ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১১শ অংশ)

ভাবনা: একাত্তর।

……………………..

বসুন্ধরায় স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখে বের হয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে কেউ একজন আমাকে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে দেখতে না দেখতেই দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল। হাত থেকে আমার পার্সটা রাস্তায় পড়ে যায়। ভীষণ রাগ হল—এতটা অভদ্রভাবে কেউ হাঁটে!? আরেকটু হলে তো ওই ধাক্কায় আমিই পড়ে যেতাম! সেই অচেনা লোকটাকে মনে-মনে খুব বকা দিতে-দিতে পার্সটা রাস্তা থেকে তুলে কী মনে করে যেন খুললাম। হায়! আমার মোবাইলটা কোথায়!? বুঝতে পারছিলাম না কোথায় পড়তে পারে। হঠাৎ মনে হল, মুভি দেখার সময় একবার হাত থেকে পার্সটা নিচে পড়ে গিয়েছিল। রাস্তা থেকে দৌড়ে গেলাম হলে। অবশেষে, যেখানে বসেছিলাম, সেখানেই পাওয়া গেল! মোবাইলটা কেউ মেরে দেয়নি! আশ্চর্য! বাসায় ফিরতে-ফিরতে ভাবলাম, মাঝে-মাঝে কারো অভদ্রতাও তাহলে কারো উপকার করে! তখন ধাক্কা খেয়ে পার্সটা পড়ে না গেলে তো আমি সেটা চেক করতাম না। হয়তো বাসায় গিয়ে দেখতাম যে পার্সে মোবাইল নেই। আর তখন এটা ফিরে পাবার তেমন কোনো সম্ভাবনাও থাকত না। আমরা আসলেই আগে থেকে কিছুতেই জানতে পারি না, কিংবা বুঝতে পারি না, কোন অপছন্দের ব্যাপারটাতে আমাদের জন্য মঙ্গল লুকানো আছে। স্রষ্টার এই খেলাটা বোঝা কিছুতেই সম্ভব নয়। এমনও হয়, আমরা এমন কিছু একটা প্রার্থনা করে চাইলাম, যেটাতে হয়তো আমাদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। এই ব্যাপারটা তো আর আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রায়ই এমন ঘটে, এ ধরনের প্রার্থনা বিফলে যায়। এটা দেখে আমাদের মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, স্রষ্টা আমার সাথে অবিচার করছেন। কিন্তু, একমাত্র তিনিই জানেন, কী হচ্ছে, কী হওয়া উচিত। আমরা যেটুকু চাই, যা চাই, তা পাই না। আমরা ততটুকুই পাই, যতটুকু আমাদের দরকার। আমরা তা-ই পাই, যা আমাদের দরকার।

স্বার্থের খেলায় মানুষকে যারা ঠকাতে চায়, আসলে তারা নিজেরাই বেশি ঠকে। সাময়িকভাবে মনে হয়, বড় জেতা জিতে গেলাম! কিন্তু আসল রহস্য অন্য কোথাও। হয়তো এমন কোথাও, যা আমাদের কষ্টকল্পনাতেও আসবে না। ঠকানো দুই রকম: মানসিক আর বাহ্যিক। যাকে ঠকানো হয়, সে হয়তো কিছু সময়ের জন্য সমস্যায় পড়ে বা কষ্ট পায় তারপর একসময় ভুলেও যায়। কিন্তু যে ঠকায় তার সবই মনে থাকে। একসময় যদি কখনো বুঝতে পারে ঠকানোটা আসলে ঠিক হয়নি, তখন এই যন্ত্রণাটা তাদের জীবনভর পীড়া দেয়। এমনকি যদি বুঝতে নাও পারে, তাও স্রষ্টা কোনো না কোনোভাবে তাকে অসুবিধেয় ফেলে দিয়ে, কিংবা এমন কাউকে অসুবিধেয় ফেলে দিয়ে, যে অসুবিধেয় পড়লে ওই লোকটা কষ্ট পাবে, ন্যায়বিচারটাই করেন।

