আমি একাই, তখন সে ঐশ্বর্যের অহংকারে অন্যকে তুচ্ছ করাটা আমার মূর্খতা আর নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী?

অন্যদিকে, হিংসুটে মানুষগুলো অন্যের ভালকিছুকে সহ্য করতে পারে না, তাই, হিংসা করে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় জ্বলতে থাকে…..এই যন্ত্রণা কখনোই তাদেরকে ভাল থাকতে দেয় না….. হিংসার লেলিহান শিখা হিংসুটেকেই পুড়িয়ে মারে। অন্যকে হিংসা করার মানেই হল, আমার এমনকিছু নেই যা অন্যের আছে, আমি সেটা খুব করে চাইছি, কিন্তু অন্যের তুলনায় আমার যোগ্যতা কম বিধায় তা পাচ্ছি না। ক্রমাগত হিংসা ব্যক্তিকে দুর্বল ও হতোদ্যম করে দেয়। যার যতো বেশি হিংসা, তার ততো বেশি অন্যের ক্ষতি করার দিকে ঝোঁক। হিংসুটেরা নিজে কিছু করতে পারে না, তাই যারা করতে পারে, তাদের আঘাত করে একধরনের অসুস্থ তৃপ্তি পায়। অবচেতনভাবেই হিংসুটে মানুষের মন দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়। যার প্রতি হিংসা, তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া দূরে থাক, তার সমকক্ষ হওয়ার ভাবনা বা স্পৃহাটাই হিংসুটের মনে তৈরি হয় না।

তাহলে, এই হিংসা আর অহংকার করে লাভটা কী? এই দুই প্রবৃত্তিরই তো কাজকারবার মনকে নিয়ে, সেই মনটাই যদি ভাল আর সুস্থ না থাকল, তবে তাদের বোঝা বয়ে-বয়ে বাঁচা কেন?

মানুষকে ভালোবাসলে, মমতা নিয়ে মানুষের পাশে থাকলে, মানুষের ভালতে খুশি হয়ে ওঠার আর্টটা রপ্ত করতে পারলে, মানুষের খারাপ কিছুতে দুঃখ পেলে—তা মানুষের মনে শান্তি আনে, মানুষকে সত্যিকারভাবে সুখী করে।

যা অন্য মানুষকে কষ্ট, যন্ত্রণা আর অশান্তিতে রাখে, মহানন্দে সেসব কাজ করে নিজেকে খারাপ রাখার কোনো মানে আছে? সাময়িক সুখের মোহে নিজেকে নিচে নামিয়ে অন্যের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে কী লাভ? পরে সেটা বুঝতে পারলে কিছু কষ্টকে অহেতুকই প্রশ্রয় দিতে হয়। কষ্টরা তো বেঁচেবর্তে থাকতে পারলেই মহাখুশি!

মানুষ কি একটুও নিজের ভালটা বোঝে না!? সুখ তো মানসিক। তাই, নিজেকে ভাল রাখার স্বার্থে হলেও তো অহংকার আর হিংসা—দুটোতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বাঁচার প্র্যাকটিস করা যায়।

………………………………

আমাদের সকল স্বার্থপরতা অন্যকে আহত করে নিজে ভালোথাকার অভিনয়মাত্র। সে অভিনয়ের রেশ কাটতেই শুরু হয় প্রচণ্ড অন্তর্দহন যা আমাদের ক্রমশ শেষ করে দেয়।

সত্যিকারের স্বার্থপর, আমরা আর কবে হতে পারবো?

ভাবনা: সাতষট্টি।

……………………..

দূরত্বের হিসেবে, রিকশাভাড়াটা ৫০ টাকা ঠিকই আছে, তবুও, একটু খুঁজেটুজে, ৪০ টাকায় হাসিমুখে যেতে রাজি হবে, এমন একজনকে বের করি।

বাতাস ঠেলে-ঠেলে রিকশা ছুটে চলে…… প্যাডেলের টানে-টানে চালক ঘামে—ঘাম শুকায়…….

আমারটা শুকায় গন্তব্যে পৌঁছে, যখন রিকশাচালকের হাতে ৫০ টাকা দিয়ে বলি— “সবটাই রাখেন”……. পাওনাটাকেই উপরিপাওনা ভেবে, তিনি তৃপ্তির হাসি হাসেন…..