ভাগ্যিস, প্রকৃতিই শুধু কখনো স্বার্থ খোঁজে না। সূর্য কখনো জিজ্ঞেস করে বসেনি, কীসের বিনিময়ে সে আলো দেবে? বাতাস কোনোদিনই আমায় স্পর্শ না করে থাকেনি। গাছ কখনো বলেনি, তার শীতল ছায়ায় আমার জায়গা হবে না। শস্য বলেনি কখনো, তোমাদের পেট পুরিয়ে আমার কী লাভ, বাপু? নদীর জলে স্নান করছি বলে নদী কখনো সে জল নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে না। বৃষ্টি বলে না, তোমায় ভেজানোর দামটা দাও। রাতের আঁধারে আলো দেবে বলে চাঁদ কারো কাছে কোনোদিন, কখনো বিনিময় চায়নি। প্রকৃতির পরম বন্ধুদের এমন নিঃস্বার্থ দান পেয়েও মানুষ হয়ে উঠেছে চরম স্বার্থপর। তার শ্বাসে স্বার্থ, প্রশ্বাসে স্বার্থ। যার স্বার্থ নেই, সে উন্মাদ, সে তুচ্ছ, সে অচল পয়সাটির চাইতেও অচল। আজকাল এমন অচল পয়সা মিউজিয়ামে চলে যাচ্ছে—অনেক দামি তো, মিউজিয়াম ছাড়া তাকে কাছে রাখবে, এমন সাধ্য কার?

ভাবনা: বাহাত্তর।

……………………..

এক রাত্রির বাস ছুটেচলা। শাদা-শাদা গাছের সাথে পাল্লা দিয়ে পিচঢালা রাস্তার সাথে চাকার অবিরাম চুম্বনে মাতাল রাত্রির নৈঃশব্দ্যে নেশা ভর করে শরীরে, মনে।

অসম্ভব রকমের প্রিয় পুরোনো কিছু বাংলা গান। বাজছে, অনুভব করছি, বেঁচে থাকাটাকেও চমৎকার ভাবতে ইচ্ছে করছে ভীষণভাবে!

অন্ধকার হাওয়ায় কামনার ফুলকি এসে-এসে ধাক্কা দেয় একেকবার। কাঁপিয়ে দেয় একেবারে! মাথা কাজ করে না, শুধুই অনুভূতি কাজ করে! বিশ্রীরকমের ভালোলাগা। আমাকে অসহায় করে দিয়ে খিলখিল শব্দে হাসতে থাকে মাথার ভেতর! পেছনের ওই কোণাটার সিটের যুগলকে অসহ্য মনে হচ্ছে! তাকালেই কষ্ট বাড়ছে, তবুও বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে! এমনই অদ্ভুত রকমের বেহায়া নিঃসঙ্গ মানুষের মনস্তত্ত্ব!!

গানের মায়াবী কথাগুলি একাকিত্বের বুকে ছুরি বসিয়েই যাচ্ছে বসিয়েই যাচ্ছে……..গানের রেশের আশ্চর্য ক্ষমতা!

অন্ধকারেরও একটা রঙ আছে। সে রঙে সুর মিশলে ভেতরেবাইরে পাগল-পাগল লাগে, সে রঙটা আকণ্ঠ পান করতে-করতে রক্তের স্রোতে আঁধারসুরের নেশা চাপে, ভেতর আর বাইরের জগতটার মাঝখানের দেয়ালটা ভাঙতে-ভাঙতে থাকে, ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায় স্বচ্ছ কাঁচের আয়না মাথার গহীনে……..আচ্ছা, সবাইই কি এমনই উন্মত্ত?

রাত সবকিছুকেই নিপুণহাতে বদলে দেয়। রাতের সবকিছুই যেন অন্যকিছু! ভালোবাসা আর কামনার সহাবস্থান! এক-এক করে দুইই জাগে সুরের যাদুতে আর রাতের শরীরী টানে!!

বড় ভাল লাগছে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, এমন একজন রোমান্টিক বাসড্রাইভার দশজন আনরোমান্টিক প্রেয়সীর চাইতেও বেশি আবেদনময়!!

ভাবনা: তিয়াত্তর।

……………………..

খাবার জিনিসের মধ্য দিয়েই লোকে হয় সবার চাইতে আপন; অচ্ছেদ্য পারিবারিক জীবনের সম্বন্ধগুলি যেখানেই খুব মিষ্টি দেখেছি, সেখানেই লক্ষ্য করেছি, স্ত্রী স্বামীকে বেশ নিত্যনূতন খাইয়ে রাখেন।

~ সতীনাথ ভাদুড়ী

ভাদুড়ীমশাই, আপনাদের জেনারেশানকে আমি বরাবরাই এই জাতীয় কিছু ব্যাপারে ঈর্ষা করি। অধুনা আধুনিকারা রান্নাঘরের ছায়া মাড়ান হাউসমেডদের পা দিয়ে। অথবা শাশুড়িদের। রান্নার বই কিংবা টিভি-শো দেখে দেখে সিদ্দিকা কবীর সাজেন ভীষণ যত্নে। সেই যত্ন মাথার অগম্য দুর্জ্ঞেয় রাজ্যে আনাগোনা করে যতটা, মনের রাজ্যে ততটা করে না। রান্নাঘর থেকে বইয়ে যাওয়া যতটা সহজ, এর উল্টো যাত্রাটা ততটাই কঠিন! তবে হ্যাঁ, সেই রান্নাটা খাওয়ার সময় টিভি-শো’র অনিন্দ্যসুন্দরীর কথা ভেবেও বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যায়। কেন? মাথাখারাপ করে দেয়া সুন্দরীরা সব রান্না শেখায়। তাই ওদের ঢংটাই আমায় টানে বেশি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেই সুন্দরীর রান্না তার বেচারা বরটির ভাগ্যেও জোটে না ততো। অন্তত সেইদিক বিবেচনায়, অধুনা শিক্ষিতা বধূ জিন্দাবাদ!

বন্ধুদের দেখেছি, ভদ্রতাবশত বৌয়ের রান্নার তারিফ করলে কী শুকনো মুখে থ্যাঙ্কসটা বলে। দোষটা বন্ধুর বৌয়ের যতটা, তারচে বেশি বোধ হয় বন্ধুর শাশুড়ির। উনি কেনো ধরেই নেন, বিয়ের পরেও জামাইয়ের মায়ের হাতের রান্নাই মেয়ে আর মেয়ে-জামাই খেয়ে যাবে আয়েশ করে? পড়াশোনার যোগ্যতায় যতই ওপরের দিকে হোক না কেন, বাঙালির স্বভাবই হলো অন্তত আরো একটি ব্যাপারে ‘বাড়তি যোগ্যতা’র পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে মনের দরোজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা-ই। বেহালা-বাদক আইনস্টাইন, ফুটবলার নিলস্ বোর, ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে বড়ো বেশি আদরের। হোক গান। সাহিত্য। রান্না। কিংবা অন্যকিছু, অন্যকোনো আর্ট। তবে এটাও ঠিক, ‘মূল যোগ্যতা’ না থাকলে কিন্তু ওই ‘বাড়তি যোগ্যতা’র কদর কম। কারণ ওতে সেটা তো আর ‘বাড়তি’ থাকে না! বছর-বছর স্কুল পরীক্ষায় ফেলকরা রান্নাবান্নায় দারুণ প্রতিভাসম্পন্ন মেয়েদের ভবিষ্যৎ বড়ই পানসে।

ন্যায্য পাওনাটি বুঝে নেয়ার পর এমন উপরি, ফাও, বাড়তি—এগুলোর প্রতি উদাসীন এ জগতে কে? এই ফাঁকে বলে রাখা ভাল, সব ঔদাসীন্যই কিন্তু সত্যিকারের নয়। পাওনাদারের কাছ থেকে পয়সাফেরত চাইতে যে ভুলে যায়, সে-ই আসলে ভুলোমনের অথেনটিক সার্টিফিকেটটা পায়। কত কী স্বপ্ন-টপ্ন নিয়ে ছেলেরা বিয়ে করে, শেষ-মেশ কিনা বসে-বসে দীর্ঘশ্বাসের সেতু (Bridges of Sighs) বানায়!

ভাবনা: চুয়াত্তর।

……………………..