লস ছাড়াই লাভ (মানুষকে আনন্দ দেয়া) পেয়ে, আমিও হাসি প্রশস্তহাসি।

যা থাকার কথা, সব তা-ই আছে…তবুও, দুজন, দুভাবে মনঝুড়িতে কিছু বাড়তি ভালোলাগা নিয়ে দুপথে চলে যাই……… খরচ হল না বাড়তি, অথচ আয়টা হল বেশ!

যখন আমি লিখি……. আহা, কত কী যে শিখি! আমি মহান!—আপনারা ভাবেন।

আমি ভাবি, এই যে ভালোলাগা, ওটা না পেলে, লিখতোটা কে?

অমন অসীম যন্ত্রণার কাজ, ভালোবাসা ছাড়া করতোটা কে? লেখার সাথে মহত্ত্বের সম্পর্ক অতি সামান্যই।

আমি লিখি আমার জন্যই, আপনাদের জন্য নয়—আর আপনারা ভাবেন উল্টোটা।

লিখতে কষ্ট ভীষণ, না লিখে যারা ভাল থাকে, ওরা ওই কষ্ট ঘাড়ে বয়ে বাঁচার বোকামিটা করে না। কখনো-কখনো যা করে ওরা, তা হল, ফরমায়েশ দেয়……… এটা লিখ, ওটা লিখ। ফরমায়েশে চাকরি বেরোয়, লেখা নয়। এইজন্যই, লেখকরা চাকর নন—হায়! পোশাকি কায়দায় চাকর বেচারা চাকুরে হলো, ওই ভারি দলে লেখক নেই। কে বোঝাবে?

আমি, লিখে বড্ডো খুশি!

আপনাদের খুশিতেও খুশি,

যা লিখি, তা ফেলে দেয়ার মতো নয়, একেবারেই–এ খুশিতেও খুশি।

আপনারা দয়া করে আমার লেখা পড়ার পেছনে আপনাদের দামি সময়টা দিয়ে দিচ্ছেন, এও বা কম কীসে?

লাভ তো পুরো আমারই!

আপনারা ভাবেন, আমি লিখি—এটা আমার ভালত্ব। আমি তো বুঝি, ওটা স্রেফ স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে মুকুট আমার নয়, সে মুকুট, আমার কাছে, সবসময়ই, বড্ডো ভারি। ওটা পরাবেন না, প্লিজ! পরালে—ওর ভার, মটকাবে ঘাড়! নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!

ভাল থাকতে লিখি……… ইদানিং, লিখতেও ভাল থাকি। দুটোই—স্বার্থপরতাই তো, না? লস সামলে লাভে বাঁচা! আহা আহা!

ভাবনা: আটষট্টি।

……………………..

ক্রিং ক্রিং!!
হ্যালো…….
হ্যালো, এটা কি তরী ক্যুরিয়ার সার্ভিস?
জ্বি। বলেন।
ভাই, একটা কথা…….
জ্বি জ্বি, বলেন…….শুনতেসি।
আচ্ছা, আপনারা কি ক্লায়েন্টদের সব জিনিসপত্র দিয়ে রোজ ফুটবল খেলেন!? নাকি, ক্যাচ্ ক্যাচ্?
কীইইইইইই…….??? (চিৎকার)
(রিপিট করলাম—আগের প্রশ্নটাই।)
মানে!? কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?? পরিষ্কার করে বলেন।
আরে ভাই, আমি বলতে চাচ্ছি যে—আপনাদের ক্যুরিয়ারে, ধান পাঠালে—গন্তব্যে পৌঁছায় রুটি হয়ে…! রুটি পাঠালে…….
(আমাকে বলতে দিল না, কথা শেষ করার আগেই…..) কীইইইইইই……?? কী বলতেসেন এইসব আপনি? কে আপনি? কী বলতে চান, ঠিক করে বলেন।
আরে ভাই, বুঝেন নাই? আপনাদের ক্যুরিয়ারে যা-ই পাঠাই—সবকিছু, কয়েক অংশে বিভক্ত হয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়……আপনাদেরটা কি ক্যুরিয়ার? নাকি, ব্লেন্ডার?
কেন? কী সমস্যা হইসে? এইভাবে কথা বলতেসেন কেন?
শোনেন, বলতেসি। এক পিচ্চি, তার বাবা কিছুদিনের জন্য দূরে বলে—রোজ একবার করে কাঁদে……..একটা খেলনা পাঠালাম ওর মনখুশি করতে…….এখন সেই ভাঙা খেলনা দেখে—সে রোজ দুইবার করে কাঁদে…..! আপনাদের এক সার্ভিসেই বাচ্চার কান্না এক থেকে দুই হয়ে গেল! শর্টকাটে প্রমোশন। কাঁদতে-কাঁদতে বাচ্চা এক হাতে হেলিকপ্টার ওড়ায়, আরেক হাতে হেলিকপ্টারের ফ্যান। এইবার বুঝসেন?
ও আচ্ছা, বুঝতে পারসি স্যার ……..আসলে আমাদের……. ব্লা ব্লা ব্লা……..
ভাই, আপনারা ক্যুরিয়ার চালু রাখবেন, আবার বলবেন—ভেঙে যেতে পারে, এমন জিনিসপত্র পাঠাবেন না—এটা তো হয় না…….ভঙ্গুর জিনিসপত্র কি তাহলে আমরা মাথায় নিয়ে দৌড়ায়ে-দৌড়ায়ে দিয়ে আসবো?………..হয়, আমাদের দয়া করেন! নয়তো, নিজেদের দয়া করেন!…….আরেকবার, আমার বন্ধুকে একটা স্ট্যাচু পাঠালাম। আর আপনারা, পাঠানোর আগেই বুদ্ধি করে, স্ট্যাচুর কল্লা ঝুলায়ে দিসেন স্ট্যাচুর ঠ্যাঙের সাথে। পাঠালাম রবীন্দ্রনাথ, পৌঁছালো ভ্যাম্পায়ার হয়ে! এসবের মানে কী? ফাজলামো পাইসেন? সার্ভিসের প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করেন।
আমরা চেষ্টা করবো স্যার!……ব্লা ব্লা ব্লা……..
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ……..খটটট্‌…..!

ভাবনা: ঊনসত্তর।

……………………..

সুস্থ মানসিকতা, কিংবা অসুস্থ মানসিকতা………কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট বা প্রাক্তন স্টুডেন্ট, কোন সামাজিক বা আর্থিক অবস্থানের ব্যক্তি, কোন পেশায় নিযুক্ত—এসবের উপর নির্ভর করে না। অনেক অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত মানুষকে দেখেছি, অনেক চমৎকার মানসিকতার, আবার (সবার চোখে) সর্বোচ্চ দেশীয় কিংবা বিদেশি বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশোনাকরা অনেককেই দেখেছি, অতি নিম্ন মানসিকতার। ওদের সাথে মেশা দূরে থাক, ওদের নিয়ে ভাবতেও রুচিতে বাধে। হিংসা, দম্ভ, অপচিকীর্ষা (অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছা), পরনিন্দা সহ বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তি— তাদের সার্টিফিকেটের ভারবৃদ্ধির সাথে-সাথে বাড়তে থাকে। চাকরিতে নিয়োগ দেয়ার সময়, যদি মানসিকতার পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা থাকত, তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভাল-ভাল ডিগ্রিধারী মেধাবী অনেক ব্যক্তিই চাকরি পেতেন না। মেধার সাথে মানসিকতার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ নয়। যেকোনো চাকরির ক্ষেত্রে, একজন অসুস্থ মানসিকতার মেধাবী মানুষের চাইতে একজন সুস্থ মানসিকতার স্বল্প মেধাবী মানুষ প্রতিষ্ঠান এবং সেবাগ্রহীতাদের বেশি সেবা দিতে পারে। চাকরি করতে মূলত একটা সার্টিফিকেট লাগে, যেটা ব্যবহার করে চাকরির পরীক্ষায় বসা যায়। একজন অসুস্থ মানসিকতার বাজে মানুষ তার আশেপাশের সবাইকেই তার মতো মানসিক গঠনের অধিকারী হিসেবে দেখতে চায়। যদি সে হয় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ, তবে সে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানসিক পরিচ্ছন্নতা সহ্য করতে পারে না, এবং প্রতিনিয়তই নানানভাবে শোষণ ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। সে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রাখে, যেটা তার অধীনস্থদের নিম্ন মানসিকতা ধারণ করে কাজ করতে বাধ্য করে। শুয়োর চায় তার আশেপাশের সবাই তার সাথে নোংরায় বসবাস করুক, প্রয়োজনে সে সবাইকে পা ধরে তার পর্যায়ে টেনে নামাতেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করে না। মানসিক পরিচ্ছন্নতার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। নিম্ন মানসিকতা মানুষকে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার জগতে সবসময়ই অনিরাপত্তায় রেখে দেয়, বিচারশক্তিহীন ও উগ্র করে তোলে। উগ্রতার প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে হীনমন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। যে ব্যক্তি সুন্দর করে ভাবতে পারে না, সে, যারা সুন্দর করে ভাবতে পারে, তাদের সবাইকেই, মনেমনে জাতশত্রু বানিয়ে ফেলে। জাতটা কাদের?—বাজে ভাবনার মানুষের জাত। ওরা মস্তিষ্কে খাটো, সংখ্যায় দীর্ঘ, শক্তিতে দুর্বল—-তাই সবল মানুষের পেছনে লেগে থেকে প্রমাণ করে দেয়, ওদের অবস্থান পেছনে, মানে, ওরা স্পষ্টতই কিছু পিছিয়েপড়া বাজে লোক। বাজে লোকদের নিয়তিই হল, বাজে কায়দায় বেঁচে বাজে কায়দায় মরা।