একেকটা নদীর ঘ্রাণ একেকরকম। জলের ঘ্রাণও বদলে যায়, এরকমটা আগে কখনো মনে হয়নি; আগে মানে, সেইদিনের আগে। ঢেউ কেটে-কেটে নৌকা সামনে অথবা ঠিক সামনেও বলা যায় না, আবার পেছনেও বলা যায় না, এরকমভাবে যাচ্ছে; ধীর লয়ে। এমনিতেই জলেভেজা হাওয়াটা শরীরমন জাগিয়ে দেয়, তার উপরে আমাদের নৌকাটা ডিঙি; জলের খুব কাছে আমি শুয়ে, যতটা কাছ থেকে জল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে চাঁদের মিষ্টি আলোয় গা ধুয়ে নেয়া যায়, ততোটা কাছে। চাঁদের কোনো ভাষা থাকে না, অথচ কতকিছুই বলিয়ে নেয়; অমন এক পূর্ণিমায় নদীতে ভাসবো, ভাসাবো—এই ইচ্ছেটা পুরোনো। নিজে ভেসেছি, ভাসানোর কেউ পাশে ছিল না বলে ভাসতে-ভাসতে যেভাবে করে হারিয়ে যাবো ভেবে রেখেছিলাম, সেভাবে হয়নি। অথচ সেদিনের ক্ষণটা ছিল অন্যরকম। সেদিন হারিয়েছিলাম বুঝি? হ্যাঁ, হারিয়েছিই তো! নইলে কেনো মনে হবে কেউ আলতো ছোঁয়ায় আমার কপোল-চোখ-চুল ছুঁয়ে বলছে, তোমাকে না, চাঁদটাকে ছুঁয়ে দেখছি, এই এক রাত্রির রুপোলী নদীর সমস্ত আলো তোমার চোখে আজ ঠাঁই নিলো, রাত ফুরোনোর আগে আমি ফুরোবো না—কথা দিলাম, তুমিও ফুরিয়ো না, ঘুমঘুম চোখে থেকো প্রিয়, ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। হাতের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে গলে জলের যে গান আমাকে চন্দ্রাহত করে দিয়েছিলো সেই মায়াবী রাতে, সেই গানের মাতাল সুর কী এক সুরমায়ায় হেরে বসেছিল কোনো এক অদৃশ্য মানসীর সুখকল্পনাতে। কপোলে কপোল ছুঁইয়ে বাঁধ ভাঙা চাঁদের হাসিতে আমাদের রাত, অস্তিত্ব, নদী, দূরের পাহাড়, মাঝির ভাটিয়ালি গান—সব, সবকিছুই একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল সেই রাতে; ওর নিঃশ্বাসের স্পর্শে, শরীরের স্পন্দনে, চুল-চিবুক-ঘাড়ের মাদকতাভরা ঘ্রাণের সাথে জলের ঘ্রাণের অপূর্ব মিশেলে সেই বিস্ময়বিহ্বল রাতে আমার ডান হাতে ওর বাম হাত লুকিয়ে, আমার বাম হাত ওর কাঁধের ওপর থেকে জড়িয়ে ওর বাম বাহু আধোজড়িয়ে ছিলাম; সে মায়াবিনী তার ডান হাতের অনামিকায় আমার ডান কপোলে কী কীসব দুর্বোধ্য অক্ষর এঁকে-এঁকে দিচ্ছিলো, সেইসব অক্ষরের অর্থ আমি, সেই রাত, সেই চাঁদ, সেই নদী, সেই দূরের পাহাড়, এমনকি সেই ছোট্টো নৌকো, যে নৌকো স্রেফ নৌকো হয়েই থাকেনি সেই রাতে—কেউই ধরতে পারিনি। ওই সফেদ চাঁদনী রাতে ধবধবে শাদা আলোর ফোয়ারা আর আমার কল্পলোকের মানসীর অবিরত ইশারায় আমার ভাবনা অনুভব পিছলে-পিছলে মিহি মোলায়েম ছোঁয়ার যে শিহরণ জেগে উঠেছিলো দেহেমনে, ততোটা সাড়া কোনো নারী জাগাতে পারতো কি? প্রকৃতির সাথে অন্তরঙ্গ সঙ্গমমুহূর্তে কোনো প্রিয় মানুষের প্রতি দুর্নিবার মনোদৈহিক আকর্ষণে প্রকৃতি সেই নারী কিংবা পুরুষের কাছে ওই মুহূর্তটির জন্য হলেও যে কতোটা অর্থহীন ম্লান হয়ে ওঠে, তা সেদিন বুঝলাম। এই হেরে যাওয়াতেই প্রকৃতির জিত।

…….এই রাত তোমার আমার ওই চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের| এই রাত শুধু যে গানের, এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের। কুহু কুজনের। তুমি আছো আমি আছি তাই, অনুভবে তোমারে যে পাই, শুধু দুজনের| এই রাত তোমার আমার|