ভাবনা: সত্তর।

……………………..

সে ‘চাওয়া’ বড় যন্ত্রণার—

যা, মানুষ চায় আবার চায়ও না।

কেন যে চায়—

তা, সে জানে আবার জানে না।

কেন যে চায় না—

তাও, সে জানে আবার জানে না।

এই জানা কিংবা না জানার কারণে তার যতটা দুঃখবোধ, ততোধিক দুঃখ। সে টেরই পায় না, সে দুঃখের সীমা কতটা বিস্তৃত। যখন টের পায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন আর করার তেমনকিছুই থাকে না।

চাওয়া উচিত, চাওয়া অনুচিত—বলে আসলে কিছু নেই। যা আছে, তা হল—চাই, কিংবা চাই না।

চাইলাম তাই পেলাম, চাইলাম অথচ পেলাম না…….কিংবা, চাইলাম না তাই পেলাম না, চাইলাম না অথচ পেলাম—এই সবকিছুই এমন কিছু, যা মানুষ, অন্য কিছু মাথায় আসে না বলে মাথায় আনতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা দেখা যায়।

প্রকৃত ব্যাপারটা হল এই—মানুষ, যা পাওয়ার কথা, তা এমনিতেই পায়, সেটার পাওয়ার জন্য বেশি চেষ্টা, চেষ্টা, কম চেষ্টা, এমনকি, চেষ্টাহীনতা—এ সবই সেটা পাওয়ার রাস্তাটা করে দেয়। আর, যা পাওয়ার কথা নয়, সেটা, এমনকি, হাতের নাগালে এসে গেলেও ঠিকই ফসকে যায়।

………… তবে হ্যাঁ, অন্য পথের পথিকের খোঁজও পাওয়া যায়, কখনো-কখনো।

মানুষের ইচ্ছের ধরন, মানুষের পাওয়া না-পাওয়ার ধরনের সাথে অতোটা একই তালে চলে না। ইচ্ছে আর প্রাপ্তির মধ্যকার সম্পর্কটা বরাবরই গোলমেলে।

মানুষের ইচ্ছেঘুড়ি কোনদিকে ওড়ে, মানুষ ভাবে, তা সে নিশ্চিত করে জানে; কিন্তু আসলে, মানুষ সে নিশ্চয়তা দেয়, হাওয়ার বয়ে চলার ধরন আর ঘুড়ির গঠন বুঝে। ঘুড়ির কিন্তু যেদিকে ওড়ার কথা, সেদিকেই ওড়ে।

নিশ্চয়তাই হোক, আর অনিশ্চয়তাই হোক—দুই অনুভূতিরই জন্ম মানুষের পছন্দ, পূর্ববিশ্বাস, সামর্থ্য আর অভিজ্ঞতা থেকে।

মানুষ নিশ্চিত করে কেবল জানে—

দুইটি ইচ্ছে—দুই মেরুর; যারা দুইদিক থেকে প্রবলভাবে টেনে ধরে প্রতিটি মুহূর্তেই তার নিজেকে ছিঁড়েছুঁড়ে খাচ্ছে……. সেগুলির যেকোনটিতে নিজেকে স্থির করে জীবনটাকে কোনরকমে হলেও টিকিয়ে রাখার সবকটা রাস্তা জীবনই আস্তে-আস্তে বন্ধ করে দেয়। এমন নিরন্তর অসহায়ত্বেই মানুষ বাঁচে।