জানি না কতক্ষণ ধরে গাইছিলাম। কী এক প্রগাঢ় অসহায় চুম্বনতৃষ্ণা ফিরে-ফিরে আশ্রয় খুঁজছিলো রাতজাগা জল আর নৌকোর যুগলবন্দী ছলাৎ-ছলাৎ ছন্দের কাছে। সুচিত্রার চোখের যাদু হঠাৎ হারালো মাঝির সমাহিত বিমূর্ত রাত্রির ঘুমভাঙানো চিৎকারে: স্যার, ফিরবেন না?……..সেই কঠিন প্রশ্নে আমার সমস্ত শরীরে কী এক ক্লান্তি ভর করলো; কোলাহলে ফেরার ক্লান্তি। চাঁদের গা জুড়েও যেন অবসাদ আর বিষণ্ণতার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ভাবলাম, এখানে তো আমি ফিরতে আসিনি। এই একান্ত ঘর থেকে ফেরা যায়?

ভাবনা: পঁচাত্তর।

……………………..

এক ছেলে জেলটেল দিয়ে চুল স্পাইক করে ক্লাসে এসেছে। মাথার মাঝখানে উঁচু হয়ে চুলগুলোকে দেখাচ্ছে শিংয়ের মতো। কুল-কুল লুক দিয়ে ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে ছেলেটা স্যারের দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখেমুখে ডোন্ট-কেয়ার ভাবটা স্পষ্ট।

স্যার তাকে দেখে বললেন, Hey dude! Horn থাকলেই কিন্তু Horny হওয়া যায় না!

বেচারা তো পুরাই ফিউজ! মেয়েদের সে কী হাসি!

আরেকদিনের ঘটনা। একটু ভাবটাব নিয়ে এক ছেলে শার্টের ৩টা বোতাম খুলে পা-টা ছড়িয়ে নবাবি স্টাইলে ক্লাসে বসে আছে। পারলে তখুনি একটা সিগ্রেট ফুঁকে, এই অবস্থা।

ওর দিকে তাকিয়ে (একই) স্যার বললেন, এই যে মিস্টার, শার্টের বোতাম লাগান। You’ve nothing to show me.

বেচারার মুখখানা সেইসময় দেখার মতো হয়েছিলো!

আইবিএ’তে ক্লাস করাটাও খুব মজার একটা অভিজ্ঞতা। অনেক-অনেক কিছু শেখার আছে এখান থেকে। স্যারদের কাছ থেকে, পিয়ার্সদের কাছ থেকে, কোর্স কারিকুলাম থেকে, এক্সট্রাকারিকুলাম এ্যাক্টিভিটিস থেকে, ক্লাসরুমের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে। স্মার্টনেস, খুব দ্রুত ডেডলাইনে কাজ করা, প্রেজেন্টেশন দেয়া, ফাঁকিবাজি, বদমাইশি, কাজের লোড নেয়া (কিংবা না নিয়েও নেয়া। টিমওয়ার্কে প্রায়ই ২’য়ে ১’য়ে, ১’য়ে ১’য়ে, ০’য়ে ১’য়ে, ০’য়ে ০’য়ে যোগ ক’রেও ৪ হয়। ২+২=৪, ২+১=৪, ১+১=৪, ০+১=৪, ০+০=৪! এ শুধু টিমওয়ার্কেই সম্ভব!)

দুনিয়ার তাবৎ স্মার্ট পোলাপান আইবিএ’তে পড়ে। স্মার্টার স্যাররা ক্লাস নেন। (অথবা আইবিএ-ই পোলাপানগুলারে স্মার্ট বানাইয়া ছাড়ে।) কোনোদিক দিয়েই আইবিএ’র প্রোডাক্টদের আনডারএস্টিমেট করা যায় না। (তবে পাবলিক আমাগোরে ওভাররেটই করে বেশি। ইয়ে মানে, করলে অবশ্য আমরা খুব একটা মাইন্ডও করি না!)

সত্যি কথা বলতে কী, আইবিএ’র প্রেমিজেসে, হোস্টেলে নিজেকে পুরাই খ্যাত্ খ্যাত্ মনে হতো। কোনো পাত্তাই পেতাম না কারো কাছ থেকে। তাও ভাল লাগত। খুব মিস করি আইবিএ’র দিনগুলি।

ভাবনা: ছিয়াত্তর।

……………………..

গুলজারের লেখা একটা গান আছে লতার কণ্ঠে: তুঝসে নারাজ নাহি জিন্দেগি, হ্যয়রান হু ম্যয়। একদিন পাবনায় বৃষ্টিতে মোটরসাইকেলে ঘুরছি। বৃষ্টির ফোঁটা চোখেমুখে তীরের মতো বিঁধে, বাইক চালানো বেশ কঠিন। তাই একটু পরপর থামতে হয়। কথা সেটা না। কথা হচ্ছে, আমরা যতবারই বাইক থামিয়ে কোনো শেডে ওয়েট করা মাত্র শুরু করছি, ততবারই বৃষ্টি থেমে মেঘভাঙা রৌদ্রের খেলা। প্রকৃতির এই হেঁয়ালি লুকোচুরিতে গানটাকে বদলে দিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে, তুঝসে নারাজ নাহি বারিষ, হ্যয়রান হু ম্যয় . . . . . .

সেলিম খানকে মনে পড়ে আপনাদের? গুলজারের বন্ধু এবং চিন্তাভাবনার সঙ্গী। তাঁদের আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসতো অনেক গান, কাহিনীর প্লট। চিনতে পারছেন না? আচ্ছা, একটু হেল্প করি। নিচের ডায়লগগুলো মনে আছে কিনা দেখুন তো?

: মর্দ হোতি তো দর্দ নেহি হোতি।

: ডন কো পাকারনা মুশকিল ভি নেহি হ্যায়, নামুমকীন হ্যায়!

: তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়, বাসন্তী? (হোয়াট অ্যা সেন্স অব হিউমার! এই ডায়লগটা যতবারই মনে আসে, মনে-মনে হাসতে থাকি।)

এসব কথা সেলিম খানের সৃষ্টি। বলিউডকে উনি এইরকম অসংখ্য সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘শোলে’ উনার লেখা। আরো আছে। আওয়ারা, দিওয়ার, জাঞ্জির, ডন, মিস্টার ইন্ডিয়া। সায়মন বিওফয় তাঁর সাথে তিন দিন কথা বলে ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ লেখার রসদ যোগাড় করেছিলেন।

জাভেদ আখতার তাঁরই আবিষ্কার। সেসবদিনে, কে সিনেমাটা লিখলেন, সেটা সিনেমার পোস্টারে ছাপতো না। এখন ছাপে। এই অবদানটা সেলিম খান আর জাভেদ আখতারের। তাঁরা দুজন মিলে সারারাত ধরে শহরের সব পোস্টারের গায়ে লিখে দিয়েছিলেন, স্ক্রিপরাইটার: সেলিম খান। বলাই বাহুল্য, সেই পোস্টারগুলি ছিল সেলিম খানের লেখা কোনো এক সিনেমার।

উনার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যথাগুলো নিয়ে জানলে খুব করে মনে হতেই পারে, লতার গাওয়া ওই গানটি তাঁর পক্ষে লেখা খুব সম্ভব। না, তিনি ওটা লেখেননি। গুলজার যেদিন ওটা লেখেন, তার দুএকদিন আগে সেলিম খানের সাথে তাঁদের নিজেদের কিছু জীবনদর্শন নিয়ে আলাপ হয়। গানটির কথা ভাবলে বোঝা যায়, ওটা মাথা দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে লেখা। এবং, সে হৃদয়ের দাগটা গুলজারের একার নয়!

উনার আরেকটা ছোটো পরিচয় দিই। উনার পরিচয়ে উনার ছেলে অনেক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে থাকেন। ইয়ে মানে, উনার সেই ছেলেও কিছু সিনেমাটিনেমা করে বিখ্যাত হয়েছেন। কাইফি আজমিকে শাবানা আজমির বাবা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। সেলিম খানকে সালমান খানের বাবা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়, তবে দিতেই হয়, কিছুতেই এমন নয়! যদি দিতেই হয়, তবে এই না-জানাটা পরিচয়গ্রহীতার পক্ষে সত্যিই অস্বস্তিকর।

পাঠকদের জন্য ক্যুইজ: বলুনতো, ডায়লগ ৩টি কোন কোন মুভিতে আছে?

ভাবনা: সাতাত্তর।

……………………..

আজকের ফাগুনী পূর্ণিমার রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলো রাস্তার পাশের চন্দ্রাহত গাছগুলোর ওপর চাবুকের মতো ততটা সপাং-সপাং করে পড়ছে না, কালকে এই গাড়িটাই এই রুটে এই সময়েই চলে যাবার সময় যতটা পড়েছিলো। যে মানুষটির, তার ভালোবাসা যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবার আগেই প্রিয় মানুষটাই শুধু তার দিকে ছাড়া অন্য যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে গেছে, তার চেয়ে যে একা হয়ে আছে অন্য কেউ একা করে দিয়ে চলে যায়নি বলে, সে অনেকবেশি ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যবতী। দূরে থাকা কষ্টের, দূরে সরে যাওয়া আরো বেশি কষ্টের। একা-একা থাকতে অভ্যস্ত মানুষকে একা থাকতে অনভ্যস্ত করে দিয়ে যারা ভাল আছে কিংবা সুখে থাকে তাদেরকে পর্যন্ত এমন সময় মনে পড়ে। মনে-পড়া’টা আজকের রাস্তায় শাদা-শাদা চাঁদের আলো যেমনি করে পিছলে-পিছলে যাচ্ছে, তেমনি করে ওর সারাটা ভাবনাজুড়ে কী এক বিশ্রী আবেশে ওকে সেই খবরের কাগজটার মতো আরো বেশি অসহায় করে দিচ্ছে যেটা কেউ পড়ার আগেই তিনতলার বারান্দা থেকে এক দমকা হাওয়ায় উড়ে একতলায় পড়ে গেছে এবং অফিসের সময় হয়ে গেছে বলে কেউ ওটা আর আনিয়ে নেয়নি, এমনকি সন্ধ্যায় ফিরেও ওটা পড়তে বেমালুম ভুলে গেছে, অথচ ওতে পড়ার মতো অনেককিছুই ছিলো।

আমরা যে গাড়িটায় চেপে ফিরছি, সেই গাড়ির চাকাগুলোর জন্যে রাস্তার পাথরগুলো আজকেও অভিনব কোনো দ্যোতনা সৃষ্টি করছে না; হোক না পাথরগুলোর ওপরে সফেদ জ্যোত্‍স্নাতে পাথরগুলো আর স্রেফ পাথর নেই, কিংবা পাশের রাবারবাগান যেখানে নানান ফাঁকেফোকরে সাপেরা পর্যন্ত সঙ্গম ভুলে রাতকে দেখছে, কিংবা আরো কিছু দূরে—চোখে পড়ে, আবার পড়েও না—এমন দূরত্বে ডিঙি নৌকাগুলো নদী যতটুকু ভালোবাসা দিতে পারে ততটুকু মমতায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, কিংবা বাগানের ওদিকটায় সেই পাহাড়গুলো যেগুলো অনেকদিন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে-থেকেও আজো সুন্দরভাবে সাজতে ক্লান্তি দেখায় না; চাকাগুলো ওরকমই নিস্পৃহ নির্দয় নির্মম। চাকার কথা কেনো? মানুষের কথা মানুষ বলতে কখনো-কখনো ভয় পায়, তাই।

বলছি শোনো। ঘুমিয়েপড়া আর জেগেওঠা—আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে, এই দুই নিয়ে যাদের জীবন কাটে তাদের ভালোবাসার বাড়তি কাজটা দিয়ো না। যদি দিয়েই দাও তবে এমনভাবে বেকার করে দিয়ে চলে যেয়ো না যাতে সে আগের পুরোনো কাজ দুটোও ভুল মেরে বসে থাকে এবং সে নিতান্ত অথর্ব বলে কাজটা হারিয়েছে, এমনটা ছাড়া আর অন্যকিছুই ভাবতে পারে না। আমরা চাই, সবার প্রিয়মানুষ স্বচ্ছলমনের আর হৃদয়বান হোক। নইলে আমাদের ড্রাইভারটা যেমন করে এই চমৎকার সন্ধ্যায় পর্যন্ত আশেপাশের গাড়ির ড্রাইভারগুলোকে গালি দিতে-দিতে পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলেছে, তেমন করেই যে একা করে দিয়েছে তাকে নয়, দুঃখী মানুষটি বরং নিজেকেই গালিগালাজ করতে-করতে কোনোরকমে মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে মৃত্যুর দিকে সময়ের আগেই ছুটে যাবে।